কিতাবুস সুনান - ইমাম আবু দাউদ রহঃ

২. নামাযের অধ্যায়

হাদীস নং: ৯৪১
আন্তর্জাতিক নং: ৯৪১
১৭৯. নামাযের মধ্যে হাতে তালি দেওয়া।
৯৪১. আমর ইবনে আওন (রাহঃ) .... সাহল ইবনে সা’দ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, বনু আমর ইবনে আউফ গোত্রের মধ্যে সংঘর্ষের খবর নবী করীম (ﷺ) এর নিকট পৌঁছানোর পর তিনি যোহরের নামায আদায় করে তাদের মধ্যে সন্ধি প্রতিষ্ঠার জন্য গমন করেন এবং বিলাল (রাযিঃ)-কে বলেন, আমি যদি আসরে সময় ফিরে আসতে না পারি, তবে আবু বকর (রাযিঃ)-কে নামায পড়াতে বলবে। অতঃপর আসরের নামাযের সময় হলে বিলাল (রাযিঃ) আযান ও ইকামত দেয়ার পর আবু বকর (রাযিঃ)-কে ইমামতি করার অনুরোধ করেন। আবু বকর (রাযিঃ) ইমামতির স্থানে দণ্ডায়মান হয়ে নামায শুরু করেন।

রাবী হাদীসের শেষাংশে মহানবী (ﷺ) এর কথাও বর্ণনা করেছেন যে, যখন তোমরা নামাযে ইমামের কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখতে পাও তখন পুরুষেরা “সুবহানাল্লাহ” এবং স্ত্রীলোকেরা “হাতে তালি দিয়ে” শব্দ করবে।
باب التَّصْفِيقِ فِي الصَّلاَةِ
حَدَّثَنَا عَمْرُو بْنُ عَوْنٍ، أَخْبَرَنَا حَمَّادُ بْنُ زَيْدٍ، عَنْ أَبِي حَازِمٍ، عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ، قَالَ كَانَ قِتَالٌ بَيْنَ بَنِي عَمْرِو بْنِ عَوْفٍ فَبَلَغَ ذَلِكَ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَأَتَاهُمْ لِيُصْلِحَ بَيْنَهُمْ بَعْدَ الظُّهْرِ فَقَالَ لِبِلاَلٍ " إِنْ حَضَرَتْ صَلاَةُ الْعَصْرِ وَلَمْ آتِكَ فَمُرْ أَبَا بَكْرٍ فَلْيُصَلِّ بِالنَّاسِ " . فَلَمَّا حَضَرَتِ الْعَصْرُ أَذَّنَ بِلاَلٌ ثُمَّ أَقَامَ ثُمَّ أَمَرَ أَبَا بَكْرٍ فَتَقَدَّمَ قَالَ فِي آخِرِهِ " إِذَا نَابَكُمْ شَىْءٌ فِي الصَّلاَةِ فَلْيُسَبِّحِ الرِّجَالُ وَلْيُصَفِّحِ النِّسَاءُ " .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে গোত্রের বিবাদ মীমাংসার জন্য গিয়েছিলেন তার নাম বনূ আমর ইবন আওফ। এ গোত্রটি বিখ্যাত আওস গোত্রের একটি শাখা। আওস মদীনা মুনাউওয়ারার আনসারদের প্রধান দুই গোত্রের একটি। অপর গোত্রের নাম খাযরাজ। যাহোক আওস গোত্রের লোকজন কুবা অঞ্চলে বাস করত। বিবাদটি সেখানেই দেখা দিয়েছিল। এক বর্ণনায় আছে أن أهل قباء اقتتلوا حتى تراموا بالحجارة، فأخبر رسول الله صلى الله عليه وسلم بذلك، فقال: اذهبوا بنا نصلح بينهم ‘কুবাবাসী পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এমনকি তাদের মধ্যে পাথর ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু হয়ে যায়। এ সংবাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানানো হলে তিনি বললেন, চল আমরা গিয়ে তাদের মধ্যে মীমাংসা করি।
তাদের মধ্যে এ কলহ হয়েছিল দুপুরবেলা। তাবারানী রহ.-এর এক বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, এ সংবাদ যখন আসে তখন হযরত বিলাল রাযি. যোহরের আযান দিয়ে ফেলেছেন। ইমাম বুখারী রহ.-এর এক বর্ণনায় উল্লেখ আছে, তিনি সেখানে গিয়েছিলেন যোহরের নামায আদায় করার পর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত উবাই ইবন কা'ব রাযি. সুহায়ল ইবন বাইদা রাযি. প্রমুখ সাহাবীকে নিয়ে সেখানে ছুটে গেলেন। স্বাভাবিকভাবেই দুই পক্ষের মধ্যে আপস-নিষ্পত্তি করতে সময় লেগে যায়। ততক্ষণে আসরের নামাযের ওয়াক্ত হয়ে যায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে যাওয়ার সময় হযরত বিলাল রাযি. কে বলে গিয়েছিলেন, যদি আসরের ওয়াক্ত এসে যায় আর ততক্ষণে আমি ফিরে না আসি, তবে আবূ বকরকে নামাযের ইমামত করতে বলো। সুতরাং আসরের ওয়াক্ত হয়ে গেলে হযরত বিলাল রাযি আযান দিলেন, তারপর ইকামতও দিলেন এবং আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে ইমামত করতে বললেন। তিনি সামনে গিয়ে নামায শুরু করে দিলেন।

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর শ্রেষ্ঠত্ব

লক্ষ্যণীয় যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইমামতীর জন্য আর কারও নাম না বলে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. এরই নাম বলেছেন। এটা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণ করে যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবীগণ হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে অন্য সকলের উপর অগ্রগণ্য মনে করতেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো তাঁর ওফাতপূর্ব নামাযসমূহে যথারীতি তাঁকেই ইমাম বানিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য এ অগ্রগণ্যতাই ছিল। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর অবিসংবাদিতভাবে তাঁর ইমামত ও খেলাফতের পদে বরিত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ।

পুরুষদের জন্য তাসবীহ ও মহিলাদের জন্য হাতে তালি বাজানোর নির্দেশ এবং এর তাৎপর্য
নামায শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযের ভেতর পুরুষদেরকে হাততালি দিতে নিষেধ করে দিলেন। তিনি ইরশাদ করলেন التصفيق للنساء من نابه شيء في صلاته فليقل سبحان الله (হাততালি দেওয়ার কাজটি তো মহিলাদের জন্য। কারও যদি নামাযের মধ্যে কিছু ঘটে, তবে সে যেন সুবহানাল্লাহ বলে)। বস্তুত নামাযের পূর্ণাঙ্গ রূপ ও বিস্তারিত বিধি-নিষেধ একসঙ্গে নয়; বরং পর্যায়ক্রমে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। যখন তারা হাততালি দিয়েছিলেন, সম্ভবত তখনও পর্যন্ত এর প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়নি। এ-ই সর্বপ্রথম এটা নিষেধ করা হয়।
লক্ষ্যণীয়, হাততালি দেওয়ার নিষেধাজ্ঞা কেবল পুরুষদের জন্যই, নারীদের জন্য এটা জায়েয রাখা হয়েছে। বিষয়টা তাৎপর্যপূর্ণ। বস্তুত নামায হচ্ছে যিকর, তিলাওয়াত, দুআ, আল্লাহ অভিমুখিতা ও একান্তভাবে আল্লাহতে সমর্পিত থাকার সমষ্টি। হাতে তালি বাজানো এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই ভুলের প্রতি ইমামের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যও এটা সমীচীন নয়। এর জন্য এমন কোনও পন্থাই অবলম্বন করা উচিত, যা নামাযের কার্যাবলীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাসবীহ পড়া (সুবহানাল্লাহ বলা ) সেরকমই এক কাজ । সুতরাং ইমামের ভুল হলে মুসল্লীগণ সুবহানাল্লাহ বলবে, তাতেই ইমাম তার করণীয় বুঝে ফেলবে।
হাঁ, মহিলাদের জন্য হাতে তালি বাজানোর অবকাশ রাখা হয়েছে এজন্য যে, যদিও সুবহানাল্লাহ বলা উৎকৃষ্ট এক যিকর, কিন্তু মহিলাদের জন্য তা নিম্নস্বরে বলাই শ্রেয়। তাদের কন্ঠস্বরে আল্লাহ তাআলা বিশেষ আকর্ষণ রেখেছেন। এটা তাদের জন্য একটা নিআমত। কিন্তু সব নিআমতেরই সঙ্গত ব্যবহার কাম্য। অসঙ্গত ব্যবহার দ্বারা উৎকৃষ্ট নিআমতও ক্ষতির কারণ হয়ে যায়। তাই তাদের কণ্ঠস্বর দ্বারা যাতে পরপুরুষ প্রলুব্ধ না হয় সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি। ইমামের ভুল শোধরাতে গিয়ে তারা উচ্চস্বরে সুবহানাল্লাহ বলে উঠলে শয়তান সে স্বরকে তার বদমতলবে কাজে লাগাতে পারে। হয়তো কোনও পুরুষ-নামাযীর ধ্যান ভাঙিয়ে তার প্রতি মগ্ন করে দেবে। এটা অনেক বড় ক্ষতি। শয়তান যাতে সে ক্ষতি সাধন করতে না পারে, সে লক্ষ্যেই তাদেরকে তাসবীহ'র পরিবর্তে তালি বাজাতে বলা হয়েছে। এটা বড় ক্ষতি থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে ছোট ক্ষতি মেনে নেওয়ার পর্যায়ভুক্ত

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা যাচ্ছে মুসলিম ভ্রাতৃবর্গের পারস্পরিক দন্দ্ব-কলহ নিরসন করা এবং তাদের ঐক্য ও সংহতি রক্ষায় ভূমিকা রাখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

খ. এ হাদীছ দ্বারা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ হয়।

গ. নামাযে ইমামের ভুল হলে পুরুষ মুক্তাদীর কর্তব্য সুবহানাল্লাহ বলে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা। মহিলা মুসল্লি সুবহানাল্লাহ না বলে হাতে তালি বাজাবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান