আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ
৪৯- তাকদির সংশ্লিষ্ট অধ্যায়
হাদীস নং: ৬৪৮৫
আন্তর্জাতিক নং: ২৬৪৫-১
১. মাতৃ উদরে মানুষ সৃষ্টির অবস্থা (ক্রমধারা), তার রিযক, তার মৃত্যু, তার আমল এবং তার দুর্ভাগ্য ও তার সৌভাগ্য লিপিবদ্ধকরণ
৬৪৮৫। আবু তাহির আহমাদ ইবনে আমর ইবনে সারহ (রাহঃ) ......... আমির ইবনে ওয়াসিলা (রাহঃ) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) কে বলতে শুনেছেন যে, তিনি বলেছেন, হতভাগ্য সেই ব্যক্তি, যে তার মাতৃ উদর থেকে হতভাগ্য (রূপে জন্মগ্রহণ করেছে)। আর ভাগ্যবান ব্যক্তি সে, যে অন্যের কাছ থেকে উপদেশ লাভ করে। এরপর তিনি [আমির ইবনে ওয়াসিলা (রাহঃ)] রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সাহাবী হুযাইফা ইবনে আসাদ গিফারী (রাযিঃ) এর কাছে এলেন। তখন তিনি তার কাছে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) এর উক্তি বর্ণনা করলেন এবং বললেন, আমল ব্যতীত একজন মানুষ কিভাবে দুর্ভাগা (গুনাহগার) হতে পারে?
এরপর তিনি [হুযাইফা (রাযিঃ)] তাকে বললেন, তুমি কি এতে বিস্ময়বোধ করছ? আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেছেনঃ যখন শুক্রের উপর বিয়াল্লিশ রাত (দিন) অতিবাহিত হয়ে যায় তখন আল্লাহ তাআলা একজন ফিরিশতা পাঠান। সে সেটিকে (শুক্রকে) একটি আকৃতি দান করে, তার কান, চোখ, চামড়া, গোশত ও হাড় সৃষ্টি করে দেয়। এরপর সে বলে, হে আমার প্রতিপালক! সে কি পুরুষ, না স্ত্রীলোক হবে? তখন তোমার রব যা চান নির্দেশ দেন এবং ফিরিশতা (নির্দেশ মুতাবিক) লিপিবদ্ধ করেন।
এরপর সে বলতে থাকে, হে আমার প্রতিপালক! তার বয়স কত হবে? তখন তোমার রব যা চান তাই বলেন এবং সেই মুতাবিক ফিরিশতা লিখেন। এরপর সে বলতে থাকে, হে আমার প্রতিপালক! তার জীবিকা কি হবে, তখন তোমার রব তার মর্জি মাফিক মীমাংসা করেন এবং ফিরিশতা তা লিপিবদ্ধ করেন। এরপর ফিরিশতা তাঁর হাতে একটি লিপি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সে তাতে বাড়ায়ও না এবং কমায়ও না।
এরপর তিনি [হুযাইফা (রাযিঃ)] তাকে বললেন, তুমি কি এতে বিস্ময়বোধ করছ? আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেছেনঃ যখন শুক্রের উপর বিয়াল্লিশ রাত (দিন) অতিবাহিত হয়ে যায় তখন আল্লাহ তাআলা একজন ফিরিশতা পাঠান। সে সেটিকে (শুক্রকে) একটি আকৃতি দান করে, তার কান, চোখ, চামড়া, গোশত ও হাড় সৃষ্টি করে দেয়। এরপর সে বলে, হে আমার প্রতিপালক! সে কি পুরুষ, না স্ত্রীলোক হবে? তখন তোমার রব যা চান নির্দেশ দেন এবং ফিরিশতা (নির্দেশ মুতাবিক) লিপিবদ্ধ করেন।
এরপর সে বলতে থাকে, হে আমার প্রতিপালক! তার বয়স কত হবে? তখন তোমার রব যা চান তাই বলেন এবং সেই মুতাবিক ফিরিশতা লিখেন। এরপর সে বলতে থাকে, হে আমার প্রতিপালক! তার জীবিকা কি হবে, তখন তোমার রব তার মর্জি মাফিক মীমাংসা করেন এবং ফিরিশতা তা লিপিবদ্ধ করেন। এরপর ফিরিশতা তাঁর হাতে একটি লিপি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সে তাতে বাড়ায়ও না এবং কমায়ও না।
بَاب كَيْفِيَّةِ خَلْقِ الْآدَمِيِّ فِي بَطْنِ أُمِّهِ وَكِتَابَةِ رِزْقِهِ وَأَجَلِهِ وَعَمَلِهِ وَشَقَاوَتِهِ وَسَعَادَتِهِ
حَدَّثَنِي أَبُو الطَّاهِرِ، أَحْمَدُ بْنُ عَمْرِو بْنِ سَرْحٍ أَخْبَرَنَا ابْنُ وَهْبٍ، أَخْبَرَنِي عَمْرُو، بْنُ الْحَارِثِ عَنْ أَبِي الزُّبَيْرِ الْمَكِّيِّ، أَنَّ عَامِرَ بْنَ وَاثِلَةَ، حَدَّثَهُ أَنَّهُ، سَمِعَ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ مَسْعُودٍ، يَقُولُ الشَّقِيُّ مَنْ شَقِيَ فِي بَطْنِ أُمِّهِ وَالسَّعِيدُ مَنْ وُعِظَ بِغَيْرِهِ . فَأَتَى رَجُلاً مِنْ أَصْحَابِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يُقَالُ لَهُ حُذَيْفَةُ بْنُ أَسِيدٍ الْغِفَارِيُّ فَحَدَّثَهُ بِذَلِكَ مِنْ قَوْلِ ابْنِ مَسْعُودٍ فَقَالَ وَكَيْفَ يَشْقَى رَجُلٌ بِغَيْرِ عَمَلٍ فَقَالَ لَهُ الرَّجُلُ أَتَعْجَبُ مِنْ ذَلِكَ فَإِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ " إِذَا مَرَّ بِالنُّطْفَةِ ثِنْتَانِ وَأَرْبَعُونَ لَيْلَةً بَعَثَ اللَّهُ إِلَيْهَا مَلَكًا فَصَوَّرَهَا وَخَلَقَ سَمْعَهَا وَبَصَرَهَا وَجِلْدَهَا وَلَحْمَهَا وَعِظَامَهَا ثُمَّ . قَالَ يَا رَبِّ أَذَكَرٌ أَمْ أُنْثَى فَيَقْضِي رَبُّكَ مَا شَاءَ وَيَكْتُبُ الْمَلَكُ ثُمَّ يَقُولُ يَا رَبِّ أَجَلُهُ . فَيَقُولُ رَبُّكَ مَا شَاءَ وَيَكْتُبُ الْمَلَكُ ثُمَّ يَقُولُ يَا رَبِّ رِزْقُهُ . فَيَقْضِي رَبُّكَ مَا شَاءَ وَيَكْتُبُ الْمَلَكُ ثُمَّ يَخْرُجُ الْمَلَكُ بِالصَّحِيفَةِ فِي يَدِهِ فَلاَ يَزِيدُ عَلَى مَا أُمِرَ وَلاَ يَنْقُصُ " .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
তাকদীর লেখা সম্পর্কে কিছু কথা
এ হাদীছে বলা হয়েছে, ফিরিশতা মাতৃগর্ভে শিশুর কয়েকটি বিষয় লিখে থাকে। হাদীসে আছে ثم تطوى الصحف، فلا يزاد فيها ولا ينقص ‘তারপর সহীফা (রেজিস্ট্রার) ভাঁজ করে ফেলা হয়। তাতে আর কিছু বাড়ানো ও কমানো হয় না।
কিন্তু হযরত আবূ যার রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে ثم يكتب بين عينيه ما هو لاق ‘তারপর তার দুই চোখের মাঝখানে (কপালে) লিখে দেয় সে যা-কিছুর সম্মুখীন হবে তা সব।
বাস্তবিকপক্ষে উভয় বর্ণনার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। হাদীছে বর্ণিত বিষয়গুলো যেমন কোনও রেজিস্ট্রারে লেখা হয়, তেমনি শিশুর ললাটেও লিখে দেওয়া হয়।
প্রশ্ন হতে পারে, কোনও কোনও হাদীছ দ্বারা তো জানা যায় তাকদীর লেখা হয়েছে মানবসৃষ্টির অনেক আগে, যেমন হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে كتب الله مقادير الخلائق قبل أن يخلق السماوات والأرض بخمسين ألف سنة “আল্লাহ মাখলুকাতের তাকদীর লিখেছেন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগে।
উভয় বর্ণনা কি পরস্পরবিরোধী নয়?
