আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ

৪৮- সদ্ব্যবহার,আত্নীয়তা রক্ষা (মুআশারা) ও বিবিধ শিষ্টাচার

হাদীস নং: ৬৪৬৯
আন্তর্জাতিক নং: ২৬৩৮-২
৪৯. আত্মাসমূহ সম্মিলিত (বহুমাত্রিক) দল
৬৪৬৯। যুহাইর ইবনে হারব (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে মারফু সনদে বর্ণিত। তিনি বলেন, মানুষের উপমা হচ্ছে স্বর্ণ ও রৌপ্যের খনির মত। জাহিলীয়া যুগে যারা উত্তম ছিলেন তারা ইসলামী যুগেও উত্তম (বলে বিবেচিত হবেন), যখন তারা ফিকহ (দ্বীনের) জ্ঞান সম্পন্ন হয় (দ্বীনের সমঝদার হয়ে থাকেন) আর আত্মাসমূহ সম্মিলিত বাহিনীতুল্য (স্বভাবজাত কারণে পৃথক পৃথক)। (সেখানে) যে সব আত্মা পরস্পরে পরিচিত ছিল (দুনিয়াতে) সেগুলো সখ্যতার বন্ধনে আব্দ্ধ; আর সেখানে যেগুলো অপরিচিত ছিল, এখানেও তারা মতভেদপূর্ণ অপরিচিত।
باب الأَرْوَاحِ جُنُودٌ مُجَنَّدَةٌ
حَدَّثَنِي زُهَيْرُ بْنُ حَرْبٍ، حَدَّثَنَا كَثِيرُ بْنُ هِشَامٍ، حَدَّثَنَا جَعْفَرُ بْنُ بُرْقَانَ، حَدَّثَنَا يَزِيدُ بْنُ الأَصَمِّ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، بِحَدِيثٍ يَرْفَعُهُ قَالَ " النَّاسُ مَعَادِنُ كَمَعَادِنِ الْفِضَّةِ وَالذَّهَبِ خِيَارُهُمْ فِي الْجَاهِلِيَّةِ خِيَارُهُمْ فِي الإِسْلاَمِ إِذَا فَقُهُوا وَالأَرْوَاحُ جُنُودٌ مُجَنَّدَةٌ فَمَا تَعَارَفَ مِنْهَا ائْتَلَفَ وَمَا تَنَاكَرَ مِنْهَا اخْتَلَفَ " .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

معادن শব্দটি معدن -এর বহুবচন। এর অর্থ খনি। এ হাদীছে মানুষকে খনির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। খনিতে সোনা-রুপা, লোহা, শীসা প্রভৃতি সম্পদ থাকে। তদ্রূপ মানুষও বিভিন্ন গুণের ধারক হয়ে থাকে, তাই রূপকার্থে তাকে معدن (খনি) বলা হয়েছে।

খনিজ সম্পদ প্রাকৃতিক হয়ে থাকে। তেমনিভাবে মানুষও প্রাকৃতিক তথা জন্মগতভাবে বিভিন্ন গুণের অধিকারী হয়ে থাকে। খনিজ সম্পদের মধ্যে কোনওটি অপেক্ষা কোনওটি বেশি দামী। মানুষের জন্মগত গুণাবলীতেও পার্থক্য থাকে। জন্মগতভাবে একজন অপেক্ষা অন্যজন উন্নত গুণের অধিকারী হয়। বিশেষ বিশেষ গুণের কারণে কেউ কেউ এত উপরে চলে যায় যে, অন্যরা তাদেরকে নেতৃত্বের আসনে বসাতে বাধ্য হয়। অনেক সময় গোত্রবিশেষের মধ্যেও অন্যদের তুলনায় ভালো ভালো গুণ বেশি পাওয়া যায়। ফলে সেসব গোত্র অন্যান্য গোত্র অপেক্ষা অভিজাত বলে গণ্য হয়। তাদেরকে অন্যদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করা হয়।

বোঝা গেল ঈমান ও ইসলামের শর্ত ছাড়াও জন্মগত সদ্‌গুণের কারণেও কেউ কেউ অপেক্ষাকৃত শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হতে পারে। তবে এ শ্রেষ্ঠত্ব কেবলই পার্থিব বিষয়। আল্লাহ তাআলার কাছে শ্রেষ্ঠত্ব লাভের জন্য ইসলাম শর্ত। জন্মগত সদ্‌গুণের সঙ্গে যদি ইসলাম যুক্ত হয়ে যায়, তবে তুলনামূলকভাবে অপরাপর মুসলিম অপেক্ষা তার মর্যাদা উপরে চলে যায়। সেইসঙ্গে সে যদি ইলমে দীনের অধিকারীও হয়, তবে সর্বশ্রেষ্ঠদের কাতারে চলে যায়। আলোচ্য হাদীছে সেদিকে ইঙ্গিত রয়েছে।

