আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

৩. অধ্যায়ঃ ইলেম

হাদীস নং: ১২৪
অধ্যায়ঃ ইলেম
অনুচ্ছেদ
১২৪. হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ মুমিন ব্যক্তির মৃত্যুর পরে যে সব আমল ও নেককাজ তার উপকারে আসবে, তা হলো: (১) যে ইলম সে অন্যকে শিক্ষা দিয়েছে এবং তার প্রচার-প্রসার করেছে, (২) যে নেক সন্তান, সে রেখে গিয়েছে, (৩) যে কিতাব সে রেখে গিয়েছে অথবা (৪) যে মসজিদ সে নির্মাণ করেছে, (৫) কিংবা পথিকের জন্য যে সরাইখানা সে তৈরি করেছে, (৬) অথবা যে নহর সে খনন করেছে, (৭) জীবদ্দশায় সে সুস্থ থাকাকালীন যে দান-খয়রাত তার অর্থ-সম্পদ থেকে বের করেছে- এগুলোর সওয়াব সে মৃত্যুর পরও পেতে থাকবে।
(ইমাম ইব্ন মাজাহ (র) হাসান সনদে হাদীসটি বর্ণনা করেন, বায়হাকী ও ইব্‌ন খুবায়মাও তাঁর 'সহীহ' গ্রন্থে অনুরূপ বর্ণনা করেন। তবে তিনি বলেছেনঃ نَهرا كراه অর্থাৎ "সে নহর বা খাল যা সে খনন করেছে," তবে তিনি তাঁর বর্ণনায় কিতাবের কথা উল্লেখ করেন নি।)
كتاب الْعلم
فصل
124 - وَعَن أبي هُرَيْرَة رَضِي الله عَنهُ قَالَ قَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم إِن مِمَّا يلْحق الْمُؤمن من عمله وحسناته بعد مَوته علما علمه ونشره وَولدا صَالحا تَركه أَو مُصحفا وَرثهُ أَو مَسْجِدا بناه أَو بَيْتا لِابْنِ السَّبِيل بناه أَو نَهرا أجراه أَو صَدَقَة أخرجهَا من مَاله فِي صِحَّته وحياته تلْحقهُ من بعد مَوته
رَوَاهُ ابْن مَاجَه بِإِسْنَاد حسن وَالْبَيْهَقِيّ وَرَوَاهُ ابْن خُزَيْمَة فِي صَحِيحه مثله إِلَّا أَنه قَالَ أَو نَهرا كراه وَقَالَ يَعْنِي حفره وَلم يذكر الْمُصحف

হাদীসের ব্যাখ্যা:

অন্য বর্ণনায় হাদীসটি কিছুটা ভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে হাদীস ও তার ব্যাখ্যা পেশ করা হলো।

হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মানুষ যখন মারা যায়, তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমল ছাড়া– সদাকায়ে জারিয়া; এমন ইলম, যা দ্বারা উপকার লাভ হয় এবং নেককার সন্তান, যে তার জন্য দু'আ করে।

