আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ

৫৬- দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি ও হৃদয়গ্রাহী বিষয়াদির বর্ণনা

হাদীস নং: ৭১৫৩
শিরোনামবিহীন পরিচ্ছেদ
৭১৫৩। মুহাম্মাদ ইবনে মুসান্না ও ইবনে বাশশার (অন্য সনদে) ইবনে মুসান্না (রাহঃ) ......... মুতাররিফ এর পিতা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি নবী (ﷺ) এর নিকট গেলাম ...... অতঃপর তিনি হাম্মামের হাদীসের অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ الْمُثَنَّى، وَابْنُ، بَشَّارٍ قَالاَ حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ جَعْفَرٍ، حَدَّثَنَا شُعْبَةُ، وَقَالاَ، جَمِيعًا حَدَّثَنَا ابْنُ أَبِي عَدِيٍّ، عَنْ سَعِيدٍ، ح وَحَدَّثَنَا ابْنُ الْمُثَنَّى، حَدَّثَنَا مُعَاذُ بْنُ هِشَامٍ، حَدَّثَنَا أَبِي كُلُّهُمْ، عَنْ قَتَادَةَ، عَنْ مُطَرِّفٍ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ انْتَهَيْتُ إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم . فَذَكَرَ بِمِثْلِ حَدِيثِ هَمَّامٍ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার হাকীকত তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন-
يَقُوْلُ ابْنُ آدَمَ : مَالِيْ، مَالِيْ (আদম সন্তান বলে, আমার মাল, আমার মাল)। অর্থাৎ মানুষ মালিকানা নিয়ে তৃপ্তিবোধ করে, মালিকানার বড়াই দেখায়। বস্তুত সব মানুষেরই মালিকানার প্রতি বড় আগ্রহ। মালিকানা লাভের উৎসাহ মানবস্বভাবের মধ্যেই নিহিত। কেউ কোনওকিছুর মালিক হতে পারলে বড় খুশি হয়। খুব উৎসাহের সঙ্গে বলে বেড়ায় এটা আমার মাল, আমার বাড়ি, আমার জমি, আমি এর মালিক। সামান্য কিছুর মালিক হতে পারলে সে সেই মালিকানার আরও বিস্তার ঘটাতে চায়। যার মালিকানার বিস্তার যত বেশি, সে নিজেকে ততো বেশি সফল মনে করে। মানুষের দৃষ্টিতে মালিকানা একটি গর্বের বিষয়। যে যত বেশি মালের মালিক, সে নিজেকে ততো বেশি গর্বিত বোধ করে। প্রকৃতপক্ষে এ সবই ধোঁকা। মৃত্যুতে সব তো নিঃশেষ হয়ই, তার আগেও মানুষ ক্ষণে ক্ষণে তা হারাতে থাকে। যা-কিছু মালিকানায় আসে, তার অল্পই নিজ কাজে লাগে। সেদিকে ইঙ্গিত করে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَهَلْ لَكَ يَا ابْنَ آدَمَ مِنْ مَالِكَ إِلَّا مَا أَكَلْتَ فَأَفْنَيْتَ (অথচ হে আদম সন্তান! তোমার সম্পদ তো কেবল এতটুকুই, যা তুমি খেয়ে শেষ করেছ)। অর্থাৎ তোমার সম্পদ থেকে যতটুকু তুমি নিজে খেয়েছ তা তোমার কাজে লেগেছে। তোমার ক্ষুধা মিটেছে, শরীর পুষ্ট হয়েছে, শক্তি অর্জন করেছ। কাজেই বলতে পার এইটুকু তোমার মাল।

أَوْ لَبِسْتَ فَأَبْلَيْتَ (বা পরিধান করে পুরোনো করেছ)। তুমি যেসব পোশাক পরিধান করেছ তা দ্বারা তোমার লজ্জা নিবারণ হয়েছে, শীত ও তাপ থেকে আরাম পেয়েছ, শরীরের সৌন্দর্য প্রকাশ পেয়েছে এবং সমাজে ইজ্জত-সম্মান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কাজেই তোমার অর্থ-সম্পদের যতটুকু তোমার পোশাকের পেছনে খরচ হয়েছে সেটুকু সম্পর্কে বলতে পার যে, তা তোমার মাল, যেহেতু তা তোমার কাজে এসেছে।

أَوْ تَصَدَّقْتَ فَأَمْضَيْتَ (কিংবা দান-সদাকা করে (তার ছাওয়াব) সঞ্চয় করেছ)। অর্থাৎ সম্পদের যে অংশ তুমি আল্লাহর পথে খরচ করেছ, গরীব-দুঃখীকে দিয়েছ এবং দীনের প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় করেছ, সে সম্পর্কেও বলতে পার যে, তা তোমার মাল। প্রকৃতপক্ষে সেটাই তোমার মাল। কারণ খাবার ও পোশাকের মতো তা শেষ হয়ে যায়নি; বরং তার ছাওয়াব সংরক্ষিত আছে। আখিরাতে তা তোমার উপকারে আসবে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
مَا عِنْدَكُمْ يَنْفَدُ وَ مَا عِنْدَ اللَّهِ بَاقٍ
'তোমাদের কাছে যা-কিছু আছে তা নিঃশেষ হয়ে যাবে আর আল্লাহর কাছে যা আছে তা স্থায়ী।'২৭৯

হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. থেকে বর্ণিত-
أَنَّهُمْ ذَبَحُوا شَاةً ، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَا بَقِيَ مِنْهَا؟ قَالَتْ: مَا بَقِيَ مِنْهَا إِلَّا كَتِفُهَا ، قَالَ : بَقِيَ كُلُّهَا غَيْرَ كَتِفِهَا.
'তারা একটি ছাগল যবাই করেছিলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তা থেকে কিছু বাকি আছে? হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বললেন, তা থেকে কেবল তার কাঁধের অংশ বাকি আছে। তিনি বললেন, সবটাই বাকি আছে তার কাঁধের অংশটুকু ছাড়া।’২৮০

আলোচ্য হাদীছের সারকথা হল সম্পদ থেকে তুমি দুনিয়ায় যতটুকু ভোগ করেছ, তা খাওয়ার কাজে হোক বা পোশাকের কাজে, এক তো সেটুকু তোমার সম্পদ, তবে এমন সম্পদ যা নিঃশেষ হয়ে যায়, বাকি থাকে না। আর দ্বিতীয় সম্পদ হল ওইটুকু, যা তুমি আখিরাতের কাজে ব্যয় করেছ। প্রকৃতপক্ষে তাই তোমার আসল সম্পদ। কারণ তা তোমার জন্য আখিরাতের ভাণ্ডারে স্থায়ী হয়ে আছে। এ ছাড়া আর যা-কিছু সম্পদ আছে, মূলত তা তোমার নয়; তোমার ওয়ারিশদের সম্পদ। তুমি তার একজন খাদেম ও খাজাঞ্চি মাত্র। এক হাদীছে আছে-
أَيُّكُمْ مَالُ وَارِثِهِ أَحَبُّ إِلَيْهِ مِنْ مَالِهِ؟ قَالُوا : يَا رَسُولَ اللَّهِ، مَا مِنَّا أَحَدٌ إِلَّا مَالُهُ أَحَبُّ إِلَيْهِ، قَالَ : فَإِنَّ مَالَهُ مَا قَدَّمَ، وَمَالُ وَارِثِهِ مَا أَخَرَ
'একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রশ্ন করলেন, তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যার কাছে তার নিজের মাল অপেক্ষা ওয়ারিশের মাল বেশি প্রিয়? সাহাবীগণ বললেন, আমাদের প্রত্যেকেই এমন, যার কাছে তার নিজের মালই বেশি প্রিয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তার নিজের মাল তো তাই, যা সে (আখিরাতের জন্য) আগে আগে পাঠিয়ে দিয়েছে। আর ওয়ারিশের মাল তাই, যা সে পেছনে রেখে দিয়েছে।’২৮১

বোঝা গেল খাওয়া-পরা ও দান-খয়রাতের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তা কেবলই ওয়ারিশের সম্পদ। তাকে নিজের সম্পদ বলা যায় না। তবে কি ওয়ারিশদের জন্য কিছুই না রেখে সবটা খরচ করে ফেলা হবে? না, তাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা নয়। ওয়ারিশদের জন্যও কিছু রেখে যাওয়া চাই। হযরত সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি. বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের উল্লেখ আছে। তার আংশিক নিম্নরূপ-
أَفَأَتَصَدَّقُ بِثُلُثَيْ مَالِي؟ قَالَ : لا ، قُلْتُ : فَالشَّطْرُ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ فَقَالَ : لَا ، قُلْتُ: فَالثُّلُثُ يَا رَسُوْلَ اللهِ ؟ قَالَ : وَ الثُّلُثُ كَثِيرٌ أَوْ كَبِيرٌ ، إِنَّكَ أَنْ تَذَرَ وَرَثَتَكَ أَغْنِيَاءَ خَيْرٌ مِنْ أن تَذَرَهُمْ عَالَةٌ يَتَكَفَّفُوْنَ النَّاسَ ، وَإِنَّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللَّهِ إِلَّا أُجِرْتَ عَلَيْهَا، حَتّٰى مَا تَجْعَلُ فِي فِي امْرَأَتِكَ.
'আমি কি আমার সম্পদের দুই-তৃতীয়াংশ দান করে দেব? তিনি বললেন, না। আমি বললাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! তবে অর্ধেক? তিনি বললেন, না। আমি বললাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! তবে তিন ভাগের একভাগ? তিনি বললেন, তিন ভাগের একভাগ! তিন ভাগের একভাগও বেশিই বটে। ওয়ারিশদেরকে তোমার ধনী রেখে যাওয়াটা তাদেরকে এমন গরীব রেখে যাওয়া অপেক্ষা উত্তম যে, তারা মানুষের কাছে হাত পেতে বেড়াবে। তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনায় যা-কিছুই ব্যয় করো না কেন, তার জন্য তোমাকে প্রতিদান দেওয়া হবে। এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যা রাখবে তার জন্যও।’২৮২

বোঝা গেল ওয়ারিশদের জন্যও কিছু সম্পদ রেখে যাওয়া চাই। অবশ্য সে রেখে যাওয়াটা কাজে আসবে তখনই, যখন ওয়ারিশদেরকে দীনদাররূপে গড়ে যাওয়া হবে। তারা দীনদার না হলে রেখে যাওয়া সম্পদ তাদের উপকার অপেক্ষা ক্ষতিই করবে বেশি। এ কারণেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَا نَحَلَ وَالِدٌ وَلَدًا مِنْ نَحْلٍ أَفْضَلَ مِنْ أَدَبٍ حَسَنٍ
'কোনও পিতা তার সন্তানকে ভালো শিক্ষার চেয়ে উৎকৃষ্ট কিছু উপহার দিতে পারে না।’২৮৩

বস্তুত আলোচ্য হাদীছ আমাদেরকে ধন-সম্পদ উপার্জনে নিরুৎসাহিত করেনি। বরং উপার্জনের পর তার যথার্থ ব্যবহারের পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছে। আমরা সম্পদ অবশ্যই উপার্জন করব। অন্যের গলগ্রহ হব না। তবে উপার্জনের পর কর্তব্য হবে যতটুকু খাওয়া-পরার কাজে লাগে তার অতিরিক্ত সম্পদ দ্বারা আখিরাতের কল্যাণ ও সফলতা লাভের চেষ্টা করা। এটাই تَصَدَّقْتَ فَأَمْضَيْتَ (দান-সদাকা করে (তার ছাওয়াব) সঞ্চয় করেছ) - এর মর্মবস্তু। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
وَابْتَغِ فِيمَا اٰتٰكَ اللهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ وَلَا تَنْسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا
'আল্লাহ তোমাকে যা-কিছু দিয়েছেন তার মাধ্যমে আখিরাতের নিবাস লাভের চেষ্টা কর এবং দুনিয়া হতেও নিজ হিস্যা অগ্রাহ্য করো না।'২৮৪

আরও ইরশাদ হয়েছে-
وَمَا تُقَدِّمُوا لِأَنْفُسِكُمْ مِّنْ خَيْرٍ تَجِدُوهُ عِنْدَ اللَّهِ
'তোমরা যে-কোনও সৎকর্ম নিজেদের কল্যাণার্থে সম্মুখে প্রেরণ করবে, আল্লাহর কাছে তা পাবে।'২৮৫

আরও ইরশাদ-
مَنْ ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا فَيُضٰعِفَه لَه أَضْعَافًا كَثِيرَةً
'কে আছে, যে আল্লাহকে উত্তম পন্থায় ঋণ দেবে, ফলে তিনি তার কল্যাণে তা বহুগুণ বৃদ্ধি করবেন?'২৮৬

হাদীস থেকে শিক্ষনীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা আমরা দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত থাকার শিক্ষা পাই।

খ. সম্পদের যথার্থ ব্যবহার তাই, যা আখিরাতে উপকারে আসে।

গ. খাওয়া-পরার পেছনে যা খরচ হয় তা দ্বারা স্থায়ী কোনও উপকার হয় না। তাই এ ক্ষেত্রে বিলাসিতা বাঞ্ছনীয় নয়।

২৭৯. সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৯৬

২৮০. জামে' তিরমিযী: ২৪৭০; মুসনাদে আহমাদ: ২৪২৪০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ১৬৩৬

২৮১. সহীহ বুখারী: ৬৪৪২; সুনানে নাসাঈ ৩৬১২: মুসনাদে আহমাদ: ৩৬২৬; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা : ২৬২; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা : ৫১৬৩; সহীহ ইবন হিব্বান: ৩৩৩০; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৬৫০৯; শু'আবুল ঈমান: ৩০৬০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৪০৫৬

২৮২. সহীহ বুখারী: ১২৯৫; সহীহ মুসলিম: ১৬২৮

২৮৩. তিরমিযী: ১৯৫২; মুসনাদে আহমাদ: ১৬৭১০; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১৩২৩৪: বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ২২৭৩; শু'আবুল ঈমান : ১৫৫৩

২৮৪. সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৭৭

২৮৫. সূরা বাকারা (২), আয়াত ১১০

২৮৬. সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৪৫
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
rabi
বর্ণনাকারী:
সহীহ মুসলিম - হাদীস নং ৭১৫৩ | মুসলিম বাংলা