দীনের বুঝ-জ্ঞান থাকার মর্যাদা
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করছেন- خيارهم في الجاهلية خيارهم في الإسلام اذا فقهوا (জাহেলী যুগে তাদের মধ্যে যারা শ্রেষ্ঠ ছিল, ইসলামেও তারাই শ্রেষ্ঠ, যখন তারা দীনের বুঝ-জ্ঞান অর্জন করবে)। অর্থাৎ ইসলামেও তারাই শ্রেষ্ঠ, যারা জাহিলী যুগে শ্রেষ্ঠ ছিল। তবে একটা শর্ত রয়েছে। শর্তটি হলো দীনের জ্ঞান বুঝ থাকা। যারা দীনের জ্ঞান-বুঝ হাসিল করেছে, প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্ব তাদেরই। জাহিলী যুগে যদি তারা শ্রেষ্ঠ হয়ে থাকে, তবে ইসলামে তারা অধিকতর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হবে। কেননা জাহিলী যুগে যে সমস্ত সদগুণের কারণে তারা অন্যদের ছাড়িয়ে গিয়েছিল, যেমন সাহসিকতা, অতিথিপরায়ণতা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা, সত্যবাদিতা ইত্যাদি, ইসলামেও সেগুলোর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তো যখন এসব সদগুণ আগে থেকেই তাদের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে, সেইসঙ্গে দীনের 'ইলম ও অনুসরণের বাড়তি মহিমাও অর্জন হয়ে গেল, তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা ইসলামেও অন্যান্যদের থেকে এগিয়ে থাকবে। বাস্তব ইতিহাসও তাই প্রমাণ করে।

জাহিলী যুগে কুরায়শ গোত্র বিভিন্ন সদগুণে অন্যসব গোত্রের চেয়ে অগ্রসর ছিল। এ কারণে তারা অন্যান্য গোত্রের উপর নেতৃত্ব দান করত। ইসলামী যুগেও দেখা গেল তারা সকলের অগ্রগামী। সেই কুরায়শ গোত্রের ভেতর আবার বনু হাশিমকে শ্রেষ্ঠ মনে করা হতো। তার মানে বনূ হাশিম সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গোত্র। তাই এ গোত্রেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব হয়। এক হাদীছে তিনি এ গোত্রের শ্রেষ্ঠত্বের সাক্ষ্য দান করেছেন। ইসলামী যুগেও তাদের সে শ্রেষ্ঠত্ব বজায় থাকে।

শ্রেষ্ঠত্ব লাভের জন্য এ হাদীছে যে শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, অর্থাৎ দীনের বুঝ-জ্ঞান, তা না পাওয়া গেলে কোনও ব্যক্তি বা কোনও গোত্র শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হতে পারবে না, তাতে সে ব্যক্তি বা সে গোত্র জাহিলী যুগে যতই অভিজাত গণ্য হোক না কেন। বরং জাহিলী যুগে সর্বনিম্ন স্তরের গণ্য হওয়া সত্ত্বেও যে ব্যক্তি দীন বুঝবে ও দীনের অনুসরণ করবে, সে অবশ্যই বেদীনদের তুলনায় অনেক বেশি মর্যাদাবান সাব্যস্ত হবে। ইসলামে প্রকৃত মর্যাদার মাপকাঠি কেবলই দীনের বুঝ-জ্ঞান।

উল্লেখ্য, দীনের বুঝ-জ্ঞান ও আমল-অনুসরণ পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। দীনের অনুসরণ যদি না করা হয়, তবে কেবল বুঝ জ্ঞানের কোনও মূল্য নেই। সুতরাং যে সকল স্থানে দীনের ইলম ও দীনের বুঝ-সমঝের মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে, তাতে আমল ও অনুসরণের বিষয়টাও অপরিহার্যভাবে তার অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

পারস্পরিক মিল-অমিলের রহস্য
হাদীছটির দ্বিতীয় অংশে মানুষের পাস্পরিক মনের মিল-অমিলের রহস্য বর্ণিত হয়েছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন
الأرواح جنود مجندة 'রূহসমূহ বহুদলে বিভক্ত (ছিল)'। অর্থাৎ রূহসমূহকে সৃষ্টি করা হয়েছিল দেহের আগে। সৃষ্টি করার পর রূহসমূহকে বিভিন্ন দলে ভাগ করে আলাদা আলাদা রাখা হয়েছিল। একেক দলকে একেক স্থানে। অথবা এর অর্থ স্বভাব-চরিত্রে রূহসমূহ বিভিন্ন দলে বিভক্ত। একেক দল একেক স্বভাব-চরিত্রের অধিকারী। তার মধ্যে আবার কারও তুলনায় কারও স্বভাব-চরিত্র অনেক উচ্চস্তরের। কোনও কোনও রূহ এমন উন্নত গুণের অধিকারী হয়ে থাকে, যদ্দরুন তারা দুনিয়ায় আসার পর সকলের মধ্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিতরূপে পরিগণিত হয় এবং অন্যদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়।

فما تعارف منها ائتلف وما تناكر منها اختلف (তার মধ্যে যারা পরস্পর পরিচিত ছিল তাদের মধ্যে সম্প্রীতি দেখা দেয়। যারা পরস্পর অপরিচিত ছিল তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়)। অর্থাৎ‍ দুনিয়ায় দুই ব্যক্তির মধ্যে যে সদ্ভাব ও সম্প্রীতি দেখা দেয়, তা আত্মীয় হোক বা না হোক, তা এ কারণে যে, রূহের জগতে এ দুই ব্যক্তির রূহ একদলে একত্রে ছিল। দুনিয়ায় তাদের মধ্যে দেখা হওয়ার পর উভয়ের রূহ একে অপরকে চিনতে পেরেছে। সে পরিচয়ের সূত্র ধরে সহজেই উভয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

অপরদিকে শত চেষ্টাতেও দুই ব্যক্তির মধ্যে যে সুসম্পর্ক ও সম্প্রীতি গড়ে ওঠে না, তারও কারণ হলো সে ব্যক্তিদ্বয়ের রূহ রূহানী জগতে ভিন্ন ভিন্ন দলভুক্ত ছিল। তাদের একজনের রূহের কাছে অপরজনের রূহ অপরিচিত ছিল। তাই দুনিয়ার আসার পরও তারা পরস্পর অপরিচিত থেকে যায়। তাই সহজে তাদের মধ্যে সদ্ভাব গড়ে ওঠে না।

অথবা হাদীছটির অর্থ হলো, যেহেতু সৃষ্টিগতভাবে রূহসমূহকে বিভিন্ন স্বভাব-চরিত্র দেওয়া হয়েছে, তাই দুনিয়ায় যার সঙ্গে যার স্বভাবের মিল হয় তার সঙ্গে তার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে, তা আত্মীয় না হলেও। অপরদিকে যে দুই ব্যক্তির মধ্যে আত্মীয়তা থাকা সত্ত্বেও মিলমিশ হয় না, তার কারণ তাদের রূহের মধ্যে স্বভাবগত মিল নেই।

প্রকাশ থাকে যে, অমিল যদি দ্বন্দ্ব-কলহ ও শত্রুতার পর্যায়ে না পৌছায়, তবে তাতে দোষ নেই। স্বভাবগত অমিলের ক্ষেত্রে দুই ব্যক্তির মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হওয়া কঠিন বটে। শুধু লক্ষ রাখা জরুরি অমিলের কারণে যেন আচার-আচরণ অসৌজন্যমূলক না হয় এবং একজনের দ্বারা অন্যজনের কোনও হকও নষ্ট না হয়।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. অমুসলিম ব্যক্তির মধ্যেও উল্লেখযোগ্য ভালো গুণ থাকতে পারে। তা দ্বারা সে দুনিয়ায় উপকৃত হবে, কিন্তু ঈমান না থাকার কারণে আখেরাতে তা কোনও কাজে আসবে না।

খ. সদ্গুণসম্পন্ন অমুসলিম ব্যক্তি ঈমান আনলে মুসলিম হিসেবে তার মর্যাদা অনেক বেড়ে যায়।

গ. কোনও মুসলিম ব্যক্তির মধ্যে জন্মগতভাবে বিশেষ কোনও অসদ্গুণ থাকলে তার কর্তব্য সাধনা-মুজাহাদা দ্বারা তা সংযত ও দমিত রাখা।

ঘ. স্বভাবগত মিল না থাকলে দুই ব্যক্তির মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়া কঠিন। তবে সতর্ক থাকা জরুরি যাতে সে অমিল শত্রুতা ও বিদ্বেষের কারণ না হয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)