উত্তর হলো, না, পরস্পরবিরোধী নয়। কেননা মুসলিম শরীফের হাদীছে যে তাকদীর লিখনের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে লাওহে মাহফূযের লেখা, যাকে ‘উম্মুল কিতাব'ও বলা হয়। সর্বপ্রথম আল্লাহ তাআলা তাতে সমস্ত মাখলূক সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় লিপিবদ্ধ করেছেন। হযরত উবাদা ইবনুস সামিত রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে أول ما خلق الله : القلم، ثم قال له: أكتب قال: وما أكتب؟ قال: القدر، قال فكتب ما يكون وما هو كائن إلى أن تقوم الساعة “আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম যে জিনিস সৃষ্টি করেছেন তা হলো কলম। তাকে বললেন, লেখ। সে বলল, কী লিখব? বললেন, তাকদীর। তখন কলম কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত যা-কিছু ঘটবে সব লিখল।
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা নিজ 'ইলম ও কুদরতে যা-কিছু সৃষ্টি করবেন বলে স্থির করেছেন এবং প্রত্যেক সৃষ্টির আনুষাঙ্গিক যা-কিছু নির্ধারণ করেছেন তা সব সে আদি কলম দ্বারা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সে লেখার কোনও পরিবর্তন নেই। এটি অপরিবর্তনীয় তাকদীর। তারপর ফিরিশতাদের দ্বারা মাতৃগর্ভে যে তাকদীর লেখানো হয় বলে আমাদের আলোচ্য এ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, এটা স্বতন্ত্র লিখন, যা প্রত্যেক মানবশিশুর জন্য পৃথক পৃথকভাবে লেখা হয়ে থাকে। এ লেখায় পরিবর্তনেরও সুযোগ থাকে। বিভিন্ন হাদীছে যে বিভিন্ন আমলের দ্বারা আয়ু বাড়া-কমার উল্লেখ পাওয়া যায়, তার সম্পর্কও এ লেখার সঙ্গেই। কুরআন মাজীদেও এর প্রতি ইশারা পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে يَمْحُو اللَّهُ مَا يَشَاءُ وَيُثْبِتُ وَعِنْدَهُ أُمُّ الْكِتَابِ 'আল্লাহ যা চান (অর্থাৎ যে বিধানকে ইচ্ছা করেন) রহিত করে দেন এবং যা চান বলবৎ রাখেন। সমস্ত কিতাবের যা মূল, তা তাঁরই কাছে।
মাতৃগর্ভে যে কয়েকটি বিষয় লেখা হয়
এ হাদীছে যে কয়েকটি জিনিস লেখা হয় বলে জানানো হয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো রিযিক। এর দ্বারা আমাদেরকে পরিতুষ্টির গুণ অর্জনে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তোমাদের প্রত্যেকের রিযিক যখন নির্ধারিত আছে, তখন অহেতুক লোভ করো না। বাড়তি উপার্জনের জন্য উন্মত্ত হয়ে যেও না। চেষ্টা অবশ্যই করবে, তবে তাতে বাড়াবাড়ি করবে না। যখন যা অর্জিত হয় তাতে সন্তুষ্ট থাকবে। আরও কেন অর্জিত হলো না সে আক্ষেপ করবে না।
দুনিয়ায় কে কতদিন বাঁচবে তাও লিখে দেওয়া হয়। কাজেই যার যতদিন আয়ু সে ততদিনই বাঁচবে, তার বেশিও নয় কমও নয়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ "যখন তাদের সেই নির্দিষ্ট সময় এসে পড়ে, তখন তারা এক মুহূর্তও বিলম্ব করতে পারে না এবং ত্বরাও করতে পারে না।
সুতরাং যার যখন মৃত্যু হয়, তা তার নির্দিষ্ট সময়ই হয়। তার প্রিয়জনদের উচিত আল্লাহ তাআলার ফয়সালা হিসেবে তা মেনে নেওয়া। এমন কোনও কথা বলা উচিত নয়, যা তাকদীর বা আল্লাহ তাআলার ফয়সালার বিরুদ্ধে অভিযোগ বলে মনে হয়।
