আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ
৫৬- দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি ও হৃদয়গ্রাহী বিষয়াদির বর্ণনা
হাদীস নং: ৭২১৫
৮. মানুষের নিজের গোপন দোষ প্রকাশ করা নিষেধ
৭২১৫। যুহাইর ইবনে হারব, মুহাম্মাদ ইবনে হাতিম ও আব্দ ইবনে হুমায়দ (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে বলতে শুনেছি যে, নিজের অপরাধ প্রকাশকারী ব্যতিত আমার উম্মতের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। নিজদের অপরাধ প্রকাশ করার মানে হচ্ছে এই যে, মানুষ রাতে কোন অপরাধ জনিত কাজ করে, অতঃপর সকাল হয় আর তাঁর প্রতিপালক উহা গোপন করে রাখেন। অথচ সে নিজেই বলে, হে অমুক! গতরাতে আমি এই কাজটি করেছি। অথচ রাত্রে তাঁর প্রতিপালক উহাকে গোপন রেখেছেন এবং অবিরত তাঁর প্রতিপালক তা গোপন রাখছিলেন আর সে রাত যাপন করছিল। কিন্তু সকালে সে তাঁর প্রতিপালকের গোপন রাখা বিষয়টিকে প্রকাশ করে দিল। রাবী যুহাইর (রাহঃ) لإِجْهَارِ এর স্থলে الْهِجَارِ শব্দটি উল্লেখ করেছেন।
باب النَّهْىِ عَنْ هَتْكِ الإِنْسَانِ، سِتْرَ نَفْسِهِ
حَدَّثَنِي زُهَيْرُ بْنُ حَرْبٍ، وَمُحَمَّدُ بْنُ حَاتِمٍ، وَعَبْدُ بْنُ حُمَيْدٍ، قَالَ عَبْدٌ حَدَّثَنِي وَقَالَ، الآخَرَانِ حَدَّثَنَا يَعْقُوبُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، حَدَّثَنَا ابْنُ أَخِي ابْنِ شِهَابٍ، عَنْ عَمِّهِ، قَالَ قَالَ سَالِمٌ سَمِعْتُ أَبَا هُرَيْرَةَ، يَقُولُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ " كُلُّ أُمَّتِي مُعَافَاةٌ إِلاَّ الْمُجَاهِرِينَ وَإِنَّ مِنَ الإِجْهَارِ أَنْ يَعْمَلَ الْعَبْدُ بِاللَّيْلِ عَمَلاً ثُمَّ يُصْبِحُ قَدْ سَتَرَهُ رَبُّهُ فَيَقُولُ يَا فُلاَنُ قَدْ عَمِلْتُ الْبَارِحَةَ كَذَا وَكَذَا وَقَدْ بَاتَ يَسْتُرُهُ رَبُّهُ فَيَبِيتُ يَسْتُرُهُ رَبُّهُ وَيُصْبِحُ يَكْشِفُ سِتْرَ اللَّهِ عَنْهُ " . قَالَ زُهَيْرٌ " وَإِنَّ مِنَ الْهِجَارِ " .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রকাশ্যে গুনাহ করার ভয়াবহতার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। সে সতর্কবাণীর অন্তর্ভুক্ত এমন লোকও, যে গোপনে গুনাহ করার পর তা মানুষের সামনে প্রকাশ করে। তিনি ইরশাদ করেছেন- كل امتى معافى الا المجاهرين (আমার উম্মতের প্রত্যেকেই ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে, কিন্তু প্রকাশ্যে গুনাহকারীগণ নয়)। معافى শব্দটি العافية থেকে। العافية অর্থ মুক্তি ও নিরাপত্তা। কাজেই معافى অর্থ হবে, যাকে তার কৃত গুনাহর দায় থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে বা যাকে ক্ষমা করা হয়েছে, ফলে তার কৃত গুনাহের জন্য তাকে পাকড়াও করা হবে না ও শাস্তি দেওয়া হবে না। অর্থাৎ তার মধ্যে যেহেতু এতটুকু লজ্জাবোধ আছে যে, আল্লাহর নাফরমানি করা এমনিতেই খারাপ, যাতে লিপ্ত হওয়া কোনও মুমিন বান্দার উচিত নয়, লোকজনকে সাক্ষী রেখে আমি তাতে কিভাবে প্রকাশ্যে লিপ্ত হতে পারি, সে তো চরম ধৃষ্টতা- এই ভাবনায় সে তাতে প্রকাশ্যে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকে, তাই আল্লাহ তাআলাও তার সঙ্গে অনুরূপ আচরণ করেন। সে নিজে প্রকাশ্যে তা না করায় আল্লাহ তাআলাও তা প্রকাশ করেন না। আর আল্লাহ তাআলা যখন তা দুনিয়ায় প্রকাশ করেন না, তখন আখেরাতেও তা সর্বসম্মুখে প্রকাশ করে তাকে লাঞ্ছিত করবেন না। তার ঈমান ও নেক আমলসমূহের বদৌলতে ডান হাতে আমলনামা দিয়ে তাকে জান্নাতে যেতে দেবেন।
এর দ্বারা গোপনে গুনাহ করতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে না। গুনাহ তো গুনাহই। তা গোপনে করাও অবশ্যই দোষ। উদ্দেশ্য কেবল প্রকাশ্যে গুনাহ করার মত ধৃষ্টতায় লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে সাবধান করা। আর যে ব্যক্তি সাবধান থাকে, তার মধ্যে ওই ধৃষ্টতাটুকু না থাকার কারণে এ আশাবাদ ব্যক্ত করা যে, তার তাওবা নসীব হবে, ফলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন। কিংবা ধৃষ্ট ও নির্লজ্জ না হওয়ার কারণে আল্লাহ তাআলার বিশেষ রহমতে সে ক্ষমা লাভ করবে।
অথবা এর অর্থ হবে, আল্লাহ তাআলা যাকে নিরাপত্তা দিয়েছেন। অর্থাৎ তার গুনাহর জন্য পেছনে তার বদনাম ও তার গীবত করা যাবে না। যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে গুনাহ করে, তার এ নিরাপত্তা নেই। তার গুনাহর কথা তার পেছনে বললে তা নিষিদ্ধ গীবতের অন্তর্ভুক্ত হয় না। ইমাম নববী রহ. বলেন, যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে গুনাহে লিপ্ত হয় বা প্রকাশ্যে বিদআতী কাজ করে, তার সেই গুনাহ ও বিদআতে লিপ্ত হওয়ার কথা তার পেছনে বলা জায়েয। তবে তার অন্যান্য অপরাধ, যা সে প্রকাশ্যে করে না, তা তার পেছনে বলা যাবে না।
একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর
المجاهرين শব্দটির উৎপত্তি المجاهرة থেকে। প্রশ্ন হতে পারে, এ পরিমাপের শব্দ সাধারণত দ্বিপাক্ষিক কাজ বোঝানোর অর্থে ব্যবহৃত হয়, সে হিসেবে এর অর্থ হয় দুই পক্ষ থেকে প্রকাশ করা, কিন্তু গুনাহকারী প্রকাশ্যে গুনাহ করলে তা প্রকাশ করার বিষয়টি তো কেবল তার পক্ষ থেকেই হয়, বাকিরা তো দর্শকমাত্র, সে হিসেবে তার ক্ষেত্রে এ শব্দ পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ হয় কি?
কেউ কেউ এর উত্তর এভাবে দিয়েছেন যে, এস্থলে দুই পক্ষ থেকে প্রকাশ করার অর্থ বোঝানো উদ্দেশ্য নয়। এ পরিমাপের শব্দ কখনও কখনও একপাক্ষিক অর্থও দিয়ে থাকে। এস্থলেও তাই হয়েছে। অর্থাৎ গুনাহটির প্রকাশকারী কেবল সেই ব্যক্তিই, যে তা প্রকাশ্যে করে।
তবে কারও কারও মতে, এস্থলে দ্বিপাক্ষিক অর্থও নেওয়া যেতে পারে। যারা প্রকাশ্যে গুনাহকারীর গুনাহ দেখতে পায়, তারা যদি প্রকাশ্যে এ নিয়ে আলোচনায় রত হয় এবং তাদের সে আলোচনা দ্বারা তার প্রতি সমর্থন বোঝা যায়, তবে তারাও সে গুনাহের প্রকাশে অংশীদার হল। এভাবে গুনাহের কর্তা ও দর্শক উভয়পক্ষ থেকে সেটির প্রকাশ ঘটল।
আমরা এটাও বলতে পারি যে, যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে গুনাহে লিপ্ত হয়, তাকে তার গুনাহের কাজে বাধা না দেওয়ার দ্বারা গুনাহের কাজে তাকে একরকম সহযোগিতা করা হয়। সে হিসেবে গুনাহকারী নিজে এবং নীরব দর্শক উভয়ের পক্ষ থেকেই যেন প্রকাশ্যে গুনাহ করার কাজটি ঘটছে। এদিকে লক্ষ করলে নীরব দর্শকের সঙ্গেও শব্দটি সঙ্গতিপূর্ণ হয় বৈকি।
যাহোক প্রকাশ্যে গুনাহ করাটা একরকম ধৃষ্টতা। যে ব্যক্তি তা করে, সে যেন আল্লাহ তাআলার নিষেধাজ্ঞার কোনও তোয়াক্কাই করে না। তার মধ্যে কোনও লজ্জাবোধও নেই। সে এক তো গুনাহ করে আল্লাহর অবাধ্যতা করছে, সেইসঙ্গে তা প্রকাশ্যে করে নির্লজ্জতার পরিচয় দিচ্ছে আর এভাবে সে পরোক্ষে অন্যদেরকেও তাতে লিপ্ত হতে প্ররোচিত করছে। এক গুনাহের মধ্যে ত্রিমাত্রিক দোষ। তাই সতর্ক করা হয়েছে যে, সে ক্ষমা পাবে না এবং তার জন্য নিরাপত্তা নেই। তার সে গুনাহর কথা পেছনে বলা যাবে। যারা পেছনে তা বলবে, তাদের গুনাহ হবে না। আর সে বিনা তাওবায় মারা গেলে জাহান্নামের শাস্তিও ভোগ করতে হবে।
যেহেতু সে গুনাহ করেছে ধৃষ্টতার সাথে, প্রকাশ্যে লোকজনকে সাক্ষী রেখে, তাই তার তাওবা নসীব হওয়ার ব্যাপারেও আশঙ্কা আছে। অসম্ভব নয় যে, তাওবা ছাড়াই তার মৃত্যু ঘটবে, যদি না আল্লাহ তাআলার খাস রহমত তাকে শামিল করে নেয়।
কোনও গুনাহ গোপনে করার পর তা প্রকাশ করার কদর্যতা
প্রকাশ্যে গুনাহ করা যেমন ধৃষ্টতা, তেমনি কোনও গুনাহ গোপনে করার পর তা মানুষকে বলে বেড়ানোও ধৃষ্টতাই বটে। লজ্জাশীলতার অভাবে কেউ কেউ এরূপ করেও থাকে। তাই হাদীছের পরবর্তী বাক্যে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারেও সতর্ক করেছেন। তিনি ইরশাদ করেনঃ- وإن من المجاهرة أن يعمل الرجل بالليل عملا، ثم يصبح وقد ستره الله عليه، فيقول يا فلان، عملت البارحة كذا وكذا ‘এটাও প্রকাশ্য গুনাহের অন্তর্ভুক্ত যে, কোনও ব্যক্তি রাতের বেলা কোনও (পাপের) কাজ করে তারপর এ অবস্থায় তার ভোর হয় যে, আল্লাহ তাআলা তার কাজটি গোপন রাখেন, কিন্তু সে নিজেই বলে, হে অমুক! (শোন) আমি গতরাতে এই এই কাজ করেছি।'
এটা প্রকাশ্য গুনাহ হয় এ কারণে যে, সে যদিও কাজটি গোপনে করেছে, কিন্তু পরে যখন নিজেই লোকজনকে বলে বেড়াচ্ছে যে, আমি এই এই পাপ করেছি, তখন আর তা গোপন থাকল না, প্রকাশ হয়ে গেল। যেন সে পাপকর্মটি প্রকাশ্যেই করেছে। এ-ও একরকম ধৃষ্টতা। আল্লাহ তাআলা তার অপরাধটি পর্দার আড়ালে রেখেছিলেন। এটা তার প্রতি আল্লাহ তাআলার এক অনুগ্রহ ছিল যে, অপরাধ করা সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা তাকে পর্দার আড়ালে রেখেছিলেন। প্রকাশ করে দিয়ে সে সেই নি'আমতের অকৃতজ্ঞতা করল এবং আল্লাহর দেওয়া পর্দা ছিঁড়ে ফেলল। এ অকৃতজ্ঞতা ও ধৃষ্টতার কারণে আখেরাতে তো সে শাস্তি পাবেই, দুনিয়ায়ও এরূপ লোককে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হতে হয়। আর পাপকর্মটি যদি দুনিয়ার আদালতেও শাস্তিযোগ্য হয়, তবে প্রকাশ করার দ্বারা নিজের প্রতি সে শাস্তিও ত্বরান্বিত করল।
