আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

৮. অধ্যায়ঃ সদকা

হাদীস নং: ১২৩৬
ভিক্ষাবৃত্তির প্রতি ভীতি প্রদর্শন, ধনী ব্যক্তির ভিক্ষাবৃত্তির আশ্রয় নেয়া হারাম হওয়া, লোভ-লালসার নিন্দা এবং লোভ-লালসা থেকে পবিত্র থাকা, অল্পে তুষ্টি এবং নিজ হাতে উপার্জিত বস্তু খাওয়ার প্রতি অনুপ্রেরণা
১২৩৬. হযরত আবু উমামা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ হে বনী আদম। আতিরিক্ত সম্পদ ব্যয় করা তোমাদের জন্য উত্তম এবং অতিরিক্ত সম্পদ আটকে রাখায় রয়েছে তোমাদের জন্য অকল্যাণ। প্রয়োজন পরিমাণ রাখার ব্যাপারে তোমাকে অভিযুক্ত করা হবে না। আর যাদের প্রতিপালনের দায়িত্ব তোমার উপরে, তাদের দিয়ে দান করা শুরু কর এবং উপরের হাত নীচের হাত অপেক্ষা উত্তম।
(মুসলিম, তিরমিযী ও অপরাপর গ্রন্থাবলী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।)
التَّرْهِيب من الْمَسْأَلَة وتحريمها مَعَ الْغنى وَمَا جَاءَ فِي ذمّ الطمع وَالتَّرْغِيب فِي التعفف والقناعة وَالْأكل من كسب يَده
1236 - وَعَن أبي أُمَامَة رَضِي الله عَنهُ أَن رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم قَالَ يَا ابْن آدم إِنَّك أَن تبذل الْفضل خير لَك وَأَن تمسكه شَرّ لَك وَلَا تلام على كفاف وابدأ بِمن تعول وَالْيَد الْعليا خير من الْيَد السُّفْلى

رَوَاهُ مُسلم وَالتِّرْمِذِيّ وَغَيرهمَا

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে চারটি বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সর্বপ্রথম নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে আল্লাহর পথে খরচ করা সম্পর্কে।

আল্লাহর পথে অর্থব্যয়ের তাগিদ
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
يا ابن آدم، إنك أن تبذل الفضل خير لك
হে আদম সন্তান! তোমার অতিরিক্ত সম্পদ (সৎপথে) খরচ করাটা তোমার পক্ষে ভালো। অর্থাৎ তোমার প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ জমা করে না রেখে আল্লাহর পথে খরচ করে ফেলো। এতেই তোমার কল্যাণ। কারণ আল্লাহর পথে যা খরচ করবে, তা তোমার জন্য স্থায়ী হয়ে থাকবে। তুমি তা আখিরাতে পাবে। আর যা জমা করবে তা মৃত্যুতেই শেষ। আখিরাতে তা তোমার কোনও কাজে আসবে না। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
مَا عِنْدَكُمْ يَنْفَدُ وَمَا عِنْدَ اللهِ بَاقٍ
তোমাদের কাছে যা-কিছু আছে তা নিঃশেষ হয়ে যাবে আর আল্লাহর কাছে যা আছে তা স্থায়ী।

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. থেকে বর্ণিত আছে-
أنهم ذبحوا شاة، فقال النبي صلى الله عليه وسلم: ما بقي منها؟ قالت: ما بقي منها إلا كتفها قال: بقي كلها غير كتفها.
তাঁরা একটি বকরি যবাহ করেছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তা থেকে কী অবশিষ্ট আছে? আয়েশা রাযি. বললেন, সেটির কাঁধ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বরং সেটির কাঁধ ছাড়া সবই অবশিষ্ট আছে।

হযরত উছমান রাযি. তাঁর এক বক্তৃতায় বলেন, আল্লাহ তা'আলা তোমাদেরকে দুনিয়া দিয়েছেন এর মাধ্যমে আখিরাত সন্ধান করার জন্য। তা এজন্য দেননি যে, তোমরা এর দিকে ঝুঁকে পড়বে। দুনিয়া তো ধ্বংসশীল। আখিরাত স্থায়ী। এ অস্থায়ী দুনিয়া যেন তোমাদেরকে স্থায়ী আখিরাত ভুলিয়ে না দেয়। তোমরা অস্থায়ীর উপর স্থায়ীকে প্রাধান্য দিও। দুনিয়া একদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তোমাদের শেষ গন্তব্য আল্লাহরই কাছে।

