কিতাবুস সুনান - ইমাম আবু দাউদ রহঃ
৩. যাকাতের অধ্যায়
হাদীস নং: ১৬৭৩
আন্তর্জাতিক নং: ১৬৭৩
৩৯. যে ব্যক্তি তার সকল সম্পদ দান করতে চায়।
১৬৭৩. মুসা ইবনে ইসমাঈল (রাহঃ) ..... জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আল-আনসারী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। এমতাবস্থায় জনৈক ব্যক্তি ডিমের পরিমাণ এক খণ্ড স্বর্ণ নিয়ে তার নিকট উপস্থিত হয়। সে বলে ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি এই স্বর্ণ খনিতে প্রাপ্ত হয়েছি। আপনি তা দানস্বরূপ গ্রহণ করুন। এছাড়া আমার আর কিছুই নাই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার দিক হতে মুখ ফিরিয়ে নেন। অতঃপর সে তার ডান দিক হতে এসে একইরূপ বলে এবং তিনি এবারও তার দিক হতে মুখ ফিরিয়ে নেন। অতঃপর সে তার বাম দিক হতে এলে এবারও তিনি তার মুখ ফিরিয়ে নেন।
অতঃপর সে তার পশ্চাত দিকে হতে আগমন করলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তা কবুল করে পুনরায় তার দিকে জোরে নিক্ষেপ করেন। যদি তা তার গায়ে লাগত তবে অবশ্যই সে আঘাত পেত অথবা আহত হত। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমাদের কেউ তার মালিকানার সমস্ত মাল নিয়ে এসে বলে এটা সদকা স্বরূপ। অতঃপর সে মানুষের নিকট সাহায্যের জন্য স্বীয় হাত প্রসারিত করে। (জেনে রাখ!) উত্তম সাদকাহ তাই, যা প্রয়োজনাতিরিক্ত মাল হতে দেওয়া হয়।
অতঃপর সে তার পশ্চাত দিকে হতে আগমন করলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তা কবুল করে পুনরায় তার দিকে জোরে নিক্ষেপ করেন। যদি তা তার গায়ে লাগত তবে অবশ্যই সে আঘাত পেত অথবা আহত হত। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমাদের কেউ তার মালিকানার সমস্ত মাল নিয়ে এসে বলে এটা সদকা স্বরূপ। অতঃপর সে মানুষের নিকট সাহায্যের জন্য স্বীয় হাত প্রসারিত করে। (জেনে রাখ!) উত্তম সাদকাহ তাই, যা প্রয়োজনাতিরিক্ত মাল হতে দেওয়া হয়।
باب الرَّجُلِ يَخْرُجُ مِنْ مَالِهِ
حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ إِسْمَاعِيلَ، حَدَّثَنَا حَمَّادٌ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ إِسْحَاقَ، عَنْ عَاصِمِ بْنِ عُمَرَ بْنِ قَتَادَةَ، عَنْ مَحْمُودِ بْنِ لَبِيدٍ، عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ الأَنْصَارِيِّ، قَالَ كُنَّا عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذْ جَاءَ رَجُلٌ بِمِثْلِ بَيْضَةٍ مِنْ ذَهَبٍ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَصَبْتُ هَذِهِ مِنْ مَعْدِنٍ فَخُذْهَا فَهِيَ صَدَقَةٌ مَا أَمْلِكُ غَيْرَهَا . فَأَعْرَضَ عَنْهُ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ثُمَّ أَتَاهُ مِنْ قِبَلِ رُكْنِهِ الأَيْمَنِ فَقَالَ مِثْلَ ذَلِكَ فَأَعْرَضَ عَنْهُ ثُمَّ أَتَاهُ مِنْ قِبَلِ رُكْنِهِ الأَيْسَرِ فَأَعْرَضَ عَنْهُ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ثُمَّ أَتَاهُ مِنْ خَلْفِهِ فَأَخَذَهَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَحَذَفَهُ بِهَا فَلَوْ أَصَابَتْهُ لأَوْجَعَتْهُ أَوْ لَعَقَرَتْهُ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " يَأْتِي أَحَدُكُمْ بِمَا يَمْلِكُ فَيَقُولُ هَذِهِ صَدَقَةٌ ثُمَّ يَقْعُدُ يَسْتَكِفُّ النَّاسَ خَيْرُ الصَّدَقَةِ مَا كَانَ عَنْ ظَهْرِ غِنًى " .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
দান-খয়রাতে কী নীতি অবলম্বন করা চাই
দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে মূলনীতি হচ্ছে, প্রথমে নিজের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য যা প্রয়োজন তা রেখে দেওয়া। তারপর যা অবশিষ্ট থাকে তা থেকেই দান-খয়রাত করা হবে। এ হাদীছে বলা হয়েছে- وخير الصدقة ما كان عن ظهر غنى (উৎকৃষ্ট দান সেটাই, যা অভাবমুক্ততা রক্ষার সঙ্গে করা হয়)।- (এখানে ظهر শব্দটি অতিরিক্ত। আরবী ভাষায় বাক্যের সৌন্দর্য বা অন্য কোনও উদ্দেশ্য এরকম অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অনুবাদে এর অর্থ আসে না।) অর্থাৎ যা দান করা হয় তার প্রতি যদি দাতার মুখাপেক্ষিতা না থাকে এবং তা ছাড়াও তার পক্ষে চলা সম্ভব হয়, তবে সেই দানই উত্তম। এভাবেও বলা যায় যে, ওই দান উত্তম, যা দেওয়ার পর দাতার হাতে এতটুকু সম্পদ অবশিষ্ট থাকে, যা দ্বারা সে নিজ প্রয়োজন সমাধা করতে পারে। অপর এক হাদীছে কথাটি আরও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে خير الصدقة ما أبقت غنى “শ্রেষ্ঠ দান তাই, যা প্রয়োজন সমাধা করার মত সম্পদ অবশিষ্ট রাখে।- (মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৫৫৭৭; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১২৭২৬; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩১৪৬; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ১০৬৯৩)
মূলত এ হাদীছটি কুরআন মাজীদের আয়াত থেকেই গৃহীত। ইরশাদ হয়েছে وَيَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ قُلِ الْعَفْوَ "লোকে আপনাকে জিজ্ঞেস করে, (আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে) তারা কী ব্যয় করবে? আপনি বলে দিন, যা (তোমাদের প্রয়োজনের) অতিরিক্ত।- (সূরা বাকারা (২), আয়াত ২১৯)
একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর
প্রশ্ন হতে পারে যে, এক হাদীছ দ্বারা তো এর বিপরীত কথাই জানা যায়, তাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কোন্ সদাকা উত্তম, এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন- جهد المقل (দারিদ্র্যপীড়িত ব্যক্তির দান),- (الجهد এর অর্থ শক্তি, শ্রম ও কষ্ট। কেউ বলেন, শব্দটির ج হরফে যবর দেওয়া হলে তখন অর্থ হয়, কষ্ট-ক্লেশ। আর পেশ দেওয়া হলে অর্থ হয়, সামর্থ্য। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে- وَالَّذِينَ لَا يَجِدُونَ إِلَّا جُهْدَهُمْ 'তাদেরকেও (মুনাফিকগণ দোষারোপ করে) যারা নিজ শ্রম (লব্ধ অর্থ) ছাড়া কিছুই পায় না (সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৭৯)'। ইবনুল আছীর রহ. বলেন, কেউ যখন কষ্টক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন বলা হয় جهد الرجل فهو مجهود। এমনিভাবে লোকে খরাপীড়িত হয়ে পড়লে বলা হয় جهد الناس فهم مجهودون । কেউ সফরকালে নিজ বাহনের পিঠে তার সামর্থ্যের বাইরে বোঝা চাপালে বলা হয় أجهد دابته । সফরে কারও পশু ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়লে তাকে বলা হয় رجل مجهد । এরই সঙ্গে উপমিত করে অর্থসংকটে জর্জরিত ব্যক্তিকেও رجل مجهد বলে। তো এই হাদীছে جهد المقل দ্বারা দারিদ্র্যপীড়িত ব্যক্তির দান বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থসংকটের কারণে যে ব্যক্তি কষ্ট-ক্লেশের সঙ্গে দিনাতিপাত করে, তার দান শ্রেষ্ঠ দান, যেহেতু সে নিজ কষ্ট-ক্লেশ উপেক্ষা করে আল্লাহর পথে খরচকে প্রধান্য দেয়।) এ উভয় হাদীছ কি পরস্পরবিরোধী নয়?- (সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৪৪৯; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫২৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৭০২; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ৪৮৪৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩৬১; তবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০৩; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৭৭৭২; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১৬৭৫)