সুতরাং কারও দ্বারা কোনও পাপ ঘটে গেলে তার কর্তব্য অন্যকে তা না জানানো; বরং মনে মনে লজ্জিত-অনুতপ্ত হয়ে সে পাপকর্মটি ছেড়ে দেওয়া এবং পুনরায় তাতে লিপ্ত না হওয়ার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়া।
অবশ্য ইসলাহ ও আত্মসংশোধন এবং সে ব্যাপারে পরামর্শ ও নির্দেশনা গ্রহণের জন্য নিজ শায়খ ও মুরুব্বীর কাছে তা বলা যেতে পারে; বরং বলাই উচিত। এটা গুনাহ প্রকাশ করার নিষেধাজ্ঞার মধ্যে দাখিল হবে না; বরং সদুদ্দেশ্যে হওয়ার কারণে এটা একটা সৎকর্মরূপেই গণ্য হবে।
বস্তুত নিন্দনীয় হল সেই প্রকাশ, যা ধৃষ্টতা ও তাচ্ছিল্য প্রদর্শনের জন্য হয়।উদ্দেশ্য যদি থাকে জিজ্ঞাসার মাধ্যমে আত্মসংশোধন ও নিজেকে পাপের কলঙ্ক থেকে মুক্ত করার উপায় খোঁজা, তবে তা প্রশংসনীয় বৈকি।
সবশেষে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কারও গোপন গুনাহের পর তা প্রকাশ করাটা কতটা ধৃষ্টতামূলক সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেনঃ- وقد بات يستره ربه ويصبح يكشف ستر الله عنه (অথচ সে রাত যাপন করেছিল এ অবস্থায় যে, তার প্রতিপালক তার দোষ আড়ালে রেখেছিলেন। আর সে সকালবেলা আল্লাহর আড়াল উন্মোচন করে দেয়)। অর্থাৎ দোষ আড়াল রাখার আল্লাহপ্রদত্ত যে নিআমতের মধ্যে সে রাত কাটিয়েছিল, সে নিআমতের কদর তো করলই না, উপরন্তু আল্লাহর আড়াল ও পর্দা সে সরিয়ে দিল। পর্দা ছিঁড়ে ফেলে সে নিজ পাপের কথা ফাঁস করে দিল।
উচিত তো ছিল আল্লাহ যখন গোপন রেখেছেন তখন সেই সুযোগে লজ্জিত অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে তাওবা করা ও ক্ষমা প্রার্থনা করা। তা না করে সে উল্টো বাহাদুরী দেখাল যে, আমি এই এই নাফরমানি করেছি। এটা কঠিন হঠকারিতা। এটা আল্লাহর বিধানের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন। এটা নিজের প্রতিও তাচ্ছিল্য প্রদর্শন বটে। তার যদি আত্মমর্যাদাবোধ থাকত, নিজের কাছে নিজের কণামাত্রও মূল্য থাকত, তবে এভাবে পাপ-পঙ্কিলতার কথা প্রকাশ করে নিজেকে বেইজ্জত করত না। যার নিজের কাছে নিজের কোনও ইজ্জত নেই, আল্লাহর কাছেও সে ইজ্জত পেতে পারে না। তাই ঘোষণা করা হয়েছে- সবাইকে মাফ করা হলেও যারা নিজেদের পাপের কথা প্রকাশ করে দেয় তারা মাফ পাবে না। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এরকম আত্মাবমাননা থেকে হেফাজত করুন- আমীন।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন اجتنبوا هذه القاذورة التي نهى الله عنها، فمن ألم بشيء منها، فليستتر بستر الله 'আল্লাহ তাআলা যা নিষেধ করেছেন, সেই (পাপ) পঙ্কিলতা পরিহার কর। কেউ তাতে লিপ্ত হয়ে পড়লে সে যেন আল্লাহর পর্দায় নিজেকে আড়াল করে রাখে।[১]
