কিতাবুস সুনান - ইমাম আবু দাউদ রহঃ

২. নামাযের অধ্যায়

হাদীস নং: ১৩২৪
আন্তর্জাতিক নং: ১৩২৪
৩১৮. দুই রাকআত নফল দ্বারা রাতের নামায আরাম্ভ করা।
১৩২৪. মাখলাদ ইবনে খালিদ (রাহঃ) ..... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) হতে এই সনদেও উপরোক্ত হাদীসের অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। তবে এতে আরও বর্ণিত হয়েছে যে, অতঃপর তুমি তোমার ইচ্ছানুযায়ী দীর্ঘ কিরাআত দ্বারা নামায আদায় করতে পার।
باب افْتِتَاحِ صَلاَةِ اللَّيْلِ بِرَكْعَتَيْنِ
حَدَّثَنَا مَخْلَدُ بْنُ خَالِدٍ، حَدَّثَنَا إِبْرَاهِيمُ، - يَعْنِي ابْنَ خَالِدٍ - عَنْ رَبَاحِ بْنِ زَيْدٍ، عَنْ مَعْمَرٍ، عَنْ أَيُّوبَ، عَنِ ابْنِ سِيرِينَ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ : " إِذَا " . بِمَعْنَاهُ زَادَ : " ثُمَّ لْيُطَوِّلْ بَعْدُ مَا شَاءَ " . قَالَ أَبُو دَاوُدَ : رَوَى هَذَا الْحَدِيثَ حَمَّادُ بْنُ سَلَمَةَ وَزُهَيْرُ بْنُ مُعَاوِيَةَ وَجَمَاعَةٌ عَنْ هِشَامٍ عَنْ مُحَمَّدٍ أَوْقَفُوهُ عَلَى أَبِي هُرَيْرَةَ، وَكَذَلِكَ رَوَاهُ أَيُّوبُ وَابْنُ عَوْنٍ أَوْقَفُوهُ عَلَى أَبِي هُرَيْرَةَ، وَرَوَاهُ ابْنُ عَوْنٍ عَنْ مُحَمَّدٍ قَالَ : فِيهِمَا تَجَوَّزْ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

সকল ইবাদতের সেরা ইবাদত নামায। প্রশ্ন হল, এই নামায কীভাবে সেরা নামায হিসেবে পরিগণিত হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ প্রশ্ন করা হলে উত্তরে তিনি বলেন-

طول القنوت.

দীর্ঘ ‘কুনূত’। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৫৬

এ ‘কুনূত’ শব্দ দিয়ে এখানে কী উদ্দেশ্য- এ বিষয়ে ইমাম নববী রাহ.-এর ভাষ্য হল, দীর্ঘ কুনূত মানে দীর্ঘ কিয়াম। দীর্ঘ সময় ধরে নামাযে দাঁড়িয়ে থাকা। আর দাঁড়িয়ে থাকা মানেই কুরআন তিলাওয়াত চালিয়ে যাওয়া।

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহর নির্দেশ-

یٰۤاَیُّهَا الْمُزَّمِّلُ، قُمِ الَّیْلَ اِلَّا قَلِیْلًا، نِّصْفَهٗۤ اَوِ انْقُصْ مِنْهُ قَلِیْلًا، اَوْ زِدْ عَلَیْهِ وَ رَتِّلِ الْقُرْاٰنَ تَرْتِیْلًا.

হে কম্বলাবৃত! রাতে (নামাযে) দাঁড়িয়ে থাকো, কিছু অংশ ব্যতীত। অর্ধরাত কিংবা তার চেয়ে কিছু কম। অথবা তার চেয়ে কিছু বেশি। আর কুরআন তিলাওয়াত করো ধীরে ধীরে ও সুস্পষ্টভাবে। -সূরা মুযযাম্মিল (৭৩) : ১-৪

এ আদেশের বাস্তবায়ন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে কীভাবে ঘটেছিল, এর একটি নমুনা আমরা লক্ষ করি হযরত মুগীরা ইবনে শু‘বা রা.-এর এ হাদীসে-

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নামাযে দাঁড়াতেন, তখন (দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকার কারণে) তাঁর পা ফুলে যেত। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, আল্লাহ তো আপনার আগের-পরের সবকিছু ক্ষমা করে দিয়েছেন! (এরপরও কেন আপনি এত কষ্ট করছেন?) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন-

أَفَلاَ أَكُونُ عَبْدًا شَكُورًا.