বস্তুত তাকদীরের উপর বিশ্বাস রাখা ঈমানের অপরিহার্য অঙ্গ। এ বিশ্বাস ছাড়া কেউ মুমিনই হতে পারে না। মৃত্যু তো বটেই, ছোটখাটো কোনও আঘাতও তাকদীরের লিখন ছাড়া হয় না। যে-কোনও অর্জন বা যে-কোনও ক্ষয় ও বিয়োগ তাকদীর অনুযায়ীই হয়ে থাকে। এতে বিশ্বাস রাখাতেই দুনিয়ার প্রশান্তি ও আখেরাতের মুক্তি।
এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন ما بلغ عبد حقيقة الإيمان، حتى يعلم أن ما أصابه لم يكن ليخطئه، وما أخطأه لم يكن ليصيبه “কোনও বান্দা ঈমানের প্রকৃত স্তরে পৌঁছতে পারে না, যতক্ষণ না সে মনেপ্রাণে জেনে নেয় যে, যা সে লাভ করেছে তা তার হারানোর ছিল না, আর যা সে হারিয়েছে তা তার পাওয়ার ছিল না।
প্রকাশ থাকে যে, তাকদীরের বিষয়টি আল্লাহ তাআলার এক গুপ্ত রহস্য। এর প্রকৃত স্বরূপ আল্লাহ তাআলাই জানেন। এ নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করা উচিত নয়। ঘাঁটাঘাটি করলে এর কুলকিনারা পাওয়ার কোনও নিশ্চয়তা নেই। বরং তাতে অস্থিরতাই বাড়ে। এমনকি পদস্খলিত হওয়ারও যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে। উলামায়ে কেরাম বলেন, আল্লাহ তাআলা নিজ হিকমতে তাকদীরের জ্ঞান মানুষের থেকে আড়াল করে রেখেছেন। কারও আকল-বুদ্ধি তা আয়ত্ত করতে সক্ষম নয়। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, যখন তাকদীরের আলোচনা আসে, তখন তোমরা ক্ষান্ত হয়ে যেও। বলা হয়ে থাকে, জান্নাতবাসীগণ যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে, তখনই তাদের কাছে তাকদীরের রহস্য উন্মোচিত হবে, তার আগে নয়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. তাকদীরের লিখন সত্য। মানুষের রিযিক, আয়ু সবই লেখা আছে।
খ. রিযিক ও অর্থ-সম্পদের জন্য লোভ-লালসা না করে আপন অবস্থায় পরিতুষ্ট থাকা ও পরিমিত চেষ্টা করাই কাম্য।
গ. প্রিয়জনের মৃত্যুতে তাকদীর-বিরোধী অনুচিত মন্তব্য করা হতে বিরত থেকে আল্লাহর ফয়সালায় রাজি থাকাই ঈমানের দাবি।
এ হাদীছে বলা হয়েছে, ফিরিশতা মাতৃগর্ভে শিশুর কয়েকটি বিষয় লিখে থাকে। হাদীসে আছে ثم تطوى الصحف، فلا يزاد فيها ولا ينقص ‘তারপর সহীফা (রেজিস্ট্রার) ভাঁজ করে ফেলা হয়। তাতে আর কিছু বাড়ানো ও কমানো হয় না।
কিন্তু হযরত আবূ যার রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে ثم يكتب بين عينيه ما هو لاق ‘তারপর তার দুই চোখের মাঝখানে (কপালে) লিখে দেয় সে যা-কিছুর সম্মুখীন হবে তা সব।
বাস্তবিকপক্ষে উভয় বর্ণনার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। হাদীছে বর্ণিত বিষয়গুলো যেমন কোনও রেজিস্ট্রারে লেখা হয়, তেমনি শিশুর ললাটেও লিখে দেওয়া হয়।
প্রশ্ন হতে পারে, কোনও কোনও হাদীছ দ্বারা তো জানা যায় তাকদীর লেখা হয়েছে মানবসৃষ্টির অনেক আগে, যেমন হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে كتب الله مقادير الخلائق قبل أن يخلق السماوات والأرض بخمسين ألف سنة “আল্লাহ মাখলুকাতের তাকদীর লিখেছেন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগে।
উভয় বর্ণনা কি পরস্পরবিরোধী নয়?
উত্তর হলো, না, পরস্পরবিরোধী নয়। কেননা মুসলিম শরীফের হাদীছে যে তাকদীর লিখনের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে লাওহে মাহফূযের লেখা, যাকে ‘উম্মুল কিতাব'ও বলা হয়। সর্বপ্রথম আল্লাহ তাআলা তাতে সমস্ত মাখলূক সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় লিপিবদ্ধ করেছেন। হযরত উবাদা ইবনুস সামিত রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে أول ما خلق الله : القلم، ثم قال له: أكتب قال: وما أكتب؟ قال: القدر، قال فكتب ما يكون وما هو كائن إلى أن تقوم الساعة “আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম যে জিনিস সৃষ্টি করেছেন তা হলো কলম। তাকে বললেন, লেখ। সে বলল, কী লিখব? বললেন, তাকদীর। তখন কলম কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত যা-কিছু ঘটবে সব লিখল।
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা নিজ 'ইলম ও কুদরতে যা-কিছু সৃষ্টি করবেন বলে স্থির করেছেন এবং প্রত্যেক সৃষ্টির আনুষাঙ্গিক যা-কিছু নির্ধারণ করেছেন তা সব সে আদি কলম দ্বারা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সে লেখার কোনও পরিবর্তন নেই। এটি অপরিবর্তনীয় তাকদীর। তারপর ফিরিশতাদের দ্বারা মাতৃগর্ভে যে তাকদীর লেখানো হয় বলে আমাদের আলোচ্য এ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, এটা স্বতন্ত্র লিখন, যা প্রত্যেক মানবশিশুর জন্য পৃথক পৃথকভাবে লেখা হয়ে থাকে। এ লেখায় পরিবর্তনেরও সুযোগ থাকে। বিভিন্ন হাদীছে যে বিভিন্ন আমলের দ্বারা আয়ু বাড়া-কমার উল্লেখ পাওয়া যায়, তার সম্পর্কও এ লেখার সঙ্গেই। কুরআন মাজীদেও এর প্রতি ইশারা পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে يَمْحُو اللَّهُ مَا يَشَاءُ وَيُثْبِتُ وَعِنْدَهُ أُمُّ الْكِتَابِ 'আল্লাহ যা চান (অর্থাৎ যে বিধানকে ইচ্ছা করেন) রহিত করে দেন এবং যা চান বলবৎ রাখেন। সমস্ত কিতাবের যা মূল, তা তাঁরই কাছে।
মাতৃগর্ভে যে কয়েকটি বিষয় লেখা হয়
এ হাদীছে যে কয়েকটি জিনিস লেখা হয় বলে জানানো হয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো রিযিক। এর দ্বারা আমাদেরকে পরিতুষ্টির গুণ অর্জনে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তোমাদের প্রত্যেকের রিযিক যখন নির্ধারিত আছে, তখন অহেতুক লোভ করো না। বাড়তি উপার্জনের জন্য উন্মত্ত হয়ে যেও না। চেষ্টা অবশ্যই করবে, তবে তাতে বাড়াবাড়ি করবে না। যখন যা অর্জিত হয় তাতে সন্তুষ্ট থাকবে। আরও কেন অর্জিত হলো না সে আক্ষেপ করবে না।
দুনিয়ায় কে কতদিন বাঁচবে তাও লিখে দেওয়া হয়। কাজেই যার যতদিন আয়ু সে ততদিনই বাঁচবে, তার বেশিও নয় কমও নয়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ "যখন তাদের সেই নির্দিষ্ট সময় এসে পড়ে, তখন তারা এক মুহূর্তও বিলম্ব করতে পারে না এবং ত্বরাও করতে পারে না।
সুতরাং যার যখন মৃত্যু হয়, তা তার নির্দিষ্ট সময়ই হয়। তার প্রিয়জনদের উচিত আল্লাহ তাআলার ফয়সালা হিসেবে তা মেনে নেওয়া। এমন কোনও কথা বলা উচিত নয়, যা তাকদীর বা আল্লাহ তাআলার ফয়সালার বিরুদ্ধে অভিযোগ বলে মনে হয়।
বস্তুত তাকদীরের উপর বিশ্বাস রাখা ঈমানের অপরিহার্য অঙ্গ। এ বিশ্বাস ছাড়া কেউ মুমিনই হতে পারে না। মৃত্যু তো বটেই, ছোটখাটো কোনও আঘাতও তাকদীরের লিখন ছাড়া হয় না। যে-কোনও অর্জন বা যে-কোনও ক্ষয় ও বিয়োগ তাকদীর অনুযায়ীই হয়ে থাকে। এতে বিশ্বাস রাখাতেই দুনিয়ার প্রশান্তি ও আখেরাতের মুক্তি।
এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন ما بلغ عبد حقيقة الإيمان، حتى يعلم أن ما أصابه لم يكن ليخطئه، وما أخطأه لم يكن ليصيبه “কোনও বান্দা ঈমানের প্রকৃত স্তরে পৌঁছতে পারে না, যতক্ষণ না সে মনেপ্রাণে জেনে নেয় যে, যা সে লাভ করেছে তা তার হারানোর ছিল না, আর যা সে হারিয়েছে তা তার পাওয়ার ছিল না।
প্রকাশ থাকে যে, তাকদীরের বিষয়টি আল্লাহ তাআলার এক গুপ্ত রহস্য। এর প্রকৃত স্বরূপ আল্লাহ তাআলাই জানেন। এ নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করা উচিত নয়। ঘাঁটাঘাটি করলে এর কুলকিনারা পাওয়ার কোনও নিশ্চয়তা নেই। বরং তাতে অস্থিরতাই বাড়ে। এমনকি পদস্খলিত হওয়ারও যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে। উলামায়ে কেরাম বলেন, আল্লাহ তাআলা নিজ হিকমতে তাকদীরের জ্ঞান মানুষের থেকে আড়াল করে রেখেছেন। কারও আকল-বুদ্ধি তা আয়ত্ত করতে সক্ষম নয়। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, যখন তাকদীরের আলোচনা আসে, তখন তোমরা ক্ষান্ত হয়ে যেও। বলা হয়ে থাকে, জান্নাতবাসীগণ যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে, তখনই তাদের কাছে তাকদীরের রহস্য উন্মোচিত হবে, তার আগে নয়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. তাকদীরের লিখন সত্য। মানুষের রিযিক, আয়ু সবই লেখা আছে।
খ. রিযিক ও অর্থ-সম্পদের জন্য লোভ-লালসা না করে আপন অবস্থায় পরিতুষ্ট থাকা ও পরিমিত চেষ্টা করাই কাম্য।
গ. প্রিয়জনের মৃত্যুতে তাকদীর-বিরোধী অনুচিত মন্তব্য করা হতে বিরত থেকে আল্লাহর ফয়সালায় রাজি থাকাই ঈমানের দাবি।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)


বর্ণনাকারী: