আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ

৫৬- দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি ও হৃদয়গ্রাহী বিষয়াদির বর্ণনা

হাদীস নং: ৭১৪৯
অধ্যায়ঃ যুহদ ও দুনিয়ার প্রতি অনীহা
৭১৪৯। কুতায়বা ইবনে সাঈদ (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেনঃ দুনিয়া মুমিনের জন্য জেলখানা এবং কাফিরের জন্য জান্নাত (স্বরূপ)।
كتاب الزهد والرقائق
حَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ بْنُ سَعِيدٍ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الْعَزِيزِ، - يَعْنِي الدَّرَاوَرْدِيَّ - عَنِ الْعَلاَءِ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " الدُّنْيَا سِجْنُ الْمُؤْمِنِ وَجَنَّةُ الْكَافِرِ " .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

الدنيا سجن المؤمن (মুমিনের জন্য দুনিয়া কারাগার)। অর্থাৎ কারাগারের মত। এর এক অর্থ এই যে, আল্লাহ তা'আলা আখিরাতে মুমিনদের জন্য যে অকল্পনীয় নি'আমতের ব্যবস্থা রেখেছেন সে তুলনায় দুনিয়া তাদের জন্য কারাগারস্বরূপ। অথবা এর অর্থ বন্দী যেমন কারাগারে নিজ ইচ্ছামত কোনওকিছু পায় না বা নিজ ইচ্ছাপূরণের কোনও সুযোগ তার সেখানে নেই, তেমনি মুমিনের জন্যও দুনিয়ায় নিজ ইচ্ছামত চলার সুযোগ নেই। মুমিনকে নিজ খেয়াল-খুশিমত চলতে নিষেধ করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, দুনিয়ায় মুমিনদেরকে যে কষ্ট-ক্লেশ, রোগ-ব্যাধি, বাধা-বিপত্তি ও নানামুখী পরীক্ষার ভেতর দিয়ে চলতে হয়, সেদিকে লক্ষ করলে দুনিয়াকে তাদের জন্য কারাগারই বলতে হয়। আল্লাহ তা'আলা মুমিনদেরকে আখিরাতে অপরিমিত ইজ্জত-সম্মান ও আরাম-আয়েশ দেওয়ার লক্ষ্যে দুনিয়ায় কারাবাসের মত কষ্ট তাদের দিয়ে থাকেন। এসব কষ্ট মূলত তার জন্য জান্নাতে পৌঁছার ব্যবস্থাস্বরূপ। মৃত্যুর মাধ্যমে সে এ দুনিয়ার কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতের উন্মুক্ত অবারিত ঠিকানায় পৌঁছে যাবে। যেমন এক হাদীছে আছে
إن العبد إذا سبقت له من الله منزلة، لم يبلغها بعمله، ابتلاه الله في جسده، أو في ماله، أو في ولده، ثم صبره على ذلك، حتى يبلغه المنزلة التي سبقت له من الله تعالى
বান্দার জন্য যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে (জান্নাতে) বিশেষ কোনও মর্যাদা নির্ধারিত থাকে, যে মর্যাদায় নিজ আমল দ্বারা সে পৌছতে পারে না, তখন আল্লাহ তা'আলা তার শরীর, তার মাল বা তার সন্তান-সন্ততি দ্বারা তাকে পরীক্ষা করে থাকেন (অর্থাৎ এসবের মধ্যে বালা-মসিবত দিয়ে থাকেন)। তারপর তাকে তাতে সবরের তাওফীক দেন।এভাবে তার জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে যে মর্যাদা নির্ধারিত রয়েছে সেখানে তাকে পৌঁছানো হয়।

وجنة الكافر (এবং কাফেরের জন্য জান্নাত)। অর্থাৎ আখিরাতে কাফেরের জন্য জাহান্নামের যে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, সে তুলনায় দুনিয়া তার জন্য জান্নাতস্বরূপ। তাছাড়া জান্নাতে যেমন মুমিনদের জন্য কোনওকিছুতে বারণ নেই, সে তার ইচ্ছামত সেখানকার আনন্দ-উপভোগ করতে পারবে, ঠিক তেমনি কাফেরগণ দুনিয়ায় কোনও বারণ মানে না। তারা তাদের ইচ্ছামত আনন্দ উপভোগ করে থাকে। মন যখন যা চায় তাই করে। প্রকৃতপক্ষে এ আনন্দ-স্ফূর্তি তার জন্য জাহান্নামে যাওয়ার ব্যবস্থা। মৃত্যুর মাধ্যমে সে এ দুনিয়ার জান্নাত থেকে গ্রেফতার হয়ে জাহান্নামের কারাগারে নিক্ষিপ্ত হবে।

প্রশ্ন হতে পারে, কুরআন-হাদীছের বিভিন্ন পাঠ দ্বারা তো জানা যায় যে, ঈমানদারগণ শরী'আতের বিধানাবলী পালন করার দ্বারা দুনিয়ায়ও শান্তি ও স্বস্তির জীবন লাভ করে থাকে, তাহলে এ হাদীছটি কি তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়? কারাগার তো কষ্টের জায়গা, শান্তি ও স্বস্তি কোথায়?

উত্তর হল, দুনিয়ায় মুমিনের যে কষ্ট-ক্লেশ, তার সবই মূলত দৈহিক ও বাহ্যিক। মনের দিক থেকে পরম আনন্দ ও স্বস্তির ভেতর থাকে। যেমন অপারেশনের রোগী শারীরিকভাবে কষ্ট পায়, কিন্তু অপারেশন দ্বারা সে যে প্রাণে বেঁচে যাবে এই ভাবনার কারণে শারীরিক সে কষ্ট তার মনকে স্পর্শ করতে পারে না। মনে মনে সে স্বস্তির ভেতর থাকে। এ কারণেই তার চিৎকার ও অস্থিরতা দেখে চিকিৎসক যদি বলে তোমার অপারেশন করা হবে না, তবে সে তাতে খুশি হবে না। হাজার কষ্ট সত্ত্বেও সে অপারেশন করানোকেই মেনে নেবে। তদ্রূপ মুমিন ব্যক্তিও আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি ও জান্নাতের অপরিমিত সুখ-শান্তির প্রত্যাশায় মানসিকভাবে পরম আনন্দের মধ্যে থাকে। পার্থিব দুঃখ-কষ্ট তার শরীরের উপর দিয়েই যায়, মনকে স্পর্শ করতে পারে না।

কোনও কোনও মুমিন ব্যক্তিকে দেখা যায় বাহ্যিকভাবেও দুনিয়ায় আরামের মধ্যে থাকে। বিশেষ কষ্ট-ক্লেশ তাকে ভোগ করতে দেখা যায় না। তার ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে, দুনিয়া তার জন্য কারাগার কিভাবে?

ইমাম ইবন হাজার আসকালানী রহ.-এর একটি ঘটনার ভেতর এ প্রশ্নের সমাধান রয়েছে। তিনি বিচারপতি থাকাকালে একবার আকর্ষণীয় বেশভূষায় সজ্জিত অবস্থায় অনুচর-অনুরক্তদের নিয়ে একটি বাজারের উপর দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার এ জাঁকজমকপূর্ণ অবস্থা দেখে এক ইহুদী তার দিকে এগিয়ে আসল। সে ছিল একজন তেলবিক্রেতা। তার কাপড়-চোপড় ছিল তৈলাক্ত। খুবই মলিন ও আলুথালু তার বেশভূষা। সে ইমাম ইবন হাজার রহ.-এর বাহনটির লাগাম ধরে বলল, হে শায়খুল ইসলাম! আপনাদের নবী নাকি বলেছেন দুনিয়া মুমিনের জন্য কারাগার ও কাফেরের জান্নাত! তা কোন কারাগারের মধ্যে আপনি আছেন আর আমিই বা কোন জান্নাতে রয়েছি? তিনি চটজলদি উত্তর দিয়ে দিলেন, আল্লাহ তা'আলা আখিরাতে আমার জন্য যে অপরিমিত নি'আমতের ব্যবস্থা রেখেছেন, সে তুলনায় এখন আমি যেন কারাগারেই আছি। আর আখিরাতে তোমার জন্য যে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সে তুলনায় তুমি যেন এখন জান্নাতেই রয়েছ। তার এ উত্তর ইহুদীর অন্তরে রেখাপাত করল। তখনই সে ইসলাম গ্রহণ করল।

প্রখ্যাত বুযুর্গ দাউদ তাঈ রহ.-এর ইন্তিকাল হয়ে গেলে অদৃশ্য আওয়াজ শোনা গিয়েছিল- দাউদ কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করল।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

এ হাদীছটির শিক্ষা এই যে, আমরা দুনিয়ায় প্রয়োজনীয় সবই করব, কিন্তু এর প্রতি আসক্ত হওয়া যাবে না। কারাবন্দী ব্যক্তি কারাগারকে যে দৃষ্টিতে দেখে, দুনিয়াকেও আমাদেরকে সে দৃষ্টিতেই দেখতে হবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
সহীহ মুসলিম - হাদীস নং ৭১৪৯ | মুসলিম বাংলা