আমি কি তবে (আল্লাহ তাআলার) একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হব না! -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮৩৬

আরেকটি উদাহরণ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন রাতে নফল নামাযে দাঁড়ালেন। সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. তাঁর সঙ্গে নামাযে শরীক হলেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায এতটাই দীর্ঘ করছিলেন, যার সঙ্গে পেরে না উঠে হযরত ইবনে মাসউদ রা. নামায ছেড়ে দিতে চাইলেন। তার বক্তব্য এমন-

صَلّيْتُ مَعَ النّبِيِّ صلى الله عليه وسلم لَيْلَةً فَلَمْ يَزَلْ قَائِمًا حَتّى هَمَمْتُ بِأَمْرِ سَوْءٍ.

আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে এক রাতে নামায পড়ছিলাম। তিনি এত দীর্ঘ সময় নামাযে দাঁড়িয়ে ছিলেন, একপর্যায়ে আমি এক মন্দ চিন্তা করতে লাগলাম।

উপস্থিত ব্যক্তিরা জিজ্ঞেস করলেন : আপনি কী চিন্তা করেছিলেন? তিনি উত্তর দিলেন-

هَمَمْتُ أَنْ أَقْعُدَ وَأَذَرَ النّبِيّ صلىالله عليه وسلم .

আমি চাইছিলাম, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে এ নামায ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ি! -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৩৫

হযরত ইবনে মাসউদ রা. সম্পর্কে যারা জানেন, তারা জানেন- নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের প্রতি তিনি কতটা যত্নবান ছিলেন! নবী-পরিবারের সদস্য না হয়েও তিনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে যতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন, তা সাহাবায়ে কেরামের কাফেলার মধ্যেও বিরল। স্বাভাবিক কথা, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাতের নামাযের দীর্ঘতা সম্পর্কেও জেনে থাকবেন। কিন্তু সে ইবনে মাসউদ রা.-ই যখন নামায ছেড়ে দিতে চাইলেন, এতে সহজেই অনুমেয়- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সে রাতের নামায কতটা দীর্ঘ হয়েছিল!

আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা.-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাতের নফল নামায সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেছিলেন-

يُصَلِّي أَرْبَعًا فَلاَ تَسَأَلْ عَنْ حُسْنِهِنّ وَطُولِهِنّ ثُمّ يُصَلِّي أَرْبَعًا فَلاَ تَسَأَلْ عَنْ حُسْنِهِنّ وَطُولِهِنّ ثُمّ يُصَلِّي ثَلاَثًا.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে প্রথমে (দুই রাকাত করে) চার রাকাত নামায পড়তেন। এগুলোর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতার কথা তুমি জিজ্ঞেস করো না। এরপর আবার (দুই রাকাত করে) চার রাকাত পড়তেন। তুমি এগুলোর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতার কথাও জানতে চেয়ো না। এরপর তিন রাকাত (বিতির) পড়তেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৪৭

হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরের মানুষ। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এসব আমল তিনি নিয়মিত দেখে অভ্যস্ত। অথচ সেই আমলের কথা যখন তিনি বর্ণনা করেছেন, কতটা বিস্ময় তার কথায় ঝরে পড়ছে, ভাবা যায়- ‘সে রাকাতগুলোর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা তুমি জানতে চেয়ো না!’

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইসলামের দাওয়াত নিয়ে এলেন তখন আহলে কিতাব, যারা পূর্ববর্তী কোনো আসমানী কিতাবের অনুসারী, এককথায় ইহুদী-খ্রিস্টান, তাদের কেউ কেউ সে দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করল, কেউ আবার মনেপ্রাণে গ্রহণ করল সে দাওয়াত। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের কথাই শুধু নয়, তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ছিল তাদের কিতাবে। যাদের মধ্যে সত্যসন্ধানী মানসিকতা ছিল, তারা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসেবে স্বীকার করল। এ শ্রেণির একটি পরিচয় মহান রাব্বুল আলামীন এভাবে দিয়েছেন-

مِنْ اَهْلِ الْكِتٰبِ اُمَّةٌ قَآىِٕمَةٌ یَّتْلُوْنَ اٰیٰتِ اللهِ اٰنَآءَ الَّیْلِ وَ هُمْ یَسْجُدُوْنَ.

কিতাবীদের একটি দল এমন, যারা রাতের বিভিন্ন প্রহরে নামাযে দাঁড়িয়ে থেকে আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১১৩

দীর্ঘ সময় নিয়ে নামায পড়া, নামাযে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুরআন তিলাওয়াতে ডুবে থাকা- নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ তালীম গ্রহণ করেছেন সাহাবায়ে কেরাম। পরবর্তী কালেও এ ধারাবাহিকতা বন্ধ হয়নি কখনো। যুগে যুগেই নেককার বুযুর্গ ব্যক্তিগণের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- রাতের বেলা লম্বা সময় তারা নামায পড়তেন। ইমাম তিরমিযী রাহ. হযরত উসমান ইবনে আফফান রা. সাঈদ ইবনে জুবায়ের রাহ. সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন- তারা এক রাকাতে পুরো কুরআন খতম করতেন। (দ্র. জামে তিরমিযী, ২৯৪৬ নং হাদীসের আলোচনা)

তবে লক্ষণীয় বিষয় হল, হাদীসে যে দীর্ঘ সময় ধরে নামাযে দাঁড়িয়ে থাকাকে সর্বোত্তম নামায বলা হয়েছে, এর অর্থ এই নয়- কেবল নামাযের কিয়ামটুকুই দীর্ঘ হবে, আর রুকু-সিজদা ইত্যাদি সংক্ষিপ্ত হবে; বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল ছিল এমন- তিনি যখন দীর্ঘক্ষণ নামাযে তিলাওয়াত করতেন, রুকু-সিজদাগুলোও দীর্ঘ করতেন। এভাবে তিনি পুরো নামাযের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতেন। একবারের ঘটনা। রাতের বেলা সাহাবী হযরত হুযাইফা রা. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে নামায পড়ছিলেন। হুযাইফা রা. নিজে এ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন-

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরা বাকারা পড়তে শুরু করেছেন। আমি ভাবলাম, তিনি ১০০ আয়াত পড়ে রুকুতে যাবেন। ১০০ আয়াত শেষ করে তিনি আরও সামনে পড়তে লাগলেন। তখন ভাবলাম, তিনি হয়তো এক রাকাতেই সূরা বাকারা শেষ করবেন। সূরা বাকারা শেষ করার পর তিনি আরও পড়তে লাগলেন। এক সূরা। এরপর আরেক সূরা। তাঁর কুরআন তিলাওয়াত ছিল খুবই ধীরস্থির। তিলাওয়াতের মাঝে যখন তাসবীহ পাঠের কথা আসত, তিনি তাসবীহ পাঠ করতেন, যখন দুআ করার কোনো বিষয় আসত, তিনি দুআ করতেন, যখন কোনো কিছু থেকে আশ্রয় চাওয়ার প্রসঙ্গ আসত, তিনি তা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। এরপর সূরা বাকারা থেকে সূরা নিসা পর্যন্ত শেষ করার পর তিনি রুকুতে গেলেন। সেখানে রুকুর তাসবীহ পাঠ করলেন। তাঁর রুকুও ছিল তাঁর কিয়ামের প্রায় কাছাকাছি। এরপর দাঁড়ালেন। এবার দাঁড়ানো অবস্থায়ও রুকুর কাছাকাছি সময় কাটিয়ে দিলেন। এরপর সিজদায় গেলেন। সেখানে সিজদার তাসবীহ পাঠ করলেন। তাঁর সিজদাও ছিল দাঁড়িয়ে থাকার প্রায় কাছাকাছি সময় ধরে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৭২

এভাবে দীর্ঘ সময় নিয়ে কিয়াম, রুকু, কওমা, সিজদা আদায় করার ঘটনা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে এই একটিই নয়। হাদীসের কিতাবে এমন বর্ণনা প্রচুর রয়েছে। এসব ঘটনা থেকে এ ভারসাম্যই প্রমাণিত হয়- নামাযের কিয়াম যখন দীর্ঘায়িত হবে, রুকু-সিজদাও দীর্ঘ হবে।

উল্লেখ্য, এখানে শুরুতে যে হাদীস উল্লেখ করেছি, তাতে যেমন দীর্ঘায়িত নামাযের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, আবার কোনো কোনো হাদীসের মর্ম এমন- সিজদা যত বেশি তত ভালো।

হযরত সাওবান রা.। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আজাদকৃত গোলাম। তার এক শিষ্য মা‘দান রাহ. তাকে বললেন, আমাকে আল্লাহ তাআলার নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয় আমলের কথা বলে দিন। সাওবান রা. নীরব রইলেন। মা‘দান আবারও একই আবদার করলেন। সাওবান রা. এবারও নীরব। তিনি তৃতীয়বারের মতো একই আবদার করলে সাওবান রা. বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন-

عَلَيْكَ بِكَثْرَةِ السّجُودِ لِلهِ فَإِنّكَ لاَ تَسْجُدُ لِلهِ سَجْدَةً إِلاّ رَفَعَكَ اللهُ بِهَا دَرَجَةً وَحَطّ عَنْكَ بِهَا خَطِيئَةً.

তুমি অধিক পরিমাণে আল্লাহকে সিজদা করো। কেননা তুমি যখনই আল্লাহকে একটি সিজদা করবে, এর বিনিময়ে আল্লাহ তোমার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন এবং তোমার একটি পাপ মোচন করবেন।

মা‘দান বলেন, একই প্রশ্ন আমি আবুদ দারদা রা.-কেও করেছিলাম। তিনিও আমাকে একই উত্তর দিয়েছেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৮৮

এ তো বলাবাহুল্য- সিজদার আধিক্যের জন্যে প্রয়োজন অধিক সংখ্যক রাকাত। আর রাকাতসংখ্যা বেশি হলে নামায কিছুটা সংক্ষিপ্ত হবে- এ-ও স্বাভাবিক। এ থেকে বোঝা যায়, রাকাতসংখ্যা কম হলেও দীর্ঘ কিয়াম দীর্ঘ সিজদাবিশিষ্ট নামায যেমন সেরা নামায, তেমনি কিয়াম-রুকু-সিজদা সংক্ষিপ্ত হলেও অধিক রাকাত নামায আর অধিক সিজদার পদ্ধতিটিও হাদীস শরীফে স্বীকৃত। অধিক রাকাতের আরও কয়েকটি হাদীস লক্ষ করুন-

হযরত উবাদা ইবনে সামিত রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَا مِنْ عَبْدٍ يَسْجُدُ لِلهِ سَجْدَةً إِلّا كَتَبَ اللهُ لَهُ بِهَا حَسَنَةً، وَمَحَا عَنْهُ بِهَا سَيِّئَةً، وَرَفَعَ لَهُ بِهَا دَرَجَةً، فَاسْتَكْثِرُوا مِنْ السّجُودِ.

কোনো বান্দা যখনই আল্লাহকে একটি সিজদা করে, আল্লাহ এর বিনিময়ে তার জন্যে একটি নেকি লিখে দেন, তার একটি পাপ মিটিয়ে দেন এবং তার এক স্তর মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। তাই তোমরা বেশি পরিমাণে সিজদা করো। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৪২৪

মুসনাদে আহমাদের আরেকটি বর্ণনা অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী। রবীআ আসলামী রা. নামের এক সাহাবী। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমত করতেন। রাতে এশার নামাযের পর যখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে চলে যেতেন, তখনও তিনি প্রায় বসে থাকতেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরজার বাইরে। যদি কোনো প্রয়োজনে তিনি আবার বেরিয়ে আসেন- এ অপেক্ষায়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে তিনি নিজেকে এভাবেই বিলিয়ে দিয়েছিলেন। এমন খেদমতের ফলে একদিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, রবীআ, তুমি আমার কাছে কিছু চাও, আমি তোমাকে দেব। রবীআ বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি একটু চিন্তা করে নিই। এরপর আপনাকে জানাব।’ তার ভাষ্য হল- এরপর আমি নিজে নিজে অনেক ভাবলাম। আমি দেখলাম, দুনিয়া শেষ হয়েই যাবে, এটা অস্থায়ী। আর এখানে আমার যে রিযিক আছে তা-ই আমার জন্যে যথেষ্ট এবং তা আমার কাছে চলেও আসবে। তাই আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আমার আখেরাতের জন্যে কিছু চাইব। কারণ তিনি তো আল্লাহ তাআলার নিকট বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। এরপর আমি যখন তাঁর কাছে গেলাম, তিনি বললেন, কী করলে, রবীআ! আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার কাছে আমার চাওয়া- আপনি আমার জন্যে আপনার প্রভুর কাছে সুপারিশ করে আমাকে জাহান্নাম থেকে বাঁচিয়ে দেবেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, একথা তোমাকে কে বলে দিয়েছে? আমি বললাম, না, আল্লাহর কসম, কেউ আমাকে বলে দেয়নি; বরং আপনি যখন আমাকে কিছু চাওয়ার কথা বলেছেন, আর আপনি তো আল্লাহর নিকট অনেক মর্যাদাশীল, তখন আমি নিজে নিজেই ভাবলাম; আমি দেখলাম, দুনিয়া অস্থায়ী, তা শেষ হয়ে যাবে। এখানে আমার যে রিযিক তা আমার কাছে আসবেই। তখনই আমি মনে মনে বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আমি আমার আখেরাতের জন্যে কিছু চাইব। একথা শুনে তিনি দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইলেন। এরপর বললেন-

إِنِّي فَاعِلٌ فَأَعِنِّي عَلَى نَفْسِكَ بِكَثْرَةِ السّجُودِ.

ঠিক আছে, আমি অবশ্যই তা করব। তবে তুমি আমাকে তোমার নিজের বিষয়ে অধিক সংখ্যক সিজদা দিয়ে সহযোগিতা করো। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬৫৭৯

উপরে এক হাদীসে সেরা নামাযের পরিচয়ে যে দীর্ঘ ‘কুনূতে’র কথা বলা হয়েছে, এর ব্যাখ্যায় হাদীসবিশারদগণ কেউ কেউ আবার নামাযের খুশু-খুযু অর্থাৎ বিনয় ও একাগ্রতার কথাও বলেছেন। একে আমরা সেরা নামাযের তৃতীয় ব্যাখ্যাও বলতে পারি। আবার উপরোক্ত দুই ব্যাখ্যার পরিপূরকও বলতে পারি। অর্থাৎ খুশু-খুযু যদি থাকে, তবে সে নামায সেরা হবেই- তা কমসংখ্যক রাকাতে দীর্ঘ নামায হোক, সংক্ষিপ্ত কিয়াম-রুকু-সিজদায় অধিকসংখ্যক রাকাত নামায হোক। পবিত্র কুরআনে কারীমে বলা হয়েছে-

قَدْ اَفْلَحَ الْمُؤْمِنُوْنَ، الَّذِیْنَ هُمْ فِیْ صَلَاتِهِمْ خٰشِعُوْنَ.

নিশ্চয়ই সফলতা অর্জন করেছে মুমিনগণ; যারা তাদের নামাযে বিনয়ী। -সূরা মুমিনূন (২৩) : ১-২

এ ব্যাখ্যা ফরয-নফল সব নামাযের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। নামাযে যদি বিনয় ও একাগ্রতা না থাকে, তবে সে নামায পড়ে কেউ হয়তো দায়িত্বমুক্ত হতে পারবে, কিন্তু নামাযের পরিপূর্ণ বরকত ও ফযীলত তার হাসিল হবে না। এমনকি যারা নামাযে থাকে অস্থিরচিত্ত, দ্রুততার সাথে রুকু-সিজদা আদায় করে, তাদের জন্যে হাদীস শরীফে উচ্চারিত হয়েছে কঠোর সতর্কবাণী। হযরত আবু আবদিল্লাহ আশআরী রাযিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

مَثَلُ الّذِي لا يُتِمّ رُكُوعَهُ ويَنْقُرُ فِي سُجُودِهِ، مَثَلُ الْجَائِعِ يَأْكُلُ التّمْرَةَ وَالتّمْرَتينِ لا يُغْنِيَانِ عَنْهُ شَيْئًا.

قال الهيثمي في مجمع الزوائد : رَوَاهُ الطّبَرَانِيّ فِي الْكَبِيرِ وَأَبُو يَعْلَى، وَإِسْنَادُهُ حَسَنٌ.

যে ব্যক্তি (নামায পড়ে ঠিকই, কিন্তু) রুকু ঠিকমত আদায় করে না এবং সিজদায় যেন ঠোকর দিয়ে উঠে যায়, তার দৃষ্টান্ত ঐ ক্ষুধার্ত ব্যক্তির ন্যায়, যে এক-দুইটি খেজুর খেয়ে উঠে গেল অথচ এই দুটো খেজুর তার কোনো কাজে আসবে না। -আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৩৭৪৮; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ২৭২৮
.
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
সুনানে আবু দাউদ - হাদীস নং ১৩২৪ | মুসলিম বাংলা