আল্লাহর পর্দায় নিজেকে আড়াল করার অর্থ নিজের থেকে গুনাহের কথা প্রকাশ না করা। বান্দা যতক্ষণ সীমালঙ্ঘন না করে, ততক্ষণ আল্লাহ তাআলা তার দোষ গোপন রাখেন। তিনি সাত্তারুল উয়ুব বান্দার দোষত্রুটি গোপনকারী। তাঁর পক্ষ থেকে গোপন রাখাটাই তাঁর পর্দা। সুতরাং যে ব্যক্তি তাঁর সে পর্দার মর্যাদা রক্ষা করবে অর্থাৎ নিজের পক্ষ থেকে পাপ প্রকাশ করবে না, আল্লাহ তাআলাও তার প্রতি রহমতের আচরণ করবেন। তাঁর রহমত তাঁর ক্রোধের উপর প্রবল। তিনি দুনিয়ায় যার দোষ গোপন রাখবেন, আখেরাতে তাকে কিছুতেই লাঞ্ছিত করবেন না।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা বান্দার প্রতি আল্লাহর অসীম দয়ার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি নিজ দয়ায় সহজে বান্দার দোষ প্রকাশ করেন না। নিজ দয়ার পর্দা দিয়ে তা ঢেকে রাখেন। তাই বান্দারও কর্তব্য নিজের থেকে তা প্রকাশ না করা।
খ. কিছুতেই যাতে গুনাহ না হয়ে যায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত। তারপরও যে গুনাহ গোপনে হয়ে যায়, সে ব্যাপারে ক্ষমার বেশি আশা থাকে।
গ. প্রকাশ্যে গুনাহ করা বা গোপনে গুনাহ করার পর নিজের পক্ষ থেকে তা প্রকাশ করা একরকম ধৃষ্টতা, আল্লাহর পর্দার প্রতি অশ্রদ্ধা ও একরকম নির্লজ্জতার বহিঃপ্রকাশ। এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিত। কেননা এ হাদীছে তাকে ক্ষমা না করার সতর্কবাণী শোনানো হয়েছে।
[১] মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ১৩৩৪২; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার, হাদীছ নং ৯১; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৭৬০১; আস্ সুনানুস্ সগীর, হাদীছ নং ২৭২৯; ফাতহুল বারী, ১০ খণ্ড, ৫৯৮ পৃষ্ঠা (হাকিম, আল-মুস্তাদরাক-এর বরাতে)
এর দ্বারা গোপনে গুনাহ করতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে না। গুনাহ তো গুনাহই। তা গোপনে করাও অবশ্যই দোষ। উদ্দেশ্য কেবল প্রকাশ্যে গুনাহ করার মত ধৃষ্টতায় লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে সাবধান করা। আর যে ব্যক্তি সাবধান থাকে, তার মধ্যে ওই ধৃষ্টতাটুকু না থাকার কারণে এ আশাবাদ ব্যক্ত করা যে, তার তাওবা নসীব হবে, ফলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন। কিংবা ধৃষ্ট ও নির্লজ্জ না হওয়ার কারণে আল্লাহ তাআলার বিশেষ রহমতে সে ক্ষমা লাভ করবে।
অথবা এর অর্থ হবে, আল্লাহ তাআলা যাকে নিরাপত্তা দিয়েছেন। অর্থাৎ তার গুনাহর জন্য পেছনে তার বদনাম ও তার গীবত করা যাবে না। যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে গুনাহ করে, তার এ নিরাপত্তা নেই। তার গুনাহর কথা তার পেছনে বললে তা নিষিদ্ধ গীবতের অন্তর্ভুক্ত হয় না। ইমাম নববী রহ. বলেন, যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে গুনাহে লিপ্ত হয় বা প্রকাশ্যে বিদআতী কাজ করে, তার সেই গুনাহ ও বিদআতে লিপ্ত হওয়ার কথা তার পেছনে বলা জায়েয। তবে তার অন্যান্য অপরাধ, যা সে প্রকাশ্যে করে না, তা তার পেছনে বলা যাবে না।
একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর
المجاهرين শব্দটির উৎপত্তি المجاهرة থেকে। প্রশ্ন হতে পারে, এ পরিমাপের শব্দ সাধারণত দ্বিপাক্ষিক কাজ বোঝানোর অর্থে ব্যবহৃত হয়, সে হিসেবে এর অর্থ হয় দুই পক্ষ থেকে প্রকাশ করা, কিন্তু গুনাহকারী প্রকাশ্যে গুনাহ করলে তা প্রকাশ করার বিষয়টি তো কেবল তার পক্ষ থেকেই হয়, বাকিরা তো দর্শকমাত্র, সে হিসেবে তার ক্ষেত্রে এ শব্দ পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ হয় কি?
কেউ কেউ এর উত্তর এভাবে দিয়েছেন যে, এস্থলে দুই পক্ষ থেকে প্রকাশ করার অর্থ বোঝানো উদ্দেশ্য নয়। এ পরিমাপের শব্দ কখনও কখনও একপাক্ষিক অর্থও দিয়ে থাকে। এস্থলেও তাই হয়েছে। অর্থাৎ গুনাহটির প্রকাশকারী কেবল সেই ব্যক্তিই, যে তা প্রকাশ্যে করে।
তবে কারও কারও মতে, এস্থলে দ্বিপাক্ষিক অর্থও নেওয়া যেতে পারে। যারা প্রকাশ্যে গুনাহকারীর গুনাহ দেখতে পায়, তারা যদি প্রকাশ্যে এ নিয়ে আলোচনায় রত হয় এবং তাদের সে আলোচনা দ্বারা তার প্রতি সমর্থন বোঝা যায়, তবে তারাও সে গুনাহের প্রকাশে অংশীদার হল। এভাবে গুনাহের কর্তা ও দর্শক উভয়পক্ষ থেকে সেটির প্রকাশ ঘটল।
আমরা এটাও বলতে পারি যে, যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে গুনাহে লিপ্ত হয়, তাকে তার গুনাহের কাজে বাধা না দেওয়ার দ্বারা গুনাহের কাজে তাকে একরকম সহযোগিতা করা হয়। সে হিসেবে গুনাহকারী নিজে এবং নীরব দর্শক উভয়ের পক্ষ থেকেই যেন প্রকাশ্যে গুনাহ করার কাজটি ঘটছে। এদিকে লক্ষ করলে নীরব দর্শকের সঙ্গেও শব্দটি সঙ্গতিপূর্ণ হয় বৈকি।
যাহোক প্রকাশ্যে গুনাহ করাটা একরকম ধৃষ্টতা। যে ব্যক্তি তা করে, সে যেন আল্লাহ তাআলার নিষেধাজ্ঞার কোনও তোয়াক্কাই করে না। তার মধ্যে কোনও লজ্জাবোধও নেই। সে এক তো গুনাহ করে আল্লাহর অবাধ্যতা করছে, সেইসঙ্গে তা প্রকাশ্যে করে নির্লজ্জতার পরিচয় দিচ্ছে আর এভাবে সে পরোক্ষে অন্যদেরকেও তাতে লিপ্ত হতে প্ররোচিত করছে। এক গুনাহের মধ্যে ত্রিমাত্রিক দোষ। তাই সতর্ক করা হয়েছে যে, সে ক্ষমা পাবে না এবং তার জন্য নিরাপত্তা নেই। তার সে গুনাহর কথা পেছনে বলা যাবে। যারা পেছনে তা বলবে, তাদের গুনাহ হবে না। আর সে বিনা তাওবায় মারা গেলে জাহান্নামের শাস্তিও ভোগ করতে হবে।
যেহেতু সে গুনাহ করেছে ধৃষ্টতার সাথে, প্রকাশ্যে লোকজনকে সাক্ষী রেখে, তাই তার তাওবা নসীব হওয়ার ব্যাপারেও আশঙ্কা আছে। অসম্ভব নয় যে, তাওবা ছাড়াই তার মৃত্যু ঘটবে, যদি না আল্লাহ তাআলার খাস রহমত তাকে শামিল করে নেয়।
কোনও গুনাহ গোপনে করার পর তা প্রকাশ করার কদর্যতা
প্রকাশ্যে গুনাহ করা যেমন ধৃষ্টতা, তেমনি কোনও গুনাহ গোপনে করার পর তা মানুষকে বলে বেড়ানোও ধৃষ্টতাই বটে। লজ্জাশীলতার অভাবে কেউ কেউ এরূপ করেও থাকে। তাই হাদীছের পরবর্তী বাক্যে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারেও সতর্ক করেছেন। তিনি ইরশাদ করেনঃ- وإن من المجاهرة أن يعمل الرجل بالليل عملا، ثم يصبح وقد ستره الله عليه، فيقول يا فلان، عملت البارحة كذا وكذا ‘এটাও প্রকাশ্য গুনাহের অন্তর্ভুক্ত যে, কোনও ব্যক্তি রাতের বেলা কোনও (পাপের) কাজ করে তারপর এ অবস্থায় তার ভোর হয় যে, আল্লাহ তাআলা তার কাজটি গোপন রাখেন, কিন্তু সে নিজেই বলে, হে অমুক! (শোন) আমি গতরাতে এই এই কাজ করেছি।'
