কিতাবুস সুনান - ইমাম আবু দাউদ রহঃ

২. নামাযের অধ্যায়

হাদীস নং: ১৪৫৫
আন্তর্জাতিক নং: ১৪৫৫
৩৫৫. কুরআন তিলাওয়াতের সাওয়াব সম্পর্কে।
১৪৫৫. উছমান ইবনে আবি শাঈবা (রাহঃ) ...... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) নবী করীম (ﷺ) হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ যখন কোন কওমের লোকেরা আল্লাহর ঘরের কোন এক ঘরে একত্রিত হয়ে কুরআন পাঠ করে এবং একে অন্যকে শিখায় এবং শিখে, তখন তাদের উপর শান্তি বর্ষিত হয় এবং আল্লাহর রহমত তাদেরকে আচ্ছাদিত করে এবং ফিরিশতারা তাদেরকে ঘিরে রাখে এবং আল্লাহ তাআলা ঐ সমস্ত বান্দাদের ব্যাপারে তাঁর নিকটবর্তী ফিরিশতাদের সামনে উল্লেখ করেন।
باب فِي ثَوَابِ قِرَاءَةِ الْقُرْآنِ
حَدَّثَنَا عُثْمَانُ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ، حَدَّثَنَا أَبُو مُعَاوِيَةَ، عَنِ الأَعْمَشِ، عَنْ أَبِي صَالِحٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " مَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِي بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللَّهِ تَعَالَى يَتْلُونَ كِتَابَ اللَّهِ وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ إِلاَّ نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلاَئِكَةُ وَذَكَرَهُمُ اللَّهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ " .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে যে ফযীলতের আমল উল্লেখ করা হয়েছে, তা হচ্ছে মসজিদে সম্মিলিতভাবে কুরআন মাজীদের চর্চা ও পঠন-পাঠন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ما اجتمع قوم في بيت من بيوت الله تعالى (কোনও লোকসমষ্টি আল্লাহর ঘরসমূহের মধ্যে কোনও একটি ঘরে একত্র হয়ে)। এখানে আল্লাহর ঘর বলে মসজিদ বোঝানো হয়েছে।
তখনকার যুগে কুরআন শিক্ষা ও ইলমে দীন চর্চার আমল মসজিদেই হত। সে এ হাদীছে বিশেষভাবে মসজিদের কথা বলা হয়েছে। মূল বিষয় যেহেতু কুরআন মাজীদের শিক্ষা ও চর্চা, কাজেই মসজিদ না হয়ে অন্য কোথাও যদি এ আমল করা হয়, তাতেও এ হাদীছে বর্ণিত ফযীলত লাভ হবে। বর্তমানকালে মসজিদের পাশাপাশি আলাদা শিক্ষালয়েও এ আমল ব্যাপকভাবে জারি আছে; বরং মসজিদ অপেক্ষা পৃথক শিক্ষাগারই এর জন্য বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মসজিদ নয় বলে সে শিক্ষাগার বা মাদরাসাসমূহের কুরআন চর্চা এ ফযীলত থেকে খারিজ হয়ে যাবে না।
অবশ্য হাদীছে ব্যবহৃত শব্দটি সরাসরিও মক্তব-মাদরাসার গৃহসমূহকে শামিল করে। হাদীছের শব্দ হচ্ছে بيت من بيوت الله (আল্লাহর ঘরসমূহের কোনও ঘর)। তার মানে যেসকল ঘরে আল্লাহর কালাম শিক্ষা দেওয়া হয়, তাঁর নাযিল করা শরীআতের চর্চা হয় এবং তাঁর মনোনীত দীনের প্রচার-প্রতিষ্ঠায় মেহনত হয়। আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পৃক্ত ও বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ আমলের কেন্দ্র হওয়ায় এসব ঘরকে 'আল্লাহর ঘর' বলা হয়ে থাকে।
যাহোক আল্লাহর কোনও ঘরে তারা কী উদ্দেশ্যে জমায়েত হয়? হাদীছের পরবর্তী অংশে জানানো হয়েছে-يتلون كتاب الله ويتدارسونه بينهم (তারা আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত এবং নিজেদের মধ্যে তার পঠন-পাঠনে মশগুল থাকে)। يتدارسون ক্রিয়াপদটি درس থেকে নির্গত। এর অর্থ পাঠ করা, বোঝা ও মুখস্থ করার উদ্দেশ্যে পড়া। অর্থ পরস্পরের মধ্যে পাঠবিনিময় করা। এর একটা সুরত তো এরকম যে, একজন কিছুটা পড়ল, তারপর অন্যজন হুবহু সেটুকুই পড়ল। এরূপ পড়ার দ্বারা পঠিত বিষয় সহজে মুখস্থ হয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযানের প্রতি রাতে হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামের সঙ্গে কুরআন মাজীদ এভাবে পড়তেন।
এর আরেক সুরত হচ্ছে উস্‌তাযকর্তৃক ছাত্র পড়ানো। উস্‌তায একটা অংশ ছাত্রকে পড়িয়ে দিল, তারপর ছাত্র নিজে নিজে তা পড়তে থাকল। তারপর আবার ছাত্র উস্‌তাযকে তা শোনাল। এটাও يتدارسون -এর অন্তর্ভুক্ত। এ পদ্ধতিটি যেমন কুরআন মাজীদের শব্দপাঠের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তেমনি এর অর্থ ও মর্মের জন্যও প্রযোজ্য বটে। অর্থাৎ উস্‌তায ছাত্রের সামনে আয়াত পড়ে তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দিল এবং ছাত্র তা মনোযোগ সহকারে শুনল। কোনও কথা বুঝে না আসলে তা জিজ্ঞেস করে নিল, আবার কোনও প্রশ্ন জাগলে তা উত্থাপন করল। অর্থাৎ যথারীতি পাঠদান ও পাঠগ্রহণ।
কুরআন মাজীদের পারস্পরিক পাঠবিনিময় ও সম্মিলিত পঠন-পাঠন অত্যন্ত বরকতময় ও ফযীলতপূর্ণ আমল। হাদীছে এর চারটি ফীলত উল্লেখ করা হয়েছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন إلا نزلت عليهم السكينة، وغشيتهم الرحمة، وحفتهم الملائكة، وذكرهم الله فيمن عنده (তাদের উপর সাকীনা নাযিল হয়, রহমত তাদেরকে ঢেকে নেয়, ফিরিশতাগণ তাদেরকে ঘিরে রাখেন এবং আল্লাহ তাঁর কাছে উপস্থিত (ফিরিশতা)-দের মধ্যে তাদের উল্লেখ করেন)। সাকীনা হচ্ছে মনের ওই স্থিরতা ও শান্ত-সমাহিত অবস্থার নাম, যা আল্লাহর যিকির ও কুরআন তিলাওয়াতের ফলে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নাযিল করা হয়। যেমন ইরশাদ হয়েছে أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ 'স্মরণ রেখ, কেবল আল্লাহর যিকিরেই অন্তরে প্রশান্তি লাভ হয়।১৯৬
অন্যত্র ইরশাদ هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ السَّكِينَةَ فِي قُلُوبِ الْمُؤْمِنِينَ لِيَزْدَادُوا إِيمَانًا مَعَ إِيمَانِهِمْ “তিনিই মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি অবতীর্ণ করেছেন, যাতে তাদের ঈমানে অধিকতর ঈমান যুক্ত হয়।১৯৭
সাকীনা দ্বারা ঈমানে মজবুতী আসে, যদ্দরুন পার্থিব কোনও বিপদাপদে চিত্তচাঞ্চল্য ও পেরেশানি দেখা দেয় না। মন এ বিশ্বাসে অবিচল থাকে যে, সমগ্র কায়েনাত আল্লাহর কুদরতের অধীন। সবকিছু তাঁর ইচ্ছাতেই হয়। তাঁর ইচ্ছার বাইরে কোনওকিছু ঘটা সম্ভব নয়। কাজেই অস্থির না হয়ে আল্লাহতে সমর্পিত থাকাই শ্রেয়। তাতে বিপদাপদের বিনিময়ে তিনি অভাবনীয় আজর ও ছাওয়াব দান করেন। যার অন্তরে সাকীনা থাকে, সে ওই আজর ও ছাওয়াবের আশায় যাবতীয় পরিস্থিতিতে শান্ত ও ভারমুক্ত থাকে। এমনিভাবে আল্লাহ তাআলার যাবতীয় বিধি-বিধান পালনেও সে স্থির-অবিচল থাকে। পরিবেশ-পরিস্থিতি তাকে প্রভাবিত করতে পারে না। নিন্দুকের নিন্দা ও প্রশংসাকারীর প্রশংসায় তার ভাবান্তর হয় না। সুতরাং সাকীনা আল্লাহ তাআলার এক বিরাট নিআমত। কুরআন তিলাওয়াত ও কুরআনে লিপ্ততা দ্বারা এ নিআমত অর্জিত হয়।
রহমত ঢেকে নেওয়ার অর্থ চতুর্দিক থেকে এমনভাবে বেষ্টন করে ফেলা যে, কোনও বিপদ-আপদ বা পরিবেশ-পরিস্থিতির কুপ্রভাব তাদের অন্তর স্পর্শ করতে পারে না। সব হালতে তাদের উপর আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ ও করুণা বর্ধিত হতে থাকে। ফলে শয়তানের প্ররোচনা ও নফসের ওয়াসওয়াসা তাদের অন্তরে প্রভাব ফেলতে পারে না।
ফিরিশতা তাদের পরিবেষ্টন করে রাখে। তারা রহমত ও বরকতের ফিরিশতা। আল্লাহ তাআলা একদল ফিরিশতাকে এ কাজে নিযুক্ত করে রেখেছেন। তারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়। যখনই কোথাও যিকির ও তিলাওয়াতের মজলিস দেখে, তখন তাদেরকে পরিবেষ্টন করে ফেলে। যেমন হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে-

إن الله ملائكة يطوفون في الطرق يلتمسون أهل الذكر، فإذا وجدوا قوما يذكرون الله تنادوا : هلموا إلى حاجتكم، قال فيحفونهم بأجنحتهم إلى السماء الدنيا

“আল্লাহ তাআলার এমন একদল ফিরিশতা আছে, যারা পথে পথে ঘুরে বেড়ায় এবং যিকিরকারীদের সন্ধান করে। যখনই কোথাও লোকজনকে আল্লাহর যিকিরে মশগুল দেখতে পায়, তখন তারা একে অন্যকে ডেকে বলে, এসো, তোমরা তোমাদের কাঙ্ক্ষিত বিষয় পেয়ে গেছ। তারপর তারা তাদের ডানা বিস্তার করে প্রথম আসমান পর্যন্ত তাদেরকে ঘিরে রাখে।১৯৮
অন্য এক হাদীছে ইরশাদ إن الله ملائكة سيارة فضلاء يبتغون مجالس الذكر 'আল্লাহ তাআলার একদল বাড়তি ফিরিশতা আছে, যারা সর্বদা পরিভ্রমণে থাকে এবং যিকিরের মজলিস অনুসন্ধান করে।১৯৯
এটা করে তাদের সম্মানার্থে এবং তাদের যিকির ও তিলাওয়াত আসমানে পৌছানোর উদ্দেশ্যে। এভাবে তারা শয়তান থেকে যিকিরকারীদের হেফাজতও করে থাকে। তারা এমন কোনও ফাঁক রাখে না, যেখান থেকে শয়তান প্রবেশ করতে পারবে।
সম্মিলিত কুরআন চর্চা এমনই এক মর্যাদাপূর্ণ আমল যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর কাছের মাখলুকদের সামনে এ আমলকারীদের কথা উল্লেখ করে থাকেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানাচ্ছেন-وذكرهم الله فيمن عنده, (আল্লাহ তাঁর কাছে উপস্থিত (ফিরিশতা)-দের মধ্যে তাদের উল্লেখ করেন)। এর দ্বারা উদ্দেশ্য তাদের সামনে এ আমলকারীদের মর্যাদা তুলে ধরা এবং তাদের প্রতি নিজ সন্তুষ্টির কথা প্রকাশ করা। আল্লাহ তাআলা তাঁর যিকির বড় ভালোবাসেন। বান্দা যিকির করলে তিনি খুশি হন। তাঁর নিকটবর্তীদের সামনে যাকিরীনের উল্লেখ করা সে খুশিরই প্রকাশ । আল্লাহ বলেন فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ 'সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব।২০০
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত একটি হাদীছে কুদসীতে আছে فإن ذكرني في نفسه ذكرته في نفسي، وإن ذكرني في ملأ ذكرته في ملأ خير منهم 'বান্দা যদি আমাকে নিজে নিজে স্মরণ করে, আমি তাকে নিজে নিজে স্মরণ করি। বান্দা যদি আমাকে কোনও সমাবেশের মধ্যে স্মরণ করে, তবে আমি তার সমাবেশ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট সমাবেশে (অর্থাৎ ফিরিশতাদের সমাবেশে) তাকে স্মরণ করি।২০১

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. আল্লাহর ঘরে সম্মিলিতভাবে কুরআন মাজীদের তিলাওয়াত ও পঠন-পাঠনের যে চারটি ফযীলত আমরা জানতে পেরেছি, তা অর্জনের লক্ষ্যে আমরা অবশ্যই এ মূল্যবান আমলটি করে যাব।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
সুনানে আবু দাউদ - হাদীস নং ১৪৫৫ | মুসলিম বাংলা