আল্লাহ তা'আলা কতইনা দয়ালু। মানুষ জীবিত অবস্থায় সৎকর্ম করার সুযোগ পায়। তাতে তার গুনাহ মাফ হয়, নেকী লেখা হয় এবং আল্লাহ তা'আলার কাছে মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। কারও মৃত্যু হয়ে গেলে সে সুযোগ আর থাকে না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তার আমলনামায় নতুন কোনও নেকী যোগ হওয়ার সুযোগ থাকে না। কিন্তু কত মানুষ দুনিয়া থেকে চলে যায়, অথচ তার আমলনামায় খুব বেশি নেকী থাকে না। কারণ সে জীবিত অবস্থার সুযোগসমূহ খুব একটা কাজে লাগায়নি। নেকী বেশি না হলে পাপের পাল্লা ভারী হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এ অবস্থায় সে কীভাবে নাজাত পেতে পারে? দয়াময় আল্লাহ বান্দাকে নাজাত দিতেই চান। সে লক্ষ্যে তিনি মৃত্যুর পরও বান্দার আমলনামায় নতুন নতুন নেকী যুক্ত হওয়ার ব্যবস্থা রেখে দিয়েছেন। ফলে এমনও হতে পারে যে, খুব বেশি নেকী নিয়ে মারা না গেলেও বান্দার আমলনামায় কিয়ামত পর্যন্ত নেকী লেখা অব্যাহত থাকবে। আর তাতে করে তার পাপের চেয়ে পুণ্যের পাল্লা ভারী হয়ে যাবে। তা কী সে ব্যবস্থা, যা দ্বারা বান্দার মৃত্যুর পরও তার আমলনামায় নতুন নতুন নেকী যুক্ত হতে পারে? আলোচ্য হাদীছটিতে সে বিষয়েই আমাদের অবহিত করা হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মানুষ মারা গেলে তার আমল বন্ধ হয়ে যায় বটে, তবে তিনটি বিষয় ব্যতিক্রম। তার একটি হচ্ছে-
صَدَقَة جارية (সদাকায়ে জারিয়া)। অর্থাৎ এমন দান-খয়রাত, যার উপকার অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। যেমন মসজিদ নির্মাণ করা, মাদরাসা কায়েম করা, খাল খননের মাধ্যমে সেচের ব্যবস্থা করা, নলকূপ বসিয়ে পানীয়-জলের ব্যবস্থা করা মসজিদ মাদরাসা, খানকাহ, মুসাফিরখানা, হাসপাতাল, কবরস্থান, ঈদগাহ ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক কাজে জমি ওয়াকফ করা, রাস্তাঘাট ও সেতু নির্মাণ করা, দীনী বই-পুস্তক মুদ্রণ ও বিতরণ করা, দীনী পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। এসব কাজ আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির নিয়তে করলে মৃত্যুর পরও ব্যক্তির আমলনামায় ছাওয়াব যুক্ত হতে থাকবে। মানুষ যতকাল এর দ্বারা উপকৃত হবে, ততকালই ছাওয়াব লেখা অব্যাহত থাকবে। দ্বিতীয় বিষয় হল-
أَوْ عِلْمٍ يُنتفعُ بِه (এমন ইলম, যা দ্বারা উপকার লাভ হয়)। অর্থাৎ দীনী ইলমের শিক্ষা ও বিস্তারে ভূমিকা রাখা। শিক্ষার্থীদেরকে সরাসরি দীন শেখানো, তাদের শিক্ষালাভে আর্থিক সহযোগিতা করা, যেমন দীনী শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে দীনী বই-পুস্তক বিতরণ করা ইত্যাদি। কাউকে হাফেয-আলেম বানানোর ছাওয়াব অসংখ্য, অপরিমিত। উত্তরোত্তর তা বাড়তে থাকে। ঠিক গাণিতিক হারে। কেউ একজনকে হাফেয বা আলেম বানাল। তারপর সেই হাফেয ও আলেম তো বসে থাকবে না। সে আরও পাঁচ-দশজনকে হাফেয-আলেম বানানোর চেষ্টা করবে। অনেক সময় একজন হাফেয বা একজন আলেমের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করে শত শত এমনকি হাজার হাজার হাফেয-আলেম তৈরি হয়। তারপর তাদের প্রত্যেকের চেষ্টায় বহু হাফেয-আলেম তৈরি হতে থাকে। পরে যারা তৈরি হল, তাদের দ্বারাও তৈরি হয় বহু হাফেয-আলেম। এভাবে এক পর্যায়ে তাদের সংখ্যা লাখে লাখে হয়ে যায়। সেই সকলের ইলম, আমল, আখলাক ও তরবিয়াত দ্বারা যত লোক উপকৃত হয়, তাদের সকলের সমপরিমাণ নেকী ওই প্রথম ব্যক্তির আমলনামায় লেখা হতে থাকে। ভাবা যায় এর সংখ্যা কী পরিমাণ হতে পারে? সুতরাং আমলনামায় অব্যাহতভাবে সর্বাধিক পরিমাণ ছাওয়াব যুক্ত হওয়ার সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হল হাফেয-আলেম বানানোর চেষ্টায় যুক্ত থাকা।

মৃত্যুর পর নতুন নতুন নেকী লাভের তৃতীয় উপায় হল- أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ (এবং নেককার সন্তান, যে তার জন্য দু'আ করে)। কারও নেককার সন্তান যা-কিছু নেক আমল করে, তাতে সে নিজে যে ছাওয়াব পায় তার সমপরিমাণ ছাওয়াব তার পিতা- মাতাও পেয়ে থাকে। কারণ তার নেককার হওয়াটা পিতা-মাতার সুশিক্ষা ও তরবিয়াতের ফলেই সম্ভব হয়। কাজেই প্রত্যেক পিতা-মাতার উচিত তাদের সন্তান-সন্ততিকে উত্তম তরবিয়াত ও শিক্ষা-দীক্ষা প্রদানের মাধ্যমে নেককাররূপে গড়ে তোলার চেষ্টা করা। এ হাদীছে বলা হয়েছে, নেককার সন্তান পিতা-মাতার জন্য যে দু'আ করে, পিতা-মায় তা দ্বারা উপকৃত হয়ে থাকে। এ বিষয়ে অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ الرَّجُلَ لَتُرْفَعُ دَرَجَتُهُ فِي الْجَنَّةِ فَيَقُولُ : أَنّى هَذَا؟ فَيُقَالُ: بِاسْتِغْفَارِ وَلَدِكَ لَكَ
‘নিশ্চয়ই জান্নাতে কোনও কোনও ব্যক্তির মর্যাদা উঁচু করা হবে। আর তাতে সে ব্যক্তি বলবে, এটা কীভাবে হল? তখন বলা হবে, (এটা হয়েছে) তোমার জন্য তোমার সন্তানের ইস্তিগফারের মাধ্যমে’।(সুনানে ইবন মাজাহ: ৩৬৬০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১২০৮১; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৫১০৮)

এ হাদীছে যদিও দু'আ-ইস্তিগফারের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু সদাকায়ে জারিয়া ও উপকারী শিক্ষার বিষয়কে এর সঙ্গে যুক্ত করা হলে বোঝা যায়, পিতা-মাতা কেবল সন্তানের দু'আ-ইস্তিগফার দ্বারাই উপকৃত হবে না, তাদের যাবতীয় সৎকর্ম দ্বারাও তারা উপকার লাভ করবে। তা দ্বারা সন্তান নিজে যেমন ছাওয়াব পাবে, সমপরিমাণ ছাওয়াব তাদের পিতা-মাতার আমলনামায়ও লেখা হবে।

আলোচ্য হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ مِمَّا يَلْحَقُ الْمُؤْمِنَ مِنْ عَمَلِهِ وَحَسَنَاتِهِ بَعْدَ مَوْتِهِ : عِلْمًا نَشَرَهُ ، وَوَلَدًا صَالِحًا تَرَكَهُ ، وَمُصْحَفًا وَرَّثَهُ ، أَوْ مَسْجِدًا بَنَاهُ ، أَوْ بَيْتًا لاِبْنِ السَّبِيلِ بَنَاهُ ، أَوْ نَهْرًا أَجْرَاهُ ، أَوْ صَدَقَةً أَخْرَجَهَا مِنْ مَالِهِ فِي صِحَّتِهِ وَحَيَاتِهِ ، تَلْحَقُهُ مِنْ بَعْدِ مَوْتِهِ
'মুমিন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার সঙ্গে যে আমল ও সৎকর্ম যুক্ত হয় তার মধ্যে রয়েছে তার প্রচার করে যাওয়া ইলম, তার রেখে যাওয়া নেক সন্তান, উত্তরাধিকারস্বরূপ রেখে যাওয়া কুরআন মাজীদের কপি, তার নির্মিত মসজিদ, তার নির্মিত মুসাফিরখানা, তার খনন করে যাওয়া খাল, তার জীবদ্দশায় ও সুস্থতাকালে করে যাওয়া দান-সদাকা। তার মৃত্যুর পরও এসব (এর নেকী) তার সঙ্গে যুক্ত হবে’। (সুনানে ইবন মাজাহ: ২৪২; সহীহ ইবনে খুযায়মা: ২৪৯০; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৩৪৪৮)

এ হাদীছটিতে মোট সাতটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে, যার ছাওয়াব ব্যক্তি তার মৃত্যুর পরও পেতে থাকে। তবে লক্ষ করলে বোঝা যায় এ সবগুলো বিষয়ই আলোচ্য হাদীছটিতে যে তিনটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে তার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কাজেই উভয় হাদীছের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। বরং সদাকায়ে জারিয়া কথাটি অনেক ব্যাপক। আরও বহু মানবকল্যাণমূলক কাজ এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, যেমনটা উপরের ব্যাখ্যায় ইঙ্গিত করা হয়েছে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. জীবিত ও সুস্থ থাকা অবস্থায় সাধ্যমতো সদাকায়ে জারিয়া বা এমন জনকল্যাণমূলক খাতে দান-খয়রাত করা উচিত, যা দ্বারা মানুষ অব্যাহতভাবে উপকৃত হয়।

খ. জীবিতদের দু'আ-ইস্তিগফার দ্বারা মৃতব্যক্তি উপকৃত হয়ে থাকে।

গ. দীনী শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রাখার ছাওয়াব অপরিমিত ও অনিঃশেষ। তাই আপন সাধ্য অনুযায়ী এ কাজে অংশগ্রহণ করা উচিত।

ঘ. নিজ সন্তানের উত্তম তরবিয়াত ও উত্তম শিক্ষাদান করা প্রত্যেক পিতা-মাতার একান্ত জরুরি। এর দ্বারা মৃত্যুর পরও পিতা-মাতা নিরবচ্ছিন্নভাবে উপকৃত হতে পারে।

ঙ. সে-ই প্রকৃত সুসন্তান, যে পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তাদের জন্য নিয়মিত দু'আ-ইস্তিগফার করে।

চ. জীবদ্দশায় যার বেশি নেককাজ করা হয়ে উঠেনি, তার হতাশ হওয়া উচিত নয়। অন্ততপক্ষে মৃত্যুর আগে আগে হলেও সদাকায়ে জারিয়ার অন্তর্ভুক্ত কোনও কাজ যদি করে যাওয়া যায়, তবে তা দ্বারা মৃত্যুর পর অনেক অনেক উপকারলাভের আশা রয়েছে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব - হাদীস নং ১২৪ | মুসলিম বাংলা