এটা প্রকাশ্য গুনাহ হয় এ কারণে যে, সে যদিও কাজটি গোপনে করেছে, কিন্তু পরে যখন নিজেই লোকজনকে বলে বেড়াচ্ছে যে, আমি এই এই পাপ করেছি, তখন আর তা গোপন থাকল না, প্রকাশ হয়ে গেল। যেন সে পাপকর্মটি প্রকাশ্যেই করেছে। এ-ও একরকম ধৃষ্টতা। আল্লাহ তাআলা তার অপরাধটি পর্দার আড়ালে রেখেছিলেন। এটা তার প্রতি আল্লাহ তাআলার এক অনুগ্রহ ছিল যে, অপরাধ করা সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা তাকে পর্দার আড়ালে রেখেছিলেন। প্রকাশ করে দিয়ে সে সেই নি'আমতের অকৃতজ্ঞতা করল এবং আল্লাহর দেওয়া পর্দা ছিঁড়ে ফেলল। এ অকৃতজ্ঞতা ও ধৃষ্টতার কারণে আখেরাতে তো সে শাস্তি পাবেই, দুনিয়ায়ও এরূপ লোককে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হতে হয়। আর পাপকর্মটি যদি দুনিয়ার আদালতেও শাস্তিযোগ্য হয়, তবে প্রকাশ করার দ্বারা নিজের প্রতি সে শাস্তিও ত্বরান্বিত করল।
সুতরাং কারও দ্বারা কোনও পাপ ঘটে গেলে তার কর্তব্য অন্যকে তা না জানানো; বরং মনে মনে লজ্জিত-অনুতপ্ত হয়ে সে পাপকর্মটি ছেড়ে দেওয়া এবং পুনরায় তাতে লিপ্ত না হওয়ার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়া।
অবশ্য ইসলাহ ও আত্মসংশোধন এবং সে ব্যাপারে পরামর্শ ও নির্দেশনা গ্রহণের জন্য নিজ শায়খ ও মুরুব্বীর কাছে তা বলা যেতে পারে; বরং বলাই উচিত। এটা গুনাহ প্রকাশ করার নিষেধাজ্ঞার মধ্যে দাখিল হবে না; বরং সদুদ্দেশ্যে হওয়ার কারণে এটা একটা সৎকর্মরূপেই গণ্য হবে।
বস্তুত নিন্দনীয় হল সেই প্রকাশ, যা ধৃষ্টতা ও তাচ্ছিল্য প্রদর্শনের জন্য হয়।উদ্দেশ্য যদি থাকে জিজ্ঞাসার মাধ্যমে আত্মসংশোধন ও নিজেকে পাপের কলঙ্ক থেকে মুক্ত করার উপায় খোঁজা, তবে তা প্রশংসনীয় বৈকি।
সবশেষে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কারও গোপন গুনাহের পর তা প্রকাশ করাটা কতটা ধৃষ্টতামূলক সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেনঃ- وقد بات يستره ربه ويصبح يكشف ستر الله عنه (অথচ সে রাত যাপন করেছিল এ অবস্থায় যে, তার প্রতিপালক তার দোষ আড়ালে রেখেছিলেন। আর সে সকালবেলা আল্লাহর আড়াল উন্মোচন করে দেয়)। অর্থাৎ দোষ আড়াল রাখার আল্লাহপ্রদত্ত যে নিআমতের মধ্যে সে রাত কাটিয়েছিল, সে নিআমতের কদর তো করলই না, উপরন্তু আল্লাহর আড়াল ও পর্দা সে সরিয়ে দিল। পর্দা ছিঁড়ে ফেলে সে নিজ পাপের কথা ফাঁস করে দিল।