কৃপণতা করার নিন্দা
দ্বিতীয়ত বলেন- وأن تمسكه شر لك (আর তা আটকে রাখা তোমার পক্ষে মন্দ)। অর্থাৎ সম্পদ আল্লাহর পথে খরচ না করে জমা করে রাখার মধ্যে কোনও কল্যাণ নেই। যেসব জায়গায় খরচ করা ফরয, তাতে খরচ না করলে তো এ সম্পদ তার সঞ্চয়কারীকে আখিরাতে আগুন হয়ে জ্বালাবে। সাপ হয়ে দংশন করবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
من آتاه الله مالا فلم يؤد زكاته، مثل له ماله شجاعا أقرع، له زبيبتان يطوقه يوم القيامة، يأخذ بلهزمتيه - يعني بشدقيه - يقول: أنا مالك أنا كنزك ثم تلا هذه الآية: (ولا يحسبن الذين يبخلون بما آتاهم الله من فضله) إلى آخر الآية
আল্লাহ তা'আলা যাকে সম্পদ দিয়েছেন সে যদি তার যাকাত আদায় না করে, তাহলে কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে বিষাক্ত দাঁতওয়ালা সাপের আকৃতি দান করা হবে। (অত্যধিক বিষের কারণে) সে সাপের মাথায় পশম থাকবে না। সাপটি তার দুই চোয়াল পেঁচিয়ে ধরবে। তারপর বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার ধনভাণ্ডার। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত করেন-
{وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَهُمْ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلِلَّهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ} [آل عمران: 180]
(আল্লাহপ্রদত্ত অনুগ্রহে (সম্পদে) যারা কৃপণতা করে, তারা যেন কিছুতেই মনে না করে, এটা তাদের জন্য ভালো কিছু। বরং এটা তাদের পক্ষে অতি মন্দ। যে সম্পদের ভেতর তারা কৃপণতা করে, কিয়ামতের দিন তাকে তাদের গলায় বেড়ি বানিয়ে দেওয়া হবে- সূরা আলে ইমরান ১৮০)।

যদি যাকাতসহ অন্যান্য হকসমূহ আদায় করা হয়, তারপরও অতিরিক্ত সম্পদ সঞ্চয় করে রাখার মধ্যে ঝুঁকি থাকে। তা নাজায়েয খাতে ব্যয় হতে পারে, মৃত্যুর পর ওয়ারিশগণ তার অপব্যবহার করতে পারে। অন্ততপক্ষে এতটুকু তো হয়ই যে, আল্লাহর পথে খরচ করার যে ছাওয়াব নির্ধারিত আছে তা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। তাই জমা করে রাখার চেয়ে আল্লাহর পথে খরচ করার মধ্যেই কল্যাণ। হাঁ, ওয়ারিশগন যদি আল্লাহভীরু হয় এবং তাদের মধ্যে দীনের বুঝ থাকে, তবে তাদের জন্য কিছু রেখে গেলে সে ক্ষেত্রে কল্যাণের আশা আছে। কোনও কোনও হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতিরিক্ত সম্পদের সবটা খরচ না করে ওয়ারিশদের জন্য কিছু রেখে যাওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন।

প্রয়োজন পরিমাণ সম্পদ জমা করার বৈধতা
হাদীছটির তৃতীয় নির্দেশনা হল- ولا تلام على كفاف (প্রয়োজন পরিমাণ সম্পদ রাখার কারণে তুমি নিন্দনীয় হবে না)। অর্থাৎ পানাহার, পোশাক, বাসস্থান ও অন্যান্য জরুরত পূরণের জন্য যে সম্পদ প্রয়োজন তা রেখে দেওয়া দোষের নয়। অর্থাৎ এতটুকু সম্পদ রাখার কারণে কাউকে দুনিয়াদার বা আয়েশপ্রিয় বলা হবে না। বরং এর মধ্যেই নিরাপত্তা। এতটুকু সম্পদ থাকলে মাখলুকের কাছে হাত পাতা থেকে বাঁচা যায়। আবার এতটুকু সম্পদের মালিককে যেহেতু ধনীও বলা হয় না, তাই ধনের অহমিকা থেকেও আত্মরক্ষা হয়। যাদের ঈমান তেমন মজবুত নয়, তাদের পক্ষে বর্তমানকালে ইজ্জত-সম্মান রক্ষার মত সম্পদ থাকাই শ্রেয়।

সুফিয়ান সাওরী রহ. বলেন, অতীতে সম্পদকে অপসন্দ করা হতো। কিন্তু বর্তমানকালে এটা মুমিনের ঢাল। তিনি বলেন, এই দীনারগুলো না হলে রাজা-বাদশারা আমাদেরকে নাক মোছার রুমাল বানাত।
তিনি আরও বলেন, যার হাতে কিছু সম্পদ আছে সে যেন তার যত্ন করে। কেননা এটা এমন এক কাল যে, কারও হাতে সম্পদ না থাকলে সে সর্বপ্রথম যা খরচ করে তা তার দীন।
তিনি আরও বলেন, হালাল সম্পদ এমন যে, তাতে অপব্যয়-অপচয়ের সুযোগই থাকে না (কারণ হালাল সম্পদ অত বেশি হয়ও না)।

হরত হুযায়ফা রাযি. বলেন, তোমাদের মধ্যে ওই লোক শ্রেষ্ঠ নয়, যে আখিরাতের জন্য দুনিয়া পরিত্যাগ করে কিংবা দুনিয়ার জন্য আখিরাত পরিত্যাগ করে। শ্রেষ্ঠ তো সেই-ই, যে উভয়টা থেকেই তার অংশ নিয়ে নেয়।

হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব রহ. বলেন, ওই ব্যক্তির মধ্যে কোনও কল্যাণ নেই, যে কোন মাল সঞ্চয় করে না, যা দ্বারা সে নিজ ইজ্জত-সম্মান রক্ষা করতে পারে, আমানত আদায় করতে পারে এবং আত্মীয়ের খোঁজখবর রাখতে পারে। তিনি মৃত্যুকালে কিছু দীনার রেখে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, হে আল্লাহ, তুমি জান এ সম্পদ আমি আমার দীন ও ইজ্জত রক্ষার্থেই রেখেছিলাম।

যাদের পেছনে অর্থব্যয় করা হবে, তাদের পর্যায়ক্রম
সবশেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- وابدأ بمن تعول (তুমি যাদের লালন-পালন কর তাদের থেকে খরচ শুরু কর)। অর্থাৎ নিজ সত্তা, ছেলে-মেয়ে, পিতা-মাতা এবং আরও যারা নিজ লালন-পালনাধীন থাকে, প্রথম খরচটা তাদের পেছনেই করতে হবে। এ ক্ষেত্রেও যদি সকলের পেছনে খরচ করা সম্ভব হয়। তবে তো সেটাই করবে, অন্যথায় প্রথমে খরচ করবে নিজের জন্য, তারপর কিছু বেঁচে থাকলে শিশুসন্তানের জন্য, তারপর স্ত্রীর জন্য, তারপর পিতা, তারপর মাতা, তারপর দাদা, তারপর বালেগ সন্তান- এ ধারাবাহিকতা অনুসরণ করবে।

একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জনৈক সাহাবীর হাতে কিছু দিরহাম দিয়ে তাঁকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন যে-
ابدأ بنفسك، فتصدق عليها، فإن فضل شيء فلأهلك، فإن فضل شيء عن أهلك، فلذي قرابتك، فإن فضل عن ذي قرابتك شيء، فهكذا، وهكذا يقول: بين يديك، وعن يمينك، وعن شمالك
তুমি এটা সর্বপ্রথম খরচ করবে তোমার নিজের উপর। তারপর কিছু বেঁচে থাকলে তোমার পরিবার-পরিজনের উপর, তারপর কিছু বেঁচে থাকলে তোমার নিকটাত্মীয়দের উপর। তাদের উপর খরচ করার পরও যদি কিছু বেঁচে থাকে, তবে তা এভাবে এভাবে অর্থাৎ তোমার সামনে, ডানে ও বামে বিতরণ করবে।

হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, জনৈক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ। (যদি এমন হয় যে.) আমার কাছে একটি দীনার আছে। তিনি বললেন, এটি তোমার নিজের উপর খরচ করো।
সে বলল, আমার কাছে আরেকটি দীনার আছে। তিনি বললেন, এটি তোমার সন্তানের উপর খরচ করো।
সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার কাছে আরেকটি আছে। তিনি বললেন, এটি তোমার স্ত্রীর উপর খরচ করো।
সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার কাছে আরেকটি আছে। তিনি বললেন, এটি তোমার খাদেমের (অর্থাৎ গোলামের) উপর খরচ করো।
সে বলল, আমার কাছে আরও একটি আছে। তিনি বললেন, এটি কী করবে সে ব্যাপারে তুমিই ভালো জান।

এ হাদীছটি বর্ণনা করার পর হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বলতেন, এমন না হলে তোমার সন্তান বলবে আমাকে খাওয়াও, তুমি আমাকে কার হাতে ছাড়ছ? স্ত্রী বলবে, আমার খাবার দাও নয়তো আমাকে তালাক দাও। খাদেম বলবে, আমার খাবার দাও নয়তো আমাকে বিক্রি করে দাও।

ইমাম সামহুদী রহ. বলেন, এ হাদীছটির সম্পর্ক যদিও আর্থিক ব্যয়ের সঙ্গে, তবে মুহাক্কিকগণ একে পরকালীন বিষয়েও ব্যবহার করেছেন। যেমন আলেম ব্যক্তি অন্যদের আগে নিজ পরিবারবর্গকে দীনের শিক্ষাদান করবে। কুরআন মাজীদের আয়াত দ্বারাই এর সমর্থন পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে-
قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا
"তোমরা নিজেদেরকে ও নিজেদের পরিবারবর্গকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও।"

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. আমাদেরকে আপন আপন অবস্থা অনুযায়ী প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ আল্লাহর পথে খরচে সচেষ্ট থাকতে হবে।

খ. অর্থ-সম্পদ সঞ্চয়ের ধান্দা ও কৃপণতা একটি মন্দ স্বভাব। এর থেকে বিরত থাকা চাই।

গ. দীন ও ঈমান এবং ইজ্জত-সম্মান রক্ষার মত প্রয়োজনীয় সম্পদ হাতে রাখা দূষণীয় নয়।

ঘ. অর্থ-সম্পদ খরচের বেলায় নিজ পরিবারবর্গ ও পোষ্যজনদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব - হাদীস নং ১২৩৬ | মুসলিম বাংলা