আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ

৫৬- দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি ও হৃদয়গ্রাহী বিষয়াদির বর্ণনা

হাদীস নং: ৭১৬২
আন্তর্জাতিক নং: ২৯৬৪
শিরোনামবিহীন পরিচ্ছেদ
৭১৬২। শায়বান ইবনে ফাররুখ (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি নবী (ﷺ) কে বলতে শুনেছেন যে, বনী ইসরাঈলের মধ্যে তিন ব্যক্তি ছিল। একজন ছিল কুষ্ঠরোগী, দ্বিতীয় জন টাক মাথা এবং তৃতীয় জন অন্ধ। আল্লাহ তাআলা এ তিনজনকে পরীক্ষা করার ইচ্ছা করলেন। তাই তিনি তাদের নিকট একজন ফিরিশতা পাঠালেন। ফিরিশতা প্রথমে কুষ্ঠরোগীর কাছে আসলেন এবং বললেন, তোমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় বস্তু কি? সে বলল, উত্তম রং, উত্তম চর্ম এবং আমার থেকে যেন এ ব্যাধি নিরাময় হয়ে যায়, যার কারণে লোকেরা আমাকে ঘৃণা করে। অতঃপর ফিরিশতা তার শরীরে হাত বুলালেন। এতে তার এ কুৎসিত ব্যাধি নিরাময় হল এবং তাকে উত্তম রং ও উত্তম চর্ম প্রদান করা হল। ফিরিশতা আবার তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার নিকট প্রিয় মাল কি? সে বলল, উট বা গাভী। বর্ণনাকারী ইসহাক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তবে কুষ্ঠরোগী বা টাক মাথা তাদের একজন বলল, উট আর অপর জন বলল গাভী। অতঃপর তাকে গর্ভবতী উট প্রদান করা হল এবং বললেন, আল্লাহ তোমাকে এতে বরকত দান করুন।

এরপর ফিরিশতা টাক মাথা ব্যক্তির নিকট এসে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার নিকট অধিক প্রিয় বস্তু কি? সে বলল, সুন্দর চুল এবং আমার থেকে যেন এই ব্যাধি নিরাময় হয়ে যায় যার কারণে লোকেরা আমাকে ঘৃণা করছে। ফিরিশতা তার শরীরে হাত বুলালে তার ব্যাধি নিরাময় হয়ে যায়। অতঃপর তাকে প্রদান করা হয় সুন্দর চুল। পুনঃরায় ফিরিশতা তাকে প্রশ্ন করলেন যে, কোন মাল তোমার নিকট অধিক প্রিয়? সে বলল, গাভী। অতঃপর তাকে গর্ভবতী গাভী দান করা হল এবং ফিরিশতা বললেন, আল্লাহ তোমাকে এত বরকত দান করুন।

অতঃপর ফিরিশতা অন্ধের কাছে এসে বললেন, কোন জিনিস তোমার কাছে অধিক প্রিয়। সে বলল আল্লাহ আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিন, যা দিয়ে আমি মানুষদের দেখতে পাব। তিনি বলেন তখন তার চোখের উপর হাত বুলালে আল্লাহ তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন। এরপর ফিরিশতা পুনরায় তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন মাল তোমার নিকট অধিক প্রিয়? সে বলল, বকরী। তাকে গর্তবতী বকরী দান করা হল। অতঃপর উট, গাভী এবং বকরী সবই বাচ্চা দিল। ফলে তার এক মাঠ উট, তার এক মাঠ গাভী এবং তার এক মাঠ বকরী হয়ে গেল।

অতঃপর ফিরিশতা (অনতিকাল পরে) তার প্রথম আকৃতিতে কুষ্ঠরোগীর নিকট এসে বলল, আমি একজন মিসকীন ও নিঃস্ব ব্যক্তি, সফরে আমার সমস্ত অবলম্বন শেষ হয়ে গিয়েছে। আল্লাহর সাহায্য এবং অতঃপর তোমার সাহায্য ব্যতিরেকে বাড়ী পৌছানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং যে আল্লাহ তোমাকে উত্তম রং, সুন্দর চামড়া এবং মাল দান করেছেন তার নামে আমি তোমার নিকট একটি উট প্রার্থনা করছি, যেন এ সফরে আমি তার সাহায্যে বাড়ী পৌছতে পারি। (এ কথা শুনে) সে বলল, দায়-দায়িত্ব (দেনা পাওনা) অনেক বেশী। তখন ফিরিশতা বললেন, আমি তোমাকে চিনি বলে মনে হচ্ছে তুমি কি নিঃস্ব কুষ্ঠরোগী ছিলে না? অতঃপর আল্লাহ তোমাকে সম্পদ দান করেছেন। সে বলল, বাহ! আমরা তো বাপ-দাদার কাল হতেই ক্রমাগত এ সম্পদের ওয়ারিস হয়ে আসছি। অতঃপর ফিরিশতা বললেন, যদি তুমি মিথ্যাবাদী হও, তবে আল্লাহ তাআলা যেন তোমাকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দেন।

