আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ
৪৭- সাহাবায়ে কিরামের রাঃ মানাকিব ও ফাযায়েল
হাদীস নং: ৬১৮৬
আন্তর্জাতিক নং: ২৫০৪
৪২. সালমান ফারসী (রাযিঃ) সুহায়ব (রাযিঃ) ও বিলাল (রাযিঃ) এর ফযীলত
৬১৮৬। মুহাম্মাদ ইবনে হাতিম (রাহঃ) ......... আয়িয ইবনে আমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, আবু সুফিয়ান (রাযিঃ) একদল লোকের সাথে সালমান ফারসী (রাযিঃ), সুহায়ব (রাযিঃ) ও বিলাল (রাযিঃ)-এর কাছে এলেন। তখন তাঁরা বললেন, আল্লাহর তরবারীসমূহ আল্লাহর দুশমনদের গর্দান হতে তার যথাপ্রাপ্য আদায় করেনি। বর্ণনাকারী বলেন, আবু বকর (রাযিঃ) বললেন, তোমরা কি একজন প্রবীণ কুরাইশ নেতাকে এমন কথা বলছ? এরপর তিনি নবী (ﷺ) এর কাছে এসে তাকে বিষয়টি অবহিত করলেন। তখন তিনি (রাসূলুল্লাহ (ﷺ)) বললেনঃ হে আবু বকর! তুমি বোধ হয় তাদের রাগিয়েছ। যদি তুমি তাদের রাগিয়ে থাক তাহলে তুমি তাদের রবকেই রাগিয়েছ। এরপর আবু বকর (রাযিঃ) তাদের কাছে এলেন এবং বললেন, হে ভাই সকল! আমি তোমাদের রাগিয়েছি, তাই না? তারা বললেন, না, হে ভাই! আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করে দিন।
باب مِنْ فَضَائِلِ سَلْمَانَ وَصُهَيْبٍ وَبِلاَلٍ رضى الله تعالى عنهم
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ حَاتِمٍ، حَدَّثَنَا بَهْزٌ، حَدَّثَنَا حَمَّادُ بْنُ سَلَمَةَ، عَنْ ثَابِتٍ، عَنْ مُعَاوِيَةَ، بْنِ قُرَّةَ عَنْ عَائِذِ بْنِ عَمْرٍو، أَنَّ أَبَا سُفْيَانَ، أَتَى عَلَى سَلْمَانَ وَصُهَيْبٍ وَبِلاَلٍ فِي نَفَرٍ فَقَالُوا وَاللَّهِ مَا أَخَذَتْ سُيُوفُ اللَّهِ مِنْ عُنُقِ عَدُوِّ اللَّهِ مَأْخَذَهَا . قَالَ فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ أَتَقُولُونَ هَذَا لِشَيْخِ قُرَيْشٍ وَسَيِّدِهِمْ فَأَتَى النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَأَخْبَرَهُ فَقَالَ " يَا أَبَا بَكْرٍ لَعَلَّكَ أَغْضَبْتَهُمْ لَئِنْ كُنْتَ أَغْضَبْتَهُمْ لَقَدْ أَغْضَبْتَ رَبَّكَ " . فَأَتَاهُمْ أَبُو بَكْرٍ فَقَالَ يَا إِخْوَتَاهْ أَغْضَبْتُكُمْ قَالُوا لاَ يَغْفِرُ اللَّهُ لَكَ يَا أُخَىَّ .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
সংক্ষেপে কিছু হযরত আবূ সুফয়ান রাযি. সম্পর্কে
এ হাদীছে হযরত আবূ সুফয়ান রাযি.-কে লক্ষ্য করে কয়েকজন গরীব সাহাবী যে মন্তব্য করেছিলেন, তা মক্কাবিজয়ের পরের কথা। হযরত আবূ সুফয়ান রাযি. প্রথম জীবনে ইসলাম ও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘোর শত্রু ছিলেন। ইসলামের বিরুদ্ধে মক্কাবিজয়ের পূর্ববর্তী সবগুলো যুদ্ধে তাঁর ছিল প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব ও মুখ্য ভূমিকা। এ কারণে তাঁর প্রতি সাহাবায়ে কেরামের অন্তরে ছিল প্রচণ্ড বিদ্বেষ। সে বিদ্বেষ আল্লাহরই জন্য। তাঁর ইসলাম গ্রহণও ছিল মূলত পরিস্থিতির মুখে অনেকটা বাধ্য হয়ে। তাঁর অন্তরে যাতে ঈমান পরিপক্ক হয়ে ওঠে, সেজন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রতি মনোরঞ্জনমূলক বিভিন্ন সদাচরণ করেন। ক্রমে তাঁর অন্তরে ইসলাম বদ্ধমূল হতে থাকে। অচিরেই তিনি ইসলামের সেবায় আত্মনিবেদন করেন এবং বিভিন্ন যুদ্ধে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন। তায়েফের যুদ্ধে তিনি একটি চোখ হারান। ইয়ারমুকের যুদ্ধে বিপুল বিক্রমে লড়াই করেন। তিনি এ যুদ্ধে দ্বিতীয় চোখটিও হারিয়ে ফেলেন। ফলে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে নাজরানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর এ পদে থাকা অবস্থায়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকাল হয়ে যায়।
হযরত আবূ সুফয়ান রাযি.-কে লক্ষ্য করে কয়েকজন সাহাবীর মন্তব্য ও হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর জবাব
যাহোক মক্কাবিজয়ের আগে দীর্ঘকাল ইসলামের শত্রুতায় নিয়োজিত থাকার কারণে যেহেতু সাহাবায়ে কেরামের অন্তরে তাঁর প্রতি প্রচণ্ড বিদ্বেষ জমাট বেঁধেছিল,তাই মক্কাবিজয়কালে তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেও সে বিদ্বেষ দূর হতে খানিকটা সময় লাগে। ফলে মক্কাবিজয়ের পরপর তিনি তাদের সামনে উপস্থিত হলে তারা বলে ওঠেন- ما أخذت سيوف الله من عدو الله مأخذها (আল্লাহর তরবারিসমূহ কি আল্লাহর দশমনকে পুরোপুরি বুঝে নেয়নি?)। 'আল্লাহর তরবারি' বলে মুসলিমদেরকে বোঝানো হয়েছে। বোঝানো হচ্ছে, মুসলিমগণ এখনও পর্যন্ত তাদের তরবারি দ্বারা আল্লাহর এ দুশমনের মুক্তপাত করেনি? অর্থাৎ তার দ্বারা এ যাবতকাল ইসলামের যা ক্ষতি হয়েছে, তাতে তো ইতোমধ্যে একে সাবাড় করে ফেলার কথা ছিল।
আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তাদের এ মন্তব্য পসন্দ করেননি। তিনি চাচ্ছিলেন আবৃ সুফয়ান রাযি. পরিস্থিতির চাপে হলেও যেহেতু ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছে, তাই এখন করণীয় হচ্ছে তাঁর প্রতি মনোরঞ্জনমূলক আচরণ করা। এতে করে ইসলাম তাঁর অন্তরে বদ্ধমূল হবে এবং সে মুমিনদের প্রতি আকৃষ্ট হবে আর তাঁর অন্তরে তাদের প্রতি ভালোবাসা সঞ্চার হবে। তাই তিনি তাদের লক্ষ্য করে বললেন-
أَتَقُوْلُوْنَ هَذَا لِشَيْخِ قُرَيْشٍ وَسَيدِهِمْ؟
(তোমরা কি কুরাইশের এ মুরব্বী ও তাদের নেতাকে এরকম কথা বলছ?)।
অর্থাৎ তোমাদের এখন আর তাঁকে এমন কথা বলা উচিত নয়। কারণ এক তো তিনি ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছেন, সেইসঙ্গে বর্তমানে তিনি কুরায়শদের সবচে' বড় মুরব্বী ও তাদের নেতা। নিজ কওমের একজন নেতা হিসেবে তাঁকে সম্মান দেখানো চাই। এটাও ইসলামেরই শিক্ষা।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সতর্কীকরণ ও তাঁর বিনয়ী আচরণ
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি, তারপর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে সবকথা খুলে বললেন। সব শুনে তিনি বললেন, হে আবূ বকর! তুমি হয়তো তাদেরকে রাগিয়ে দিয়েছ। অর্থাৎ তুমি তাদেরকে যা বলেছ তাতে হয়তো তারা মনে কষ্ট পেয়েছে এবং তোমার কথা তাদের রাগের কারণ হয়েছে। তারপর তিনি হযরত আবূ বকর রাযি.-কে এই বলে সতর্ক করলেন-
لَئِنْ كُنْتَ أَغْضَبْتَهُمْ لَقَدْ أَغْضَبْتَ رَبَّكَ
(যদি তুমি তাদেরকে নাখোশ করে থাক, তবে তুমি তোমার প্রতিপালককেই নাখোশ করলে) । কেননা তারা আল্লাহর ওলী। ঈমান ও তাকওয়ার উচ্চতর স্তরে তারা অধিষ্ঠিত। কাজেই তারা উচ্চস্তরের আওলিয়াই বটে। কেউ আল্লাহর ওলীকে কষ্ট দিলে তাতে আল্লাহ নাখোশ হন। হাদীছে কুদসীতে আছে-
مَنْ عَادَى لِيْ وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ
‘যে কেউ আমার ওলীকে কষ্ট দেয়, তার সঙ্গে আমি যুদ্ধ ঘোষণা করলাম।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এখানে আল্লাহ তাআলার গুণবাচক নাম 'রব্ব' উল্লেখ করেছেন। রব্ব বলা হয় এমন সত্তাকে, যিনি বান্দার প্রয়োজনীয় সব সামগ্রীর যোগান দিয়ে ক্রমান্বয়ে তাকে পরিপূর্ণতায় পৌঁছান। তো তুমি তোমার রব্বকে নারাজ করলে' বলে ইঙ্গিত করা হচ্ছে যে, আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে তোমাকে ঈমান ও তাকওয়ার এক অসাধারণ স্তরে পৌঁছিয়েছেন। সে হিসেবে তোমার ভেতর আল্লাহপ্রেমও থাকার কথা অসামান্য। কেননা কারও প্রতি যার অনুগ্রহ যত বেশি হয়, তার প্রতি তার প্রেম ও মহব্বতও তত বেশিই হয়ে থাকে। এ আল্লাহপ্রেমের দাবি হচ্ছে তাঁর সকল প্রিয়জনকে ভালোবাসা। ওই গরীব সাহাবীগণ যখন আল্লাহর ওলী ও প্রিয়জন, তখন আল্লাহর ভালোবাসায় তাদেরও ভালোবাসা উচিত। তাদেরকে ভালো না বাসলে সে যেন আল্লাহপ্রেমের দাবি সম্পর্কে খানিকটা উদাসীন হয়ে গেল আর এভাবে সে তাঁকে একপর্যায়ে নারাজও করে ফেলল। সুতরাং তুমি তাদেরকে নারাজ করে থাকলে যেন আল্লাহ তাআলাকেই নারাজ করেছ।
ইনি তো সিদ্দীকে আকবার। উম্মতের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি। শ্রেষ্ঠতম আল্লাহপ্রেমিক ও শ্রেষ্ঠতম আশেকে রাসূল। কাজেই আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূলের বিন্দুমাত্র নারাজিও তিনি বরদাশত করতে পারেন কি? সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেই মজলিসে চলে গেলেন, যেখানে হযরত সালমান রাযি. বিলাল রাযি. ও সুহায়ব রাযি. প্রমুখ বসা ছিলেন। তিনি তাদেরকে পরম বিনয় ও ভালোবাসার সঙ্গে সম্বোধন করে বললেন-يا إخوتاه ২৮২ أغضبتكم؟ (ওহে আমার ভাইয়েরা! আমি কি তোমাদের নারাজ করে ফেলেছি?)। অর্থাৎ আবূ সুফয়ানের পক্ষ হয়ে আমি তোমাদের যা বলেছি, তোমরা কি তাতে মনে কষ্ট পেয়েছ? এই বলে তিনি তাদের কাছে পরোক্ষভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন কিংবা বলা যায় তাদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করলেন। তারা বললেন- ‘لا يغفر الله لك يا اخي (না, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন হে আমাদের প্রিয় ভাই)। অর্থাৎ আপনার সে কথায় আমরা মনে কষ্ট পাইনি। বাস্তবিকপক্ষে মনে কষ্ট পাওয়ার কথাও নয়। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর সমুচ্চ আখলাক ও মহানুভবতার সাথে তারা পরিচিত ছিলেন। তারা জানতেন তিনি তাদেরকে তুচ্ছ গণ্য করেন না এবং তিনি তাদেরকে কষ্ট দিতেও চাননি। তিনি কেবল আবূ সুফয়ান রাযি.-কে খুশি করতে চেয়েছিলেন, যাতে তাঁর ঈমানে পরিপক্কতা আসে এবং তাঁর ও তাঁর অনুসারীদের দ্বারা উম্মতের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে।
তারা তাঁর জন্য মাগফিরাতের দুআও করলেন। এ দুআ দ্বারা ইঙ্গিত হয় না যে, আবূ সুফয়ান রাযি.-এর পক্ষে কথা বলে তিনি কিছু অপরাধ করেছিলেন। কারও জন্য মাগফিরাতের দুআ করতে অপরাধের প্রতি দৃষ্টিপাতের প্রয়োজন হয় না। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মাগফিরাতলাভ বান্দার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। কাজেই কারও জন্য এ দুআ করাও তার জন্য দুআকারীর পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠতম উপহার। তারা খুশি হয়ে এ দুআর মাধ্যমে তাঁকে সে উপহারই দান করেছেন।
উল্লেখ্য, তারা যে বলেছেন- لا‘ يغفر الله لك (না, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন), এখানে لا -এর পর ওয়াক্ফ করা জরুরি। অন্যথায় অর্থ হয়ে যাবে- আল্লাহ যেন আপনাকে ক্ষমা না করেন। একবার এমন হল যে, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. একজনের হাতে কিছু পণ্য দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এটা বিক্রি করবে? সে ওয়াক্ফ ছাড়াই বলল- لا يرحمك الله (না আল্লাহ আপনার প্রতি রহমত করুন)। তিনি বললেন, এরকম নয়; বরং বল- لا‘ يرحمك الله (না, আল্লাহ আপনার প্রতি রহমত করুন)।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি এরকম বাক্য ব্যবহার করতেই নিষেধ করতেন। অর্থাৎ তিনি দুআর আগে لا ব্যবহার করতে নিষেধ করতেন। কেননা لا ব্যবহার করলে দুআর পরিবর্তে বদ্দুআ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
সবশেষে তারা يا اخي (হে আমাদের প্রিয় ভাই) বলে ইঙ্গিত করছেন যে, তাঁর কথায় তাদের মনে কষ্ট আসবে কি করে, যখন তাদের মধ্যে সম্পর্কটা ভ্রাতৃত্বের এবং সে ভ্রাতৃত্বও অনেক গভীর! এক ভাই অন্য ভাইকে তিরস্কার করলে তা তার কল্যাণার্থেই করে থাকে। সেজন্য মনে কষ্ট নেওয়া উচিত নয়। আবার তাও যদি হয় মহান আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর মত কোনও ভাই, যিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছায়াস্বরূপ, উম্মতের সকলের প্রতি যাঁর অসাধারণ স্নেহ-মমতা!
হাদীছটির শিক্ষা
ক. কারও প্রতি বিদ্বেষ যদি হয় আল্লাহর জন্য, তবে সে বিদ্বেষ দোষের নয়। অবশ্য কোন্ বিদ্বেষ আল্লাহর জন্য এবং কোন্টা আল্লাহর জন্য নয়, আল্লাহওয়ালা উলামার কাছ থেকে তা শিখে নেওয়া চাই ।
খ. এ হাদীছ দ্বারা হযরত সালমান রাযি., হযরত সুহায়ব রাযি., হযরত বিলাল রাযি প্রমুখ গরীব সাহাবীদের মর্যাদা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। বলাবাহুল্য তাদের সে মর্যাদা লাভ হয়েছিল ঈমান ও তাকওয়ার কারণে। সুতরাং মুত্তাকী ও পরহেযগার গরীবদের মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা চাই।
গ. বড়র সামনে ছোটদের কোনও কথা আপত্তিকর মনে হলে তার উচিত তা সংশোধন করে দেওয়া।
ঘ. নিজের কোনও কথা সঠিক হল কি না এ ব্যাপারে সন্দেহ হলে বিজ্ঞজনের কাছে গিয়ে সে সন্দেহের নিরসন করে নেওয়া উচিত।
ঙ. যারা মুত্তাকী-পরহেযগার, তারা আল্লাহর ওলী। কোনও অবস্থায়ই তাদেরকে কষ্ট দেওয়া উচিত নয়। তাতে আল্লাহ নারাজ হন।
চ. কাউকে কষ্ট দিয়ে ফেললে যথাশীঘ্র ক্ষমা চেয়ে নেওয়া উচিত। ক্ষমা চাইতে লজ্জাবোধ করা উচিত নয়।
ছ. বড়র তিরস্কারে ছোটদের মনে কষ্ট নেওয়া উচিত নয়। মনে করতে হবে তার সে তিরস্কার তাদের কল্যাণার্থেই ।
জ. কেউ ক্ষমা চাইলে সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। সেইসঙ্গে তার জন্য আল্লাহর কাছে মাগফিরাতের দুআ করাও বাঞ্ছনীয়।
এ হাদীছে হযরত আবূ সুফয়ান রাযি.-কে লক্ষ্য করে কয়েকজন গরীব সাহাবী যে মন্তব্য করেছিলেন, তা মক্কাবিজয়ের পরের কথা। হযরত আবূ সুফয়ান রাযি. প্রথম জীবনে ইসলাম ও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘোর শত্রু ছিলেন। ইসলামের বিরুদ্ধে মক্কাবিজয়ের পূর্ববর্তী সবগুলো যুদ্ধে তাঁর ছিল প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব ও মুখ্য ভূমিকা। এ কারণে তাঁর প্রতি সাহাবায়ে কেরামের অন্তরে ছিল প্রচণ্ড বিদ্বেষ। সে বিদ্বেষ আল্লাহরই জন্য। তাঁর ইসলাম গ্রহণও ছিল মূলত পরিস্থিতির মুখে অনেকটা বাধ্য হয়ে। তাঁর অন্তরে যাতে ঈমান পরিপক্ক হয়ে ওঠে, সেজন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রতি মনোরঞ্জনমূলক বিভিন্ন সদাচরণ করেন। ক্রমে তাঁর অন্তরে ইসলাম বদ্ধমূল হতে থাকে। অচিরেই তিনি ইসলামের সেবায় আত্মনিবেদন করেন এবং বিভিন্ন যুদ্ধে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন। তায়েফের যুদ্ধে তিনি একটি চোখ হারান। ইয়ারমুকের যুদ্ধে বিপুল বিক্রমে লড়াই করেন। তিনি এ যুদ্ধে দ্বিতীয় চোখটিও হারিয়ে ফেলেন। ফলে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে নাজরানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর এ পদে থাকা অবস্থায়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকাল হয়ে যায়।
হযরত আবূ সুফয়ান রাযি.-কে লক্ষ্য করে কয়েকজন সাহাবীর মন্তব্য ও হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর জবাব
যাহোক মক্কাবিজয়ের আগে দীর্ঘকাল ইসলামের শত্রুতায় নিয়োজিত থাকার কারণে যেহেতু সাহাবায়ে কেরামের অন্তরে তাঁর প্রতি প্রচণ্ড বিদ্বেষ জমাট বেঁধেছিল,তাই মক্কাবিজয়কালে তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেও সে বিদ্বেষ দূর হতে খানিকটা সময় লাগে। ফলে মক্কাবিজয়ের পরপর তিনি তাদের সামনে উপস্থিত হলে তারা বলে ওঠেন- ما أخذت سيوف الله من عدو الله مأخذها (আল্লাহর তরবারিসমূহ কি আল্লাহর দশমনকে পুরোপুরি বুঝে নেয়নি?)। 'আল্লাহর তরবারি' বলে মুসলিমদেরকে বোঝানো হয়েছে। বোঝানো হচ্ছে, মুসলিমগণ এখনও পর্যন্ত তাদের তরবারি দ্বারা আল্লাহর এ দুশমনের মুক্তপাত করেনি? অর্থাৎ তার দ্বারা এ যাবতকাল ইসলামের যা ক্ষতি হয়েছে, তাতে তো ইতোমধ্যে একে সাবাড় করে ফেলার কথা ছিল।
আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তাদের এ মন্তব্য পসন্দ করেননি। তিনি চাচ্ছিলেন আবৃ সুফয়ান রাযি. পরিস্থিতির চাপে হলেও যেহেতু ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছে, তাই এখন করণীয় হচ্ছে তাঁর প্রতি মনোরঞ্জনমূলক আচরণ করা। এতে করে ইসলাম তাঁর অন্তরে বদ্ধমূল হবে এবং সে মুমিনদের প্রতি আকৃষ্ট হবে আর তাঁর অন্তরে তাদের প্রতি ভালোবাসা সঞ্চার হবে। তাই তিনি তাদের লক্ষ্য করে বললেন-
أَتَقُوْلُوْنَ هَذَا لِشَيْخِ قُرَيْشٍ وَسَيدِهِمْ؟
(তোমরা কি কুরাইশের এ মুরব্বী ও তাদের নেতাকে এরকম কথা বলছ?)।
অর্থাৎ তোমাদের এখন আর তাঁকে এমন কথা বলা উচিত নয়। কারণ এক তো তিনি ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছেন, সেইসঙ্গে বর্তমানে তিনি কুরায়শদের সবচে' বড় মুরব্বী ও তাদের নেতা। নিজ কওমের একজন নেতা হিসেবে তাঁকে সম্মান দেখানো চাই। এটাও ইসলামেরই শিক্ষা।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সতর্কীকরণ ও তাঁর বিনয়ী আচরণ
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি, তারপর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে সবকথা খুলে বললেন। সব শুনে তিনি বললেন, হে আবূ বকর! তুমি হয়তো তাদেরকে রাগিয়ে দিয়েছ। অর্থাৎ তুমি তাদেরকে যা বলেছ তাতে হয়তো তারা মনে কষ্ট পেয়েছে এবং তোমার কথা তাদের রাগের কারণ হয়েছে। তারপর তিনি হযরত আবূ বকর রাযি.-কে এই বলে সতর্ক করলেন-
لَئِنْ كُنْتَ أَغْضَبْتَهُمْ لَقَدْ أَغْضَبْتَ رَبَّكَ
(যদি তুমি তাদেরকে নাখোশ করে থাক, তবে তুমি তোমার প্রতিপালককেই নাখোশ করলে) । কেননা তারা আল্লাহর ওলী। ঈমান ও তাকওয়ার উচ্চতর স্তরে তারা অধিষ্ঠিত। কাজেই তারা উচ্চস্তরের আওলিয়াই বটে। কেউ আল্লাহর ওলীকে কষ্ট দিলে তাতে আল্লাহ নাখোশ হন। হাদীছে কুদসীতে আছে-
مَنْ عَادَى لِيْ وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ
‘যে কেউ আমার ওলীকে কষ্ট দেয়, তার সঙ্গে আমি যুদ্ধ ঘোষণা করলাম।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এখানে আল্লাহ তাআলার গুণবাচক নাম 'রব্ব' উল্লেখ করেছেন। রব্ব বলা হয় এমন সত্তাকে, যিনি বান্দার প্রয়োজনীয় সব সামগ্রীর যোগান দিয়ে ক্রমান্বয়ে তাকে পরিপূর্ণতায় পৌঁছান। তো তুমি তোমার রব্বকে নারাজ করলে' বলে ইঙ্গিত করা হচ্ছে যে, আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে তোমাকে ঈমান ও তাকওয়ার এক অসাধারণ স্তরে পৌঁছিয়েছেন। সে হিসেবে তোমার ভেতর আল্লাহপ্রেমও থাকার কথা অসামান্য। কেননা কারও প্রতি যার অনুগ্রহ যত বেশি হয়, তার প্রতি তার প্রেম ও মহব্বতও তত বেশিই হয়ে থাকে। এ আল্লাহপ্রেমের দাবি হচ্ছে তাঁর সকল প্রিয়জনকে ভালোবাসা। ওই গরীব সাহাবীগণ যখন আল্লাহর ওলী ও প্রিয়জন, তখন আল্লাহর ভালোবাসায় তাদেরও ভালোবাসা উচিত। তাদেরকে ভালো না বাসলে সে যেন আল্লাহপ্রেমের দাবি সম্পর্কে খানিকটা উদাসীন হয়ে গেল আর এভাবে সে তাঁকে একপর্যায়ে নারাজও করে ফেলল। সুতরাং তুমি তাদেরকে নারাজ করে থাকলে যেন আল্লাহ তাআলাকেই নারাজ করেছ।
ইনি তো সিদ্দীকে আকবার। উম্মতের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি। শ্রেষ্ঠতম আল্লাহপ্রেমিক ও শ্রেষ্ঠতম আশেকে রাসূল। কাজেই আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূলের বিন্দুমাত্র নারাজিও তিনি বরদাশত করতে পারেন কি? সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেই মজলিসে চলে গেলেন, যেখানে হযরত সালমান রাযি. বিলাল রাযি. ও সুহায়ব রাযি. প্রমুখ বসা ছিলেন। তিনি তাদেরকে পরম বিনয় ও ভালোবাসার সঙ্গে সম্বোধন করে বললেন-يا إخوتاه ২৮২ أغضبتكم؟ (ওহে আমার ভাইয়েরা! আমি কি তোমাদের নারাজ করে ফেলেছি?)। অর্থাৎ আবূ সুফয়ানের পক্ষ হয়ে আমি তোমাদের যা বলেছি, তোমরা কি তাতে মনে কষ্ট পেয়েছ? এই বলে তিনি তাদের কাছে পরোক্ষভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন কিংবা বলা যায় তাদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করলেন। তারা বললেন- ‘لا يغفر الله لك يا اخي (না, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন হে আমাদের প্রিয় ভাই)। অর্থাৎ আপনার সে কথায় আমরা মনে কষ্ট পাইনি। বাস্তবিকপক্ষে মনে কষ্ট পাওয়ার কথাও নয়। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর সমুচ্চ আখলাক ও মহানুভবতার সাথে তারা পরিচিত ছিলেন। তারা জানতেন তিনি তাদেরকে তুচ্ছ গণ্য করেন না এবং তিনি তাদেরকে কষ্ট দিতেও চাননি। তিনি কেবল আবূ সুফয়ান রাযি.-কে খুশি করতে চেয়েছিলেন, যাতে তাঁর ঈমানে পরিপক্কতা আসে এবং তাঁর ও তাঁর অনুসারীদের দ্বারা উম্মতের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে।
তারা তাঁর জন্য মাগফিরাতের দুআও করলেন। এ দুআ দ্বারা ইঙ্গিত হয় না যে, আবূ সুফয়ান রাযি.-এর পক্ষে কথা বলে তিনি কিছু অপরাধ করেছিলেন। কারও জন্য মাগফিরাতের দুআ করতে অপরাধের প্রতি দৃষ্টিপাতের প্রয়োজন হয় না। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মাগফিরাতলাভ বান্দার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। কাজেই কারও জন্য এ দুআ করাও তার জন্য দুআকারীর পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠতম উপহার। তারা খুশি হয়ে এ দুআর মাধ্যমে তাঁকে সে উপহারই দান করেছেন।
উল্লেখ্য, তারা যে বলেছেন- لا‘ يغفر الله لك (না, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন), এখানে لا -এর পর ওয়াক্ফ করা জরুরি। অন্যথায় অর্থ হয়ে যাবে- আল্লাহ যেন আপনাকে ক্ষমা না করেন। একবার এমন হল যে, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. একজনের হাতে কিছু পণ্য দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এটা বিক্রি করবে? সে ওয়াক্ফ ছাড়াই বলল- لا يرحمك الله (না আল্লাহ আপনার প্রতি রহমত করুন)। তিনি বললেন, এরকম নয়; বরং বল- لا‘ يرحمك الله (না, আল্লাহ আপনার প্রতি রহমত করুন)।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি এরকম বাক্য ব্যবহার করতেই নিষেধ করতেন। অর্থাৎ তিনি দুআর আগে لا ব্যবহার করতে নিষেধ করতেন। কেননা لا ব্যবহার করলে দুআর পরিবর্তে বদ্দুআ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
সবশেষে তারা يا اخي (হে আমাদের প্রিয় ভাই) বলে ইঙ্গিত করছেন যে, তাঁর কথায় তাদের মনে কষ্ট আসবে কি করে, যখন তাদের মধ্যে সম্পর্কটা ভ্রাতৃত্বের এবং সে ভ্রাতৃত্বও অনেক গভীর! এক ভাই অন্য ভাইকে তিরস্কার করলে তা তার কল্যাণার্থেই করে থাকে। সেজন্য মনে কষ্ট নেওয়া উচিত নয়। আবার তাও যদি হয় মহান আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর মত কোনও ভাই, যিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছায়াস্বরূপ, উম্মতের সকলের প্রতি যাঁর অসাধারণ স্নেহ-মমতা!
হাদীছটির শিক্ষা
ক. কারও প্রতি বিদ্বেষ যদি হয় আল্লাহর জন্য, তবে সে বিদ্বেষ দোষের নয়। অবশ্য কোন্ বিদ্বেষ আল্লাহর জন্য এবং কোন্টা আল্লাহর জন্য নয়, আল্লাহওয়ালা উলামার কাছ থেকে তা শিখে নেওয়া চাই ।
খ. এ হাদীছ দ্বারা হযরত সালমান রাযি., হযরত সুহায়ব রাযি., হযরত বিলাল রাযি প্রমুখ গরীব সাহাবীদের মর্যাদা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। বলাবাহুল্য তাদের সে মর্যাদা লাভ হয়েছিল ঈমান ও তাকওয়ার কারণে। সুতরাং মুত্তাকী ও পরহেযগার গরীবদের মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা চাই।
গ. বড়র সামনে ছোটদের কোনও কথা আপত্তিকর মনে হলে তার উচিত তা সংশোধন করে দেওয়া।
ঘ. নিজের কোনও কথা সঠিক হল কি না এ ব্যাপারে সন্দেহ হলে বিজ্ঞজনের কাছে গিয়ে সে সন্দেহের নিরসন করে নেওয়া উচিত।
ঙ. যারা মুত্তাকী-পরহেযগার, তারা আল্লাহর ওলী। কোনও অবস্থায়ই তাদেরকে কষ্ট দেওয়া উচিত নয়। তাতে আল্লাহ নারাজ হন।
চ. কাউকে কষ্ট দিয়ে ফেললে যথাশীঘ্র ক্ষমা চেয়ে নেওয়া উচিত। ক্ষমা চাইতে লজ্জাবোধ করা উচিত নয়।
ছ. বড়র তিরস্কারে ছোটদের মনে কষ্ট নেওয়া উচিত নয়। মনে করতে হবে তার সে তিরস্কার তাদের কল্যাণার্থেই ।
জ. কেউ ক্ষমা চাইলে সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। সেইসঙ্গে তার জন্য আল্লাহর কাছে মাগফিরাতের দুআ করাও বাঞ্ছনীয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)


বর্ণনাকারী: