আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ
৪৮- সদ্ব্যবহার,আত্নীয়তা রক্ষা (মুআশারা) ও বিবিধ শিষ্টাচার
হাদীস নং: ৬২৭৮
২. নফল নামায ইত্যাদির উপর মাতাপিতার খিদমত অগ্রগণ্য
৬২৭৮। যুহাইর ইবনে হারব (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) সূত্রে নবী (ﷺ)থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ তিনজন ব্যতীত কেউ দোলনায় কথা বলেনি। তার মধ্যে একজন ঈসা ইবনে মারইয়াম (আলাইহিস সালাম), আরেকজন জুরায়জ এর ঘটনার শিশু। জুরায়জ ছিলেন একজন ইবাদতগুজার ব্যক্তি। তিনি একটি ইবাদতখানা তৈরী করে সেখানে অবস্থান করতেন। তখন তার কাছে তার মা আসলেন। তিনি সে সময় নামাযে মশগুল ছিলেন। মা ডাকলেন, হে জুরায়জ! তখন তিনি (মনে মনে) বলতে লাগলেন, হে পরওয়ারদিগার! (একদিকে) আমার মা ও (অপর দিকে) আমার নামায। এরপর তিনি নামাযে মশগুল রইলেন। আর মা ফিরে গেলেন।
পরের দিন তিনি আবার তার কাছে আসলেন। তখনও তিনি নামায আদায় করছিলেন। তিনি বললেন, হে জুরায়জ! তখন তিনি (মনে মনে) বললেন, হে আমার প্রতিপালক! একদিকে আমার মা (আমাকে ডাকছেন) আর (অন্য দিকে) আমার নামায। এরপর তিনি নামাযে মশগুল রইলেন। তখন মা বললেন, হে আল্লাহ! বদকার স্ত্রীলোকের চেহারা দেখার আগে তুমি তার মৃত্যু দিয়ো না।
এরপর বনু ইসরাঈলদের মধ্যে জুরায়জ ও তার ইবাদত সম্পর্কে আলোচনা হতে লাগল। (বনী ইসরাঈলের মধ্যে) সৌন্দর্য উপমেয় এক দুশ্চরিত্রা স্ত্রীলোক ছিল। সে বলল, যদি তোমরা চাও তাহলে আমি তোমাদের সামনে তাকে (জুরায়জকে) ফিতনায় ফেলতে পারি। তিনি বলেন, এরপর সে সাজসজ্জা করে জুরায়জের সামনে উপস্থিত। কিন্তু জুরায়জ তার প্রতি ভ্রুক্ষেপও করেন নি। অবশেষে সে এক মেষ রাখালের কাছে এল। সে জুরায়জের ইবাদতখানায় আশ্রয় নিত। সে তাকে নিজের দিকে প্রলুব্ধ করল। সে (রাখাল) তার উপর উপগত হল। এতে সে গর্তবতী হয়ে গেল।
যখন সে সন্তান প্রসব করল তখন বলে দিল যে, এই সন্তান জুরায়জের। লোকেরা (একথা শুনে) তার কাছে এসে জড়ো হল এবং তাঁকে নীচে নেমে আসতে বাধ্য করল এবং তারা তার ইবাদতখানা ধ্বংস করে দিল আর তাকে প্রহার করতে লাগল। তখন তিনি (জুরায়জ) জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের ব্যাপার কী? তারা বলল, তুমি তো এই দূশ্চরিত্রা স্ত্রীলোকের সাথে ব্যভিচার করেছ এবং তোমার পক্ষ থেকে সে সন্তান প্রসব করেছে। তখন তিনি বললেন, শিশুটি কোথায়? তারা শিশুটি নিয়ে এলো। এরপর তিনি বললেন, আমাকে একটু অবকাশ দাও, আমি নামায আদায় করে নেই। তারপর তিনি নামায আদায় করলেন এবং নামায শেষে কাছে এলেন।
এরপর তিনি শিশুটির পেটে টোকা দিয়ে বললেন হে বৎস! তোমার পিতা কে? সে উত্তর করল, অমুক রাখাল। বর্ণনাকারী বলেন, তখন লোকেরা জুরায়জের দিকে এগিয়ে আসল এবং তাঁকে চুম্বন করতে এবং তাঁর গায়ে হাত বুলাতে লাগল। এরপর বলল, আমরা আপনার ইবাদতখানা স্বর্ণ দ্বারা নির্মাণ করে দেব। তিনি বললেন, না বরং পুনরায় মাটি দিয়ে তৈরী করে দাও, যেমন ছিল। লোকেরা তাই করল।
একদা এক শিশু তার মায়ের দুধ পান করছিল। তখন উত্তম পোশাকে সজ্জিত এক লোক একটি হৃষ্টপুষ্ট সওয়ারীর উপর সওয়ার হয়ে সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। তখন তার মা বলল, হে আল্লাহ! তুমি আমার ছেলেকে এর মত বানিয়ে দাও। তখন শিশুটি মাতৃস্তন ছেড়ে তার প্রতি লক্ষ্য করে বলল, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে এর মত বানিও না। এরপর সে আবার স্তনের দিকে ফিরে দুধ পান করতে লাগল।
রাবী বলেন, মনে হয় যেন আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে এখনো দেখছি যে, তিনি তার শাহাদাত অঙ্গুলি নিজ মুখে দিয়ে তা চুষে সেই শিশুটির দুধ পানের দৃশ্য দেখাচ্ছেন। এরপর বর্ণনা করলেন যে, কিছু লোক একজন যুবতীকে নিয়ে যাচ্ছিল এবং তাকে তারা প্রহার করছিল এবং বলাবলি করছিল যে, তুই যিনা করেছিস আর তুই চুরি করেছিস। আর সে বলছিল, حَسْبِيَ اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ আল্লাহরই উপর আমার ভরসা; আর তিনি উত্তম কর্ম বিধায়ক। তখন তার মা বলল, হে আল্লাহ! তুমি আমার পুত্রকে এর (দাসীর) মত বানিও না।
তখন শিশুটি দুধপান ছেড়ে তার (দাসীর) প্রতি লক্ষ্য করে বলল, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে এর (এই দাসীর) মত বানিয়ে দাও। সে সময় মা ও পুত্রের মধ্যে আলাপ হল। তখন মা বলল, ঠাটা পড়ুক (দুর্ভাগা! এ কেমন কথা)। সুদর্শন এক ব্যক্তি যাচ্ছিল তখন আমি বললাম, “হে আল্লাহ! তুমি আমার ছেলেকে এর মত বানিও”। এরপর তুমি বললে হে আল্লাহ! তুমি আমাকে এর মত বানিও না। এরপর লোকেরা এই দাসীকে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন তারা তাকে প্রহার করছিল এবং বলছিল, যিনা করেছিস এবং চুরি করেছিস। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহ! তুমি আমার ছেলেকে তার মত বানিও না। আর তুমি বললে, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তার মত বানাও।
সে বলল, সেই আরোহী ব্যক্তি ছিল অত্যাচারী। তাই আমি বলেছি, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তার মত বানিও না। আর যে দাসীকে ওরা বলছিল, তুই যিনা করেছিস। আসলে সে ব্যভিচারে লিপ্ত না এবং বলছিল, চুরি করেছিস, অথচ সে চুরি করেনি। তাই আমি বললাম, “হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তার মত বানিয়ে দাও”।
পরের দিন তিনি আবার তার কাছে আসলেন। তখনও তিনি নামায আদায় করছিলেন। তিনি বললেন, হে জুরায়জ! তখন তিনি (মনে মনে) বললেন, হে আমার প্রতিপালক! একদিকে আমার মা (আমাকে ডাকছেন) আর (অন্য দিকে) আমার নামায। এরপর তিনি নামাযে মশগুল রইলেন। তখন মা বললেন, হে আল্লাহ! বদকার স্ত্রীলোকের চেহারা দেখার আগে তুমি তার মৃত্যু দিয়ো না।
এরপর বনু ইসরাঈলদের মধ্যে জুরায়জ ও তার ইবাদত সম্পর্কে আলোচনা হতে লাগল। (বনী ইসরাঈলের মধ্যে) সৌন্দর্য উপমেয় এক দুশ্চরিত্রা স্ত্রীলোক ছিল। সে বলল, যদি তোমরা চাও তাহলে আমি তোমাদের সামনে তাকে (জুরায়জকে) ফিতনায় ফেলতে পারি। তিনি বলেন, এরপর সে সাজসজ্জা করে জুরায়জের সামনে উপস্থিত। কিন্তু জুরায়জ তার প্রতি ভ্রুক্ষেপও করেন নি। অবশেষে সে এক মেষ রাখালের কাছে এল। সে জুরায়জের ইবাদতখানায় আশ্রয় নিত। সে তাকে নিজের দিকে প্রলুব্ধ করল। সে (রাখাল) তার উপর উপগত হল। এতে সে গর্তবতী হয়ে গেল।
যখন সে সন্তান প্রসব করল তখন বলে দিল যে, এই সন্তান জুরায়জের। লোকেরা (একথা শুনে) তার কাছে এসে জড়ো হল এবং তাঁকে নীচে নেমে আসতে বাধ্য করল এবং তারা তার ইবাদতখানা ধ্বংস করে দিল আর তাকে প্রহার করতে লাগল। তখন তিনি (জুরায়জ) জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের ব্যাপার কী? তারা বলল, তুমি তো এই দূশ্চরিত্রা স্ত্রীলোকের সাথে ব্যভিচার করেছ এবং তোমার পক্ষ থেকে সে সন্তান প্রসব করেছে। তখন তিনি বললেন, শিশুটি কোথায়? তারা শিশুটি নিয়ে এলো। এরপর তিনি বললেন, আমাকে একটু অবকাশ দাও, আমি নামায আদায় করে নেই। তারপর তিনি নামায আদায় করলেন এবং নামায শেষে কাছে এলেন।
এরপর তিনি শিশুটির পেটে টোকা দিয়ে বললেন হে বৎস! তোমার পিতা কে? সে উত্তর করল, অমুক রাখাল। বর্ণনাকারী বলেন, তখন লোকেরা জুরায়জের দিকে এগিয়ে আসল এবং তাঁকে চুম্বন করতে এবং তাঁর গায়ে হাত বুলাতে লাগল। এরপর বলল, আমরা আপনার ইবাদতখানা স্বর্ণ দ্বারা নির্মাণ করে দেব। তিনি বললেন, না বরং পুনরায় মাটি দিয়ে তৈরী করে দাও, যেমন ছিল। লোকেরা তাই করল।
একদা এক শিশু তার মায়ের দুধ পান করছিল। তখন উত্তম পোশাকে সজ্জিত এক লোক একটি হৃষ্টপুষ্ট সওয়ারীর উপর সওয়ার হয়ে সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। তখন তার মা বলল, হে আল্লাহ! তুমি আমার ছেলেকে এর মত বানিয়ে দাও। তখন শিশুটি মাতৃস্তন ছেড়ে তার প্রতি লক্ষ্য করে বলল, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে এর মত বানিও না। এরপর সে আবার স্তনের দিকে ফিরে দুধ পান করতে লাগল।
রাবী বলেন, মনে হয় যেন আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে এখনো দেখছি যে, তিনি তার শাহাদাত অঙ্গুলি নিজ মুখে দিয়ে তা চুষে সেই শিশুটির দুধ পানের দৃশ্য দেখাচ্ছেন। এরপর বর্ণনা করলেন যে, কিছু লোক একজন যুবতীকে নিয়ে যাচ্ছিল এবং তাকে তারা প্রহার করছিল এবং বলাবলি করছিল যে, তুই যিনা করেছিস আর তুই চুরি করেছিস। আর সে বলছিল, حَسْبِيَ اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ আল্লাহরই উপর আমার ভরসা; আর তিনি উত্তম কর্ম বিধায়ক। তখন তার মা বলল, হে আল্লাহ! তুমি আমার পুত্রকে এর (দাসীর) মত বানিও না।
তখন শিশুটি দুধপান ছেড়ে তার (দাসীর) প্রতি লক্ষ্য করে বলল, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে এর (এই দাসীর) মত বানিয়ে দাও। সে সময় মা ও পুত্রের মধ্যে আলাপ হল। তখন মা বলল, ঠাটা পড়ুক (দুর্ভাগা! এ কেমন কথা)। সুদর্শন এক ব্যক্তি যাচ্ছিল তখন আমি বললাম, “হে আল্লাহ! তুমি আমার ছেলেকে এর মত বানিও”। এরপর তুমি বললে হে আল্লাহ! তুমি আমাকে এর মত বানিও না। এরপর লোকেরা এই দাসীকে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন তারা তাকে প্রহার করছিল এবং বলছিল, যিনা করেছিস এবং চুরি করেছিস। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহ! তুমি আমার ছেলেকে তার মত বানিও না। আর তুমি বললে, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তার মত বানাও।
সে বলল, সেই আরোহী ব্যক্তি ছিল অত্যাচারী। তাই আমি বলেছি, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তার মত বানিও না। আর যে দাসীকে ওরা বলছিল, তুই যিনা করেছিস। আসলে সে ব্যভিচারে লিপ্ত না এবং বলছিল, চুরি করেছিস, অথচ সে চুরি করেনি। তাই আমি বললাম, “হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তার মত বানিয়ে দাও”।
باب تَقْدِيمِ بِرِّ الْوَالِدَيْنِ عَلَى التَّطَوُّعِ بِالصَّلاَةِ وَغَيْرِهَا
حَدَّثَنَا زُهَيْرُ بْنُ حَرْبٍ، حَدَّثَنَا يَزِيدُ بْنُ هَارُونَ، أَخْبَرَنَا جَرِيرُ بْنُ حَازِمٍ، حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ سِيرِينَ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " لَمْ يَتَكَلَّمْ فِي الْمَهْدِ إِلاَّ ثَلاَثَةٌ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ وَصَاحِبُ جُرَيْجٍ وَكَانَ جُرَيْجٌ رَجُلاً عَابِدًا فَاتَّخَذَ صَوْمَعَةً فَكَانَ فِيهَا فَأَتَتْهُ أُمُّهُ وَهُوَ يُصَلِّي فَقَالَتْ يَا جُرَيْجُ . فَقَالَ يَا رَبِّ أُمِّي وَصَلاَتِي . فَأَقْبَلَ عَلَى صَلاَتِهِ فَانْصَرَفَتْ فَلَمَّا كَانَ مِنَ الْغَدِ أَتَتْهُ وَهُوَ يُصَلِّي فَقَالَتْ يَا جُرَيْجُ فَقَالَ يَا رَبِّ أُمِّي وَصَلاَتِي فَأَقْبَلَ عَلَى صَلاَتِهِ فَانْصَرَفَتْ فَلَمَّا كَانَ مِنَ الْغَدِ أَتَتْهُ وَهُوَ يُصَلِّي فَقَالَتْ يَا جُرَيْجُ . فَقَالَ أَىْ رَبِّ أُمِّي وَصَلاَتِي . فَأَقْبَلَ عَلَى صَلاَتِهِ فَقَالَتِ اللَّهُمَّ لاَ تُمِتْهُ حَتَّى يَنْظُرَ إِلَى وُجُوهِ الْمُومِسَاتِ . فَتَذَاكَرَ بَنُو إِسْرَائِيلَ جُرَيْجًا وَعِبَادَتَهُ وَكَانَتِ امْرَأَةٌ بَغِيٌّ يُتَمَثَّلُ بِحُسْنِهَا فَقَالَتْ إِنْ شِئْتُمْ لأَفْتِنَنَّهُ لَكُمْ - قَالَ - فَتَعَرَّضَتْ لَهُ فَلَمْ يَلْتَفِتْ إِلَيْهَا فَأَتَتْ رَاعِيًا كَانَ يَأْوِي إِلَى صَوْمَعَتِهِ فَأَمْكَنَتْهُ مِنْ نَفْسِهَا فَوَقَعَ عَلَيْهَا فَحَمَلَتْ فَلَمَّا وَلَدَتْ قَالَتْ هُوَ مِنْ جُرَيْجٍ . فَأَتَوْهُ فَاسْتَنْزَلُوهُ وَهَدَمُوا صَوْمَعَتَهُ وَجَعَلُوا يَضْرِبُونَهُ فَقَالَ مَا شَأْنُكُمْ قَالُوا زَنَيْتَ بِهَذِهِ الْبَغِيِّ فَوَلَدَتْ مِنْكَ . فَقَالَ أَيْنَ الصَّبِيُّ فَجَاءُوا بِهِ فَقَالَ دَعُونِي حَتَّى أُصَلِّيَ فَصَلَّى فَلَمَّا انْصَرَفَ أَتَى الصَّبِيَّ فَطَعَنَ فِي بَطْنِهِ وَقَالَ يَا غُلاَمُ مَنْ أَبُوكَ قَالَ فُلاَنٌ الرَّاعِي - قَالَ - فَأَقْبَلُوا عَلَى جُرَيْجٍ يُقَبِّلُونَهُ وَيَتَمَسَّحُونَ بِهِ وَقَالُوا نَبْنِي لَكَ صَوْمَعَتَكَ مِنْ ذَهَبٍ . قَالَ لاَ أَعِيدُوهَا مِنْ طِينٍ كَمَا كَانَتْ . فَفَعَلُوا . وَبَيْنَا صَبِيٌّ يَرْضَعُ مِنْ أُمِّهِ فَمَرَّ رَجُلٌ رَاكِبٌ عَلَى دَابَّةٍ فَارِهَةٍ وَشَارَةٍ حَسَنَةٍ فَقَالَتْ أُمُّهُ اللَّهُمَّ اجْعَلِ ابْنِي مِثْلَ هَذَا . فَتَرَكَ الثَّدْىَ وَأَقْبَلَ إِلَيْهِ فَنَظَرَ إِلَيْهِ فَقَالَ اللَّهُمَّ لاَ تَجْعَلْنِي مِثْلَهُ . ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَى ثَدْيِهِ فَجَعَلَ يَرْتَضِعُ . قَالَ فَكَأَنِّي أَنْظُرُ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَهُوَ يَحْكِي ارْتِضَاعَهُ بِإِصْبَعِهِ السَّبَّابَةِ فِي فَمِهِ فَجَعَلَ يَمُصُّهَا . قَالَ وَمَرُّوا بِجَارِيَةٍ وَهُمْ يَضْرِبُونَهَا وَيَقُولُونَ زَنَيْتِ سَرَقْتِ . وَهِيَ تَقُولُ حَسْبِيَ اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ . فَقَالَتْ أُمُّهُ اللَّهُمَّ لاَ تَجْعَلِ ابْنِي مِثْلَهَا . فَتَرَكَ الرَّضَاعَ وَنَظَرَ إِلَيْهَا فَقَالَ اللَّهُمَّ اجْعَلْنِي مِثْلَهَا . فَهُنَاكَ تَرَاجَعَا الْحَدِيثَ فَقَالَتْ حَلْقَى مَرَّ رَجُلٌ حَسَنُ الْهَيْئَةِ فَقُلْتُ اللَّهُمَّ اجْعَلِ ابْنِي مِثْلَهُ . فَقُلْتَ اللَّهُمَّ لاَ تَجْعَلْنِي مِثْلَهُ . وَمَرُّوا بِهَذِهِ الأَمَةِ وَهُمْ يَضْرِبُونَهَا وَيَقُولُونَ زَنَيْتِ سَرَقْتِ . فَقُلْتُ اللَّهُمَّ لاَ تَجْعَلِ ابْنِي مِثْلَهَا . فَقُلْتَ اللَّهُمَّ اجْعَلْنِي مِثْلَهَا قَالَ إِنَّ ذَاكَ الرَّجُلَ كَانَ جَبَّارًا فَقُلْتُ اللَّهُمَّ لاَ تَجْعَلْنِي مِثْلَهُ . وَإِنَّ هَذِهِ يَقُولُونَ لَهَا زَنَيْتِ . وَلَمْ تَزْنِ وَسَرَقْتِ وَلَمْ تَسْرِقْ فَقُلْتُ اللَّهُمَّ اجْعَلْنِي مِثْلَهَا .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে তিনজন সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তারা দোলনায় থাকার বয়সে কথা বলেছে, যে বয়সে শিশুদের মুখে কথা ফোটে না। এটা ছিল আল্লাহ তাআলার কুদরতের প্রকাশ। তিনি চাইলে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুকে দিয়েও কথা বলাতে পারেন। এমনকি তিনি চাইলে গাছ ও পাথরকেও বাকশক্তি দিতে পারেন। কিয়ামতের আগে এমন ঘটবে যে, এক গাছের আড়ালে ইহুদী আত্মগোপন করে থাকবে আর সেই গাছ মুসলিম মুজাহিদকে ডেকে বলবে, এই এখানে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। হাদীছে একটি গরু সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তার পিঠে এক ব্যক্তি আরোহন করলে সেটি বলে উঠেছিল, আমাকে এইজন্য সৃষ্টি করা হয়নি। হাদীছ ও ইতিহাস গ্রন্থসমূহে এরকম আরও বহু ঘটনা বর্ণিত আছে।
এ হাদীছে তিনজনের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে দোলনার বয়সে কথা বলা শিশুদের সংখ্যা আরও বেশি। ইমাম সুয়ূতী রহ. এরকম দশজন শিশুর নাম উল্লেখ করেছেন। তাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য এক শিশু হচ্ছে, যার মাকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করার জন্য হাজির করা হয়েছিল আর সে মা তাতে নিক্ষিপ্ত হতে ভয় পাচ্ছিল, তখন শিশুটি বলে ওঠে- আম্মা, ধৈর্য ধরুন, আপনি সত্যের উপর আছেন।ফিরআউন তার কন্যার সেবিকাকে ঈমান আনার অপরাধে আগুনে নিক্ষেপ করতে চাইলে তার শিশুপুত্র মাকে লক্ষ্য করে বলেছিল يا أمه، اقتحمي، فإن عذاب الدنيا أهون من عذاب الآخرة ‘আম্মা! অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিন। কেননা দুনিয়ার শাস্তি আখেরাতের আযাব অপেক্ষা তুচ্ছ।২৬৬
এ হাদীছে তিনজনের কথা বলার দ্বারা বাকিগুলো নাকচ হয়ে যায় না। কেননা সবগুলো ঘটনা বর্ণনা করা এ হাদীছের উদ্দেশ্য নয়; বরং উদ্দেশ্য কেবল আল্লাহ তাআলার কুদরতের নমুনা বর্ণনা করা।
হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের দোলনায় কথা বলা
তিনজনের প্রথমজন হচ্ছেন হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম। তাঁর জন্ম নিয়ে যখন ইহুদীরা তাঁর মাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছিল, তখন সদ্যভূমিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাদের সামনে এক সারগর্ভ বক্তৃতা করেন। কুরআন মাজীদে তা এভাবে বর্ণিত হয়েছে-
قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا وَجَعَلَنِي مُبَارَكًا أَيْنَ مَا كُنْتُ وَأَوْصَانِي بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ مَا دُمْتُ حَيًّا وَبَرًّا بِوَالِدَتِي وَلَمْ يَجْعَلْنِي جَبَّارًا شَقِيًّا وَالسَّلَامُ عَلَيَّ يَوْمَ وُلِدْتُ وَيَوْمَ أَمُوتُ وَيَوْمَ أُبْعَثُ حَيًّا
“অমনি শিশুটি বলে উঠল, আমি আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং নবী বানিয়েছেন। এবং আমি যেখানেই থাকি না কেন আমাকে বরকতময় করেছেন এবং যত দিন জীবিত থাকি আমাকে নামায ও যাকাত আদায়ের হুকুম দিয়েছেন। এবং আমাকে আমার মায়ের প্রতি অনুগত বানিয়েছেন। আমাকে উদ্ধত ও রূঢ় বানাননি। এবং (আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে) আমার প্রতি সালাম যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন আমাকে পুনরায় জীবিত করে ওঠানো হবে।'২৬৭
জুরায়জ রহ.-এর ঘটনা
দ্বিতীয়জন হচ্ছে জুরায়জ রহ.-এর ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত এক শিশু। জুরায়জ রহ ছিলেন বনী ইসরাঈলের এক ব্যবসায়ী। ব্যবসায় কখনও লাভ ও কখনও লোকসান হওয়ায় একপর্যায়ে তার বিরক্তি ধরে যায়। শেষে তিনি একটি উপাসনালয় বানিয়ে তাতে নিভৃত জীবনযাপন করতে থাকেন এবং দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে পুরোপুরি 'রাহিব' (বৈরাগী) হয়ে যান। বৈরাগ্যবাস আগে ছিল না। এটা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের অনুসারীরা বাড়াবাড়িমূলকভাবে উদ্ভাবন করে নেয়। এর দ্বারা বোঝা যায় জুরায়জ রহ. হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের পরবর্তী জমানার লোক এবং তাঁর অনুসারীদের একজন।
কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, তার মা রোজ একবার এসে তার খোঁজ নিয়ে যেতেন। তার মা নিচ থেকে জুরায়জ বলে ডাক দিলে তিনি উপর থেকে উঁকি মেরে তার সঙ্গে কথা বলতেন। বরাবরের মত একদিন যখন তার মা এসে ডাক দিলেন, তখন তিনি নামাযরত ছিলেন। তিনি চিন্তা করছিলেন মায়ের ডাকে সাড়া দেবেন, না নামায চালিয়ে যাবেন! শেষপর্যন্ত নামাযকেই অগ্রাধিকার দিলেন। তারপর যা ঘটেছে, হাদীছের বর্ণনায় তার বিস্তারিত উল্লেখ আছে।
ব্যভিচারিণী স্ত্রীলোকটি রাখালের সঙ্গে লিপ্ত হয়ে বাচ্চা প্রসবের পর যখন জুরায়জের নামে অপবাদ দিল, তখন আমলোক সাধারণত যা করে থাকে, এ ক্ষেত্রেও তাই করল। তারা যাচাই করে দেখল না অভিযোগ সত্য কি না। এক মিথ্যা অপবাদকে চরম সত্য ধরে নিয়ে এতদিনকার ভক্তি-শ্রদ্ধা সব বিসর্জন দিল। তাঁর ইবাদত-বন্দেগী, বুযুর্গী সবকিছুই মুহূর্তের মধ্যে ভুলে গেল। তারপর যে নির্মম আচরণ তার প্রতি করল, হাদীছের বর্ণনায়ই তার উল্লেখ আছে। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, তারা জুরায়জ রহ.-কে তার ইবাদতখানা থেকে টেনে-হেঁচড়ে নামানোর পর গলায় রশি লাগিয়ে পথে-ঘাটে ঘোরাল। তারা তাকে একজন ভণ্ড ও লোকদেখানো আবেদ বলে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করল ও মারধর করতে থাকল। তাকে রাজার কাছেও নিয়ে গেল। রাজা তাকে কতক্ষণ তিরস্কার করল, তারপর তাকে শূলে চড়ানোর হুকুম দিল।
যাহোক জুরায়জ রহ. যখন এ কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন, তখন আল্লাহ তাআলা তাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করলেন। আল্লাহ তাআলার ইশারায় তিনি তাকে শিশুটির কাছে নিয়ে যেতে বললেন এবং সেখানে গিয়ে দু'রাকআত নামায পড়লেন। তারপর শিশুটির পেটে খোঁচা দিয়ে যেই না বললেন- রে বাবু! তোমার বাবা কে? অমনি শিশুটি বলে উঠল- অমুক রাখাল।
জুরায়জের এ কারামত দেখে মুহূর্তেই পরিস্থিতি বদলে গেল। এতক্ষণ যারা তাকে ঘৃণা করছিল, ফের তারা ভক্তি-শ্রদ্ধায় বিগলিত হল। কেউ ভক্তিতে চুমু দেয়, কেউ বরকতের আশায় শরীর স্পর্শ করে ইত্যাদি। এমনকি তারা স্বর্ণ দিয়ে তার উপাসনালয়টি নতুনভাবে তৈরি করে দেওয়ারও প্রস্তাব করল। কিন্তু তিনি ছিলেন খাঁটি আল্লাহওয়ালা। অর্থবিত্তের লোভ-লালসা তো আগেই ত্যাগ করেছেন। এখন তাতে আরও পরিপক্কতা এসেছে। তিনি প্রলোভনের শিকার হলেন না। আগের মতই মাটির ঘর তৈরি করে দিতে বললেন।
জুরায়জ রহ. এ বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন মায়ের বদ্দুআয়। তার কর্তব্য ছিল মায়ের ডাকে সাড়া দেওয়া। নফল ইবাদত-বন্দেগী অপেক্ষা পিতামাতার হুকুম পালন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
لو كان جريج الراهب فقيها عالما لعلم أن إجابته أنه أفضل من عبادة ربه
“সংসারত্যাগী জুরায়জ ফকীহ আলেম হলে জানতেন যে, তার পক্ষে মায়ের ডাকে সাড়া দেওয়া তার রব্বের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম ছিল।২৬৮
পিতামাতার আদেশ শরীআতবিরোধী না হলে মানা ফরয। জুরায়জ রহ.-এর দ্বারা এ ব্যাপারে ত্রুটি হয়ে গেছে। তার এ ত্রুটি মা ক্ষমা করে দিলে হয়তো কিছুই হত না, আল্লাহ তাআলাও ক্ষমা করে দিতেন। মায়ের পক্ষে সেটাই শ্রেয় ছিল। সন্তানকে বদদুআ দিতে নেই । মায়ের বদ্দুআ অমোঘ। তা লেগেই যায়। সুতরাং জুরায়জের প্রতি মায়ের বদ্দুআ লেগে গেল এবং তার সাধু জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ঘটে গেল।
বাহ্যদৃষ্টিতে যদিও জুরায়জ রহ.-কে এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটাও তার প্রতি আল্লাহ তাআলার রহমতই ছিল। দুনিয়ায় তো এর ফায়দা হয়েছে এই যে, ঘটনার পর মানুষের চোখে তিনি একজন সত্যিকারের আবেদ ও সাধকরূপে সমাদৃত হয়ে গেছেন। আর আখেরাতের ফায়দা হল মায়ের ডাকে সাড়া না দেওয়ার অপরাধ থেকে মুক্তি। এ ঘটনা দ্বারা তার অপরাধের প্রতিকার হয়ে গেছে। ফলে আশা করা যায় আখেরাতে এজন্য তাকে ধরা হবে না। আল্লাহ তাআলা তার নেক বান্দাদেরকে অনেক সময় তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতির একরকম প্রতিফল দুনিয়াতেই দিয়ে দেন, যাতে আখেরাতে পরিপূর্ণ মুক্তি পেয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানে নিরাপত্তা দান করুন।
জনৈকা নারীর দুধ পানরত শিশু
আর তৃতীয়জন হচ্ছে মায়ের কোলে দুধ পানরত শিশুটি, যার মা এক শানদার অশ্বারোহীকে দেখে আল্লাহর কাছে দুআ করেছিল শিশুটি যেন তার মত হয়। কিন্তু শিশুটি তখন দুধপান ছেড়ে দিয়ে বলে ওঠে- হে আল্লাহ, তুমি আমাকে ওর মত বানিও না। অন্যদিকে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত এক দাসীকে মারতে মারতে নিয়ে যাওয়ার সময় যখন তার মা আল্লাহর কাছে দুআ করে যে, তার বাচ্চাটি যেন ওই দাসীর মত না হয়, তখন শিশুটি বলে ওঠে- হে আল্লাহ, তুমি আমাকে তার মত বানিও।
মা শিশুটির জন্য দুআ করেছিল তার কল্যাণার্থেই। কিন্তু তার দৃষ্টি ছিল দুনিয়ার অর্থ-বিত্তের মধ্যে আবদ্ধ। তার ছিল না প্রকৃত দূরদর্শিতা, ছিল না দীনের বুঝ এবং ছিল না অন্তর্দৃষ্টিও। এ শ্রেণীর লোক দুনিয়াদারদের দেখলে দিশেহারা হয়ে যায় এবং তাদের মত হতে পারার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কুরআন মাজীদে কারুনের ঘটনায় বর্ণিত হয়েছে-
فَخَرَجَ عَلَى قَوْمِهِ فِي زِينَتِهِ قَالَ الَّذِينَ يُرِيدُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا يَالَيْتَ لَنَا مِثْلَ مَا أُوتِيَ قَارُونُ إِنَّهُ لَذُو حَظٍّ عَظِيمٍ
'অতঃপর (একদিন) সে তার সম্প্রদায়ের সামনে নিজ জাঁকজমকের সাথে বের হয়ে আসল। যারা পার্থিব জীবন কামনা করত তারা (তা দেখে) বলতে লাগল, আহা! কারূনকে যা দেওয়া হয়েছে, অনুরূপ যদি আমাদেরও থাকত। বস্তুত সে মহা ভাগ্যবান।২৬৯
কিন্তু যাদের দীনের বুঝ আছে, তাদের অন্তর্দৃষ্টি থাকে ঈমানের নূরে উদ্ভাসিত। সে উদ্ভাসে তাদের কাছে দুনিয়ার হাকীকত স্পষ্ট হয়ে যায়, ফলে তারা প্রবঞ্চনাময় দুনিয়ার অর্থবিত্তের প্রতি লালায়িত হয় না। তারা ঐশ্বর্যশালী বা ক্ষমতাবানদের শান-শওকত দেখে ধোঁকায় পড়ে না। তারা নিজেরা তো ধোঁকায় পড়েই না; বরং যারা ধোঁকায় পড়ে যায়, তাদেরকেও সতর্ক করে এবং আখেরাতের স্থায়ী সুখ-শান্তির প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, যেমন কারুনকে দেখে যারা তার মত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিল তাদেরকে লক্ষ্য করে দীনদার উলামা বলেছিল-
وَقَالَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ وَيْلَكُمْ ثَوَابُ اللَّهِ خَيْرٌ لِمَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا وَلَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الصَّابِرُونَ
'আর যারা (আল্লাহর পক্ষ হতে) জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছিল, তারা বলল, ধিক তোমাদেরকে। (তোমরা এরূপ কথা বলছ, অথচ) যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য আল্লাহপ্রদত্ত ছাওয়াব কতইনা শ্রেয়। আর তা লাভ করে কেবল ধৈর্যশীলগণই।২৭০
আলোচ্য ঘটনার শিশুটির অন্তরেও আল্লাহ তাআলা দীনের বুঝ ও হিকমত দান করেছিলেন। তাই তার জন্য তার মা যে দুআ করেছিল, তার সঙ্গে একমত হতে পারেনি। সে আল্লাহ তাআলার কাছে তার বিপরীত দুআ করেছিল। সে দুনিয়াদার হতে চায়নি; নিরীহ, নির্দোষ দাসীর মত দীনদার হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিল। আল্লাহ তাআলা আমাদের অন্তরেও দীনের সহীহ বুঝ দিয়ে দিন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
এ হাদীছটির মধ্যে শিক্ষণীয় আছে অনেক কিছুই। তার মধ্যে বিশেষ কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা যাচ্ছে।
ক. এ হাদীছ দ্বারা আল্লাহ তাআলার অসীম কুদরত সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। নবীগণের মু'জিযা এবং ওলী-বুযুর্গদের কারামত তাঁর সে কুদরতেরই প্রকাশ।
খ. নফল ইবাদত অপেক্ষা পিতামাতার হুকুম পালন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই নফল ইবাদতকালে পিতামাতার কেউ ডাক দিলে সে ডাকে সাড়া দেওয়া কর্তব্য।
গ. পিতামাতার বদ্দুআ অব্যর্থ। তাই এমন কোনও কাজ করা উচিত নয়, যাতে পিতামাতা কষ্ট পেতে পারে ও তাদের মনে বদ্দুআ আসতে পারে।
ঘ. খাঁটি ঈমানদারকে আল্লাহ তাআলা বিপদ-আপদে সাহায্য করে থাকেন, বিশেষত দীন ও ঈমান বিষয়ক ফিতনার সময়। ফলে ফিতনা তাদের ক্ষতি করতে পারে না, যেমন জুরায়জকে ব্যভিচারীনী নারী প্রলোভনে ফেলতে পারেনি।
ঙ. কোনও ব্যক্তি নিজে নির্দোষ ও খাঁটি হলে তার নামে অপবাদ ও মিথ্যা অভিযোগ বেশি দিন স্থায়ী হয় না। সত্য একদিন না একদিন প্রকাশ পেয়েই যায়।
চ. যাচাই-বাছাই ছাড়া কারও সম্পর্কিত কোনও অভিযোগে কান দিতে নেই। তাতে অনেক সময়ই নির্দোষ ব্যক্তিকে অহেতুক হয়রানি করা হয়।
ছ. ঐশ্বর্যশালী বা ক্ষমতাসীনদের দেখে তাদের মত না হতে পারার জন্য হীনম্মন্যতায় ভোগা উচিত নয় এবং তাদের মত হওয়ার জন্য আকাঙ্ক্ষাও প্রকাশ করা বাঞ্ছনীয় নয়। অন্তরকে সর্বদা আখেরাতমুখী করে রাখা চাই।
জ. কাউকে শাস্তি পেতে দেখে বাস্তবিকই সে দোষ করেছে এমন মনে করা ঠিক নয়। কেননা সে মিথ্যা অভিযোগেরও শিকার হতে পারে। অনেক সময় বিচারকের বিচারেও ভুল হয়ে যায়।
২৬৬. মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৮২১; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২৯০৩; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১২২৭৯; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১৫১৯: মুসনাদে আবূ ইয়া'লা, হাদীছ নং ২৫১৭
২৬৭. সূরা মারয়াম (২৯), আয়াত ৩০-৩৪
২৬৮. বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৪৯৬
২৬৯. সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৭৯
২৭০. সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৮০
এ হাদীছে তিনজনের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে দোলনার বয়সে কথা বলা শিশুদের সংখ্যা আরও বেশি। ইমাম সুয়ূতী রহ. এরকম দশজন শিশুর নাম উল্লেখ করেছেন। তাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য এক শিশু হচ্ছে, যার মাকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করার জন্য হাজির করা হয়েছিল আর সে মা তাতে নিক্ষিপ্ত হতে ভয় পাচ্ছিল, তখন শিশুটি বলে ওঠে- আম্মা, ধৈর্য ধরুন, আপনি সত্যের উপর আছেন।ফিরআউন তার কন্যার সেবিকাকে ঈমান আনার অপরাধে আগুনে নিক্ষেপ করতে চাইলে তার শিশুপুত্র মাকে লক্ষ্য করে বলেছিল يا أمه، اقتحمي، فإن عذاب الدنيا أهون من عذاب الآخرة ‘আম্মা! অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিন। কেননা দুনিয়ার শাস্তি আখেরাতের আযাব অপেক্ষা তুচ্ছ।২৬৬
এ হাদীছে তিনজনের কথা বলার দ্বারা বাকিগুলো নাকচ হয়ে যায় না। কেননা সবগুলো ঘটনা বর্ণনা করা এ হাদীছের উদ্দেশ্য নয়; বরং উদ্দেশ্য কেবল আল্লাহ তাআলার কুদরতের নমুনা বর্ণনা করা।
হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের দোলনায় কথা বলা
তিনজনের প্রথমজন হচ্ছেন হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম। তাঁর জন্ম নিয়ে যখন ইহুদীরা তাঁর মাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছিল, তখন সদ্যভূমিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাদের সামনে এক সারগর্ভ বক্তৃতা করেন। কুরআন মাজীদে তা এভাবে বর্ণিত হয়েছে-
قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا وَجَعَلَنِي مُبَارَكًا أَيْنَ مَا كُنْتُ وَأَوْصَانِي بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ مَا دُمْتُ حَيًّا وَبَرًّا بِوَالِدَتِي وَلَمْ يَجْعَلْنِي جَبَّارًا شَقِيًّا وَالسَّلَامُ عَلَيَّ يَوْمَ وُلِدْتُ وَيَوْمَ أَمُوتُ وَيَوْمَ أُبْعَثُ حَيًّا
“অমনি শিশুটি বলে উঠল, আমি আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং নবী বানিয়েছেন। এবং আমি যেখানেই থাকি না কেন আমাকে বরকতময় করেছেন এবং যত দিন জীবিত থাকি আমাকে নামায ও যাকাত আদায়ের হুকুম দিয়েছেন। এবং আমাকে আমার মায়ের প্রতি অনুগত বানিয়েছেন। আমাকে উদ্ধত ও রূঢ় বানাননি। এবং (আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে) আমার প্রতি সালাম যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন আমাকে পুনরায় জীবিত করে ওঠানো হবে।'২৬৭
জুরায়জ রহ.-এর ঘটনা
দ্বিতীয়জন হচ্ছে জুরায়জ রহ.-এর ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত এক শিশু। জুরায়জ রহ ছিলেন বনী ইসরাঈলের এক ব্যবসায়ী। ব্যবসায় কখনও লাভ ও কখনও লোকসান হওয়ায় একপর্যায়ে তার বিরক্তি ধরে যায়। শেষে তিনি একটি উপাসনালয় বানিয়ে তাতে নিভৃত জীবনযাপন করতে থাকেন এবং দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে পুরোপুরি 'রাহিব' (বৈরাগী) হয়ে যান। বৈরাগ্যবাস আগে ছিল না। এটা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের অনুসারীরা বাড়াবাড়িমূলকভাবে উদ্ভাবন করে নেয়। এর দ্বারা বোঝা যায় জুরায়জ রহ. হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের পরবর্তী জমানার লোক এবং তাঁর অনুসারীদের একজন।
কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, তার মা রোজ একবার এসে তার খোঁজ নিয়ে যেতেন। তার মা নিচ থেকে জুরায়জ বলে ডাক দিলে তিনি উপর থেকে উঁকি মেরে তার সঙ্গে কথা বলতেন। বরাবরের মত একদিন যখন তার মা এসে ডাক দিলেন, তখন তিনি নামাযরত ছিলেন। তিনি চিন্তা করছিলেন মায়ের ডাকে সাড়া দেবেন, না নামায চালিয়ে যাবেন! শেষপর্যন্ত নামাযকেই অগ্রাধিকার দিলেন। তারপর যা ঘটেছে, হাদীছের বর্ণনায় তার বিস্তারিত উল্লেখ আছে।
ব্যভিচারিণী স্ত্রীলোকটি রাখালের সঙ্গে লিপ্ত হয়ে বাচ্চা প্রসবের পর যখন জুরায়জের নামে অপবাদ দিল, তখন আমলোক সাধারণত যা করে থাকে, এ ক্ষেত্রেও তাই করল। তারা যাচাই করে দেখল না অভিযোগ সত্য কি না। এক মিথ্যা অপবাদকে চরম সত্য ধরে নিয়ে এতদিনকার ভক্তি-শ্রদ্ধা সব বিসর্জন দিল। তাঁর ইবাদত-বন্দেগী, বুযুর্গী সবকিছুই মুহূর্তের মধ্যে ভুলে গেল। তারপর যে নির্মম আচরণ তার প্রতি করল, হাদীছের বর্ণনায়ই তার উল্লেখ আছে। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, তারা জুরায়জ রহ.-কে তার ইবাদতখানা থেকে টেনে-হেঁচড়ে নামানোর পর গলায় রশি লাগিয়ে পথে-ঘাটে ঘোরাল। তারা তাকে একজন ভণ্ড ও লোকদেখানো আবেদ বলে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করল ও মারধর করতে থাকল। তাকে রাজার কাছেও নিয়ে গেল। রাজা তাকে কতক্ষণ তিরস্কার করল, তারপর তাকে শূলে চড়ানোর হুকুম দিল।
যাহোক জুরায়জ রহ. যখন এ কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন, তখন আল্লাহ তাআলা তাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করলেন। আল্লাহ তাআলার ইশারায় তিনি তাকে শিশুটির কাছে নিয়ে যেতে বললেন এবং সেখানে গিয়ে দু'রাকআত নামায পড়লেন। তারপর শিশুটির পেটে খোঁচা দিয়ে যেই না বললেন- রে বাবু! তোমার বাবা কে? অমনি শিশুটি বলে উঠল- অমুক রাখাল।
জুরায়জের এ কারামত দেখে মুহূর্তেই পরিস্থিতি বদলে গেল। এতক্ষণ যারা তাকে ঘৃণা করছিল, ফের তারা ভক্তি-শ্রদ্ধায় বিগলিত হল। কেউ ভক্তিতে চুমু দেয়, কেউ বরকতের আশায় শরীর স্পর্শ করে ইত্যাদি। এমনকি তারা স্বর্ণ দিয়ে তার উপাসনালয়টি নতুনভাবে তৈরি করে দেওয়ারও প্রস্তাব করল। কিন্তু তিনি ছিলেন খাঁটি আল্লাহওয়ালা। অর্থবিত্তের লোভ-লালসা তো আগেই ত্যাগ করেছেন। এখন তাতে আরও পরিপক্কতা এসেছে। তিনি প্রলোভনের শিকার হলেন না। আগের মতই মাটির ঘর তৈরি করে দিতে বললেন।
জুরায়জ রহ. এ বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন মায়ের বদ্দুআয়। তার কর্তব্য ছিল মায়ের ডাকে সাড়া দেওয়া। নফল ইবাদত-বন্দেগী অপেক্ষা পিতামাতার হুকুম পালন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
لو كان جريج الراهب فقيها عالما لعلم أن إجابته أنه أفضل من عبادة ربه
“সংসারত্যাগী জুরায়জ ফকীহ আলেম হলে জানতেন যে, তার পক্ষে মায়ের ডাকে সাড়া দেওয়া তার রব্বের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম ছিল।২৬৮
পিতামাতার আদেশ শরীআতবিরোধী না হলে মানা ফরয। জুরায়জ রহ.-এর দ্বারা এ ব্যাপারে ত্রুটি হয়ে গেছে। তার এ ত্রুটি মা ক্ষমা করে দিলে হয়তো কিছুই হত না, আল্লাহ তাআলাও ক্ষমা করে দিতেন। মায়ের পক্ষে সেটাই শ্রেয় ছিল। সন্তানকে বদদুআ দিতে নেই । মায়ের বদ্দুআ অমোঘ। তা লেগেই যায়। সুতরাং জুরায়জের প্রতি মায়ের বদ্দুআ লেগে গেল এবং তার সাধু জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ঘটে গেল।
বাহ্যদৃষ্টিতে যদিও জুরায়জ রহ.-কে এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটাও তার প্রতি আল্লাহ তাআলার রহমতই ছিল। দুনিয়ায় তো এর ফায়দা হয়েছে এই যে, ঘটনার পর মানুষের চোখে তিনি একজন সত্যিকারের আবেদ ও সাধকরূপে সমাদৃত হয়ে গেছেন। আর আখেরাতের ফায়দা হল মায়ের ডাকে সাড়া না দেওয়ার অপরাধ থেকে মুক্তি। এ ঘটনা দ্বারা তার অপরাধের প্রতিকার হয়ে গেছে। ফলে আশা করা যায় আখেরাতে এজন্য তাকে ধরা হবে না। আল্লাহ তাআলা তার নেক বান্দাদেরকে অনেক সময় তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতির একরকম প্রতিফল দুনিয়াতেই দিয়ে দেন, যাতে আখেরাতে পরিপূর্ণ মুক্তি পেয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানে নিরাপত্তা দান করুন।
জনৈকা নারীর দুধ পানরত শিশু
আর তৃতীয়জন হচ্ছে মায়ের কোলে দুধ পানরত শিশুটি, যার মা এক শানদার অশ্বারোহীকে দেখে আল্লাহর কাছে দুআ করেছিল শিশুটি যেন তার মত হয়। কিন্তু শিশুটি তখন দুধপান ছেড়ে দিয়ে বলে ওঠে- হে আল্লাহ, তুমি আমাকে ওর মত বানিও না। অন্যদিকে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত এক দাসীকে মারতে মারতে নিয়ে যাওয়ার সময় যখন তার মা আল্লাহর কাছে দুআ করে যে, তার বাচ্চাটি যেন ওই দাসীর মত না হয়, তখন শিশুটি বলে ওঠে- হে আল্লাহ, তুমি আমাকে তার মত বানিও।
মা শিশুটির জন্য দুআ করেছিল তার কল্যাণার্থেই। কিন্তু তার দৃষ্টি ছিল দুনিয়ার অর্থ-বিত্তের মধ্যে আবদ্ধ। তার ছিল না প্রকৃত দূরদর্শিতা, ছিল না দীনের বুঝ এবং ছিল না অন্তর্দৃষ্টিও। এ শ্রেণীর লোক দুনিয়াদারদের দেখলে দিশেহারা হয়ে যায় এবং তাদের মত হতে পারার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কুরআন মাজীদে কারুনের ঘটনায় বর্ণিত হয়েছে-
فَخَرَجَ عَلَى قَوْمِهِ فِي زِينَتِهِ قَالَ الَّذِينَ يُرِيدُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا يَالَيْتَ لَنَا مِثْلَ مَا أُوتِيَ قَارُونُ إِنَّهُ لَذُو حَظٍّ عَظِيمٍ
'অতঃপর (একদিন) সে তার সম্প্রদায়ের সামনে নিজ জাঁকজমকের সাথে বের হয়ে আসল। যারা পার্থিব জীবন কামনা করত তারা (তা দেখে) বলতে লাগল, আহা! কারূনকে যা দেওয়া হয়েছে, অনুরূপ যদি আমাদেরও থাকত। বস্তুত সে মহা ভাগ্যবান।২৬৯
কিন্তু যাদের দীনের বুঝ আছে, তাদের অন্তর্দৃষ্টি থাকে ঈমানের নূরে উদ্ভাসিত। সে উদ্ভাসে তাদের কাছে দুনিয়ার হাকীকত স্পষ্ট হয়ে যায়, ফলে তারা প্রবঞ্চনাময় দুনিয়ার অর্থবিত্তের প্রতি লালায়িত হয় না। তারা ঐশ্বর্যশালী বা ক্ষমতাবানদের শান-শওকত দেখে ধোঁকায় পড়ে না। তারা নিজেরা তো ধোঁকায় পড়েই না; বরং যারা ধোঁকায় পড়ে যায়, তাদেরকেও সতর্ক করে এবং আখেরাতের স্থায়ী সুখ-শান্তির প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, যেমন কারুনকে দেখে যারা তার মত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিল তাদেরকে লক্ষ্য করে দীনদার উলামা বলেছিল-
وَقَالَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ وَيْلَكُمْ ثَوَابُ اللَّهِ خَيْرٌ لِمَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا وَلَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الصَّابِرُونَ
'আর যারা (আল্লাহর পক্ষ হতে) জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছিল, তারা বলল, ধিক তোমাদেরকে। (তোমরা এরূপ কথা বলছ, অথচ) যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য আল্লাহপ্রদত্ত ছাওয়াব কতইনা শ্রেয়। আর তা লাভ করে কেবল ধৈর্যশীলগণই।২৭০
আলোচ্য ঘটনার শিশুটির অন্তরেও আল্লাহ তাআলা দীনের বুঝ ও হিকমত দান করেছিলেন। তাই তার জন্য তার মা যে দুআ করেছিল, তার সঙ্গে একমত হতে পারেনি। সে আল্লাহ তাআলার কাছে তার বিপরীত দুআ করেছিল। সে দুনিয়াদার হতে চায়নি; নিরীহ, নির্দোষ দাসীর মত দীনদার হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিল। আল্লাহ তাআলা আমাদের অন্তরেও দীনের সহীহ বুঝ দিয়ে দিন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
এ হাদীছটির মধ্যে শিক্ষণীয় আছে অনেক কিছুই। তার মধ্যে বিশেষ কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা যাচ্ছে।
ক. এ হাদীছ দ্বারা আল্লাহ তাআলার অসীম কুদরত সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। নবীগণের মু'জিযা এবং ওলী-বুযুর্গদের কারামত তাঁর সে কুদরতেরই প্রকাশ।
খ. নফল ইবাদত অপেক্ষা পিতামাতার হুকুম পালন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই নফল ইবাদতকালে পিতামাতার কেউ ডাক দিলে সে ডাকে সাড়া দেওয়া কর্তব্য।
গ. পিতামাতার বদ্দুআ অব্যর্থ। তাই এমন কোনও কাজ করা উচিত নয়, যাতে পিতামাতা কষ্ট পেতে পারে ও তাদের মনে বদ্দুআ আসতে পারে।
ঘ. খাঁটি ঈমানদারকে আল্লাহ তাআলা বিপদ-আপদে সাহায্য করে থাকেন, বিশেষত দীন ও ঈমান বিষয়ক ফিতনার সময়। ফলে ফিতনা তাদের ক্ষতি করতে পারে না, যেমন জুরায়জকে ব্যভিচারীনী নারী প্রলোভনে ফেলতে পারেনি।
ঙ. কোনও ব্যক্তি নিজে নির্দোষ ও খাঁটি হলে তার নামে অপবাদ ও মিথ্যা অভিযোগ বেশি দিন স্থায়ী হয় না। সত্য একদিন না একদিন প্রকাশ পেয়েই যায়।
চ. যাচাই-বাছাই ছাড়া কারও সম্পর্কিত কোনও অভিযোগে কান দিতে নেই। তাতে অনেক সময়ই নির্দোষ ব্যক্তিকে অহেতুক হয়রানি করা হয়।
ছ. ঐশ্বর্যশালী বা ক্ষমতাসীনদের দেখে তাদের মত না হতে পারার জন্য হীনম্মন্যতায় ভোগা উচিত নয় এবং তাদের মত হওয়ার জন্য আকাঙ্ক্ষাও প্রকাশ করা বাঞ্ছনীয় নয়। অন্তরকে সর্বদা আখেরাতমুখী করে রাখা চাই।
জ. কাউকে শাস্তি পেতে দেখে বাস্তবিকই সে দোষ করেছে এমন মনে করা ঠিক নয়। কেননা সে মিথ্যা অভিযোগেরও শিকার হতে পারে। অনেক সময় বিচারকের বিচারেও ভুল হয়ে যায়।
২৬৬. মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৮২১; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২৯০৩; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১২২৭৯; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১৫১৯: মুসনাদে আবূ ইয়া'লা, হাদীছ নং ২৫১৭
২৬৭. সূরা মারয়াম (২৯), আয়াত ৩০-৩৪
২৬৮. বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৪৯৬
২৬৯. সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৭৯
২৭০. সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৮০
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