এবার ফিরিশতা তার আকৃতিতে টাক মাথা ব্যক্তির নিকট এসে ঐ ব্যক্তির মত তাকেও বললেন এবং সে-ও প্রথম ব্যক্তির মতই উত্তর দিল। অতঃপর তিনি বললেন, যদি তুমি মিথ্যাবাদী হও তবে যেন আল্লাহ তাআলা তোমাকে তোমার পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দেন।

এরপর ফিরিশতা তাঁর পূর্বের আকৃতিতে অন্ধ ব্যক্তির নিকট এসে বলল, আমি একজন নিঃস্ব মুসাফির ব্যক্তি। আমার সফরের সমস্ত আসবাব অবলম্বন শেষ হয়ে গিয়েছে। আল্লাহ তাআলা এবং পরে তোমার সহযোগিতা ব্যতীত আজ বাড়ী পৌছা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যে আল্লাহ তোমাকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন তার নামে তোমার নিকট আমি একটি বকরী চাই যেন আমি সফর শেষে বাড়ী পৌছতে পারি।

এ কথা শুনে লোকটি বলল, হ্যাঁ, আমি অন্ধ ছিলাম, আল্লাহ আমার দৃষ্টিশক্তি পুনরায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। আপনার ইচ্ছামত আপনি নিয়ে যান এবং যা মনে চায় রেখে যান। আল্লাহর কসম! আজ আল্লাহর নামে আপনি যা নিবেন এ ব্যাপারে আমি আপনাকে বাধা দিব না। অতঃপর ফিরিশতা বললেন, তুমি তোমার মাল রেখে দাও। তোমাদের তিন জনের পরীক্ষা হল। আল্লাহ তোমার প্রতি সন্তুষ্ট এবং তোমার অপর দুই সাথীর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন।
حَدَّثَنَا شَيْبَانُ بْنُ فَرُّوخَ، حَدَّثَنَا هَمَّامٌ، حَدَّثَنَا إِسْحَاقُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي طَلْحَةَ، حَدَّثَنِي عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ أَبِي عَمْرَةَ، أَنَّ أَبَا هُرَيْرَةَ، حَدَّثَهُ أَنَّهُ، سَمِعَ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ " إِنَّ ثَلاَثَةً فِي بَنِي إِسْرَائِيلَ أَبْرَصَ وَأَقْرَعَ وَأَعْمَى فَأَرَادَ اللَّهُ أَنْ يَبْتَلِيَهُمْ فَبَعَثَ إِلَيْهِمْ مَلَكًا فَأَتَى الأَبْرَصَ فَقَالَ أَىُّ شَىْءٍ أَحَبُّ إِلَيْكَ قَالَ لَوْنٌ حَسَنٌ وَجِلْدٌ حَسَنٌ وَيَذْهَبُ عَنِّي الَّذِي قَدْ قَذِرَنِي النَّاسُ . قَالَ فَمَسَحَهُ فَذَهَبَ عَنْهُ قَذَرُهُ وَأُعْطِيَ لَوْنًا حَسَنًا وَجِلْدًا حَسَنًا قَالَ فَأَىُّ الْمَالِ أَحَبُّ إِلَيْكَ قَالَ الإِبِلُ - أَوْ قَالَ الْبَقَرُ شَكَّ إِسْحَاقُ - إِلاَّ أَنَّ الأَبْرَصَ أَوِ الأَقْرَعَ قَالَ أَحَدُهُمَا الإِبِلُ وَقَالَ الآخَرُ الْبَقَرُ - قَالَ فَأُعْطِيَ نَاقَةً عُشَرَاءَ فَقَالَ بَارَكَ اللَّهُ لَكَ فِيهَا - قَالَ - فَأَتَى الأَقْرَعَ فَقَالَ أَىُّ شَىْءٍ أَحَبُّ إِلَيْكَ قَالَ شَعَرٌ حَسَنٌ وَيَذْهَبُ عَنِّي هَذَا الَّذِي قَذِرَنِي النَّاسُ . قَالَ فَمَسَحَهُ فَذَهَبَ عَنْهُ وَأُعْطِيَ شَعَرًا حَسَنًا - قَالَ - فَأَىُّ الْمَالِ أَحَبُّ إِلَيْكَ قَالَ الْبَقَرُ . فَأُعْطِيَ بَقَرَةً حَامِلاً فَقَالَ بَارَكَ اللَّهُ لَكَ فِيهَا - قَالَ - فَأَتَى الأَعْمَى فَقَالَ أَىُّ شَىْءٍ أَحَبُّ إِلَيْكَ قَالَ أَنْ يَرُدَّ اللَّهُ إِلَىَّ بَصَرِي فَأُبْصِرَ بِهِ النَّاسَ - قَالَ - فَمَسَحَهُ فَرَدَّ اللَّهُ إِلَيْهِ بَصَرَهُ . قَالَ فَأَىُّ الْمَالِ أَحَبُّ إِلَيْكَ قَالَ الْغَنَمُ . فَأُعْطِيَ شَاةً وَالِدًا فَأُنْتِجَ هَذَانِ وَوَلَّدَ هَذَا - قَالَ - فَكَانَ لِهَذَا وَادٍ مِنَ الإِبِلِ وَلِهَذَا وَادٍ مِنَ الْبَقَرِ وَلِهَذَا وَادٍ مِنَ الْغَنَمِ . قَالَ ثُمَّ إِنَّهُ أَتَى الأَبْرَصَ فِي صُورَتِهِ وَهَيْئَتِهِ فَقَالَ رَجُلٌ مِسْكِينٌ قَدِ انْقَطَعَتْ بِيَ الْحِبَالُ فِي سَفَرِي فَلاَ بَلاَغَ لِيَ الْيَوْمَ إِلاَّ بِاللَّهِ ثُمَّ بِكَ أَسْأَلُكَ بِالَّذِي أَعْطَاكَ اللَّوْنَ الْحَسَنَ وَالْجِلْدَ الْحَسَنَ وَالْمَالَ بَعِيرًا أَتَبَلَّغُ عَلَيْهِ فِي سَفَرِي . فَقَالَ الْحُقُوقُ كَثِيرَةٌ . فَقَالَ لَهُ كَأَنِّي أَعْرِفُكَ أَلَمْ تَكُنْ أَبْرَصَ يَقْذَرُكَ النَّاسُ فَقِيرًا فَأَعْطَاكَ اللَّهُ فَقَالَ إِنَّمَا وَرِثْتُ هَذَا الْمَالَ كَابِرًا عَنْ كَابِرٍ . فَقَالَ إِنْ كُنْتَ كَاذِبًا فَصَيَّرَكَ اللَّهُ إِلَى مَا كُنْتَ . قَالَ وَأَتَى الأَقْرَعَ فِي صُورَتِهِ فَقَالَ لَهُ مِثْلَ مَا قَالَ لِهَذَا وَرَدَّ عَلَيْهِ مِثْلَ مَا رَدَّ عَلَى هَذَا فَقَالَ إِنْ كُنْتَ كَاذِبًا فَصَيَّرَكَ اللَّهُ إِلَى مَا كُنْتَ . قَالَ وَأَتَى الأَعْمَى فِي صُورَتِهِ وَهَيْئَتِهِ فَقَالَ رَجُلٌ مِسْكِينٌ وَابْنُ سَبِيلٍ انْقَطَعَتْ بِيَ الْحِبَالُ فِي سَفَرِي فَلاَ بَلاَغَ لِيَ الْيَوْمَ إِلاَّ بِاللَّهِ ثُمَّ بِكَ أَسْأَلُكَ بِالَّذِي رَدَّ عَلَيْكَ بَصَرَكَ شَاةً أَتَبَلَّغُ بِهَا فِي سَفَرِي فَقَالَ قَدْ كُنْتُ أَعْمَى فَرَدَّ اللَّهُ إِلَىَّ بَصَرِي فَخُذْ مَا شِئْتَ وَدَعْ مَا شِئْتَ فَوَاللَّهِ لاَ أَجْهَدُكَ الْيَوْمَ شَيْئًا أَخَذْتَهُ لِلَّهِ فَقَالَ أَمْسِكْ مَالَكَ فَإِنَّمَا ابْتُلِيتُمْ فَقَدْ رُضِيَ عَنْكَ وَسُخِطَ عَلَى صَاحِبَيْكَ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

বনী ইসরাঈল বলা হয় হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামের বংশধরদেরকে। ‘ইসরাঈল' হযরত ইয়াকূব আলাইহিস সালামের আরেক নাম। তিনি হযরত ইসহাক আলাইহিস সালামের পুত্র। হযরত ইসহাক আলাইহিস সালাম হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামের ছোট ভাই। তাঁরা উভয়ে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের পুত্র। বর্তমানে বনী ইসরাঈল বলতে ইহুদীদেরকে বোঝায়। কুরআন মাজীদে ও হাদীছে তাদের বহু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তারা নিজেদের হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও তাওরাত গ্রন্থের অনুসারী বলে দাবি করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে তারা হযরত মূসা আলাইহিস সালামের শিক্ষা থেকে বহু দূরে সরে গিয়েছে। তারা তাওরাত গ্রন্থও বিকৃত করে ফেলেছে।

এ হাদীছে তাদের তিন ব্যক্তির ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, যাদেরকে আল্লাহ তা'আলা পরীক্ষা করেছিলেন। তিনজনই ছিল নিতান্ত গরীব এবং একেকজন একেক রোগে আক্রান্ত। মানুষ তাদের ঘৃণা করত। আল্লাহ তা'আলা তাদের অবস্থা পরিবর্তন করে দেন। প্রত্যেকেই সুস্থ হয়ে যায়। হয়ে যায় অনেক সম্পদের মালিক। এ পরিবর্তনের জন্য তাদের কর্তব্য ছিল আল্লাহর শোকর আদায় করা। প্রত্যেকের উচিত ছিল অতীতের দুরাবস্থার কথা স্মরণ রেখে বর্তমান সুখের জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করা ও আপন আপন সম্পদের হক আদায় করা। কিন্তু এ কর্তব্যকর্ম তাদের মধ্যে মাত্র একজনই উপলব্ধি করেছিল। সে যথারীতি আল্লাহর শোকরগুযারী করে এবং আল্লাহপ্রদত্ত সম্পদ থেকে আল্লাহ ও বান্দার হক আদায়ে যত্নবান থাকে। কিন্তু বাকি দু'জন ছিল এর বিপরীত। অবস্থা পরিবর্তনের পর তারা বিগত জীবনের কথা মনে রাখেনি। তারা যে একদিন গরীব ছিল, ছিল মারাত্মক রোগে আক্রান্ত, তা বেমালুম ভুলে যায়। সম্পদের মোহে পড়ে ভুলে যায় তার প্রকৃত দাতা আল্লাহ তা'আলাকেও। ফিরিশতা এসে যখন তাদের কাছে সাহায্য চাইল, তখন সাহায্য তো করলই না, উল্টো তাদের অতীত দিনের কথা মনে করিয়ে দিলে দাবি করে বসল, তারা বাপ-দাদার আমল থেকেই ধন-দৌলতের মালিক। হঠাৎ করে ধনী হয়ে যায়নি। এ যেন কারূনের কথারই প্রতিধ্বনি। তাকে যখন তার সম্পদ থেকে গরীব-দুঃখীকে দান করতে বলা হল, সে ধৃষ্টতা দেখিয়ে বলেছিল কেন তা করবে? সে তো ধন-দৌলতের মালিক নিজ বিদ্যা-বুদ্ধি বলেই হয়েছে। তার প্রতি এটা কারও দান নয়। কুরআন মাজীদে তার কথা বর্ণিত হয়েছে-

قَالَ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ عِنْدِي

"সে বলল, এসব তো আমি আমার জ্ঞানবলে লাভ করেছি।"

অর্থাৎ এ সম্পদ আমি আল্লাহর কাছ থেকে পাইনি। এ দুই ব্যক্তিও বলল, এ সম্পদ পুরুষানুক্রমে পেয়েছি। অর্থাৎ তাতে যেন আল্লাহর কোনও হাত নেই। কত বড় অকৃতজ্ঞতা! তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ ছিল। ফিরিশতা তাদের প্রত্যেকের কাছে এসেছিলেন তাদের অতীত রূপ ও অতীত বেশভূষা নিয়ে। অন্ধের কাছে অন্ধ হয়ে, কুষ্ঠীর কাছে কুষ্ঠীরূপে এবং টেকোর কাছে টেকোবেশে। এ রূপ দেখে তারা মনে করতে পারত, একদিন তারাও এরকম ছিল। তাদের কিছুই ছিল না। নিতান্তই দরিদ্র ছিল। আল্লাহ তা'আলাই নিজ করুণায় তাদের রোগমুক্তিও দান করেছেন এবং দিয়েছেন অঢেল সম্পদ। অন্ধ লোকটি তা ঠিকই মনে করেছিল এবং স্বীকার করেছিল একদিন সে নিতান্ত গরীব ছিল। ছিল অন্ধ। আল্লাহ তা'আলা নিজ দয়ায় তার অবস্থার পরিবর্তন করেছেন। তারপর সে সাহায্য প্রার্থীকে খালি হাতেও ফিরিয়ে দেয়নি। তাকে তার যা দরকার, নিজ ইচ্ছামত নিয়ে যেতে বলেছে। কিন্তু অপর দু'জন অকৃতজ্ঞতা দেখায়। দাবি করে বসে, আগে থেকেই তারা ধনী ছিল। তারা তাকে কিছুই দিল না। নানারকম খরচের অজুহাত দেখাল, যেমনটা সবকালের কৃপণরা করে থাকে। তারা চিন্তা করেনি ধন-সম্পদ ও আরোগ্য দিয়ে আল্লাহ তা'আলা হয়তো তাদের পরীক্ষা করছেন যে, তারা শোকর আদায় করে কি না। আল্লাহ তা'আলা বান্দাকে নানাভাবেই পরীক্ষা করে থাকেন। কখনও পরীক্ষা করেন সুস্থতা দিয়ে, কখনও অসুস্থতা দিয়ে। কখনও পরীক্ষা করেন দারিদ্র্য দিয়ে, কখনও ধন-সম্পদ দিয়ে। কখনও পরীক্ষা করেন ভয়-ভীতির সম্মুখীন করে, কখনও স্বস্তি ও নিরাপত্তা দিয়ে। এক অবস্থায় কাম্য সবর করা, অন্য অবস্থায় শোকর আদায় করা। তা করতে পারলেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যায়। কিন্তু তারা তা করেনি। তারা অকৃতজ্ঞতা দেখিয়ে আল্লাহর পরীক্ষায় ফেল করেছে। এর জন্য আখিরাতে যে শাস্তির ব্যবস্থা আছে তা তো রয়েছেই, দুনিয়ায়ও তাদের কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে।

ফিরিশতা তাদের বলল, তোমরা যদি তোমাদের দাবিতে মিথ্যুক হও, তবে আল্লাহ তা'আলা যেন তোমাদেরকে আগের মতই করে দেন। সন্দেহ নেই আল্লাহ তা'আলা তাঁর দু'আ কবুল করেছিলেন। আগেও তো তাঁর দু'আ কবুল করে তাদের সুস্থ করেছিলেন এবং ধন-সম্পদের মালিক বানিয়ে দিয়েছিলেন। এবারও তাঁর দু'আ বৃথা যাওয়ার কথা নয়। ফলে হয়তো আগের মত কুষ্ঠী ও টেকো হয়ে যায় এবং ধন-সম্পদ হারিয়ে ফকীর বনে যায়। অকৃতজ্ঞের পরিণাম এমনই হয়ে থাকে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-

لين شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ وَلَبِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيد

“তোমরা সত্যিকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে আমি তোমাদেরকে আরও বেশি দেব, আর যদি অকৃতজ্ঞতা কর, তবে জেনে রেখ আমার শাস্তি অতি কঠিন।”

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

এ হাদীছে আমাদের জন্য বহু শিক্ষা রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা যাচ্ছে।

ক. সুস্থতা-অসুস্থতা এবং দারিদ্র্য ও ধনাঢ্যতাকে আল্লাহর পরীক্ষা হিসেবে দেখা উচিত। সেই হিসেবে এক অবস্থায় কর্তব্য ধৈর্যধারণ করা, অন্য অবস্থায় শোকর আদায় করা।

খ. নিজের অতীত কখনও ভুলে যাওয়া উচিত নয়। তা থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান অবস্থাকে শোধরানোর চেষ্টা করা উচিত। অকৃতজ্ঞতার পরিণাম হয় অত্যন্ত অশুভ।

গ. কৃতজ্ঞতা দ্বারা নি'আমত বৃদ্ধি পায়।

ঘ. কৃপণতা একটি কঠিন আত্মিক ব্যাধি। এর ফলে মানুষ নাশোকরিতে লিপ্ত হয় ও মিথ্যাচার করে। সুতরাং কৃপণতা পরিহার করা উচিত।

ঙ. বিশ্বাস করা উচিত যে, নিজ অর্থ-সম্পদে গরীবেরও হক আছে। প্রত্যেকের কর্তব্য সে হক আদায়ে যত্নবান থাকা এবং কখনও কাউকে বঞ্চিত না করা।

চ. অন্তরে সর্বাবস্থায় আল্লাহর ধ্যান জাগরুক রাখা উচিত। তিনিই সবকিছুর প্রকৃত দাতা- এ কথা স্মরণ রাখলে নিজের জান-মাল সবকিছু তাঁর হুকুম মোতাবেক ব্যবহার করা সহজ হয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)