আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ
৫১- যিকর, দুআ, তাওবা ও ইসতিগফারের অধ্যায়
হাদীস নং: ৬৬০৮
১১. কুরআন তিলওয়াত ও যিক্রের জন্য সমাবেশের ফযীলত
৬৬০৮। ইয়াহয়া ইবনে ইয়াহয়া তামীমী, আবু বকর ইবনে আবি শাঈবা ও মুহাম্মাদ ইবনুল আলা হামদানী (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কোন মুমিনের পার্থিব কোন বিপদ-আপদ দূর করে দেবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিনে তার থেকে বিপদ দূরীভূত করবেন। যে ব্যক্তি কোন অভাবগ্রস্ত লোকের জন্য সহজ ব্যবস্থা (দুর্দশা লাঘব) করবে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দুর্দশা মোচন করবেন। যে ব্যক্তি কোন মূসলমানের ক্রটি গোপন রাখবে আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার ক্রটি গোপন রাখবেন। বান্দা যতক্ষণ তার ভাই এর সাহায্যে নিয়োজিত থাকে আল্লাহ ততক্ষণ তার সাহায্যে নিয়োজিত থাকেন।
যে ব্যক্তি ইলম হাসিলের জন্য পথে বের হয়, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দেন। যখন কোন সম্প্রদায় আল্লাহর ঘর সমূহের কোন একটিতে সমবেত হয়ে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে এবং পরস্পরে তার পর্যালোচনায় নিয়োজিত থাকে তখন তাদের উপর প্রশান্তি অবতীর্ণ হয়। রহমতের (শামিয়ানা) তাদের আচ্ছাদিত করে এবং ফিরিশতাগণ তাদের পরিবেষ্টন করে রাখেন। আর আল্লাহ তাআলা তাঁর নৈকট্যধারীদের (ফিরিশতাগণের) মাঝে তাদের স্মরণ (আলোচনা) করেন। আর যে ব্যক্তির আমল তাকে পিছিয়ে দেবে তার বংশ মর্যাদা তাকে এগিয়ে নিতে পারবে না।
যে ব্যক্তি ইলম হাসিলের জন্য পথে বের হয়, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দেন। যখন কোন সম্প্রদায় আল্লাহর ঘর সমূহের কোন একটিতে সমবেত হয়ে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে এবং পরস্পরে তার পর্যালোচনায় নিয়োজিত থাকে তখন তাদের উপর প্রশান্তি অবতীর্ণ হয়। রহমতের (শামিয়ানা) তাদের আচ্ছাদিত করে এবং ফিরিশতাগণ তাদের পরিবেষ্টন করে রাখেন। আর আল্লাহ তাআলা তাঁর নৈকট্যধারীদের (ফিরিশতাগণের) মাঝে তাদের স্মরণ (আলোচনা) করেন। আর যে ব্যক্তির আমল তাকে পিছিয়ে দেবে তার বংশ মর্যাদা তাকে এগিয়ে নিতে পারবে না।
باب فَضْلِ الاِجْتِمَاعِ عَلَى تِلاَوَةِ الْقُرْآنِ وَعَلَى الذِّكْرِ
حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ يَحْيَى التَّمِيمِيُّ، وَأَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ وَمُحَمَّدُ بْنُ الْعَلاَءِ الْهَمْدَانِيُّ - وَاللَّفْظُ لِيَحْيَى - قَالَ يَحْيَى أَخْبَرَنَا وَقَالَ الآخَرَانِ، حَدَّثَنَا أَبُو مُعَاوِيَةَ، عَنِ الأَعْمَشِ، عَنْ أَبِي صَالِحٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " مَنْ نَفَّسَ عَنْ مُؤْمِنٍ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ الدُّنْيَا نَفَّسَ اللَّهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَمَنْ يَسَّرَ عَلَى مُعْسِرٍ يَسَّرَ اللَّهُ عَلَيْهِ فِي الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللَّهُ فِي الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَاللَّهُ فِي عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِي عَوْنِ أَخِيهِ وَمَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللَّهُ لَهُ بِهِ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِي بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللَّهِ يَتْلُونَ كِتَابَ اللَّهِ وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ إِلاَّ نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلاَئِكَةُ وَذَكَرَهُمُ اللَّهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ وَمَنْ بَطَّأَ بِهِ عَمَلُهُ لَمْ يُسْرِعْ بِهِ نَسَبُهُ " .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক হাদীছ। এতে ইলমের মর্যাদা, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আমলের ফযীলত, আমলে সচেষ্ট থাকার প্রয়োজনীয়তা এবং কুরআন মাজীদের তিলাওয়াত ও পঠন-পাঠনের মাহাত্ম্য তুলে ধরা হয়েছে। জীবনগঠনের লক্ষ্যে এ হাদীছটি প্রত্যেক মুমিনের জন্য মাইলফলকের কাজ করতে পারে। আমাদের উচিত অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এটি পড়া ও হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করা। আমরা একটি একটি করে এতে বর্ণিত বিষয়গুলোর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।
মুমিন ব্যক্তির কষ্ট নিরসন করার ফযীলত
বলা হয়েছে- من نفس عن مؤمن كربة (যে ব্যক্তি কোনও মুমিনের একটি কষ্ট দূর করে দেয়)। نفس শব্দটির উৎপত্তি تنفيس থেকে। এর অর্থ অপসারণ করা, শিথিল করা, ফাঁক করা ইত্যাদি। تنفيس -এর উৎপত্তি نفس থেকে, যার অর্থ নিঃশ্বাস, দম ও প্রাণ। বলা হয়, نفس الخناق (গলার বাঁধন শিথিল করল), যাতে নিঃশ্বাস গ্রহণ করতে পারে।
كربة অর্থ এমন দুঃখ-কষ্ট, যা মানুষের হৃদয়মন আচ্ছন্ন করে এবং তাকে এমনভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে, যদ্দরুন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এককথায় শ্বাসরুদ্ধকর কষ্ট।
হাদীছে বোঝানো হচ্ছে, কোনও কোনও দুঃখ-কষ্ট এমন তীব্র হয়ে থাকে, যদ্দরুন মানুষের দম বন্ধ হয়ে আসে। তার সে কষ্ট লাঘব করার দ্বারা যেন গলার বাঁধন শিথিল করা হয়। ফলে সে স্বচ্ছন্দে নিঃশ্বাস গ্রহণ করতে পারে। তো কারও এরকম দম বন্ধ করা দুঃখ-কষ্ট যে ব্যক্তি লাঘব করে দেয়, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি এমন খুশি হন যে, তিনি কিয়ামতের দিন তার একটি শ্বাসরুদ্ধকর কষ্ট দূর করে দেবেন। এ হাদীছে জানানো হয়েছে- نفس الله عنه كربة من كرب يوم القيامة (আল্লাহ তার কিয়ামত দিবসের কষ্টসমূহ হতে একটি কষ্ট দূর করে দেবেন)। এর দ্বারা অন্যের কষ্ট লাঘব করা-যে কত বড় ফযীলতের কাজ তা অনুমান করা যায়। কেননা আখেরাতের কষ্টের তুলনায় দুনিয়ার কষ্ট উল্লেখযোগ্য কিছুই নয়। মান ও পরিমাণ উভয়দিক থেকেই তা তুচ্ছ। আখেরাতের তুলনায় তার স্থায়িত্বও অনেক কম। বড়জোর মৃত্যু পর্যন্ত। তো কারও এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের এমন কষ্ট, যা কোনও দিক থেকেই আখেরাতের কষ্টের সঙ্গে তুলনীয় নয়, তা দূর করার দ্বারা পরকালীন দুর্বিষহ কোনও কষ্ট থেকে যদি মুক্তি পাওয়া যায়, তবে তা কত বড়ই না প্রাপ্তি।
আখেরাতের এ অতুলনীয় পুরস্কার অর্জন করাও বিশেষ কঠিন কিছু নয়। দুনিয়ার তুচ্ছ সম্পদের খানিকটা ব্যয় করেই এটা হাসিল হতে পারে। এমনিভাবে তা অর্জন হতে পারে নিজ ক্ষমতার বৈধ ব্যবহার, প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রয়োগ, সুপরামর্শ দান, কিছুটা শারীরিক শ্রম ব্যয়, নিজে সরাসরি বা লোকমারফত সুপারিশ করা, একটা চিঠি লিখে দেওয়া কিংবা ফোনে একটা কথা বলার দ্বারাও। অন্ততপক্ষে আল্লাহ তাআলার কাছে দুআও তো করা যেতে পারে যে, হে আল্লাহ, তুমি অমুকের কষ্ট দূর করে দাও। এসবই আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে সে মহান পুরস্কার লাভের এক কার্যকর উপায়। বিভীষিকাময় কিয়ামতের ঘোর কষ্ট থেকে নিরাপত্তা লাভের আশায় আমরা কি এ উপায় অবলম্বন করব না?
সুতরাং দুনিয়ায় কারও একটি বিপদ দূর করার দ্বারা যদি আখেরাতের একটি বিপদ দূরীভূত হয়, তবে সে প্রাপ্তি অনেক বড়। প্রত্যেক মুমিনের এটা কাম্যও বটে।
হাশর ময়দানের বিভীষিকা
দুনিয়ার কষ্ট-পেরেশানি অপেক্ষা আখেরাতের কষ্ট ও পেরেশানি-যে কত বেশি কঠিন, তা যথাযথভাবে অনুমান করাও সম্ভব নয়। কেননা এক তো জিজ্ঞাসাবাদ ও হিসাব-নিকাশ করার জন্য সমস্ত মানুষকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সামনে হাজির করা হবে। ইরশাদ হয়েছেঃ- يَوْمَ يَقُومُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ ‘যে দিন সমস্ত মানুষ রাব্বুল আলামীনের সামনে দাঁড়াবে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সামনে দাঁড়ানোটাই তো চরম কঠিন ব্যাপার।তদুপরি সেদিনকার পরিবেশ-পরিস্থিতি তো হবে অত্যন্ত বিভীষিকাময়।
এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- يجمع الله الأولين والأخرين في صعيد واحد، فيسمعهم الداعي وينفذهم البصر وتدنو الشمس منهم، فيبلغ النّاس من الغم والكرب ما لا يطيقون ولا يحتملون، فيقول الناس بعضهم لبعض : ألا ترون ما قد بلغكم؟ ألا تنظرون من يشفع لكم إلى ربكم؟ ‘আল্লাহ তাআলা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত মানুষকে একই ময়দানে একত্র করবেন। ঘোষক তার ঘোষণা তাদের সকলকেই শুনিয়ে দেবে, দৃষ্টিশক্তি তাদের সকলকে ভেদ করবে এবং সূর্য তাদের নিকটবর্তী হয়ে যাবে। ফলে মানুষের এতটা পেরেশানি ও অস্থিরতা দেখা দেবে, যা তারা সইতে পারবে না ও বরদাশত করতে সক্ষম হবে না। ফলে মানুষ একে অন্যকে বলবে, দেখছ না তোমরা কী কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছ? তোমরা কি এমন কাউকে খুঁজবে না, যে তোমাদের জন্য তোমার প্রতিপালকের কাছে সুপারিশ করবে?" হাদীছটিতে এর পরে শাফাআতের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছেঃ- يحشرون حفاة عراة غرلا، قالت: فقلت: يا رسول الله! الرجال والنساء؟ ينظر بعضهم إلى بعض؟ فقال: الأمر أشد من أن يهمهم ذلك 'নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, হাশরের ময়দানে তোমাদেরকে খালিপায়ে, বস্ত্রহীন ও নগ্ন অবস্থায় একত্র করা হবে। হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! নারী-পুরুষ সকলে? তাদের একজন অন্যজনকে দেখতে থাকবে? তিনি বললেন, সেদিনকার অবস্থা অনেক কঠিন। তাদের ওদিকে ভ্রূক্ষেপ করারই অবকাশ হবে না।
সেদিনের বিভীষিকা ও ভয়াবহতার কারণে নবী-রাসূলগণ পর্যন্ত অত্যন্ত ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বেন। তাঁরা প্রত্যেকে বলতে থাকবেন, اللهم سلم سلم 'হে আল্লাহ! রক্ষা কর, রক্ষা কর।" সেই কঠিন দুর্দিনে দুনিয়ার যেসকল আমল কাজে আসবে, তার একটি হচ্ছে অন্যের বিপদ-আপদ দূর করতে ভূমিকা রাখা, যেমনটা আলোচ্য হাদীছে বলা হয়েছে।
অভাবগ্রস্তের অভাবের কষ্ট লাঘব করার ফযীলত
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বিতীয় একটি সৎকর্মরূপে অভাবগ্রস্তের সাহায্য করার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেনঃ- ومن يسر على معسر (যে ব্যক্তি কোনও অভাবগ্রস্তের অর্থকষ্ট লাঘব করে দেয়)। معسر এর অর্থ অভাবগ্রস্ত। শব্দটির উৎপত্তি عسر থেকে। এর অর্থ কষ্ট। অর্থাভাব দ্বারা মানুষের নানারকম কষ্ট হয়ে থাকে। তাই অভাবগ্রস্তের নামই দেওয়া হয়েছে معسر ।
অভাবগ্রস্তের কষ্ট লাঘব করা যায় বিভিন্নভাবে। সে যদি কারও কাছে ঋণগ্রস্ত হয় আর সে তার ঋণ মওকুফ করে দেয়, তাতে তার কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। ঋণশোধের মেয়াদ বৃদ্ধি দ্বারাও আসানী লাভ হয়। পাওনাদারের কাছে নিজে গিয়ে বা লোক পাঠিয়ে পাওনা মওকুফ করা বা পরিশোধের মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ দ্বারাও কষ্ট লাঘবে সহযোগিতা করা হয়। যদি সরাসরি আর্থিক সহযোগিতা করা হয়, সে তো অনেক ভালো। এর প্রত্যেকটিই অনেক বড় ফযীলতের কাজ।
এ হাদীছে এর ফযীলত জানানো হয়েছে এই যে يسر الله عليه فى الدنيا والا خرة (আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার কষ্ট লাঘব করে দেবেন)। দুনিয়ায় কষ্ট লাঘব হতে পারে অর্থসংকট দূর করার দ্বারা, বিপদাপদ থেকে রক্ষা করার দ্বারা, বিভিন্ন রকম নেককাজের তাওফীক দ্বারা ইত্যাদি। আর আখেরাতের কষ্ট লাঘব হতে পারে হিসাব নিকাশ সহজ করার দ্বারা, গুনাহের শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি দেওয়ার দ্বারা, হাশরের ময়দানের বিভীষিকায় নিরাপত্তাদান দ্বারা ইত্যাদি।
দুনিয়ায় মানুষের যত দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়, তার মধ্যে অভাব-অনটনের কষ্টই সবচে' বড়। তাই কারও এ কষ্ট লাঘবের পুরস্কারকে আল্লাহ তাআলা কেবল পরকালের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ইহকাল-পরকাল উভয় জগতেই ব্যাপক করে দিয়েছেন। সুবহানাল্লাহ! এটা আল্লাহ তাআলার কত বড়ই না মেহেরবানী! একজনের অর্থকষ্ট দূর করার দ্বারা তাঁর অনুগ্রহে দুনিয়ারও ফায়দা হাসিল হয় এবং আখেরাতেরও।
দুনিয়ায় মানুষ তার বিভিন্ন রকম কষ্ট-ক্লেশ থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে নানা উপায় অবলম্বন করে থাকে। এ হাদীছ দ্বারা আমরা জানতে পারলাম অন্যের অর্থকষ্ট লাঘবে সহযোগিতা করাও কষ্ট-ক্লেশ থেকে মুক্তিলাভের একটি উপায়। আবার এর দ্বারা আখেরাতের কষ্ট থেকেও আল্লাহ তাআলা মুক্তি দান করেন, যা কিনা প্রত্যেক মুমিনের পরম কাম্য।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ জাতীয় কাজ নিজেও অনেক করেছেন এবং বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা আমাদেরকেও করতে উৎসাহ দিয়েছেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বর্ণনা করেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক পাওনাদার ও দেনাদারের বাদানুবাদ শুনতে পান। তারা উঁচু আওয়াজে কথা কাটাকাটি করছিল। একজন অন্যজনকে অনুরোধ করছিল যেন পাওনার অঙ্ক থেকে কিছুটা কমিয়ে দেয় এবং তার প্রতি একটু সদয় হয়। অন্যজন আল্লাহর নামে কসম করে বলছিল, কিছুতেই তা করব না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছে বের হয়ে আসলেন এবং বললেন أين المتألي على الله، لا يفعل المعروف؟ فقال: أنا يا رسول الله، وله أي ذلك أحب 'কই সে, যে সদয় আচরণ করবে না বলে আল্লাহর নামে কসম করছে? এ কথা শুনে সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি। সে যা চায় তাই হবে।
এক হাদীছে ইরশাদ من سره أن ينجيه الله من كرب يوم القيامة، فلينفس عن معسر أو يضع عنه “যে ব্যক্তি কামনা করে আল্লাহ তাআলা যেন কিয়ামত দিবসের কষ্ট থেকে তাকে নাজাত দান করেন, সে যেন অভাবগ্রস্তকে সুযোগ দান করে অথবা তার দেনা মওকুফ করে দেয়।
এ হাদীছটি হযরত আবূ কাতাদা রাযি. থেকে বর্ণিত। তিনি এক ব্যক্তির কাছে কিছু টাকা পেতেন। সে ছিল গরীব। টাকা দিতে না পেরে তাঁকে দেখে পালাত। একবার হযরত আবূ কাতাদা রাযি. তাকে গিয়ে ধরলেন। সে তার অর্থসংকটের কথা জানাল। তখন তিনি তাকে লক্ষ্য করে এ হাদীছটি বর্ণনা করলেন এবং তার দেনা মওকুফ করে দিলেন।
অন্য এক হাদীছে ইরশাদ من أنظر معسرا أو وضع عنه، أظله الله في ظله 'যে ব্যক্তি কোনও অভাবগ্রস্তকে অবকাশ দেয় বা তার দেনা মওকুফ করে দেয়, আল্লাহ তাআলা তাকে (হাশরের ময়দানে) নিজ (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দান করবেন।
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন كان رجل يداين الناس، فكان يقول لفتاه إذا أتيت معسرا فتجاوز عنه، لعل الله يتجاوز عنا، فلقي الله فتجاوز عنه ‘জনৈক (ব্যবসায়ী) ব্যক্তি মানুষের কাছে বাকিতে মাল বিক্রি করত। সে তার কর্মচারীকে বলত, কোনও অভাবগ্রস্তের কাছে মাল বিক্রি করলে তাকে ছাড় দিও, হয়তো এ অসিলায় আল্লাহ আমাদেরকেও ছাড় দেবেন। অতঃপর সে আল্লাহর সঙ্গে গিয়ে মিলিত হয় এবং আল্লাহ তাআলা তাকে এ কারণে মুক্তি দিয়ে দেন।
কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, আল্লাহ তাআলা তাকে সে দুনিয়ায় কী কী নেক আমল করেছে তা জিজ্ঞেস করলে কোনও উত্তর দিতে পারছিল না। বারংবার জিজ্ঞাসার পর পরিশেষে তার গরীব ভোক্তাকে ছাড় দেওয়ার কথাটি মনে পড়ল। সে এ কথাটি আল্লাহ তাআলাকে জানালে আল্লাহ তাআলা বললেন, হে বান্দা! তুমি গরীবকে ছাড় দিতে! ছাড় দেওয়ার বিষয়টা তো আমাকেই বেশি সাজে। সুতরাং তিনি তাকে আযাব না দিয়ে ছাড়পত্র দিয়ে দিলেন।
গরীব-দুঃখীর কষ্ট লাঘবে সহায়তা করাটা দুআ কবুলের পক্ষেও সহায়ক। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন من أراد أن تستجاب دعوته، وأن تكشف كربته، فليفرج عن معسر “যে ব্যক্তি কামনা করে তার দুআ কবুল হোক এবং তার পেরেশানি দূর হোক, সে যেন অভাবগ্রস্তের অভাব মোচনের চেষ্টা করে।
মুসলিম ব্যক্তির দোষত্রুটি গোপন করা
এ হাদীছে বর্ণিত আরেকটি ফযীলতপূর্ণ আমল হচ্ছে মুসলিম ব্যক্তির দোষত্রুটি গোপন করা। বলা হয়েছে (যে ব্যক্তি কোনও মুসলিম ব্যক্তিকে আড়াল করে)। মুসলিম ব্যক্তিকে আড়াল করার অর্থ হয়তো খোদ তাকেই শত্রু বা জালেম শাসক থেকে আড়াল করা, যাতে তারা তার কোনও ক্ষতি করতে না পারে। অথবা এর অর্থ তার দোষত্রুটি গোপন করা। যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে পাপকর্ম করে না সে যদি গোপনে এমন কোনও অপরাধ করে বসে, যা অন্যের জন্য ক্ষতিকারক নয়, তবে কেউ কোনওভাবে তা জেনে ফেললে তার উচিত নিজের মধ্যেই তা রেখে দেওয়া, অন্যের কাছে প্রকাশ না করা। অন্যের দোষ গোপন করা আল্লাহ তাআলার গুণ। তিনি সাত্তারুল উয়ুব- দোষ গোপনকারী। তাঁর আশেক বান্দার কর্তব্য এ গুণে গুণান্বিত হওয়া। তাতে আল্লাহ তার প্রতি খুশি হবেন এবং তার প্রতিও তিনি অনুরূপ আচরণ করবেন।
সুতরাং এ হাদীছে জানানো হচ্ছে- ستره الله فى الدنيا والاخرة (আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখেরাতে তাকে আড়াল করবেন)। অর্থাৎ দুনিয়ায়ও তার দোষ প্রকাশ করে মানুষের সামনে অপদস্থ করবেন না এবং আখেরাতেও তার পাপসমূহ জাহির করে কুল মাখলুকের সামনে তাকে হেয় করবেন না; বরং নিষ্পাপ ব্যক্তির মত জাহান্নাম থেকে রেহাই দিয়ে জান্নাতের বাসিন্দা বানিয়ে দেবেন।
আল্লাহর বান্দাদের সাহায্য-সহযোগিতা করে যাওয়া
এ হাদীছে বর্ণিত চতুর্থ ফযীলতপূর্ণ আমল হল আল্লাহর বান্দাদের সাহায্য সহযোগিতা করে যাওয়া। হাদীছে এ আমলটিকে সাধারণভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে, বিশেষ কোনও ক্ষেত্রের সাহায্যের কথা বলা হয়নি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- والله فى عون العبد ما كان العبد في عون أخيه (বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সাহায্যে লেগে থাকে, আল্লাহ ততক্ষণ তার সাহায্য করতে থাকেন)। মানুষের সাহায্য প্রয়োজন হয় যেমন দীনী বিষয়ে, তেমনি প্রয়োজন হয় দুনিয়াবী বিষয়েও।মানুষের কখনও অর্থ-সাহায্যের প্রয়োজন হয়, কখনও অন্ন, বস্ত্র বা বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রয়োজন হয়, কখনও দরকার পড়ে চিকিৎসা-সহযোগিতার, কখনও বিপদাপদ থেকে উদ্ধারের। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অগ্নিকাণ্ড প্রভৃতি দুর্যোগে উদ্ধার সহযোগিতা ও ত্রাণ বিতরণের প্রয়োজন হয়। দুস্থ, প্রতিবন্ধী, বেকার এবং এ জাতীয় অন্যান্য অসহায় লোকদের প্রয়োজন কর্মসংস্থানসহ নানামুখী সহযোগিতা। আসলে দুনিয়ায় মানুষের প্রয়োজন বিচিত্র ও বহুমুখী। একেকজনের একেকরকম ঠ্যাকা। এর তালিকা অনেক দীর্ঘ। জীবনচলার ক্ষেত্রে যার যা প্রয়োজন তা পূরণ করার সামর্থ্য যার আছে তার উচিত আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে সে প্রয়োজন পূরণে নিজের সে সামর্থ্য ব্যয় করা। যে ব্যক্তি তা করবে এবং যতদিন করবে, ততদিন সে আল্লাহর পক্ষ হতেও সাহায্য পেতে থাকবে, যেমনটা এ হাদীছে বলা হয়েছে।
কারও প্রয়োজন দীনী বিষয়ে সাহায্যের। আমলোকের দরকার বিভিন্ন দীনী বিষয়ে নির্দেশনার। যে ব্যক্তি কুরআন পড়তে জানে না তাকে কুরআনপাঠ শেখানো, যে ব্যক্তি ওযূ-গোসল, নামায-রোয়া প্রভৃতি দীনী জরুরি মাসাইল জানে না তাকে এসব বিষয়ক মাসাইল শেখানো, যার আকীদা-বিশ্বাস দুরস্ত নয় তাকে বিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাস শেখানো, যে ব্যক্তি হালাল-হারামের পার্থক্য সম্পর্কে খবর রাখে না তাকে এ সম্পর্কে অবহিত করা ইত্যাদি সবই দীনী সাহায্যের অন্তর্ভুক্ত। অনেক সময় মানুষ এমন জটিল মাসআলার সম্মুখীন হয়ে পড়ে, যার সমাধান ছাড়া তার পার্থিব জীবন অচল হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে সঠিক সমাধানদান যেমন দীনী সাহায্য, তেমনি তা দুনিয়াবী সাহায্যও বটে।
মানুষের সাহায্য করা যায় মনের শুভেচ্ছা ও নেক দুআ দ্বারা, সাহায্য করা যায় শারীরিক সক্ষমতা দ্বারা, সাহায্য করা যায় বিদ্যা-বুদ্ধি দ্বারা এবং সাহায্য করা যায় অর্থব্যয় দ্বারাও। আবার অনেক সময় পদমর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তি ইত্যাদির বৈধ ব্যবহার দ্বারাও মানুষের অনেক বড় সাহায্য করা যায়। সুপরামর্শ ও সুপারিশও সাহায্যের এক বড় উপায়। মোটকথা যার পক্ষে যেভাবে কারও সাহায্য করা সম্ভব, তার উচিত সেভাবেই তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ানো। এটা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত। দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহ তাআলার সাহায্য লাভার্থে তিনি আমাদেরকে বিভিন্নভাবে এর প্রতি উৎসাহিত করেছেন। তিনি নিজে তো জীবনভরই এ কাজে আন্তরিক থেকেছেন।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বিষয়ক ঘটনা আছে বহু। একটা ঘটনা উল্লেখ করা যাচ্ছে।
একটি ঘটনা
হিজরতের আগের কথা। একদিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে বসা । তাঁর সঙ্গে কয়েকজন সাহাবীও আছেন। এ অবস্থায় 'যুবায়দ' গোত্রীয় এক ব্যক্তি এগিয়ে আসল। সে বলছিল, 'হে কুরায়শ সম্প্রদায়! কিভাবে তোমাদের কাছে পণ্য নিয়ে আসা হবে? কিভাবে কোনও ব্যবসায়ী তোমাদের আঙিনায় আসবে? কেউ তোমাদের এলাকায় আসলে তোমরা তাদের প্রতি জুলুম কর'। সে এসব কথা বলছিল আর লোকজনের একেক জটলার সামনে দাঁড়াচ্ছিল। পরিশেষে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে পৌছল। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কে তোমার প্রতি জুলুম করেছে?
সে জানাল যে, সে তার শ্রেষ্ঠ তিনটি উট নিয়ে এখানে এসেছিল। কিন্তু আবূ জাহল দাম-দর করতে গিয়ে উটগুলোর দাম বলল তার প্রকৃত মূল্যের মাত্র তিনভাগের এক ভাগ। আবূ জাহল এ দাম বলার কারণে আর কেউ তার উপর দিয়ে দাম বলল না। তারপর সে বলল, আবূ জাহল আমার পণ্য অচল করে দিয়েছে। সে এভাবে আমার উপর জুলুম করেছে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার উটগুলো কোথায়?
সে জায়গার নাম বলল।
তিনি উঠে সেখানে গেলেন। সঙ্গে সাহাবীগণও। তিনি দেখলেন, খুবই উঁচু মানের উট। তারপর তিনি যুবায়দী লোকটিকে সেটির দাম বললেন। একপর্যায়ে তিনি তার কাঙ্ক্ষিত দামে উপনীত হলেন। লোকটি উপযুক্ত দাম পেয়ে তাঁর কাছে সেগুলো বিক্রি করে দিল। তিনি তা থেকে দুটি উট ওই দামেই বিক্রি করে দিলেন। একটি বিক্রি করলেন আরও বেশি দামে। তিনি সেটির মূল্য আব্দুল মুত্তালিবের আওলাদের মধ্যকার বিধবাদের মধ্যে বিতরণ করে দিলেন।
আবূ জাহল বাজারের এক প্রান্তে বসা ছিল। সে সবকিছু দেখছিল, কিন্তু কোনও কথা বলছিল না। শেষে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাছে এগিয়ে গেলেন। তিনি তাকে লক্ষ্য করে বললেন
হে আমর্ (এটা আবূ জাহলের আসল নাম)! সাবধান, এই বেদুঈনের সঙ্গে যা আচরণ করলে ভবিষ্যতে আর কারও সঙ্গে এমন করো না যেন। করলে কিন্তু আমার পক্ষ থেকে যে ব্যবহার পাবে তা তোমার প্রীতিকর বোধ হবে না।
উত্তরে আবূ জাহল বলছিল, হে মুহাম্মাদ! আর কখনও করব না। হে মুহাম্মাদ! আর কখনও করব না।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরে আসলেন।
ওদিকে উমাইয়া ইবনে খালাফ এবং উপস্থিত অন্যান্য লোকজন অবাক বিস্ময়ে এ দৃশ্য লক্ষ করছিল। শেষে তারা আবূ জাহলকে লক্ষ্য করে বলল, আপনি আজ মুহাম্মাদের হাতে বড় অপদস্থ হলেন। তবে কি আপনি তার অনুসরণ করবেন বলে মনস্থ করেছেন? নাকি কোনও কারণে তাকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন?
আবূ জাহল বলল, আমি জীবনেও তার অনুসরণ করব না। বাকি তোমরা যে দৃশ্য দেখেছ তার কারণ, আমার চোখ এমনকিছু দেখেছে যা তোমরা দেখনি। আমি দেখলাম, তার ডানে ও বামে বর্শাধারী কিছু লোক। তারা সেগুলো আমার দিকে তাক করে আছে। আমি তার অবাধ্য হলে সেই বর্শা দিয়ে তারা আমাকে গেঁথে ফেলত।
মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন সমাধা করা
من كان في حاجة أخيه كان الله في حاجته 'যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন সমাধায় রত থাকে, আল্লাহ তার প্রয়োজন সমাধা করতে থাকেন। অর্থাৎ কোনও মুসলিম ভাইয়ের কোনওরকম প্রয়োজন দেখা দিলে যার পক্ষে সে প্রয়োজন সমাধা করা সম্ভব, তার কর্তব্য তা সমাধা করে দেওয়া। যে ব্যক্তি তা সমাধা করে দেবে, তার প্রয়োজনও আল্লাহ তাআলা সমাধা করে দেবেন। অপর এক বর্ণনায় আছেঃ- والله في عون العبد ما كان العبد في عون أخيه ‘আল্লাহ বান্দার সাহায্য করতে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে রত থাকে। এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনঃ- هَلْ جَزَاءُ الْإِحْسَانِ إِلَّا الْإِحْسَانُ ‘উত্তম কাজের প্রতিদান উত্তম ছাড়া আর কী হতে পারে?
অর্থাৎ যারা আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দয়া ও ইহসানের আচরণ করবে, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেও তারা দয়ার আচরণ লাভ করবে। দুনিয়ার মানুষের প্রয়োজন নানারকম।
কারও প্রয়োজন খাদ্যের, কারও কাপড়ের, কারও বাসস্থানের, কারও চিকিৎসার, কারও সুপরামর্শের, কারও ভার লাঘবের, কারও বিবাহের, এমনিভাবে পৃথিবীতে মানুষকে নানারকম প্রয়োজনের সম্মুখীন হতে হয়। যার পক্ষে তার মুসলিম ভাইয়ের এসব প্রয়োজনের কোনওটি পূরণ করা সম্ভব, তা পূরণ করা তার অবশ্যকর্তব্য।
এ হাদীছ দ্বারা তো জানা গেল তার সে প্রয়োজন পূরণ করলে তার নিজের প্রয়োজনও আল্লাহ তাআলা পূরণ করে দেবেন। এটা নিজ প্রয়োজন সমাধারও এক উত্তম ব্যবস্থা। দুনিয়ায় মানুষের কোনও না কোনও প্রয়োজন থাকেই। অনেক সময় দেখা যায় এমন কোনও প্রয়োজন সামনে এসে পড়ে, যা হাজারও চেষ্টা সত্ত্বেও পূরণ করা সম্ভব হয় না। এরূপ ক্ষেত্রে তা সমাধার একটা ভালো উপায় এইও হতে পারে যে, অন্য কোনও ব্যক্তির যে প্রয়োজন আমার পক্ষে পূরণ করা সম্ভব আমি তা পূরণ করে দেব। অসম্ভব নয় তাতে খুশি হয়ে আল্লাহ তাআলাও আমার সে কঠিন প্রয়োজনটি অতি সহজেই পূরণ করে দেবেন। সবচে' বড় কথা এর জন্য আখেরাতের যে পুরস্কার নির্দিষ্ট আছে তা তো পাওয়া যাবেই।
হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- أيما مؤمن أطعم مؤمنا على جوع أطعمه الله يوم القيامة من ثمار الجنّة، وأيما مؤمن سقى مؤمنا على ظما سقاه الله يوم القيامة من الرحيق المختوم، وأيما مؤمن کسی مؤمنا على عري كساه الله من خضر الجنة 'যে-কোনও মুমিন কোনও ক্ষুধার্ত মুমিনকে খানা খাওয়াবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। যে-কোনও মুমিন কোনও তৃষ্ণার্ত মুমিনকে পানি পান করাবে, আল্লাহ তাআলা তাকে কিয়ামতের দিন মোহরকৃত সুপেয় শরাব পান করাবেন। যে-কোনও মুমিন কোনও বস্ত্রহীন মুমিনকে বস্ত্র দান করবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের সবুজ রেশমি পোশাক পরাবেন।
সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ শিক্ষার উপর আমল করতেন। তাঁরা খুঁজে বেড়াতেন কোথায় কোন্ মুসলিমের কী প্রয়োজন আছে। নিজ সাধ্য অনুযায়ী তার সে প্রয়োজন পূরণের চেষ্টা করতেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. মহল্লার কোনও বাড়ির পুরুষ লোক অনুপস্থিত থাকলে তাদের ছাগলের দুধ দোহন করে দিতেন। এটা সেকালের একটা প্রয়োজন ছিল। কেননা তখনকার রেওয়াজ অনুযায়ী মহিলাগণ দুধ দোহন করত না। ফলে বাড়িতে পুরুষ লোক অনুপস্থিত থাকলে তারা সমস্যায় পড়ে যেত।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ও হযরত উমর ফারূক রাযি.-এর মানবসেবা
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. নিয়মিতই তাদের এ প্রয়োজন পূরণ করতেন। তিনি খলিফা হওয়ার পর এক নারী মন্তব্য করেছিল, এখন তো আর তিনি আমাদের ছাগলের দুধ দুইয়ে দেবেন না। এ কথা তাঁর কানে পৌঁছে গেল। তিনি বললেন, অবশ্যই, আমি আশা করি যে দায়িত্ব আমার কাঁধে চেপেছে তা আমার আগেকার অভ্যাস বদলাতে পারবে না।
হযরত উমর রাযি.-ও রাতের বেলা ঘুরে ঘুরে বিধবা মহিলাদের বাড়িতে পানি পৌছিয়ে দিতেন। এ সম্পর্কে একটা চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি রাতের বেলা নিয়মিতই এক বিধবার বাড়িতে যেতেন। তাঁর এ আসা-যাওয়াটা হযরত তালহা রাযি.-এর চোখে পড়ে যায়। কী ঘটনা? তাঁর জানার কৌতূহল হল। তিনি একদিন সেই মহিলার বাড়িতে গেলেন। গিয়ে দেখেন এক অন্ধ ও অচল বৃদ্ধা। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ওই যে লোকটি রাতের বেলা আপনার কাছে এসে থাকে, সে কী করে? বৃদ্ধা বলল, সে এত-এত দিন যাবৎ এসে আমার খোঁজ-খবর নেয় এবং আমার প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করে দেয়। এ কথা শুনে হযরত তালহা রাযি. স্তম্ভিত। তিনি নিজেকে তিরস্কার করে বললেন, রে তালহা! তুই মরে যা না! উমরের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়াচ্ছিস?
সাহাবায়ে কেরাম, তাবি'ঈন, সালাফে সালিহীন ও বুযুর্গানে দীনের এ জাতীয় হাজারও ঘটনা আছে। অন্যের প্রয়োজন পূরণকে তারা অনেক বড় পুণ্যের কাজ মনে করতেন। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকেও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণের তাওফীক দিন।
অন্যের মুখে হাসি ফোটানো
মানুষের প্রয়োজন বড় বিচিত্র। এক ব্যক্তির কোনও অভাব-অনটন নেই, কিন্তু বিশেষ কোনও কারণে সে মনোকষ্টে ভুগছে। তার মলিন মুখের দিকে তাকালে মনের কষ্ট অনুভব করা যায়। এই ব্যক্তির প্রয়োজন কষ্টের কারণটি দূর করে তার মুখে হাসি ফোটানো। নিঃসন্দেহে অন্যের মনে আনন্দদানও একটি বড় নেকীর কাজ। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছেঃ- إن أحب الأعمال إلى الله بعد الفرائض إدخال السرور على المسلم ‘ফরয আমলসমূহের পর আল্লাহ কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় আমল হচ্ছে মুসলিম ব্যক্তিকে আনন্দ দান করা।
আরেক হাদীছে ইরশাদ হয়েছেঃ- إن من موجبات المغفرة إدخال السرور على أخيك المسلم 'যেসকল কারণে আল্লাহ তাআলার কাছে মাগফিরাত লাভ হয়, তার একটি হচ্ছে মুসলিম ভাইকে আনন্দ দান করা।
অপরকে আনন্দদানের জন্য ইসলাম পরিমিত রসিকতাকেও জায়েয করেছে। এর একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত হচ্ছে পোষা পাখি মারা যাওয়ায় বিষণ্ণ বালক আবূ উমায়রকে লক্ষ্য করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হালকা রসিকতা। হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি.-এর বালক পুত্র আবূ উমায়রের একটি পোষা পাখি ছিল। সেটির নাম ছিল নুগায়র। আবূ উমায়র সেটি নিয়ে সময় কাটাত। অকস্মাৎ তার সে পাখিটি মারা গেল। তাতে আবূ উমায়র ভীষণ দুঃখ পেল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায়ই তাদের বাড়ি আসতেন এবং আবূ উমায়রকে খুব আদর করতেন। আবূ উমায়রও তাঁকে পেলে বেশ আনন্দিত হত। এবার তিনি এসে দেখেন আবূ উমায়র কেমন বিষণ্ণ, মুখে হাসি নেই। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন তার পাখিটি মারা গেছে। সুতরাং তিনি তার দুঃখ ভোলানোর জন্য ছড়া গেয়ে উঠলেন
يا أبا عمير
ما فعل النغير؟
“ওহে আবূ উমায়ের!
কোথা গেল নুগায়ের?
ইলম অন্বেষণের ফযীলত
এ হাদীছে বর্ণিত পঞ্চম ফযীলতপূর্ণ আমল হল ইলম অন্বেষণ করা। বলা হয়েছে من سلك طريقا يلتمس فيه علما (যে ব্যক্তি ইলমের সন্ধানে কোনও পথে চলে)। বলাবাহুল্য এর দ্বারা ইলমে দীনের সন্ধান বোঝানোই উদ্দেশ্য, তা সরাসরি কুরআন ও হাদীছ শিক্ষা করা হোক বা কুরআন ও হাদীছ থেকে উদ্ভাবিত ইলম হোক। যেমন ফিক্হ, উসূলুল ফিক্হ, উসূলুল হাদীছ, তাফসীর, উসূলুত তাফসীর ইত্যাদি। এমনিভাবে এসব ইলম অর্জনের জন্য যেসকল বুনিয়াদী শাস্ত্রের প্রয়োজন হয়, তা হাসিলের প্রচেষ্টাও এর অন্তর্ভুক্ত হবে। যেমন নাহব, সরফ, লুগাত, বালাগাত, গণিত ইত্যাদি।
ইলমের সন্ধানে পথচলা দুভাবে হয়। এক হচ্ছে বাহ্যিক চলা। অর্থাৎ ঘর থেকে বের হয়ে এমন কোনও ব্যক্তি বা এমন কোনও প্রতিষ্ঠানে চলে যাওয়া, যেখানে ইলমের চর্চা হয়ে থাকে। আরেক হচ্ছে অভ্যন্তরীণ বা বিমূর্ত চলা। অর্থাৎ কুরআন, হাদীছ, মাসআলা-মাসাইল ইত্যাদি মুখস্থ করা, পর্যায়ক্রমিকভাবে এ বিষয়ক কিতাব ও বই-পুস্তক পাঠ করা, তা বোঝার চেষ্টা করা এবং গভীরে পৌঁছানোর জন্য চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করা। ইলম হাসিলের জন্য উভয় প্রকার চলাই জরুরি। এর জন্য প্রয়োজনে দূর-দূরান্তে সফর করা এবং উলামা-মাশায়েখের মজলিস ও দীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বছরের পর বছর কাটাতে পারা অতি বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার।
ইলমের জন্য বিস্ময়কর সফর ও কষ্ট-ক্লেশের কিছু দৃষ্টান্ত
সাহাবায়ে কেরাম থেকে নিয়ে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত যুগে যুগে জ্ঞানপিপাসুগণ যেসব বিস্ময়কর ইলমী সফর করেছেন, ইলমের প্রকৃত সন্ধানীর পক্ষে তা গভীর প্রেরণাদায়ী।
হযরত জাবির রাযি. 'কিসাস' সম্পর্কিত একটি হাদীছ জানার জন্য মদীনা মুনাউওয়ারা থেকে মিশর সফর করেছিলেন। আরেকবার তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উনাইস রাযি.-এর নিকট থেকে কিয়ামতের বিভীষিকা সম্পর্কিত একটি হাদীছ জানার জন্য মদীনা মুনাউওয়ারা থেকে এক মাসের সফর করে শামে পৌঁছেছিলেন।
হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাযি. ও হযরত উকবা ইবন আমির রাযি.-এর কাছে সুদূর মিশরে সফর করেছিলেন মানুষের দোষ গোপন করা সম্পর্কিত একটি হাদীছের জন্য।
মাত্র একটি হাদীছের তাহকীক করার জন্য ইমাম শু'বা বসরা থেকে মক্কায়, সেখান থেকে মদীনায় আবার সেখান থেকে বসরায় একটানা সফর করেছেন। বিখ্যাত তাবি'ঈ হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব রহ. বলেন, আমি একটামাত্র হাদীছ শেখার জন্য দিনের পর দিন ও রাতের পর রাত একটানা সফর করেছি।
আব্দুর রহমান ইবন কাসিম রহ. মিশর থেকে মদীনা মুনাউওয়ারায় এসে একাধারে ১৭ বছর ইমাম মালিক রহ.-এর কাছে ইলম শিক্ষায় রত থেকেছেন। ইমাম আবূ আব্দুল্লাহ ইবন মান্দা রহ. হিজরী ৩১০ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৩৯৫ সালে ইন্তিকাল করেন। এ ৮৫ বছর জীবনকালের ৪৫ বছরই তিনি সফরে সফরে কাটিয়েছেন। এ সুদীর্ঘ সফরের উদ্দেশ্য ছিল কেবলই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছ সংগ্রহ করা। বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে তিনি প্রায় ১৭০০মুহাদ্দিছ থেকে হাদীছের শিক্ষা গ্রহণ করেছেন।
ইমাম আবূ সা'দ সাম'আনী রহ. হাদীছ সংগ্রহের জন্য বহু নগর-বন্দর সফর করেছেন। আরব, অনারব ও পূব-পশ্চিমের প্রায় একশ' নগরে তিনি যাতায়াত করেছেন। এতে তাঁর সময় লেগেছিল আনুমানিক ২০ বছর।
ইমাম বাকী' ইবন মাখলাদ রহ. দু-দু'বার পায়ে হেঁটে সুদূর আন্দালুসিয়া থেকে মক্কা, মদীনা, শাম, ইরাক প্রভৃতি অঞ্চল সফর করেছেন। প্রথমবার সফরে ১৪ বছর এবং দ্বিতীয় সফরে ২০ বছর সময়কাল ব্যয় হয়েছে। এ অবর্ণনীয় কষ্ট-ক্লেশ তিনি স্বীকার করেছেন কেবলই ইলমে দীন শেখার উদ্দেশ্যে।
ইমাম আবূ হাতিম রাযী রহ. ইলমে দীন শেখার লক্ষ্যে সফর করেছেন শত শত মাইল। তিনি বলেন, আমি পায়ে হেঁটে যে পথ অতিক্রম করেছি, প্রথমদিকে তা গুণে রাখতাম। যখন তা ১০০০ ফারসাথ অতিক্রম করল তখন গণা বাদ দিয়েছি। উল্লেখ্য, এক ফারসাথ সমান ৫ কিলোমিটার। তার মানে তিনি ৫০০০ কিলোমিটারেরও অনেক বেশি পথ পায়ে হেঁটে হেঁটে পাড়ি দিয়েছেন। ভাবা যায়, ইলমে দীন শেখার কী অদম্য উৎসাহ তিনি তাঁর অন্তরে লালন করতেন!
ইলমে দীন চর্চার ইতিহাসে এরকম ঘটনা আছে শত শত। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবি'ঈন থেকে শুরু করে পরবর্তী শত শত বছর আমাদের উলামায়ে কেরাম হাদীছ, ফিক্হ প্রভৃতি শাস্ত্র সংগ্রহের লক্ষ্যে এরকম বহু রোমাঞ্চকর পরিভ্রমণ করেছেন। সেসব সফরে তারা সহ্য করেছেন অবর্ণনীয় কষ্ট-ক্লেশ। তারা মসজিদকে বানিয়ে নিয়েছিলেন থাকার জায়গা। বিশ্রামের জন্য বালিশের পরিবর্তে মসজিদের খুঁটিই ছিল তাদের অবলম্বন। তাদের বিছানা ছিল মসজিদের চাটাই। তাদের খাদ্য ছিল হাদীছ, ফিক্হ প্রভৃতি শাস্ত্রের লিখন ও মুখস্থকরণ। তাদের গল্প ছিল পারস্পরিক জ্ঞানবিনিময়। তাদের বিনোদন ছিল ইলমের লেনাদেনা। তাদের সুগন্ধি ছিল লেখার কালি। রাতের পর রাত তারা জেগে কাটাতেন। রাত জাগাটাই যেন ছিল তাদের ঘুম। আরামের সঙ্গে তাদের পরিচয় ছিল না। মাথা থাকত আলুথালু, কাপড় ছেঁড়াফাঁড়া, উদর অভুক্ত, ঠোঁট শুকনো, রং বিবর্ণ, শরীর জরাজীর্ণ। কিন্তু এসবের প্রতি তাদের ভ্রুক্ষেপ ছিল না। তাদের ছিল একই লক্ষ্য- ইলমে দীনের সংগ্রহ। এর জন্য তারা বিসর্জন দিয়েছেন সবকিছু। পিতামাতা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন, পুত্র-কন্যা, স্ত্রী ও অন্যান্য সকল প্রিয়জনের স্নেহ-মমতা ত্যাগ করে দূর-দূরান্তের সফর করেছেন। বছরের পর বছর মাতৃভূমি থেকে দূরে থেকেছেন। সে থাকাটাও ছিল অকল্পনীয় ও অবর্ণনীয় কষ্ট-ক্লেশের সঙ্গে। তাদের সে ত্যাগ-তিতিক্ষারই সুফল যে, আজ আমরা অতি আসানের সঙ্গে কুরআন-সুন্নাহ'র সংরক্ষিত, সুবিন্যস্ত ও বিশুদ্ধ ইলম হাসিল করতে পারছি।
বস্তুত ইলমের জন্য ঘর থেকে বের হওয়া এবং উলামা-মাশায়েখের মজলিসে ছোটাছুটি করা অতীব জরুরি। ঘরে বসে বসে কিতাবাদি পড়ার দ্বারাই এ মহামূল্যবান সম্পদ অর্জন করা যায় না। এ এমনই এক সম্পদ, যা দ্বারা আল্লাহকে চেনা যায়, তাঁর মর্জি ও খুশি-নাখুশির বিষয়ে অবহিত হওয়া যায়, হালাল-হারাম সম্পর্কে ধারণা লাভ হয়, কোন্ পথ জান্নাতের ও কোন পথ জাহান্নামের তা উপলব্ধি হয়, এর দ্বারাই মন্দ আখলাক পরিহার করে সচ্চরিত্র অর্জনের উপায় অবলম্বন করা যায়, জানা যায় নিজের হক, আত্মীয়ের হক, প্রতিবেশীর হক, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের হক এমনকি পশু-পাখিরও হক, পরিচিত হওয়া যায় জীবনের সকল ক্ষেত্রে নিজ দায়িত্ব কর্তব্যের সঙ্গে, এরই দ্বারা ঘটানো যায় মনুষ্যত্বের বিকাশ, এরই সঙ্গে সম্পৃক্ত দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণ, এরই মাধ্যমে রক্ষা পাওয়া যায় উভয় জাহানের সমূহ অকল্যাণ থেকে, এটা চোখের জ্যোতি, অন্তর্দৃষ্টির আলো, প্রাণের শান্তি, মন ও মননের খোরাক, এটা প্রকাশ্য ও গুপ্ত শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র, হক ও বাতিলের মীমাংসা, এর মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপন করা যায় আল্লাহর সঙ্গে, নিজেকে পরিণত করা যায় তাঁর মাহবূব বান্দায় এবং এ এক অবিনশ্বর সম্পদ, যা নশ্বর জগতের সীমানা ভেদ করে অনন্ত আখেরাতেও পৌঁছে যায়। এর জন্য সারাটা জীবনও যদি সফরে সফরে কাটিয়ে দেওয়া হয় এবং দুনিয়ায় উদয়াচল থেকে অস্তাচল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ জগতকে বিচরণভূমি বানিয়ে নেওয়া হয়, তাও এর মহামূল্যের বিপরীতে নিতান্ত তুচ্ছই গণ্য হবে।
যাহোক ইলমের জন্য সফর করা ও গভীর অভিনিবেশের সাথে চিন্তাভাবনায় লিপ্ত থাকা অত্যন্ত ফযীলতের কাজ। এ মেহনতের বদৌলতে জান্নাত লাভের পথ সহজ ও সুগম হয়ে যায়। যেমন এ হাদীছের পরবর্তী বাক্যে ইরশাদ হয়েছে سهل الله له طريقا الى الجنة (আল্লাহ তার জন্য জান্নাতগামী পথ সুগম করে দেন)। অর্থাৎ ইলমের সন্ধান ও তা অর্জনের পুরস্কারস্বরূপ তার জন্য জান্নাতে প্রবেশ সহজ করে দেন। ফলে সে হাশরের ময়দানের বিভীষিকা দেখতে পাবে না, যেমনটা অন্যরা দেখতে পাবে। সে নির্বিঘ্নে নিরাপদে জান্নাতে পৌঁছে যাবে। নিঃসন্দেহে এটা অনেক বড় পুরস্কার। এতবড় পুরস্কার প্রাপ্তির কারণ ইলমে দীন শেখার কাজটি অনেক কঠিন। এর জন্য প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। সবরের কষ্ট ছাড়াও থাকার কষ্ট ও খানাপিনার কষ্ট বরদাশত করতে হয়। ঘুম ও আরামের ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। বেছে নিতে হয় আত্মীয়-স্বজন ও প্রিয়জন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুনিয়ার হাজারও ভোগ-উপভোগ বিবর্জিত এক কঠিন তপস্যার জীবন। সে ত্যাগ-তিতিক্ষার ফলস্বরূপ আল্লাহ তাআলা তার জন্য জান্নাতে পৌঁছা সহজ করে দেন।
এটা 'যেমন কর্ম তেমন ফল' জাতীয় প্রতিদান। আল্লাহ তাআলা বান্দাকে তার আমলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ প্রতিদান দিয়ে থাকেন। যেমন এ হাদীছেই দেখা যাচ্ছে, কোনও মুমিনের কষ্ট যে দূর করে, তার প্রতিদানে আল্লাহ তার কষ্ট দূর করে দেন, যে ব্যক্তি অভাগ্রস্তের অভাব মোচন করে, আল্লাহ তার অভাব মোচন করে দেন, যে ব্যক্তি কোনও মুসলিমের দোষ গোপন করে, আল্লাহ তাআলাও তার দোষ গোপন করেন। কুরআন ও হাদীছে এর প্রচুর দৃষ্টান্ত আছে।
এর দ্বারা ইলমে দীন সন্ধানের মেহনত-যে কত মর্যাদাবান তা অনুভব করা যায়।স্বাভাবিকভাবেই এর দ্বারা ইলমে দীনের চর্চা ও প্রচার-প্রসারে লিপ্ত থাকার মর্যাদাও পরিস্ফুট হয়।
প্রকাশ থাকে যে, ইলমে দীন আহরণের এ ফযীলত কেবল তখনই লাভ হতে পারে, যখন তা ইখলাসের সঙ্গে আহরণ করা হবে অর্থাৎ কেবল আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যেই করা হবে, দুনিয়াবী কোনও স্বার্থে নয়। ইলম সন্ধানকারীকে এ বিষয়টা বিশেষভাবে স্মরণ রাখতে হবে। কেননা অন্যান্য ইবাদতের মত এ ক্ষেত্রেও রিয়া ঢুকে পড়ে; বরং রিয়ার প্রকোপ এ ক্ষেত্রে একটু বেশিই হয়। তাই ইখলাস ও সহীহ নিয়তের সাধনাও এ ক্ষেত্রে বেশি প্রয়োজন।
দলবদ্ধভাবে আল্লাহর কিতাব পঠন-পাঠনের ফযীলত
এ হাদীছে ষষ্ঠ যে ফযীলতের আমল উল্লেখ করা হয়েছে, তা হচ্ছে মসজিদে সম্মিলিতভাবে কুরআন মাজীদের চর্চা ও পঠন-পাঠন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ما اجتمع قوم في بيت من بيوت الله تعالى (কোনও লোকসমষ্টি আল্লাহর ঘরসমূহের মধ্যে কোনও একটি ঘরে একত্র হয়ে)। এখানে আল্লাহর ঘর বলে মসজিদ বোঝানো হয়েছে।
তখনকার যুগে কুরআন শিক্ষা ও ইলমে দীন চর্চার আমল মসজিদেই হত। সে এ হাদীছে বিশেষভাবে মসজিদের কথা বলা হয়েছে। মূল বিষয় যেহেতু কুরআন মাজীদের শিক্ষা ও চর্চা, কাজেই মসজিদ না হয়ে অন্য কোথাও যদি এ আমল করা হয়, তাতেও এ হাদীছে বর্ণিত ফযীলত লাভ হবে। বর্তমানকালে মসজিদের পাশাপাশি আলাদা শিক্ষালয়েও এ আমল ব্যাপকভাবে জারি আছে; বরং মসজিদ অপেক্ষা পৃথক শিক্ষাগারই এর জন্য বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মসজিদ নয় বলে সে শিক্ষাগার বা মাদরাসাসমূহের কুরআন চর্চা এ ফযীলত থেকে খারিজ হয়ে যাবে না।
অবশ্য হাদীছে ব্যবহৃত শব্দটি সরাসরিও মক্তব-মাদরাসার গৃহসমূহকে শামিল করে। হাদীছের শব্দ হচ্ছে بيت من بيوت الله (আল্লাহর ঘরসমূহের কোনও ঘর)। তার মানে যেসকল ঘরে আল্লাহর কালাম শিক্ষা দেওয়া হয়, তাঁর নাযিল করা শরীআতের চর্চা হয় এবং তাঁর মনোনীত দীনের প্রচার-প্রতিষ্ঠায় মেহনত হয়। আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পৃক্ত ও বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ আমলের কেন্দ্র হওয়ায় এসব ঘরকে 'আল্লাহর ঘর' বলা হয়ে থাকে।
যাহোক আল্লাহর কোনও ঘরে তারা কী উদ্দেশ্যে জমায়েত হয়? হাদীছের পরবর্তী অংশে জানানো হয়েছে-يتلون كتاب الله ويتدارسونه بينهم (তারা আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত এবং নিজেদের মধ্যে তার পঠন-পাঠনে মশগুল থাকে)। يتدارسون ক্রিয়াপদটি درس থেকে নির্গত। এর অর্থ পাঠ করা, বোঝা ও মুখস্থ করার উদ্দেশ্যে পড়া। অর্থ পরস্পরের মধ্যে পাঠবিনিময় করা। এর একটা সুরত তো এরকম যে, একজন কিছুটা পড়ল, তারপর অন্যজন হুবহু সেটুকুই পড়ল। এরূপ পড়ার দ্বারা পঠিত বিষয় সহজে মুখস্থ হয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযানের প্রতি রাতে হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামের সঙ্গে কুরআন মাজীদ এভাবে পড়তেন।
এর আরেক সুরত হচ্ছে উস্তাযকর্তৃক ছাত্র পড়ানো। উস্তায একটা অংশ ছাত্রকে পড়িয়ে দিল, তারপর ছাত্র নিজে নিজে তা পড়তে থাকল। তারপর আবার ছাত্র উস্তাযকে তা শোনাল। এটাও يتدارسون -এর অন্তর্ভুক্ত। এ পদ্ধতিটি যেমন কুরআন মাজীদের শব্দপাঠের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তেমনি এর অর্থ ও মর্মের জন্যও প্রযোজ্য বটে। অর্থাৎ উস্তায ছাত্রের সামনে আয়াত পড়ে তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দিল এবং ছাত্র তা মনোযোগ সহকারে শুনল। কোনও কথা বুঝে না আসলে তা জিজ্ঞেস করে নিল, আবার কোনও প্রশ্ন জাগলে তা উত্থাপন করল। অর্থাৎ যথারীতি পাঠদান ও পাঠগ্রহণ।
কুরআন মাজীদের পারস্পরিক পাঠবিনিময় ও সম্মিলিত পঠন-পাঠন অত্যন্ত বরকতময় ও ফযীলতপূর্ণ আমল। হাদীছে এর চারটি ফীলত উল্লেখ করা হয়েছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন إلا نزلت عليهم السكينة، وغشيتهم الرحمة، وحفتهم الملائكة، وذكرهم الله فيمن عنده (তাদের উপর সাকীনা নাযিল হয়, রহমত তাদেরকে ঢেকে নেয়, ফিরিশতাগণ তাদেরকে ঘিরে রাখেন এবং আল্লাহ তাঁর কাছে উপস্থিত (ফিরিশতা)-দের মধ্যে তাদের উল্লেখ করেন)। সাকীনা হচ্ছে মনের ওই স্থিরতা ও শান্ত-সমাহিত অবস্থার নাম, যা আল্লাহর যিকির ও কুরআন তিলাওয়াতের ফলে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নাযিল করা হয়। যেমন ইরশাদ হয়েছে أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ 'স্মরণ রেখ, কেবল আল্লাহর যিকিরেই অন্তরে প্রশান্তি লাভ হয়।
অন্যত্র ইরশাদ هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ السَّكِينَةَ فِي قُلُوبِ الْمُؤْمِنِينَ لِيَزْدَادُوا إِيمَانًا مَعَ إِيمَانِهِمْ “তিনিই মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি অবতীর্ণ করেছেন, যাতে তাদের ঈমানে অধিকতর ঈমান যুক্ত হয়।
সাকীনা দ্বারা ঈমানে মজবুতী আসে, যদ্দরুন পার্থিব কোনও বিপদাপদে চিত্তচাঞ্চল্য ও পেরেশানি দেখা দেয় না। মন এ বিশ্বাসে অবিচল থাকে যে, সমগ্র কায়েনাত আল্লাহর কুদরতের অধীন। সবকিছু তাঁর ইচ্ছাতেই হয়। তাঁর ইচ্ছার বাইরে কোনওকিছু ঘটা সম্ভব নয়। কাজেই অস্থির না হয়ে আল্লাহতে সমর্পিত থাকাই শ্রেয়। তাতে বিপদাপদের বিনিময়ে তিনি অভাবনীয় আজর ও ছাওয়াব দান করেন। যার অন্তরে সাকীনা থাকে, সে ওই আজর ও ছাওয়াবের আশায় যাবতীয় পরিস্থিতিতে শান্ত ও ভারমুক্ত থাকে। এমনিভাবে আল্লাহ তাআলার যাবতীয় বিধি-বিধান পালনেও সে স্থির-অবিচল থাকে। পরিবেশ-পরিস্থিতি তাকে প্রভাবিত করতে পারে না। নিন্দুকের নিন্দা ও প্রশংসাকারীর প্রশংসায় তার ভাবান্তর হয় না। সুতরাং সাকীনা আল্লাহ তাআলার এক বিরাট নিআমত। কুরআন তিলাওয়াত ও কুরআনে লিপ্ততা দ্বারা এ নিআমত অর্জিত হয়।
রহমত ঢেকে নেওয়ার অর্থ চতুর্দিক থেকে এমনভাবে বেষ্টন করে ফেলা যে, কোনও বিপদ-আপদ বা পরিবেশ-পরিস্থিতির কুপ্রভাব তাদের অন্তর স্পর্শ করতে পারে না। সব হালতে তাদের উপর আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ ও করুণা বর্ধিত হতে থাকে। ফলে শয়তানের প্ররোচনা ও নফসের ওয়াসওয়াসা তাদের অন্তরে প্রভাব ফেলতে পারে না।
ফিরিশতা তাদের পরিবেষ্টন করে রাখে। তারা রহমত ও বরকতের ফিরিশতা। আল্লাহ তাআলা একদল ফিরিশতাকে এ কাজে নিযুক্ত করে রেখেছেন। তারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়। যখনই কোথাও যিকির ও তিলাওয়াতের মজলিস দেখে, তখন তাদেরকে পরিবেষ্টন করে ফেলে। যেমন হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে إن الله ملائكة يطوفون في الطرق يلتمسون أهل الذكر، فإذا وجدوا قوما يذكرون الله تنادوا : هلموا إلى حاجتكم، قال فيحفونهم بأجنحتهم إلى السماء الدنيا “আল্লাহ তাআলার এমন একদল ফিরিশতা আছে, যারা পথে পথে ঘুরে বেড়ায় এবং যিকিরকারীদের সন্ধান করে। যখনই কোথাও লোকজনকে আল্লাহর যিকিরে মশগুল দেখতে পায়, তখন তারা একে অন্যকে ডেকে বলে, এসো, তোমরা তোমাদের কাঙ্ক্ষিত বিষয় পেয়ে গেছ। তারপর তারা তাদের ডানা বিস্তার করে প্রথম আসমান পর্যন্ত তাদেরকে ঘিরে রাখে।
অন্য এক হাদীছে ইরশাদ إن الله ملائكة سيارة فضلاء يبتغون مجالس الذكر 'আল্লাহ তাআলার একদল বাড়তি ফিরিশতা আছে, যারা সর্বদা পরিভ্রমণে থাকে এবং যিকিরের মজলিস অনুসন্ধান করে।
এটা করে তাদের সম্মানার্থে এবং তাদের যিকির ও তিলাওয়াত আসমানে পৌছানোর উদ্দেশ্যে। এভাবে তারা শয়তান থেকে যিকিরকারীদের হেফাজতও করে থাকে। তারা এমন কোনও ফাঁক রাখে না, যেখান থেকে শয়তান প্রবেশ করতে পারবে।
সম্মিলিত কুরআন চর্চা এমনই এক মর্যাদাপূর্ণ আমল যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর কাছের মাখলুকদের সামনে এ আমলকারীদের কথা উল্লেখ করে থাকেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানাচ্ছেন-وذكرهم الله فيمن عنده, (আল্লাহ তাঁর কাছে উপস্থিত (ফিরিশতা)-দের মধ্যে তাদের উল্লেখ করেন)। এর দ্বারা উদ্দেশ্য তাদের সামনে এ আমলকারীদের মর্যাদা তুলে ধরা এবং তাদের প্রতি নিজ সন্তুষ্টির কথা প্রকাশ করা। আল্লাহ তাআলা তাঁর যিকির বড় ভালোবাসেন। বান্দা যিকির করলে তিনি খুশি হন। তাঁর নিকটবর্তীদের সামনে যাকিরীনের উল্লেখ করা সে খুশিরই প্রকাশ । আল্লাহ বলেন فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ 'সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব।
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত একটি হাদীছে কুদসীতে আছে فإن ذكرني في نفسه ذكرته في نفسي، وإن ذكرني في ملأ ذكرته في ملأ خير منهم 'বান্দা যদি আমাকে নিজে নিজে স্মরণ করে, আমি তাকে নিজে নিজে স্মরণ করি। বান্দা যদি আমাকে কোনও সমাবেশের মধ্যে স্মরণ করে, তবে আমি তার সমাবেশ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট সমাবেশে (অর্থাৎ ফিরিশতাদের সমাবেশে) তাকে স্মরণ করি।
আমল করার প্রয়োজনীয়তা
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপরে বর্ণিত আমলসমূহের ফযীলত বয়ান করার পর এবার আমলের গুরুত্ব তুলে ধরছেন। বান্দাকে কেন এসব আমল করতে হবে, না করলে তার কী ক্ষতি, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি ইরশাদ করছেন- ومن بطأ به عمله لم يسرع به نسبه (যাকে তার আমল পিছিয়ে দেয়, তাকে তার বংশমর্যাদা এগিয়ে দিতে পারে না)।
এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে আল্লাহ তাআলার কাছে উচ্চমর্যাদায় উপনীত হওয়ার একমাত্র উপায় নেক আমল। আখেরাতে অগ্রগামী থাকারও অবলম্বন কেবলই সৎকর্ম। যে ব্যক্তি আমলে যতবেশি অগ্রগামী হবে, সে তত আগে মুক্তি পাবে। বংশমর্যাদা ও কৌলিন্য দ্বারা তা লাভ করা যাবে না। যে ব্যক্তি আমলে পিছিয়ে থাকবে, আখেরাতেও তাকে পিছিয়েই থাকতে হবে, তা সে নবীপুত্রই হোক না কেন কিংবা হোক কোনও নবীর পিতা। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তাআলার সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয় হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাঁর আত্মীয়-স্বজনকে এই বলে সতর্ক করেছেন যে يا بني عبد مناف، أنقذوا أنفسكم من النار، يا معشر بني هاشم، أنقذوا أنفسكم من النار، يا بني عبد المطلب، أنقذوا أنفسكم من النار، يا فاطمة بنت محمد، أنقذي نفسك من النار، فإني والله لا أملك لكم من الله شيئا 'হে আব্দে মানাফের বংশধরগণ! তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও। হে বন্ধু হাশিম সম্প্রদায়। তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও। হে আব্দুল মুত্তালিবের ছেলেমেয়েরা! তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও। হে মুহাম্মাদের মেয়ে ফাতেমা! তুমি নিজে নিজেকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও। আল্লাহর কসম, আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাতে আমি তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারব না।
বস্তুত আমল যার উন্নত, বংশীয় তুচ্ছতায় তার কোনও ক্ষতি নেই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জান্নাতে যে বিলাল রাযি.-এর পদচারণার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলেন, তিনি তো একজন হাবশী ও একদার ক্রীতদাসই ছিলেন।
জাহান্নামের উপর যে পুলসিরাত স্থাপিত থাকবে, প্রত্যেক মুমিনকেই তার উপর দিয়ে যেতে হবে। তা কেউ পার হবে হেঁটে হেঁটে, কেউ দৌড়ে, কেউ দ্রুতগামী অশ্বের গতিতে, কেউ বাতাসের বেগে, কেউ বা বিজলীর গতিতে। গতির এই যে পার্থক্য, তা আমলে প্রভেদের কারণেই হবে। দুনিয়ায় আমলে যে যত বেগবান, তার জান্নাতে যাওয়াও তেমনি সবেগেই হবে। সুতরাং কুরআন মাজীদেও আল্লাহ তাআলা আমলে গতিশীল হতে উৎসাহ দান করেছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ এবং নিজ প্রতিপালকের পক্ষ হতে মাগফিরাত ও সেই জান্নাত লাভের জন্য একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হও, যার প্রশস্ততা আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীতুল্য। তা মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
সুতরাং বংশমর্যাদা বা অন্য কোনও শ্রেষ্ঠত্বের ভরসায় আমলে অবহেলা না করে প্রত্যেকের উচিত সৎকর্মে অন্যকে ছাড়িয়ে যেতে সচেষ্ট থাকা।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. মুমিন ব্যক্তির দুঃখ-কষ্ট নিবারণের চেষ্টা আখেরাতের কষ্ট থেকে মুক্তিলাভের শ্রেষ্ঠতম একটি উপায়। তাই এ চেষ্টায় অবহেলা করা উচিত নয়।
খ. দুনিয়া ও আখেরাতের সংকট থেকে উত্তরণের একটি উপায় মানুষের অর্থসংকট দূর করার চেষ্টা। সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের প্রত্যেকেরই এ চেষ্টা করা উচিত।
গ. দুনিয়া ও আখেরাতে আপন দোষত্রুটি প্রকাশ হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচার লক্ষ্যে আমরা যেন অন্যের দোষত্রুটি গোপন রাখতে সচেষ্ট থাকি।
ঘ. সর্বদা আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্তির আশায় আমাদের কর্তব্য হবে নিয়মিতভাবে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা করে যাওয়া।
ঙ. আমরা অবশ্যই ইলমে দীন অর্জনের পথে একজন আত্মনিবেদিত পথিক হয়ে থাকব, যাতে আল্লাহ তাআলা আমাদের জান্নাতে পৌছা সহজ করে দেন।
চ. আল্লাহর ঘরে সম্মিলিতভাবে কুরআন মাজীদের তিলাওয়াত ও পঠন-পাঠনের যে চারটি ফযীলত আমরা জানতে পেরেছি, তা অর্জনের লক্ষ্যে আমরা অবশ্যই এ মূল্যবান আমলটি করে যাব।
ছ. আমরা এ হাদীছ দ্বারা জানতে পেরেছি মালাইকা বা ফিরিশতা নামে আল্লাহ তাআলার এক মাখলূক আছে, যারা আল্লাহপ্রদত্ত দায়িত্ব পালনে রত থাকে। আমাদের কর্তব্য তাদের প্রতি ঈমান রাখা।
জ. আল্লাহ তাআলার রহমতে তাঁর নৈকট্য ও আখেরাতের মুক্তি আমলের মাধ্যমেই লাভ হবে। জান্নাতে পৌছার অগ্রগামিতাও সাব্যস্ত হবে আমলের ভিত্তিতে, অন্যকিছুর ভিত্তিতে নয়। সুতরাং আমলে পিছিয়ে না থেকে অন্যদের ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাই প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা।
মুমিন ব্যক্তির কষ্ট নিরসন করার ফযীলত
বলা হয়েছে- من نفس عن مؤمن كربة (যে ব্যক্তি কোনও মুমিনের একটি কষ্ট দূর করে দেয়)। نفس শব্দটির উৎপত্তি تنفيس থেকে। এর অর্থ অপসারণ করা, শিথিল করা, ফাঁক করা ইত্যাদি। تنفيس -এর উৎপত্তি نفس থেকে, যার অর্থ নিঃশ্বাস, দম ও প্রাণ। বলা হয়, نفس الخناق (গলার বাঁধন শিথিল করল), যাতে নিঃশ্বাস গ্রহণ করতে পারে।
كربة অর্থ এমন দুঃখ-কষ্ট, যা মানুষের হৃদয়মন আচ্ছন্ন করে এবং তাকে এমনভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে, যদ্দরুন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এককথায় শ্বাসরুদ্ধকর কষ্ট।
হাদীছে বোঝানো হচ্ছে, কোনও কোনও দুঃখ-কষ্ট এমন তীব্র হয়ে থাকে, যদ্দরুন মানুষের দম বন্ধ হয়ে আসে। তার সে কষ্ট লাঘব করার দ্বারা যেন গলার বাঁধন শিথিল করা হয়। ফলে সে স্বচ্ছন্দে নিঃশ্বাস গ্রহণ করতে পারে। তো কারও এরকম দম বন্ধ করা দুঃখ-কষ্ট যে ব্যক্তি লাঘব করে দেয়, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি এমন খুশি হন যে, তিনি কিয়ামতের দিন তার একটি শ্বাসরুদ্ধকর কষ্ট দূর করে দেবেন। এ হাদীছে জানানো হয়েছে- نفس الله عنه كربة من كرب يوم القيامة (আল্লাহ তার কিয়ামত দিবসের কষ্টসমূহ হতে একটি কষ্ট দূর করে দেবেন)। এর দ্বারা অন্যের কষ্ট লাঘব করা-যে কত বড় ফযীলতের কাজ তা অনুমান করা যায়। কেননা আখেরাতের কষ্টের তুলনায় দুনিয়ার কষ্ট উল্লেখযোগ্য কিছুই নয়। মান ও পরিমাণ উভয়দিক থেকেই তা তুচ্ছ। আখেরাতের তুলনায় তার স্থায়িত্বও অনেক কম। বড়জোর মৃত্যু পর্যন্ত। তো কারও এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের এমন কষ্ট, যা কোনও দিক থেকেই আখেরাতের কষ্টের সঙ্গে তুলনীয় নয়, তা দূর করার দ্বারা পরকালীন দুর্বিষহ কোনও কষ্ট থেকে যদি মুক্তি পাওয়া যায়, তবে তা কত বড়ই না প্রাপ্তি।
আখেরাতের এ অতুলনীয় পুরস্কার অর্জন করাও বিশেষ কঠিন কিছু নয়। দুনিয়ার তুচ্ছ সম্পদের খানিকটা ব্যয় করেই এটা হাসিল হতে পারে। এমনিভাবে তা অর্জন হতে পারে নিজ ক্ষমতার বৈধ ব্যবহার, প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রয়োগ, সুপরামর্শ দান, কিছুটা শারীরিক শ্রম ব্যয়, নিজে সরাসরি বা লোকমারফত সুপারিশ করা, একটা চিঠি লিখে দেওয়া কিংবা ফোনে একটা কথা বলার দ্বারাও। অন্ততপক্ষে আল্লাহ তাআলার কাছে দুআও তো করা যেতে পারে যে, হে আল্লাহ, তুমি অমুকের কষ্ট দূর করে দাও। এসবই আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে সে মহান পুরস্কার লাভের এক কার্যকর উপায়। বিভীষিকাময় কিয়ামতের ঘোর কষ্ট থেকে নিরাপত্তা লাভের আশায় আমরা কি এ উপায় অবলম্বন করব না?
সুতরাং দুনিয়ায় কারও একটি বিপদ দূর করার দ্বারা যদি আখেরাতের একটি বিপদ দূরীভূত হয়, তবে সে প্রাপ্তি অনেক বড়। প্রত্যেক মুমিনের এটা কাম্যও বটে।
হাশর ময়দানের বিভীষিকা
দুনিয়ার কষ্ট-পেরেশানি অপেক্ষা আখেরাতের কষ্ট ও পেরেশানি-যে কত বেশি কঠিন, তা যথাযথভাবে অনুমান করাও সম্ভব নয়। কেননা এক তো জিজ্ঞাসাবাদ ও হিসাব-নিকাশ করার জন্য সমস্ত মানুষকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সামনে হাজির করা হবে। ইরশাদ হয়েছেঃ- يَوْمَ يَقُومُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ ‘যে দিন সমস্ত মানুষ রাব্বুল আলামীনের সামনে দাঁড়াবে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সামনে দাঁড়ানোটাই তো চরম কঠিন ব্যাপার।তদুপরি সেদিনকার পরিবেশ-পরিস্থিতি তো হবে অত্যন্ত বিভীষিকাময়।
এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- يجمع الله الأولين والأخرين في صعيد واحد، فيسمعهم الداعي وينفذهم البصر وتدنو الشمس منهم، فيبلغ النّاس من الغم والكرب ما لا يطيقون ولا يحتملون، فيقول الناس بعضهم لبعض : ألا ترون ما قد بلغكم؟ ألا تنظرون من يشفع لكم إلى ربكم؟ ‘আল্লাহ তাআলা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত মানুষকে একই ময়দানে একত্র করবেন। ঘোষক তার ঘোষণা তাদের সকলকেই শুনিয়ে দেবে, দৃষ্টিশক্তি তাদের সকলকে ভেদ করবে এবং সূর্য তাদের নিকটবর্তী হয়ে যাবে। ফলে মানুষের এতটা পেরেশানি ও অস্থিরতা দেখা দেবে, যা তারা সইতে পারবে না ও বরদাশত করতে সক্ষম হবে না। ফলে মানুষ একে অন্যকে বলবে, দেখছ না তোমরা কী কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছ? তোমরা কি এমন কাউকে খুঁজবে না, যে তোমাদের জন্য তোমার প্রতিপালকের কাছে সুপারিশ করবে?" হাদীছটিতে এর পরে শাফাআতের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছেঃ- يحشرون حفاة عراة غرلا، قالت: فقلت: يا رسول الله! الرجال والنساء؟ ينظر بعضهم إلى بعض؟ فقال: الأمر أشد من أن يهمهم ذلك 'নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, হাশরের ময়দানে তোমাদেরকে খালিপায়ে, বস্ত্রহীন ও নগ্ন অবস্থায় একত্র করা হবে। হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! নারী-পুরুষ সকলে? তাদের একজন অন্যজনকে দেখতে থাকবে? তিনি বললেন, সেদিনকার অবস্থা অনেক কঠিন। তাদের ওদিকে ভ্রূক্ষেপ করারই অবকাশ হবে না।
সেদিনের বিভীষিকা ও ভয়াবহতার কারণে নবী-রাসূলগণ পর্যন্ত অত্যন্ত ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বেন। তাঁরা প্রত্যেকে বলতে থাকবেন, اللهم سلم سلم 'হে আল্লাহ! রক্ষা কর, রক্ষা কর।" সেই কঠিন দুর্দিনে দুনিয়ার যেসকল আমল কাজে আসবে, তার একটি হচ্ছে অন্যের বিপদ-আপদ দূর করতে ভূমিকা রাখা, যেমনটা আলোচ্য হাদীছে বলা হয়েছে।
অভাবগ্রস্তের অভাবের কষ্ট লাঘব করার ফযীলত
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বিতীয় একটি সৎকর্মরূপে অভাবগ্রস্তের সাহায্য করার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেনঃ- ومن يسر على معسر (যে ব্যক্তি কোনও অভাবগ্রস্তের অর্থকষ্ট লাঘব করে দেয়)। معسر এর অর্থ অভাবগ্রস্ত। শব্দটির উৎপত্তি عسر থেকে। এর অর্থ কষ্ট। অর্থাভাব দ্বারা মানুষের নানারকম কষ্ট হয়ে থাকে। তাই অভাবগ্রস্তের নামই দেওয়া হয়েছে معسر ।
অভাবগ্রস্তের কষ্ট লাঘব করা যায় বিভিন্নভাবে। সে যদি কারও কাছে ঋণগ্রস্ত হয় আর সে তার ঋণ মওকুফ করে দেয়, তাতে তার কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। ঋণশোধের মেয়াদ বৃদ্ধি দ্বারাও আসানী লাভ হয়। পাওনাদারের কাছে নিজে গিয়ে বা লোক পাঠিয়ে পাওনা মওকুফ করা বা পরিশোধের মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ দ্বারাও কষ্ট লাঘবে সহযোগিতা করা হয়। যদি সরাসরি আর্থিক সহযোগিতা করা হয়, সে তো অনেক ভালো। এর প্রত্যেকটিই অনেক বড় ফযীলতের কাজ।
এ হাদীছে এর ফযীলত জানানো হয়েছে এই যে يسر الله عليه فى الدنيا والا خرة (আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার কষ্ট লাঘব করে দেবেন)। দুনিয়ায় কষ্ট লাঘব হতে পারে অর্থসংকট দূর করার দ্বারা, বিপদাপদ থেকে রক্ষা করার দ্বারা, বিভিন্ন রকম নেককাজের তাওফীক দ্বারা ইত্যাদি। আর আখেরাতের কষ্ট লাঘব হতে পারে হিসাব নিকাশ সহজ করার দ্বারা, গুনাহের শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি দেওয়ার দ্বারা, হাশরের ময়দানের বিভীষিকায় নিরাপত্তাদান দ্বারা ইত্যাদি।
দুনিয়ায় মানুষের যত দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়, তার মধ্যে অভাব-অনটনের কষ্টই সবচে' বড়। তাই কারও এ কষ্ট লাঘবের পুরস্কারকে আল্লাহ তাআলা কেবল পরকালের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ইহকাল-পরকাল উভয় জগতেই ব্যাপক করে দিয়েছেন। সুবহানাল্লাহ! এটা আল্লাহ তাআলার কত বড়ই না মেহেরবানী! একজনের অর্থকষ্ট দূর করার দ্বারা তাঁর অনুগ্রহে দুনিয়ারও ফায়দা হাসিল হয় এবং আখেরাতেরও।
দুনিয়ায় মানুষ তার বিভিন্ন রকম কষ্ট-ক্লেশ থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে নানা উপায় অবলম্বন করে থাকে। এ হাদীছ দ্বারা আমরা জানতে পারলাম অন্যের অর্থকষ্ট লাঘবে সহযোগিতা করাও কষ্ট-ক্লেশ থেকে মুক্তিলাভের একটি উপায়। আবার এর দ্বারা আখেরাতের কষ্ট থেকেও আল্লাহ তাআলা মুক্তি দান করেন, যা কিনা প্রত্যেক মুমিনের পরম কাম্য।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ জাতীয় কাজ নিজেও অনেক করেছেন এবং বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা আমাদেরকেও করতে উৎসাহ দিয়েছেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বর্ণনা করেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক পাওনাদার ও দেনাদারের বাদানুবাদ শুনতে পান। তারা উঁচু আওয়াজে কথা কাটাকাটি করছিল। একজন অন্যজনকে অনুরোধ করছিল যেন পাওনার অঙ্ক থেকে কিছুটা কমিয়ে দেয় এবং তার প্রতি একটু সদয় হয়। অন্যজন আল্লাহর নামে কসম করে বলছিল, কিছুতেই তা করব না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছে বের হয়ে আসলেন এবং বললেন أين المتألي على الله، لا يفعل المعروف؟ فقال: أنا يا رسول الله، وله أي ذلك أحب 'কই সে, যে সদয় আচরণ করবে না বলে আল্লাহর নামে কসম করছে? এ কথা শুনে সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি। সে যা চায় তাই হবে।
এক হাদীছে ইরশাদ من سره أن ينجيه الله من كرب يوم القيامة، فلينفس عن معسر أو يضع عنه “যে ব্যক্তি কামনা করে আল্লাহ তাআলা যেন কিয়ামত দিবসের কষ্ট থেকে তাকে নাজাত দান করেন, সে যেন অভাবগ্রস্তকে সুযোগ দান করে অথবা তার দেনা মওকুফ করে দেয়।
এ হাদীছটি হযরত আবূ কাতাদা রাযি. থেকে বর্ণিত। তিনি এক ব্যক্তির কাছে কিছু টাকা পেতেন। সে ছিল গরীব। টাকা দিতে না পেরে তাঁকে দেখে পালাত। একবার হযরত আবূ কাতাদা রাযি. তাকে গিয়ে ধরলেন। সে তার অর্থসংকটের কথা জানাল। তখন তিনি তাকে লক্ষ্য করে এ হাদীছটি বর্ণনা করলেন এবং তার দেনা মওকুফ করে দিলেন।
অন্য এক হাদীছে ইরশাদ من أنظر معسرا أو وضع عنه، أظله الله في ظله 'যে ব্যক্তি কোনও অভাবগ্রস্তকে অবকাশ দেয় বা তার দেনা মওকুফ করে দেয়, আল্লাহ তাআলা তাকে (হাশরের ময়দানে) নিজ (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দান করবেন।
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন كان رجل يداين الناس، فكان يقول لفتاه إذا أتيت معسرا فتجاوز عنه، لعل الله يتجاوز عنا، فلقي الله فتجاوز عنه ‘জনৈক (ব্যবসায়ী) ব্যক্তি মানুষের কাছে বাকিতে মাল বিক্রি করত। সে তার কর্মচারীকে বলত, কোনও অভাবগ্রস্তের কাছে মাল বিক্রি করলে তাকে ছাড় দিও, হয়তো এ অসিলায় আল্লাহ আমাদেরকেও ছাড় দেবেন। অতঃপর সে আল্লাহর সঙ্গে গিয়ে মিলিত হয় এবং আল্লাহ তাআলা তাকে এ কারণে মুক্তি দিয়ে দেন।
কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, আল্লাহ তাআলা তাকে সে দুনিয়ায় কী কী নেক আমল করেছে তা জিজ্ঞেস করলে কোনও উত্তর দিতে পারছিল না। বারংবার জিজ্ঞাসার পর পরিশেষে তার গরীব ভোক্তাকে ছাড় দেওয়ার কথাটি মনে পড়ল। সে এ কথাটি আল্লাহ তাআলাকে জানালে আল্লাহ তাআলা বললেন, হে বান্দা! তুমি গরীবকে ছাড় দিতে! ছাড় দেওয়ার বিষয়টা তো আমাকেই বেশি সাজে। সুতরাং তিনি তাকে আযাব না দিয়ে ছাড়পত্র দিয়ে দিলেন।
গরীব-দুঃখীর কষ্ট লাঘবে সহায়তা করাটা দুআ কবুলের পক্ষেও সহায়ক। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন من أراد أن تستجاب دعوته، وأن تكشف كربته، فليفرج عن معسر “যে ব্যক্তি কামনা করে তার দুআ কবুল হোক এবং তার পেরেশানি দূর হোক, সে যেন অভাবগ্রস্তের অভাব মোচনের চেষ্টা করে।
মুসলিম ব্যক্তির দোষত্রুটি গোপন করা
এ হাদীছে বর্ণিত আরেকটি ফযীলতপূর্ণ আমল হচ্ছে মুসলিম ব্যক্তির দোষত্রুটি গোপন করা। বলা হয়েছে (যে ব্যক্তি কোনও মুসলিম ব্যক্তিকে আড়াল করে)। মুসলিম ব্যক্তিকে আড়াল করার অর্থ হয়তো খোদ তাকেই শত্রু বা জালেম শাসক থেকে আড়াল করা, যাতে তারা তার কোনও ক্ষতি করতে না পারে। অথবা এর অর্থ তার দোষত্রুটি গোপন করা। যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে পাপকর্ম করে না সে যদি গোপনে এমন কোনও অপরাধ করে বসে, যা অন্যের জন্য ক্ষতিকারক নয়, তবে কেউ কোনওভাবে তা জেনে ফেললে তার উচিত নিজের মধ্যেই তা রেখে দেওয়া, অন্যের কাছে প্রকাশ না করা। অন্যের দোষ গোপন করা আল্লাহ তাআলার গুণ। তিনি সাত্তারুল উয়ুব- দোষ গোপনকারী। তাঁর আশেক বান্দার কর্তব্য এ গুণে গুণান্বিত হওয়া। তাতে আল্লাহ তার প্রতি খুশি হবেন এবং তার প্রতিও তিনি অনুরূপ আচরণ করবেন।
সুতরাং এ হাদীছে জানানো হচ্ছে- ستره الله فى الدنيا والاخرة (আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখেরাতে তাকে আড়াল করবেন)। অর্থাৎ দুনিয়ায়ও তার দোষ প্রকাশ করে মানুষের সামনে অপদস্থ করবেন না এবং আখেরাতেও তার পাপসমূহ জাহির করে কুল মাখলুকের সামনে তাকে হেয় করবেন না; বরং নিষ্পাপ ব্যক্তির মত জাহান্নাম থেকে রেহাই দিয়ে জান্নাতের বাসিন্দা বানিয়ে দেবেন।
আল্লাহর বান্দাদের সাহায্য-সহযোগিতা করে যাওয়া
এ হাদীছে বর্ণিত চতুর্থ ফযীলতপূর্ণ আমল হল আল্লাহর বান্দাদের সাহায্য সহযোগিতা করে যাওয়া। হাদীছে এ আমলটিকে সাধারণভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে, বিশেষ কোনও ক্ষেত্রের সাহায্যের কথা বলা হয়নি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- والله فى عون العبد ما كان العبد في عون أخيه (বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সাহায্যে লেগে থাকে, আল্লাহ ততক্ষণ তার সাহায্য করতে থাকেন)। মানুষের সাহায্য প্রয়োজন হয় যেমন দীনী বিষয়ে, তেমনি প্রয়োজন হয় দুনিয়াবী বিষয়েও।মানুষের কখনও অর্থ-সাহায্যের প্রয়োজন হয়, কখনও অন্ন, বস্ত্র বা বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রয়োজন হয়, কখনও দরকার পড়ে চিকিৎসা-সহযোগিতার, কখনও বিপদাপদ থেকে উদ্ধারের। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অগ্নিকাণ্ড প্রভৃতি দুর্যোগে উদ্ধার সহযোগিতা ও ত্রাণ বিতরণের প্রয়োজন হয়। দুস্থ, প্রতিবন্ধী, বেকার এবং এ জাতীয় অন্যান্য অসহায় লোকদের প্রয়োজন কর্মসংস্থানসহ নানামুখী সহযোগিতা। আসলে দুনিয়ায় মানুষের প্রয়োজন বিচিত্র ও বহুমুখী। একেকজনের একেকরকম ঠ্যাকা। এর তালিকা অনেক দীর্ঘ। জীবনচলার ক্ষেত্রে যার যা প্রয়োজন তা পূরণ করার সামর্থ্য যার আছে তার উচিত আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে সে প্রয়োজন পূরণে নিজের সে সামর্থ্য ব্যয় করা। যে ব্যক্তি তা করবে এবং যতদিন করবে, ততদিন সে আল্লাহর পক্ষ হতেও সাহায্য পেতে থাকবে, যেমনটা এ হাদীছে বলা হয়েছে।
কারও প্রয়োজন দীনী বিষয়ে সাহায্যের। আমলোকের দরকার বিভিন্ন দীনী বিষয়ে নির্দেশনার। যে ব্যক্তি কুরআন পড়তে জানে না তাকে কুরআনপাঠ শেখানো, যে ব্যক্তি ওযূ-গোসল, নামায-রোয়া প্রভৃতি দীনী জরুরি মাসাইল জানে না তাকে এসব বিষয়ক মাসাইল শেখানো, যার আকীদা-বিশ্বাস দুরস্ত নয় তাকে বিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাস শেখানো, যে ব্যক্তি হালাল-হারামের পার্থক্য সম্পর্কে খবর রাখে না তাকে এ সম্পর্কে অবহিত করা ইত্যাদি সবই দীনী সাহায্যের অন্তর্ভুক্ত। অনেক সময় মানুষ এমন জটিল মাসআলার সম্মুখীন হয়ে পড়ে, যার সমাধান ছাড়া তার পার্থিব জীবন অচল হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে সঠিক সমাধানদান যেমন দীনী সাহায্য, তেমনি তা দুনিয়াবী সাহায্যও বটে।
মানুষের সাহায্য করা যায় মনের শুভেচ্ছা ও নেক দুআ দ্বারা, সাহায্য করা যায় শারীরিক সক্ষমতা দ্বারা, সাহায্য করা যায় বিদ্যা-বুদ্ধি দ্বারা এবং সাহায্য করা যায় অর্থব্যয় দ্বারাও। আবার অনেক সময় পদমর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তি ইত্যাদির বৈধ ব্যবহার দ্বারাও মানুষের অনেক বড় সাহায্য করা যায়। সুপরামর্শ ও সুপারিশও সাহায্যের এক বড় উপায়। মোটকথা যার পক্ষে যেভাবে কারও সাহায্য করা সম্ভব, তার উচিত সেভাবেই তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ানো। এটা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত। দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহ তাআলার সাহায্য লাভার্থে তিনি আমাদেরকে বিভিন্নভাবে এর প্রতি উৎসাহিত করেছেন। তিনি নিজে তো জীবনভরই এ কাজে আন্তরিক থেকেছেন।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বিষয়ক ঘটনা আছে বহু। একটা ঘটনা উল্লেখ করা যাচ্ছে।
একটি ঘটনা
হিজরতের আগের কথা। একদিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে বসা । তাঁর সঙ্গে কয়েকজন সাহাবীও আছেন। এ অবস্থায় 'যুবায়দ' গোত্রীয় এক ব্যক্তি এগিয়ে আসল। সে বলছিল, 'হে কুরায়শ সম্প্রদায়! কিভাবে তোমাদের কাছে পণ্য নিয়ে আসা হবে? কিভাবে কোনও ব্যবসায়ী তোমাদের আঙিনায় আসবে? কেউ তোমাদের এলাকায় আসলে তোমরা তাদের প্রতি জুলুম কর'। সে এসব কথা বলছিল আর লোকজনের একেক জটলার সামনে দাঁড়াচ্ছিল। পরিশেষে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে পৌছল। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কে তোমার প্রতি জুলুম করেছে?
সে জানাল যে, সে তার শ্রেষ্ঠ তিনটি উট নিয়ে এখানে এসেছিল। কিন্তু আবূ জাহল দাম-দর করতে গিয়ে উটগুলোর দাম বলল তার প্রকৃত মূল্যের মাত্র তিনভাগের এক ভাগ। আবূ জাহল এ দাম বলার কারণে আর কেউ তার উপর দিয়ে দাম বলল না। তারপর সে বলল, আবূ জাহল আমার পণ্য অচল করে দিয়েছে। সে এভাবে আমার উপর জুলুম করেছে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার উটগুলো কোথায়?
সে জায়গার নাম বলল।
তিনি উঠে সেখানে গেলেন। সঙ্গে সাহাবীগণও। তিনি দেখলেন, খুবই উঁচু মানের উট। তারপর তিনি যুবায়দী লোকটিকে সেটির দাম বললেন। একপর্যায়ে তিনি তার কাঙ্ক্ষিত দামে উপনীত হলেন। লোকটি উপযুক্ত দাম পেয়ে তাঁর কাছে সেগুলো বিক্রি করে দিল। তিনি তা থেকে দুটি উট ওই দামেই বিক্রি করে দিলেন। একটি বিক্রি করলেন আরও বেশি দামে। তিনি সেটির মূল্য আব্দুল মুত্তালিবের আওলাদের মধ্যকার বিধবাদের মধ্যে বিতরণ করে দিলেন।
আবূ জাহল বাজারের এক প্রান্তে বসা ছিল। সে সবকিছু দেখছিল, কিন্তু কোনও কথা বলছিল না। শেষে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাছে এগিয়ে গেলেন। তিনি তাকে লক্ষ্য করে বললেন
হে আমর্ (এটা আবূ জাহলের আসল নাম)! সাবধান, এই বেদুঈনের সঙ্গে যা আচরণ করলে ভবিষ্যতে আর কারও সঙ্গে এমন করো না যেন। করলে কিন্তু আমার পক্ষ থেকে যে ব্যবহার পাবে তা তোমার প্রীতিকর বোধ হবে না।
উত্তরে আবূ জাহল বলছিল, হে মুহাম্মাদ! আর কখনও করব না। হে মুহাম্মাদ! আর কখনও করব না।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরে আসলেন।
ওদিকে উমাইয়া ইবনে খালাফ এবং উপস্থিত অন্যান্য লোকজন অবাক বিস্ময়ে এ দৃশ্য লক্ষ করছিল। শেষে তারা আবূ জাহলকে লক্ষ্য করে বলল, আপনি আজ মুহাম্মাদের হাতে বড় অপদস্থ হলেন। তবে কি আপনি তার অনুসরণ করবেন বলে মনস্থ করেছেন? নাকি কোনও কারণে তাকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন?
আবূ জাহল বলল, আমি জীবনেও তার অনুসরণ করব না। বাকি তোমরা যে দৃশ্য দেখেছ তার কারণ, আমার চোখ এমনকিছু দেখেছে যা তোমরা দেখনি। আমি দেখলাম, তার ডানে ও বামে বর্শাধারী কিছু লোক। তারা সেগুলো আমার দিকে তাক করে আছে। আমি তার অবাধ্য হলে সেই বর্শা দিয়ে তারা আমাকে গেঁথে ফেলত।
মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন সমাধা করা
من كان في حاجة أخيه كان الله في حاجته 'যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন সমাধায় রত থাকে, আল্লাহ তার প্রয়োজন সমাধা করতে থাকেন। অর্থাৎ কোনও মুসলিম ভাইয়ের কোনওরকম প্রয়োজন দেখা দিলে যার পক্ষে সে প্রয়োজন সমাধা করা সম্ভব, তার কর্তব্য তা সমাধা করে দেওয়া। যে ব্যক্তি তা সমাধা করে দেবে, তার প্রয়োজনও আল্লাহ তাআলা সমাধা করে দেবেন। অপর এক বর্ণনায় আছেঃ- والله في عون العبد ما كان العبد في عون أخيه ‘আল্লাহ বান্দার সাহায্য করতে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে রত থাকে। এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনঃ- هَلْ جَزَاءُ الْإِحْسَانِ إِلَّا الْإِحْسَانُ ‘উত্তম কাজের প্রতিদান উত্তম ছাড়া আর কী হতে পারে?
অর্থাৎ যারা আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দয়া ও ইহসানের আচরণ করবে, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেও তারা দয়ার আচরণ লাভ করবে। দুনিয়ার মানুষের প্রয়োজন নানারকম।
কারও প্রয়োজন খাদ্যের, কারও কাপড়ের, কারও বাসস্থানের, কারও চিকিৎসার, কারও সুপরামর্শের, কারও ভার লাঘবের, কারও বিবাহের, এমনিভাবে পৃথিবীতে মানুষকে নানারকম প্রয়োজনের সম্মুখীন হতে হয়। যার পক্ষে তার মুসলিম ভাইয়ের এসব প্রয়োজনের কোনওটি পূরণ করা সম্ভব, তা পূরণ করা তার অবশ্যকর্তব্য।
এ হাদীছ দ্বারা তো জানা গেল তার সে প্রয়োজন পূরণ করলে তার নিজের প্রয়োজনও আল্লাহ তাআলা পূরণ করে দেবেন। এটা নিজ প্রয়োজন সমাধারও এক উত্তম ব্যবস্থা। দুনিয়ায় মানুষের কোনও না কোনও প্রয়োজন থাকেই। অনেক সময় দেখা যায় এমন কোনও প্রয়োজন সামনে এসে পড়ে, যা হাজারও চেষ্টা সত্ত্বেও পূরণ করা সম্ভব হয় না। এরূপ ক্ষেত্রে তা সমাধার একটা ভালো উপায় এইও হতে পারে যে, অন্য কোনও ব্যক্তির যে প্রয়োজন আমার পক্ষে পূরণ করা সম্ভব আমি তা পূরণ করে দেব। অসম্ভব নয় তাতে খুশি হয়ে আল্লাহ তাআলাও আমার সে কঠিন প্রয়োজনটি অতি সহজেই পূরণ করে দেবেন। সবচে' বড় কথা এর জন্য আখেরাতের যে পুরস্কার নির্দিষ্ট আছে তা তো পাওয়া যাবেই।
হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- أيما مؤمن أطعم مؤمنا على جوع أطعمه الله يوم القيامة من ثمار الجنّة، وأيما مؤمن سقى مؤمنا على ظما سقاه الله يوم القيامة من الرحيق المختوم، وأيما مؤمن کسی مؤمنا على عري كساه الله من خضر الجنة 'যে-কোনও মুমিন কোনও ক্ষুধার্ত মুমিনকে খানা খাওয়াবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। যে-কোনও মুমিন কোনও তৃষ্ণার্ত মুমিনকে পানি পান করাবে, আল্লাহ তাআলা তাকে কিয়ামতের দিন মোহরকৃত সুপেয় শরাব পান করাবেন। যে-কোনও মুমিন কোনও বস্ত্রহীন মুমিনকে বস্ত্র দান করবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের সবুজ রেশমি পোশাক পরাবেন।
সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ শিক্ষার উপর আমল করতেন। তাঁরা খুঁজে বেড়াতেন কোথায় কোন্ মুসলিমের কী প্রয়োজন আছে। নিজ সাধ্য অনুযায়ী তার সে প্রয়োজন পূরণের চেষ্টা করতেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. মহল্লার কোনও বাড়ির পুরুষ লোক অনুপস্থিত থাকলে তাদের ছাগলের দুধ দোহন করে দিতেন। এটা সেকালের একটা প্রয়োজন ছিল। কেননা তখনকার রেওয়াজ অনুযায়ী মহিলাগণ দুধ দোহন করত না। ফলে বাড়িতে পুরুষ লোক অনুপস্থিত থাকলে তারা সমস্যায় পড়ে যেত।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ও হযরত উমর ফারূক রাযি.-এর মানবসেবা
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. নিয়মিতই তাদের এ প্রয়োজন পূরণ করতেন। তিনি খলিফা হওয়ার পর এক নারী মন্তব্য করেছিল, এখন তো আর তিনি আমাদের ছাগলের দুধ দুইয়ে দেবেন না। এ কথা তাঁর কানে পৌঁছে গেল। তিনি বললেন, অবশ্যই, আমি আশা করি যে দায়িত্ব আমার কাঁধে চেপেছে তা আমার আগেকার অভ্যাস বদলাতে পারবে না।
হযরত উমর রাযি.-ও রাতের বেলা ঘুরে ঘুরে বিধবা মহিলাদের বাড়িতে পানি পৌছিয়ে দিতেন। এ সম্পর্কে একটা চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি রাতের বেলা নিয়মিতই এক বিধবার বাড়িতে যেতেন। তাঁর এ আসা-যাওয়াটা হযরত তালহা রাযি.-এর চোখে পড়ে যায়। কী ঘটনা? তাঁর জানার কৌতূহল হল। তিনি একদিন সেই মহিলার বাড়িতে গেলেন। গিয়ে দেখেন এক অন্ধ ও অচল বৃদ্ধা। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ওই যে লোকটি রাতের বেলা আপনার কাছে এসে থাকে, সে কী করে? বৃদ্ধা বলল, সে এত-এত দিন যাবৎ এসে আমার খোঁজ-খবর নেয় এবং আমার প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করে দেয়। এ কথা শুনে হযরত তালহা রাযি. স্তম্ভিত। তিনি নিজেকে তিরস্কার করে বললেন, রে তালহা! তুই মরে যা না! উমরের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়াচ্ছিস?
সাহাবায়ে কেরাম, তাবি'ঈন, সালাফে সালিহীন ও বুযুর্গানে দীনের এ জাতীয় হাজারও ঘটনা আছে। অন্যের প্রয়োজন পূরণকে তারা অনেক বড় পুণ্যের কাজ মনে করতেন। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকেও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণের তাওফীক দিন।
অন্যের মুখে হাসি ফোটানো
মানুষের প্রয়োজন বড় বিচিত্র। এক ব্যক্তির কোনও অভাব-অনটন নেই, কিন্তু বিশেষ কোনও কারণে সে মনোকষ্টে ভুগছে। তার মলিন মুখের দিকে তাকালে মনের কষ্ট অনুভব করা যায়। এই ব্যক্তির প্রয়োজন কষ্টের কারণটি দূর করে তার মুখে হাসি ফোটানো। নিঃসন্দেহে অন্যের মনে আনন্দদানও একটি বড় নেকীর কাজ। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছেঃ- إن أحب الأعمال إلى الله بعد الفرائض إدخال السرور على المسلم ‘ফরয আমলসমূহের পর আল্লাহ কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় আমল হচ্ছে মুসলিম ব্যক্তিকে আনন্দ দান করা।
আরেক হাদীছে ইরশাদ হয়েছেঃ- إن من موجبات المغفرة إدخال السرور على أخيك المسلم 'যেসকল কারণে আল্লাহ তাআলার কাছে মাগফিরাত লাভ হয়, তার একটি হচ্ছে মুসলিম ভাইকে আনন্দ দান করা।
অপরকে আনন্দদানের জন্য ইসলাম পরিমিত রসিকতাকেও জায়েয করেছে। এর একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত হচ্ছে পোষা পাখি মারা যাওয়ায় বিষণ্ণ বালক আবূ উমায়রকে লক্ষ্য করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হালকা রসিকতা। হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি.-এর বালক পুত্র আবূ উমায়রের একটি পোষা পাখি ছিল। সেটির নাম ছিল নুগায়র। আবূ উমায়র সেটি নিয়ে সময় কাটাত। অকস্মাৎ তার সে পাখিটি মারা গেল। তাতে আবূ উমায়র ভীষণ দুঃখ পেল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায়ই তাদের বাড়ি আসতেন এবং আবূ উমায়রকে খুব আদর করতেন। আবূ উমায়রও তাঁকে পেলে বেশ আনন্দিত হত। এবার তিনি এসে দেখেন আবূ উমায়র কেমন বিষণ্ণ, মুখে হাসি নেই। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন তার পাখিটি মারা গেছে। সুতরাং তিনি তার দুঃখ ভোলানোর জন্য ছড়া গেয়ে উঠলেন
يا أبا عمير
ما فعل النغير؟
“ওহে আবূ উমায়ের!
কোথা গেল নুগায়ের?
ইলম অন্বেষণের ফযীলত
এ হাদীছে বর্ণিত পঞ্চম ফযীলতপূর্ণ আমল হল ইলম অন্বেষণ করা। বলা হয়েছে من سلك طريقا يلتمس فيه علما (যে ব্যক্তি ইলমের সন্ধানে কোনও পথে চলে)। বলাবাহুল্য এর দ্বারা ইলমে দীনের সন্ধান বোঝানোই উদ্দেশ্য, তা সরাসরি কুরআন ও হাদীছ শিক্ষা করা হোক বা কুরআন ও হাদীছ থেকে উদ্ভাবিত ইলম হোক। যেমন ফিক্হ, উসূলুল ফিক্হ, উসূলুল হাদীছ, তাফসীর, উসূলুত তাফসীর ইত্যাদি। এমনিভাবে এসব ইলম অর্জনের জন্য যেসকল বুনিয়াদী শাস্ত্রের প্রয়োজন হয়, তা হাসিলের প্রচেষ্টাও এর অন্তর্ভুক্ত হবে। যেমন নাহব, সরফ, লুগাত, বালাগাত, গণিত ইত্যাদি।
ইলমের সন্ধানে পথচলা দুভাবে হয়। এক হচ্ছে বাহ্যিক চলা। অর্থাৎ ঘর থেকে বের হয়ে এমন কোনও ব্যক্তি বা এমন কোনও প্রতিষ্ঠানে চলে যাওয়া, যেখানে ইলমের চর্চা হয়ে থাকে। আরেক হচ্ছে অভ্যন্তরীণ বা বিমূর্ত চলা। অর্থাৎ কুরআন, হাদীছ, মাসআলা-মাসাইল ইত্যাদি মুখস্থ করা, পর্যায়ক্রমিকভাবে এ বিষয়ক কিতাব ও বই-পুস্তক পাঠ করা, তা বোঝার চেষ্টা করা এবং গভীরে পৌঁছানোর জন্য চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করা। ইলম হাসিলের জন্য উভয় প্রকার চলাই জরুরি। এর জন্য প্রয়োজনে দূর-দূরান্তে সফর করা এবং উলামা-মাশায়েখের মজলিস ও দীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বছরের পর বছর কাটাতে পারা অতি বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার।
ইলমের জন্য বিস্ময়কর সফর ও কষ্ট-ক্লেশের কিছু দৃষ্টান্ত
সাহাবায়ে কেরাম থেকে নিয়ে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত যুগে যুগে জ্ঞানপিপাসুগণ যেসব বিস্ময়কর ইলমী সফর করেছেন, ইলমের প্রকৃত সন্ধানীর পক্ষে তা গভীর প্রেরণাদায়ী।
হযরত জাবির রাযি. 'কিসাস' সম্পর্কিত একটি হাদীছ জানার জন্য মদীনা মুনাউওয়ারা থেকে মিশর সফর করেছিলেন। আরেকবার তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উনাইস রাযি.-এর নিকট থেকে কিয়ামতের বিভীষিকা সম্পর্কিত একটি হাদীছ জানার জন্য মদীনা মুনাউওয়ারা থেকে এক মাসের সফর করে শামে পৌঁছেছিলেন।
হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাযি. ও হযরত উকবা ইবন আমির রাযি.-এর কাছে সুদূর মিশরে সফর করেছিলেন মানুষের দোষ গোপন করা সম্পর্কিত একটি হাদীছের জন্য।
মাত্র একটি হাদীছের তাহকীক করার জন্য ইমাম শু'বা বসরা থেকে মক্কায়, সেখান থেকে মদীনায় আবার সেখান থেকে বসরায় একটানা সফর করেছেন। বিখ্যাত তাবি'ঈ হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব রহ. বলেন, আমি একটামাত্র হাদীছ শেখার জন্য দিনের পর দিন ও রাতের পর রাত একটানা সফর করেছি।
আব্দুর রহমান ইবন কাসিম রহ. মিশর থেকে মদীনা মুনাউওয়ারায় এসে একাধারে ১৭ বছর ইমাম মালিক রহ.-এর কাছে ইলম শিক্ষায় রত থেকেছেন। ইমাম আবূ আব্দুল্লাহ ইবন মান্দা রহ. হিজরী ৩১০ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৩৯৫ সালে ইন্তিকাল করেন। এ ৮৫ বছর জীবনকালের ৪৫ বছরই তিনি সফরে সফরে কাটিয়েছেন। এ সুদীর্ঘ সফরের উদ্দেশ্য ছিল কেবলই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছ সংগ্রহ করা। বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে তিনি প্রায় ১৭০০মুহাদ্দিছ থেকে হাদীছের শিক্ষা গ্রহণ করেছেন।
ইমাম আবূ সা'দ সাম'আনী রহ. হাদীছ সংগ্রহের জন্য বহু নগর-বন্দর সফর করেছেন। আরব, অনারব ও পূব-পশ্চিমের প্রায় একশ' নগরে তিনি যাতায়াত করেছেন। এতে তাঁর সময় লেগেছিল আনুমানিক ২০ বছর।
ইমাম বাকী' ইবন মাখলাদ রহ. দু-দু'বার পায়ে হেঁটে সুদূর আন্দালুসিয়া থেকে মক্কা, মদীনা, শাম, ইরাক প্রভৃতি অঞ্চল সফর করেছেন। প্রথমবার সফরে ১৪ বছর এবং দ্বিতীয় সফরে ২০ বছর সময়কাল ব্যয় হয়েছে। এ অবর্ণনীয় কষ্ট-ক্লেশ তিনি স্বীকার করেছেন কেবলই ইলমে দীন শেখার উদ্দেশ্যে।
ইমাম আবূ হাতিম রাযী রহ. ইলমে দীন শেখার লক্ষ্যে সফর করেছেন শত শত মাইল। তিনি বলেন, আমি পায়ে হেঁটে যে পথ অতিক্রম করেছি, প্রথমদিকে তা গুণে রাখতাম। যখন তা ১০০০ ফারসাথ অতিক্রম করল তখন গণা বাদ দিয়েছি। উল্লেখ্য, এক ফারসাথ সমান ৫ কিলোমিটার। তার মানে তিনি ৫০০০ কিলোমিটারেরও অনেক বেশি পথ পায়ে হেঁটে হেঁটে পাড়ি দিয়েছেন। ভাবা যায়, ইলমে দীন শেখার কী অদম্য উৎসাহ তিনি তাঁর অন্তরে লালন করতেন!
ইলমে দীন চর্চার ইতিহাসে এরকম ঘটনা আছে শত শত। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবি'ঈন থেকে শুরু করে পরবর্তী শত শত বছর আমাদের উলামায়ে কেরাম হাদীছ, ফিক্হ প্রভৃতি শাস্ত্র সংগ্রহের লক্ষ্যে এরকম বহু রোমাঞ্চকর পরিভ্রমণ করেছেন। সেসব সফরে তারা সহ্য করেছেন অবর্ণনীয় কষ্ট-ক্লেশ। তারা মসজিদকে বানিয়ে নিয়েছিলেন থাকার জায়গা। বিশ্রামের জন্য বালিশের পরিবর্তে মসজিদের খুঁটিই ছিল তাদের অবলম্বন। তাদের বিছানা ছিল মসজিদের চাটাই। তাদের খাদ্য ছিল হাদীছ, ফিক্হ প্রভৃতি শাস্ত্রের লিখন ও মুখস্থকরণ। তাদের গল্প ছিল পারস্পরিক জ্ঞানবিনিময়। তাদের বিনোদন ছিল ইলমের লেনাদেনা। তাদের সুগন্ধি ছিল লেখার কালি। রাতের পর রাত তারা জেগে কাটাতেন। রাত জাগাটাই যেন ছিল তাদের ঘুম। আরামের সঙ্গে তাদের পরিচয় ছিল না। মাথা থাকত আলুথালু, কাপড় ছেঁড়াফাঁড়া, উদর অভুক্ত, ঠোঁট শুকনো, রং বিবর্ণ, শরীর জরাজীর্ণ। কিন্তু এসবের প্রতি তাদের ভ্রুক্ষেপ ছিল না। তাদের ছিল একই লক্ষ্য- ইলমে দীনের সংগ্রহ। এর জন্য তারা বিসর্জন দিয়েছেন সবকিছু। পিতামাতা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন, পুত্র-কন্যা, স্ত্রী ও অন্যান্য সকল প্রিয়জনের স্নেহ-মমতা ত্যাগ করে দূর-দূরান্তের সফর করেছেন। বছরের পর বছর মাতৃভূমি থেকে দূরে থেকেছেন। সে থাকাটাও ছিল অকল্পনীয় ও অবর্ণনীয় কষ্ট-ক্লেশের সঙ্গে। তাদের সে ত্যাগ-তিতিক্ষারই সুফল যে, আজ আমরা অতি আসানের সঙ্গে কুরআন-সুন্নাহ'র সংরক্ষিত, সুবিন্যস্ত ও বিশুদ্ধ ইলম হাসিল করতে পারছি।
বস্তুত ইলমের জন্য ঘর থেকে বের হওয়া এবং উলামা-মাশায়েখের মজলিসে ছোটাছুটি করা অতীব জরুরি। ঘরে বসে বসে কিতাবাদি পড়ার দ্বারাই এ মহামূল্যবান সম্পদ অর্জন করা যায় না। এ এমনই এক সম্পদ, যা দ্বারা আল্লাহকে চেনা যায়, তাঁর মর্জি ও খুশি-নাখুশির বিষয়ে অবহিত হওয়া যায়, হালাল-হারাম সম্পর্কে ধারণা লাভ হয়, কোন্ পথ জান্নাতের ও কোন পথ জাহান্নামের তা উপলব্ধি হয়, এর দ্বারাই মন্দ আখলাক পরিহার করে সচ্চরিত্র অর্জনের উপায় অবলম্বন করা যায়, জানা যায় নিজের হক, আত্মীয়ের হক, প্রতিবেশীর হক, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের হক এমনকি পশু-পাখিরও হক, পরিচিত হওয়া যায় জীবনের সকল ক্ষেত্রে নিজ দায়িত্ব কর্তব্যের সঙ্গে, এরই দ্বারা ঘটানো যায় মনুষ্যত্বের বিকাশ, এরই সঙ্গে সম্পৃক্ত দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণ, এরই মাধ্যমে রক্ষা পাওয়া যায় উভয় জাহানের সমূহ অকল্যাণ থেকে, এটা চোখের জ্যোতি, অন্তর্দৃষ্টির আলো, প্রাণের শান্তি, মন ও মননের খোরাক, এটা প্রকাশ্য ও গুপ্ত শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র, হক ও বাতিলের মীমাংসা, এর মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপন করা যায় আল্লাহর সঙ্গে, নিজেকে পরিণত করা যায় তাঁর মাহবূব বান্দায় এবং এ এক অবিনশ্বর সম্পদ, যা নশ্বর জগতের সীমানা ভেদ করে অনন্ত আখেরাতেও পৌঁছে যায়। এর জন্য সারাটা জীবনও যদি সফরে সফরে কাটিয়ে দেওয়া হয় এবং দুনিয়ায় উদয়াচল থেকে অস্তাচল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ জগতকে বিচরণভূমি বানিয়ে নেওয়া হয়, তাও এর মহামূল্যের বিপরীতে নিতান্ত তুচ্ছই গণ্য হবে।
যাহোক ইলমের জন্য সফর করা ও গভীর অভিনিবেশের সাথে চিন্তাভাবনায় লিপ্ত থাকা অত্যন্ত ফযীলতের কাজ। এ মেহনতের বদৌলতে জান্নাত লাভের পথ সহজ ও সুগম হয়ে যায়। যেমন এ হাদীছের পরবর্তী বাক্যে ইরশাদ হয়েছে سهل الله له طريقا الى الجنة (আল্লাহ তার জন্য জান্নাতগামী পথ সুগম করে দেন)। অর্থাৎ ইলমের সন্ধান ও তা অর্জনের পুরস্কারস্বরূপ তার জন্য জান্নাতে প্রবেশ সহজ করে দেন। ফলে সে হাশরের ময়দানের বিভীষিকা দেখতে পাবে না, যেমনটা অন্যরা দেখতে পাবে। সে নির্বিঘ্নে নিরাপদে জান্নাতে পৌঁছে যাবে। নিঃসন্দেহে এটা অনেক বড় পুরস্কার। এতবড় পুরস্কার প্রাপ্তির কারণ ইলমে দীন শেখার কাজটি অনেক কঠিন। এর জন্য প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। সবরের কষ্ট ছাড়াও থাকার কষ্ট ও খানাপিনার কষ্ট বরদাশত করতে হয়। ঘুম ও আরামের ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। বেছে নিতে হয় আত্মীয়-স্বজন ও প্রিয়জন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুনিয়ার হাজারও ভোগ-উপভোগ বিবর্জিত এক কঠিন তপস্যার জীবন। সে ত্যাগ-তিতিক্ষার ফলস্বরূপ আল্লাহ তাআলা তার জন্য জান্নাতে পৌঁছা সহজ করে দেন।
এটা 'যেমন কর্ম তেমন ফল' জাতীয় প্রতিদান। আল্লাহ তাআলা বান্দাকে তার আমলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ প্রতিদান দিয়ে থাকেন। যেমন এ হাদীছেই দেখা যাচ্ছে, কোনও মুমিনের কষ্ট যে দূর করে, তার প্রতিদানে আল্লাহ তার কষ্ট দূর করে দেন, যে ব্যক্তি অভাগ্রস্তের অভাব মোচন করে, আল্লাহ তার অভাব মোচন করে দেন, যে ব্যক্তি কোনও মুসলিমের দোষ গোপন করে, আল্লাহ তাআলাও তার দোষ গোপন করেন। কুরআন ও হাদীছে এর প্রচুর দৃষ্টান্ত আছে।
এর দ্বারা ইলমে দীন সন্ধানের মেহনত-যে কত মর্যাদাবান তা অনুভব করা যায়।স্বাভাবিকভাবেই এর দ্বারা ইলমে দীনের চর্চা ও প্রচার-প্রসারে লিপ্ত থাকার মর্যাদাও পরিস্ফুট হয়।
প্রকাশ থাকে যে, ইলমে দীন আহরণের এ ফযীলত কেবল তখনই লাভ হতে পারে, যখন তা ইখলাসের সঙ্গে আহরণ করা হবে অর্থাৎ কেবল আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যেই করা হবে, দুনিয়াবী কোনও স্বার্থে নয়। ইলম সন্ধানকারীকে এ বিষয়টা বিশেষভাবে স্মরণ রাখতে হবে। কেননা অন্যান্য ইবাদতের মত এ ক্ষেত্রেও রিয়া ঢুকে পড়ে; বরং রিয়ার প্রকোপ এ ক্ষেত্রে একটু বেশিই হয়। তাই ইখলাস ও সহীহ নিয়তের সাধনাও এ ক্ষেত্রে বেশি প্রয়োজন।
দলবদ্ধভাবে আল্লাহর কিতাব পঠন-পাঠনের ফযীলত
এ হাদীছে ষষ্ঠ যে ফযীলতের আমল উল্লেখ করা হয়েছে, তা হচ্ছে মসজিদে সম্মিলিতভাবে কুরআন মাজীদের চর্চা ও পঠন-পাঠন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ما اجتمع قوم في بيت من بيوت الله تعالى (কোনও লোকসমষ্টি আল্লাহর ঘরসমূহের মধ্যে কোনও একটি ঘরে একত্র হয়ে)। এখানে আল্লাহর ঘর বলে মসজিদ বোঝানো হয়েছে।
তখনকার যুগে কুরআন শিক্ষা ও ইলমে দীন চর্চার আমল মসজিদেই হত। সে এ হাদীছে বিশেষভাবে মসজিদের কথা বলা হয়েছে। মূল বিষয় যেহেতু কুরআন মাজীদের শিক্ষা ও চর্চা, কাজেই মসজিদ না হয়ে অন্য কোথাও যদি এ আমল করা হয়, তাতেও এ হাদীছে বর্ণিত ফযীলত লাভ হবে। বর্তমানকালে মসজিদের পাশাপাশি আলাদা শিক্ষালয়েও এ আমল ব্যাপকভাবে জারি আছে; বরং মসজিদ অপেক্ষা পৃথক শিক্ষাগারই এর জন্য বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মসজিদ নয় বলে সে শিক্ষাগার বা মাদরাসাসমূহের কুরআন চর্চা এ ফযীলত থেকে খারিজ হয়ে যাবে না।
অবশ্য হাদীছে ব্যবহৃত শব্দটি সরাসরিও মক্তব-মাদরাসার গৃহসমূহকে শামিল করে। হাদীছের শব্দ হচ্ছে بيت من بيوت الله (আল্লাহর ঘরসমূহের কোনও ঘর)। তার মানে যেসকল ঘরে আল্লাহর কালাম শিক্ষা দেওয়া হয়, তাঁর নাযিল করা শরীআতের চর্চা হয় এবং তাঁর মনোনীত দীনের প্রচার-প্রতিষ্ঠায় মেহনত হয়। আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পৃক্ত ও বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ আমলের কেন্দ্র হওয়ায় এসব ঘরকে 'আল্লাহর ঘর' বলা হয়ে থাকে।
যাহোক আল্লাহর কোনও ঘরে তারা কী উদ্দেশ্যে জমায়েত হয়? হাদীছের পরবর্তী অংশে জানানো হয়েছে-يتلون كتاب الله ويتدارسونه بينهم (তারা আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত এবং নিজেদের মধ্যে তার পঠন-পাঠনে মশগুল থাকে)। يتدارسون ক্রিয়াপদটি درس থেকে নির্গত। এর অর্থ পাঠ করা, বোঝা ও মুখস্থ করার উদ্দেশ্যে পড়া। অর্থ পরস্পরের মধ্যে পাঠবিনিময় করা। এর একটা সুরত তো এরকম যে, একজন কিছুটা পড়ল, তারপর অন্যজন হুবহু সেটুকুই পড়ল। এরূপ পড়ার দ্বারা পঠিত বিষয় সহজে মুখস্থ হয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযানের প্রতি রাতে হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামের সঙ্গে কুরআন মাজীদ এভাবে পড়তেন।
এর আরেক সুরত হচ্ছে উস্তাযকর্তৃক ছাত্র পড়ানো। উস্তায একটা অংশ ছাত্রকে পড়িয়ে দিল, তারপর ছাত্র নিজে নিজে তা পড়তে থাকল। তারপর আবার ছাত্র উস্তাযকে তা শোনাল। এটাও يتدارسون -এর অন্তর্ভুক্ত। এ পদ্ধতিটি যেমন কুরআন মাজীদের শব্দপাঠের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তেমনি এর অর্থ ও মর্মের জন্যও প্রযোজ্য বটে। অর্থাৎ উস্তায ছাত্রের সামনে আয়াত পড়ে তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দিল এবং ছাত্র তা মনোযোগ সহকারে শুনল। কোনও কথা বুঝে না আসলে তা জিজ্ঞেস করে নিল, আবার কোনও প্রশ্ন জাগলে তা উত্থাপন করল। অর্থাৎ যথারীতি পাঠদান ও পাঠগ্রহণ।
কুরআন মাজীদের পারস্পরিক পাঠবিনিময় ও সম্মিলিত পঠন-পাঠন অত্যন্ত বরকতময় ও ফযীলতপূর্ণ আমল। হাদীছে এর চারটি ফীলত উল্লেখ করা হয়েছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন إلا نزلت عليهم السكينة، وغشيتهم الرحمة، وحفتهم الملائكة، وذكرهم الله فيمن عنده (তাদের উপর সাকীনা নাযিল হয়, রহমত তাদেরকে ঢেকে নেয়, ফিরিশতাগণ তাদেরকে ঘিরে রাখেন এবং আল্লাহ তাঁর কাছে উপস্থিত (ফিরিশতা)-দের মধ্যে তাদের উল্লেখ করেন)। সাকীনা হচ্ছে মনের ওই স্থিরতা ও শান্ত-সমাহিত অবস্থার নাম, যা আল্লাহর যিকির ও কুরআন তিলাওয়াতের ফলে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নাযিল করা হয়। যেমন ইরশাদ হয়েছে أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ 'স্মরণ রেখ, কেবল আল্লাহর যিকিরেই অন্তরে প্রশান্তি লাভ হয়।
অন্যত্র ইরশাদ هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ السَّكِينَةَ فِي قُلُوبِ الْمُؤْمِنِينَ لِيَزْدَادُوا إِيمَانًا مَعَ إِيمَانِهِمْ “তিনিই মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি অবতীর্ণ করেছেন, যাতে তাদের ঈমানে অধিকতর ঈমান যুক্ত হয়।
সাকীনা দ্বারা ঈমানে মজবুতী আসে, যদ্দরুন পার্থিব কোনও বিপদাপদে চিত্তচাঞ্চল্য ও পেরেশানি দেখা দেয় না। মন এ বিশ্বাসে অবিচল থাকে যে, সমগ্র কায়েনাত আল্লাহর কুদরতের অধীন। সবকিছু তাঁর ইচ্ছাতেই হয়। তাঁর ইচ্ছার বাইরে কোনওকিছু ঘটা সম্ভব নয়। কাজেই অস্থির না হয়ে আল্লাহতে সমর্পিত থাকাই শ্রেয়। তাতে বিপদাপদের বিনিময়ে তিনি অভাবনীয় আজর ও ছাওয়াব দান করেন। যার অন্তরে সাকীনা থাকে, সে ওই আজর ও ছাওয়াবের আশায় যাবতীয় পরিস্থিতিতে শান্ত ও ভারমুক্ত থাকে। এমনিভাবে আল্লাহ তাআলার যাবতীয় বিধি-বিধান পালনেও সে স্থির-অবিচল থাকে। পরিবেশ-পরিস্থিতি তাকে প্রভাবিত করতে পারে না। নিন্দুকের নিন্দা ও প্রশংসাকারীর প্রশংসায় তার ভাবান্তর হয় না। সুতরাং সাকীনা আল্লাহ তাআলার এক বিরাট নিআমত। কুরআন তিলাওয়াত ও কুরআনে লিপ্ততা দ্বারা এ নিআমত অর্জিত হয়।
রহমত ঢেকে নেওয়ার অর্থ চতুর্দিক থেকে এমনভাবে বেষ্টন করে ফেলা যে, কোনও বিপদ-আপদ বা পরিবেশ-পরিস্থিতির কুপ্রভাব তাদের অন্তর স্পর্শ করতে পারে না। সব হালতে তাদের উপর আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ ও করুণা বর্ধিত হতে থাকে। ফলে শয়তানের প্ররোচনা ও নফসের ওয়াসওয়াসা তাদের অন্তরে প্রভাব ফেলতে পারে না।
ফিরিশতা তাদের পরিবেষ্টন করে রাখে। তারা রহমত ও বরকতের ফিরিশতা। আল্লাহ তাআলা একদল ফিরিশতাকে এ কাজে নিযুক্ত করে রেখেছেন। তারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়। যখনই কোথাও যিকির ও তিলাওয়াতের মজলিস দেখে, তখন তাদেরকে পরিবেষ্টন করে ফেলে। যেমন হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে إن الله ملائكة يطوفون في الطرق يلتمسون أهل الذكر، فإذا وجدوا قوما يذكرون الله تنادوا : هلموا إلى حاجتكم، قال فيحفونهم بأجنحتهم إلى السماء الدنيا “আল্লাহ তাআলার এমন একদল ফিরিশতা আছে, যারা পথে পথে ঘুরে বেড়ায় এবং যিকিরকারীদের সন্ধান করে। যখনই কোথাও লোকজনকে আল্লাহর যিকিরে মশগুল দেখতে পায়, তখন তারা একে অন্যকে ডেকে বলে, এসো, তোমরা তোমাদের কাঙ্ক্ষিত বিষয় পেয়ে গেছ। তারপর তারা তাদের ডানা বিস্তার করে প্রথম আসমান পর্যন্ত তাদেরকে ঘিরে রাখে।
অন্য এক হাদীছে ইরশাদ إن الله ملائكة سيارة فضلاء يبتغون مجالس الذكر 'আল্লাহ তাআলার একদল বাড়তি ফিরিশতা আছে, যারা সর্বদা পরিভ্রমণে থাকে এবং যিকিরের মজলিস অনুসন্ধান করে।
এটা করে তাদের সম্মানার্থে এবং তাদের যিকির ও তিলাওয়াত আসমানে পৌছানোর উদ্দেশ্যে। এভাবে তারা শয়তান থেকে যিকিরকারীদের হেফাজতও করে থাকে। তারা এমন কোনও ফাঁক রাখে না, যেখান থেকে শয়তান প্রবেশ করতে পারবে।
সম্মিলিত কুরআন চর্চা এমনই এক মর্যাদাপূর্ণ আমল যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর কাছের মাখলুকদের সামনে এ আমলকারীদের কথা উল্লেখ করে থাকেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানাচ্ছেন-وذكرهم الله فيمن عنده, (আল্লাহ তাঁর কাছে উপস্থিত (ফিরিশতা)-দের মধ্যে তাদের উল্লেখ করেন)। এর দ্বারা উদ্দেশ্য তাদের সামনে এ আমলকারীদের মর্যাদা তুলে ধরা এবং তাদের প্রতি নিজ সন্তুষ্টির কথা প্রকাশ করা। আল্লাহ তাআলা তাঁর যিকির বড় ভালোবাসেন। বান্দা যিকির করলে তিনি খুশি হন। তাঁর নিকটবর্তীদের সামনে যাকিরীনের উল্লেখ করা সে খুশিরই প্রকাশ । আল্লাহ বলেন فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ 'সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব।
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত একটি হাদীছে কুদসীতে আছে فإن ذكرني في نفسه ذكرته في نفسي، وإن ذكرني في ملأ ذكرته في ملأ خير منهم 'বান্দা যদি আমাকে নিজে নিজে স্মরণ করে, আমি তাকে নিজে নিজে স্মরণ করি। বান্দা যদি আমাকে কোনও সমাবেশের মধ্যে স্মরণ করে, তবে আমি তার সমাবেশ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট সমাবেশে (অর্থাৎ ফিরিশতাদের সমাবেশে) তাকে স্মরণ করি।
আমল করার প্রয়োজনীয়তা
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপরে বর্ণিত আমলসমূহের ফযীলত বয়ান করার পর এবার আমলের গুরুত্ব তুলে ধরছেন। বান্দাকে কেন এসব আমল করতে হবে, না করলে তার কী ক্ষতি, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি ইরশাদ করছেন- ومن بطأ به عمله لم يسرع به نسبه (যাকে তার আমল পিছিয়ে দেয়, তাকে তার বংশমর্যাদা এগিয়ে দিতে পারে না)।
এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে আল্লাহ তাআলার কাছে উচ্চমর্যাদায় উপনীত হওয়ার একমাত্র উপায় নেক আমল। আখেরাতে অগ্রগামী থাকারও অবলম্বন কেবলই সৎকর্ম। যে ব্যক্তি আমলে যতবেশি অগ্রগামী হবে, সে তত আগে মুক্তি পাবে। বংশমর্যাদা ও কৌলিন্য দ্বারা তা লাভ করা যাবে না। যে ব্যক্তি আমলে পিছিয়ে থাকবে, আখেরাতেও তাকে পিছিয়েই থাকতে হবে, তা সে নবীপুত্রই হোক না কেন কিংবা হোক কোনও নবীর পিতা। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তাআলার সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয় হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাঁর আত্মীয়-স্বজনকে এই বলে সতর্ক করেছেন যে يا بني عبد مناف، أنقذوا أنفسكم من النار، يا معشر بني هاشم، أنقذوا أنفسكم من النار، يا بني عبد المطلب، أنقذوا أنفسكم من النار، يا فاطمة بنت محمد، أنقذي نفسك من النار، فإني والله لا أملك لكم من الله شيئا 'হে আব্দে মানাফের বংশধরগণ! তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও। হে বন্ধু হাশিম সম্প্রদায়। তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও। হে আব্দুল মুত্তালিবের ছেলেমেয়েরা! তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও। হে মুহাম্মাদের মেয়ে ফাতেমা! তুমি নিজে নিজেকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও। আল্লাহর কসম, আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাতে আমি তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারব না।
বস্তুত আমল যার উন্নত, বংশীয় তুচ্ছতায় তার কোনও ক্ষতি নেই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জান্নাতে যে বিলাল রাযি.-এর পদচারণার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলেন, তিনি তো একজন হাবশী ও একদার ক্রীতদাসই ছিলেন।
জাহান্নামের উপর যে পুলসিরাত স্থাপিত থাকবে, প্রত্যেক মুমিনকেই তার উপর দিয়ে যেতে হবে। তা কেউ পার হবে হেঁটে হেঁটে, কেউ দৌড়ে, কেউ দ্রুতগামী অশ্বের গতিতে, কেউ বাতাসের বেগে, কেউ বা বিজলীর গতিতে। গতির এই যে পার্থক্য, তা আমলে প্রভেদের কারণেই হবে। দুনিয়ায় আমলে যে যত বেগবান, তার জান্নাতে যাওয়াও তেমনি সবেগেই হবে। সুতরাং কুরআন মাজীদেও আল্লাহ তাআলা আমলে গতিশীল হতে উৎসাহ দান করেছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ এবং নিজ প্রতিপালকের পক্ষ হতে মাগফিরাত ও সেই জান্নাত লাভের জন্য একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হও, যার প্রশস্ততা আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীতুল্য। তা মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
সুতরাং বংশমর্যাদা বা অন্য কোনও শ্রেষ্ঠত্বের ভরসায় আমলে অবহেলা না করে প্রত্যেকের উচিত সৎকর্মে অন্যকে ছাড়িয়ে যেতে সচেষ্ট থাকা।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. মুমিন ব্যক্তির দুঃখ-কষ্ট নিবারণের চেষ্টা আখেরাতের কষ্ট থেকে মুক্তিলাভের শ্রেষ্ঠতম একটি উপায়। তাই এ চেষ্টায় অবহেলা করা উচিত নয়।
খ. দুনিয়া ও আখেরাতের সংকট থেকে উত্তরণের একটি উপায় মানুষের অর্থসংকট দূর করার চেষ্টা। সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের প্রত্যেকেরই এ চেষ্টা করা উচিত।
গ. দুনিয়া ও আখেরাতে আপন দোষত্রুটি প্রকাশ হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচার লক্ষ্যে আমরা যেন অন্যের দোষত্রুটি গোপন রাখতে সচেষ্ট থাকি।
ঘ. সর্বদা আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্তির আশায় আমাদের কর্তব্য হবে নিয়মিতভাবে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা করে যাওয়া।
ঙ. আমরা অবশ্যই ইলমে দীন অর্জনের পথে একজন আত্মনিবেদিত পথিক হয়ে থাকব, যাতে আল্লাহ তাআলা আমাদের জান্নাতে পৌছা সহজ করে দেন।
চ. আল্লাহর ঘরে সম্মিলিতভাবে কুরআন মাজীদের তিলাওয়াত ও পঠন-পাঠনের যে চারটি ফযীলত আমরা জানতে পেরেছি, তা অর্জনের লক্ষ্যে আমরা অবশ্যই এ মূল্যবান আমলটি করে যাব।
ছ. আমরা এ হাদীছ দ্বারা জানতে পেরেছি মালাইকা বা ফিরিশতা নামে আল্লাহ তাআলার এক মাখলূক আছে, যারা আল্লাহপ্রদত্ত দায়িত্ব পালনে রত থাকে। আমাদের কর্তব্য তাদের প্রতি ঈমান রাখা।
জ. আল্লাহ তাআলার রহমতে তাঁর নৈকট্য ও আখেরাতের মুক্তি আমলের মাধ্যমেই লাভ হবে। জান্নাতে পৌছার অগ্রগামিতাও সাব্যস্ত হবে আমলের ভিত্তিতে, অন্যকিছুর ভিত্তিতে নয়। সুতরাং আমলে পিছিয়ে না থেকে অন্যদের ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাই প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
