আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ

৫৬- দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি ও হৃদয়গ্রাহী বিষয়াদির বর্ণনা

হাদীস নং: ৭১৮২
আন্তর্জাতিক নং: ২৯৭৩
শিরোনামবিহীন পরিচ্ছেদ
৭১৮২। আবু কুরায়ব মুহাম্মাদ ইবনে আলা ইবনে কুরায়ব (রাহঃ) ......... আয়িশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেছেন, তখন আমার পাত্রে সামান্য কিছু যব ব্যতীত কোন কলিজাধারী (প্রাণী) খেতে পারে এমন কিছুই আমার কাছে ছিল না। আমি তা থেকেই খেতাম। এভাবে অনেক দিন চলে গেলে আমি তা ওজন দিলাম। ফলে উহা শেষ হয়ে গেল।
حَدَّثَنَا أَبُو كُرَيْبٍ، مُحَمَّدُ بْنُ الْعَلاَءِ بْنِ كُرَيْبٍ حَدَّثَنَا أَبُو أُسَامَةَ، عَنْ هِشَامٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ تُوُفِّيَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَمَا فِي رَفِّي مِنْ شَىْءٍ يَأْكُلُهُ ذُو كَبِدٍ إِلاَّ شَطْرُ شَعِيرٍ فِي رَفٍّ لِي فَأَكَلْتُ مِنْهُ حَتَّى طَالَ عَلَىَّ فَكِلْتُهُ فَفَنِيَ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অর্থবিত্তের আসক্তি থেকে যে কতটা দূরে ছিলেন, এ হাদীছ দ্বারা তা আরও বেশি পরিস্ফুট হয়। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. ছিলেন তাঁর সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয় স্ত্রী। সবচে' বেশি ভালোবাসতেন তাঁকেই। সে হিসেবে পার্থিব সুযোগ-সুবিধা সবচে' বেশি তাঁরই পাওয়ার কথা। আল্লাহ তাআলা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সমগ্র দুনিয়ার রাজত্ব দিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি চাইলে স্ত্রীদের রাজকীয় আয়েশের ভেতর রাখতে পারতেন। অথচ অন্যসব সুবিধা দূরের কথা, সবচে' বেশি মৌলিক প্রয়োজন যে খাদ্য তাতেও কেমন কৃচ্ছ্রতার চর্চা তিনি চালু রেখেছিলেন! দুনিয়া থেকে চির বিদায়কালে আমাদের আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-কে পর্যন্ত এ অবস্থায় রেখে যান যে, তাঁর ঘরে সামান্য কিছু যব ছাড়া খাওয়ার মতো আর কিছু ছিল না।

এ কথা ঠিক যে, খায়বার যুদ্ধের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক স্ত্রীকে সারা বছরের খাদ্য একসঙ্গে দিয়ে দিতেন। কিন্তু সে খাদ্য যে বছরের শেষ পর্যন্ত থাকত এমন নয়। অতিথি আসলে তা থেকেই খাওয়ানো হতো। অন্য কোনও প্রয়োজন দেখা দিলেও তিনি তাদেরকে সেই খাবার থেকে দান করতে বলতেন। এভাবে দেখা যেত বছর শেষ হওয়ার আগেই সে খাবার শেষ হয়ে গেছে।

হাদীছটির পরের অংশে রয়েছে সেই সামান্য খাদ্যবস্তুতে বরকতের বর্ণনা। আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বলেন, আমি সেই যব থেকে খেতে থাকলাম। অনেক দিন খেলাম। কিন্তু তা ফুরাচ্ছিল না। সামান্য যব এতদিন খাওয়ার পরও শেষ হচ্ছে না! তাঁর কৌতূহল লাগল। কেন শেষ হচ্ছে না? তিনি বলেন فكلته ففني (পরিশেষে একদিন আমি তা মাপলাম, অমনি তা (দ্রুত) নিঃশেষ হয়ে গেল)। অর্থাৎ যতদিন মাপা হয়নি ততদিন তার বরকত চালু ছিল। মাপামাত্র বরকতের ধারা বন্ধ হয়ে গেল। ফলে সে যব দ্রুত শেষ হয়ে গেল। এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে, খাদ্যদ্রব্য মাপলে বরকত শেষ হয়ে যায়। কিন্তু অন্য বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায় মাপলেই বরকত হয়। যেমন এক হাদীছে আছে
كيلوا طعامكم يبارك لكم
তোমরা তোমাদের খাদ্যদ্রব্য মাপবে। তাহলে তোমাদের জন্য তাতে বরকত হবে।

বাহ্যত উভয় হাদীছের মধ্যে বিরোধ লক্ষ করা যায়। প্রকৃতপক্ষে কোনও বিরোধ নেই। কেননা মাপার হুকুম দেওয়া হয়েছে বেঁচাকেনার ক্ষেত্রে, আর মাপতে না করা হয়েছে খাওয়া ও খরচ করার ক্ষেত্রে। কেননা খরচ করার ক্ষেত্রে মাপামাপি দ্বারা একরকম কার্পণ্য প্রকাশ পায়। যে সম্পদে কৃপণতা করা হয় তাতে বরকত হয় না। বরকত না হওয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে বাহ্যিক আসবাবের প্রতি মনোযোগী হওয়া। বরকত সম্পূর্ণই গায়েবী বিষয়। আল্লাহ তা'আলা নিজ অনুগ্রহে অদৃশ্যভাবে তা দিয়ে থাকেন। এরূপ ক্ষেত্রে পুরোপুরি মনোযোগ আল্লাহ তা'আলার দিকেই থাকা চাই। আরও কর্তব্য অব্যাহতভাবে তাঁর শোকর আদায় করতে থাকা এবং বিলকুল বাহ্যিক আসবাবের দিকে লক্ষ না করা।

মাপতে যে নিষেধ করা হয়েছে খাওয়া বা খরচ করার বেলায়, অপর এক বর্ণনা দ্বারাও তা বোঝা যায়। যেমন হযরত জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, একবার এক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে খাবার চাইলে তিনি তাকে এক ওয়াসক যব দিলেন। লোকটি সেই যব থেকে নিজ স্ত্রীসহ খেতে থাকল। মেহমান আসলে তাকেও তা থেকে খাওয়াত। তা সত্ত্বেও সে খাবার ফুরাচ্ছিল না। পরিশেষে একদিন সে তা মাপল (ফলে তা ফুরিয়ে গেল)। তারপর সে এসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা জানাল। তিনি বললেন
لو لم تكله لأكلتم منه، ولقام لكم
“তুমি যদি তা না মাপতে, তবে তোমরা তা থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে খেতে পারতে এবং তা তোমাদের প্রয়োজন মেটাত।"

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত হিসেবে আমাদেরকে ক্ষুধাসহ অন্য যে-কোনও কষ্টে সহিষ্ণুতায় অভ্যস্ত হতে হবে।

খ. আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে কোনওকিছুতে বিশেষ বরকত দান করলে আমাদের কর্তব্য হবে তাতে কোনওরকম পরিবর্তন না ঘটানো এবং অব্যাহতভাবে আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করতে থাকা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)