উচিত তো ছিল আল্লাহ যখন গোপন রেখেছেন তখন সেই সুযোগে লজ্জিত অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে তাওবা করা ও ক্ষমা প্রার্থনা করা। তা না করে সে উল্টো বাহাদুরী দেখাল যে, আমি এই এই নাফরমানি করেছি। এটা কঠিন হঠকারিতা। এটা আল্লাহর বিধানের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন। এটা নিজের প্রতিও তাচ্ছিল্য প্রদর্শন বটে। তার যদি আত্মমর্যাদাবোধ থাকত, নিজের কাছে নিজের কণামাত্রও মূল্য থাকত, তবে এভাবে পাপ-পঙ্কিলতার কথা প্রকাশ করে নিজেকে বেইজ্জত করত না। যার নিজের কাছে নিজের কোনও ইজ্জত নেই, আল্লাহর কাছেও সে ইজ্জত পেতে পারে না। তাই ঘোষণা করা হয়েছে- সবাইকে মাফ করা হলেও যারা নিজেদের পাপের কথা প্রকাশ করে দেয় তারা মাফ পাবে না। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এরকম আত্মাবমাননা থেকে হেফাজত করুন- আমীন।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন اجتنبوا هذه القاذورة التي نهى الله عنها، فمن ألم بشيء منها، فليستتر بستر الله 'আল্লাহ তাআলা যা নিষেধ করেছেন, সেই (পাপ) পঙ্কিলতা পরিহার কর। কেউ তাতে লিপ্ত হয়ে পড়লে সে যেন আল্লাহর পর্দায় নিজেকে আড়াল করে রাখে।[১]
আল্লাহর পর্দায় নিজেকে আড়াল করার অর্থ নিজের থেকে গুনাহের কথা প্রকাশ না করা। বান্দা যতক্ষণ সীমালঙ্ঘন না করে, ততক্ষণ আল্লাহ তাআলা তার দোষ গোপন রাখেন। তিনি সাত্তারুল উয়ুব বান্দার দোষত্রুটি গোপনকারী। তাঁর পক্ষ থেকে গোপন রাখাটাই তাঁর পর্দা। সুতরাং যে ব্যক্তি তাঁর সে পর্দার মর্যাদা রক্ষা করবে অর্থাৎ নিজের পক্ষ থেকে পাপ প্রকাশ করবে না, আল্লাহ তাআলাও তার প্রতি রহমতের আচরণ করবেন। তাঁর রহমত তাঁর ক্রোধের উপর প্রবল। তিনি দুনিয়ায় যার দোষ গোপন রাখবেন, আখেরাতে তাকে কিছুতেই লাঞ্ছিত করবেন না।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা বান্দার প্রতি আল্লাহর অসীম দয়ার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি নিজ দয়ায় সহজে বান্দার দোষ প্রকাশ করেন না। নিজ দয়ার পর্দা দিয়ে তা ঢেকে রাখেন। তাই বান্দারও কর্তব্য নিজের থেকে তা প্রকাশ না করা।
খ. কিছুতেই যাতে গুনাহ না হয়ে যায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত। তারপরও যে গুনাহ গোপনে হয়ে যায়, সে ব্যাপারে ক্ষমার বেশি আশা থাকে।
গ. প্রকাশ্যে গুনাহ করা বা গোপনে গুনাহ করার পর নিজের পক্ষ থেকে তা প্রকাশ করা একরকম ধৃষ্টতা, আল্লাহর পর্দার প্রতি অশ্রদ্ধা ও একরকম নির্লজ্জতার বহিঃপ্রকাশ। এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিত। কেননা এ হাদীছে তাকে ক্ষমা না করার সতর্কবাণী শোনানো হয়েছে।
[১] মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ১৩৩৪২; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার, হাদীছ নং ৯১; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৭৬০১; আস্ সুনানুস্ সগীর, হাদীছ নং ২৭২৯; ফাতহুল বারী, ১০ খণ্ড, ৫৯৮ পৃষ্ঠা (হাকিম, আল-মুস্তাদরাক-এর বরাতে)
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