উত্তর এই যে, মূলত হাদীছদু'টি দুই স্তরের মানুষের জন্য প্রযোজ্য। নিজ প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ থেকে দান করা যে শ্রেষ্ঠ, এর সম্পর্ক সাধারণ স্তরের লোকদের সঙ্গে। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ থেকে দান করা সমীচীন নয়। কেননা খালিহাত হয়ে গেলে পরে যখন কষ্টের সম্মুখীন হবে, তখন সবটা দিয়ে ফেলার কারণে তাদের মনে অনুশোচনা দেখা দিতে পারে। ফলে দানের ছাওয়াব নষ্ট হয়ে যাবে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَى عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَحْسُورًا
(কৃপণতাবশে) নিজের হাত ঘাড়ের সাথে বেঁধে রেখ না এবং তা সম্পূর্ণরূপে খুলে দিও না, যদ্দরুন তোমাকে নিন্দিত ও অনুতপ্ত হয়ে বসে পড়তে হবে।- (সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৯)
এ কারণেই সাধারণ স্তরের লোকদের জন্য ভালো হল চলার মত টাকা-পয়সা হাতে রেখে দেওয়া, তারপর অতিরিক্ত থাকলে তা থেকে দান-খয়রাত করা।
পক্ষান্তরে আল্লাহর প্রতি যাদের তাওয়াক্কুল যথেষ্ট পরিপক্ক, সেইসঙ্গে কষ্ট-ক্লেশে ধৈর্যও হারায় না, এ শ্রেণীর গরীবগণ যদি তাদের হাতের সবটা সম্পদও দান করে দেয় তাতে ক্ষতি নেই। পরবর্তীতে তাদের অনুশোচনায় ভোগার আশঙ্কা নেই। পরের হাদীছটির সম্পর্ক এই স্তরের লোকদের সঙ্গে। এদের দান অতি উত্তম তাতে সন্দেহ কী? নিজেদের কষ্ট-ক্লেশ উপেক্ষা করে অন্যদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় তাদের দানের ছাওয়াব অনেক বেশি।
বস্তুত সব কাজ সবার জন্য নয়। যুদ্ধের জন্য যেমন সৎসাহসের প্রয়োজন হয়, দান-খয়রাতের জন্যও তেমনি হিম্মতের প্রয়োজন। উচ্চমাত্রার তাওয়াক্কুল ও সবর দ্বারা সে হিম্মত গঠিত হয়। এ গুণ যাদের আছে কেবল তাদের জন্যই আল্লাহর পথে সবকিছু উজাড় করে দেওয়া সাজে। তাদেরই জন্য এটা উৎকৃষ্টতর দান। যারা এ পর্যায়ের নয় তাদের জন্য এটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের জন্য উত্তম বাড়তি সম্পদ থেকে দান করা। সাহাবায়ে কেরাম সাধারণত উঁচু হিম্মতের অধিকারী ছিলেন, যদিও তাদের পরস্পরের মধ্যেও এ ক্ষেত্রে পার্থক্য ছিল। তাই দারিদ্র্যপীড়িত অবস্থায়ও আল্লাহর পথে শেষ কড়িটুকুও বিলিয়ে দিতে তাঁরা কুণ্ঠাবোধ করতেন না। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর স্থান ছিল এ ক্ষেত্রে সর্বশীর্ষে। একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দান-সদাকা করার হুকুম দিলে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ঘরে যা-কিছু ছিল সবটা এনে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছ? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি।- (সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৬৭৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩৬৭৫; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ১৭০১; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৭৭৭৪; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ১৬৭৫)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. সাধারণ স্তরের লোকদের জন্য এটাই শ্রেয় যে, পারিবারিক জরুরত মেটানোর পর উদ্বৃত্ত সম্পদ থেকেই দান-খয়রাত করবে।
দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে মূলনীতি হচ্ছে, প্রথমে নিজের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য যা প্রয়োজন তা রেখে দেওয়া। তারপর যা অবশিষ্ট থাকে তা থেকেই দান-খয়রাত করা হবে। এ হাদীছে বলা হয়েছে- وخير الصدقة ما كان عن ظهر غنى (উৎকৃষ্ট দান সেটাই, যা অভাবমুক্ততা রক্ষার সঙ্গে করা হয়)।- (এখানে ظهر শব্দটি অতিরিক্ত। আরবী ভাষায় বাক্যের সৌন্দর্য বা অন্য কোনও উদ্দেশ্য এরকম অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অনুবাদে এর অর্থ আসে না।) অর্থাৎ যা দান করা হয় তার প্রতি যদি দাতার মুখাপেক্ষিতা না থাকে এবং তা ছাড়াও তার পক্ষে চলা সম্ভব হয়, তবে সেই দানই উত্তম। এভাবেও বলা যায় যে, ওই দান উত্তম, যা দেওয়ার পর দাতার হাতে এতটুকু সম্পদ অবশিষ্ট থাকে, যা দ্বারা সে নিজ প্রয়োজন সমাধা করতে পারে। অপর এক হাদীছে কথাটি আরও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে خير الصدقة ما أبقت غنى “শ্রেষ্ঠ দান তাই, যা প্রয়োজন সমাধা করার মত সম্পদ অবশিষ্ট রাখে।- (মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৫৫৭৭; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১২৭২৬; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩১৪৬; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ১০৬৯৩)
মূলত এ হাদীছটি কুরআন মাজীদের আয়াত থেকেই গৃহীত। ইরশাদ হয়েছে وَيَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ قُلِ الْعَفْوَ "লোকে আপনাকে জিজ্ঞেস করে, (আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে) তারা কী ব্যয় করবে? আপনি বলে দিন, যা (তোমাদের প্রয়োজনের) অতিরিক্ত।- (সূরা বাকারা (২), আয়াত ২১৯)
একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর
প্রশ্ন হতে পারে যে, এক হাদীছ দ্বারা তো এর বিপরীত কথাই জানা যায়, তাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কোন্ সদাকা উত্তম, এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন- جهد المقل (দারিদ্র্যপীড়িত ব্যক্তির দান),- (الجهد এর অর্থ শক্তি, শ্রম ও কষ্ট। কেউ বলেন, শব্দটির ج হরফে যবর দেওয়া হলে তখন অর্থ হয়, কষ্ট-ক্লেশ। আর পেশ দেওয়া হলে অর্থ হয়, সামর্থ্য। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে- وَالَّذِينَ لَا يَجِدُونَ إِلَّا جُهْدَهُمْ 'তাদেরকেও (মুনাফিকগণ দোষারোপ করে) যারা নিজ শ্রম (লব্ধ অর্থ) ছাড়া কিছুই পায় না (সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৭৯)'। ইবনুল আছীর রহ. বলেন, কেউ যখন কষ্টক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন বলা হয় جهد الرجل فهو مجهود। এমনিভাবে লোকে খরাপীড়িত হয়ে পড়লে বলা হয় جهد الناس فهم مجهودون । কেউ সফরকালে নিজ বাহনের পিঠে তার সামর্থ্যের বাইরে বোঝা চাপালে বলা হয় أجهد دابته । সফরে কারও পশু ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়লে তাকে বলা হয় رجل مجهد । এরই সঙ্গে উপমিত করে অর্থসংকটে জর্জরিত ব্যক্তিকেও رجل مجهد বলে। তো এই হাদীছে جهد المقل দ্বারা দারিদ্র্যপীড়িত ব্যক্তির দান বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থসংকটের কারণে যে ব্যক্তি কষ্ট-ক্লেশের সঙ্গে দিনাতিপাত করে, তার দান শ্রেষ্ঠ দান, যেহেতু সে নিজ কষ্ট-ক্লেশ উপেক্ষা করে আল্লাহর পথে খরচকে প্রধান্য দেয়।) এ উভয় হাদীছ কি পরস্পরবিরোধী নয়?- (সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৪৪৯; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫২৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৭০২; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ৪৮৪৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩৬১; তবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০৩; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৭৭৭২; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১৬৭৫)
উত্তর এই যে, মূলত হাদীছদু'টি দুই স্তরের মানুষের জন্য প্রযোজ্য। নিজ প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ থেকে দান করা যে শ্রেষ্ঠ, এর সম্পর্ক সাধারণ স্তরের লোকদের সঙ্গে। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ থেকে দান করা সমীচীন নয়। কেননা খালিহাত হয়ে গেলে পরে যখন কষ্টের সম্মুখীন হবে, তখন সবটা দিয়ে ফেলার কারণে তাদের মনে অনুশোচনা দেখা দিতে পারে। ফলে দানের ছাওয়াব নষ্ট হয়ে যাবে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَى عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَحْسُورًا
(কৃপণতাবশে) নিজের হাত ঘাড়ের সাথে বেঁধে রেখ না এবং তা সম্পূর্ণরূপে খুলে দিও না, যদ্দরুন তোমাকে নিন্দিত ও অনুতপ্ত হয়ে বসে পড়তে হবে।- (সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৯)
এ কারণেই সাধারণ স্তরের লোকদের জন্য ভালো হল চলার মত টাকা-পয়সা হাতে রেখে দেওয়া, তারপর অতিরিক্ত থাকলে তা থেকে দান-খয়রাত করা।
পক্ষান্তরে আল্লাহর প্রতি যাদের তাওয়াক্কুল যথেষ্ট পরিপক্ক, সেইসঙ্গে কষ্ট-ক্লেশে ধৈর্যও হারায় না, এ শ্রেণীর গরীবগণ যদি তাদের হাতের সবটা সম্পদও দান করে দেয় তাতে ক্ষতি নেই। পরবর্তীতে তাদের অনুশোচনায় ভোগার আশঙ্কা নেই। পরের হাদীছটির সম্পর্ক এই স্তরের লোকদের সঙ্গে। এদের দান অতি উত্তম তাতে সন্দেহ কী? নিজেদের কষ্ট-ক্লেশ উপেক্ষা করে অন্যদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় তাদের দানের ছাওয়াব অনেক বেশি।
বস্তুত সব কাজ সবার জন্য নয়। যুদ্ধের জন্য যেমন সৎসাহসের প্রয়োজন হয়, দান-খয়রাতের জন্যও তেমনি হিম্মতের প্রয়োজন। উচ্চমাত্রার তাওয়াক্কুল ও সবর দ্বারা সে হিম্মত গঠিত হয়। এ গুণ যাদের আছে কেবল তাদের জন্যই আল্লাহর পথে সবকিছু উজাড় করে দেওয়া সাজে। তাদেরই জন্য এটা উৎকৃষ্টতর দান। যারা এ পর্যায়ের নয় তাদের জন্য এটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের জন্য উত্তম বাড়তি সম্পদ থেকে দান করা। সাহাবায়ে কেরাম সাধারণত উঁচু হিম্মতের অধিকারী ছিলেন, যদিও তাদের পরস্পরের মধ্যেও এ ক্ষেত্রে পার্থক্য ছিল। তাই দারিদ্র্যপীড়িত অবস্থায়ও আল্লাহর পথে শেষ কড়িটুকুও বিলিয়ে দিতে তাঁরা কুণ্ঠাবোধ করতেন না। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর স্থান ছিল এ ক্ষেত্রে সর্বশীর্ষে। একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দান-সদাকা করার হুকুম দিলে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ঘরে যা-কিছু ছিল সবটা এনে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছ? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি।- (সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৬৭৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩৬৭৫; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ১৭০১; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৭৭৭৪; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ১৬৭৫)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. সাধারণ স্তরের লোকদের জন্য এটাই শ্রেয় যে, পারিবারিক জরুরত মেটানোর পর উদ্বৃত্ত সম্পদ থেকেই দান-খয়রাত করবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
