আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ

৪৭- সাহাবায়ে কিরামের রাঃ মানাকিব ও ফাযায়েল

হাদীস নং: ৬১৫৪
আন্তর্জাতিক নং: ২৪৮২-১
- সাহাবায়ে কিরামের রাঃ মানাকিব ও ফাযায়েল
৩২. আনাস বিন মালিক (রাযিঃ) এর ফযীলত
৬১৫৪। আবু বকর ইবনে নাফি’ (রাহঃ) ......... আনাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমার কাছে আসলেন। আমি তখন বালকদের সাথে খেলছিলাম। তিনি বলেন তিনি আমাদের সালাম জানালেন। তিনি আমাকে একটি বিশেষ প্রয়োজনে পাঠালেন। আমি আমার মায়ের কাছে ফেরতে দেরী করলাম। আমি মায়ের কাছে গেলে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাকে কিসে আটকিয়ে ছিল? আমি বললাম, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে একটি প্রয়োজনে পাঠিয়েছিলেন। তিনি বললেন, প্রয়োজনটি কি? আমি বললাম, তা গোপনীয়। তিনি বললেন, রাসুল (ﷺ) এর গোপন তথ্য কখনো কাউকে বলবে না। আনাস (রাযিঃ) বললেন, আল্লাহর কসম, হে সাবিত! সেই গোপন তথ্য কারও কাছে ব্যক্ত করলে তা তোমাকে অবশ্যই জানাতাম।
كتاب فضائل الصحابة رضى الله تعالى عنهم
باب مِنْ فَضَائِلِ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رضى الله عنه
حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرِ بْنُ نَافِعٍ، حَدَّثَنَا بَهْزٌ، حَدَّثَنَا حَمَّادٌ، أَخْبَرَنَا ثَابِتٌ، عَنْ أَنَسٍ، قَالَ أَتَى عَلَىَّ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَأَنَا أَلْعَبُ مَعَ الْغِلْمَانِ - قَالَ - فَسَلَّمَ عَلَيْنَا فَبَعَثَنِي إِلَى حَاجَةٍ فَأَبْطَأْتُ عَلَى أُمِّي فَلَمَّا جِئْتُ قَالَتْ مَا حَبَسَكَ قُلْتُ بَعَثَنِي رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لِحَاجَةٍ . قَالَتْ مَا حَاجَتُهُ قُلْتُ إِنَّهَا سِرٌّ . قَالَتْ لاَ تُحَدِّثَنَّ بِسِرِّ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَحَدًا . قَالَ أَنَسٌ وَاللَّهِ لَوْ حَدَّثْتُ بِهِ أَحَدًا لَحَدَّثْتُكَ يَا ثَابِتُ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হযরত আনাস রাযি.-এর বয়স যখন মাত্র ১০ বছর, তখন তাঁর মা হযরত উন্মু সুলায়ম রাযি. তাঁকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে নিয়োজিত করেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে খুব আদর-যত্ন করতেন। তিনি তাঁর টুকটাক কাজ করে দিতেন। যেহেতু তিনি বালকবয়সী ছিলেন, তাই অন্যান্য বালকের সঙ্গে খেলাধুলায়ও মশগুল হয়ে যেতেন। এতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে কোনও বারণ ছিল না। একদিন তিনি বালকদের সঙ্গে খেলায় মশগুল রয়েছেন। এ অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে পৌছে বালকদের সালাম দিলেন।

সাধারণ নিয়ম হল ছোট বড়কে সালাম দেবে। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছোটদেরকেও সালাম দিতেন। এর দ্বারা ছোটকে শিক্ষা দেওয়া উদ্দেশ্য হত। তাছাড়া এটা তাঁর বিনয়েরও প্রকাশ ছিল। তিনি অন্যান্য মহৎ গুণের মতো অসাধারণ বিনয়েরও অধিকারী ছিলেন। আগে সালাম দেওয়া বিনয়ের আলামত।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আনাস রাযি.-কে কোনও একটা কাজে পাঠালেন। সে কাজ সেরে বাড়িতে ফিরে যেতে তাঁর বিলম্ব হয়ে গেল। মা বিলম্বের কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তা জিজ্ঞেস করাই স্বাভাবিক। সন্তান সচরাচর যে সময়ে বাড়িতে ফিরে আসে, কখনও তারচে' বিলম্ব হলে জিজ্ঞেস করা চাই কেন তার বিলম্ব হল। এটা সতর্কতা। এ সতর্কতা না থাকলে সে হয়তো অনুচিত কোনও কাজে জড়িয়ে পড়বে। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার অসতর্কতা অনেক সময়ই তাকে বিপথগামিতায় উৎসাহ যোগায়। সচেতন পিতা-মাতা কখনও সে অবকাশ তার সন্তানকে দিতে পারে না।

মায়ের জিজ্ঞাসার উত্তরে হযরত আনাস রাযি. বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে একটি প্রয়োজনে পাঠিয়েছিলেন। মা জিজ্ঞেস করলেন, কী সে প্রয়োজন? সন্তান যদি বিলম্ব হওয়ার কারণ স্বরূপ কোনও অস্পষ্ট উত্তর দেয়, যেমন একটা কাজ ছিল বা একটা প্রয়োজন ছিল, তবে তার ব্যাখ্যা চাওয়া ভালো। কেননা অস্পষ্টভাবে কোনও কাজ বা প্রয়োজনের কথা বলে সে এমন কিছু লুকাতে পারে, যা সমর্থনযোগ্য নয়। হযরত উম্মু সুলায়ম রাযি. একজন সচেতন মা ছিলেন। তাই তিনি প্রয়োজনটির ব্যাখ্যা চাইলেন।

হযরত আনাস রাযি. বললেন, সেটি গোপন কথা। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন এক কাজে আমাকে পাঠিয়েছিলেন, যা প্রকাশ করা যাবে না। নিশ্চয়ই সেটি এমন এক কাজ ছিল, দীন ও শরী'আতের সঙ্গে যার কোনও সম্পর্ক নেই। দীন ও শরী'আত সম্পর্কিত কোনও বিষয় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও লুকাতেন না। ইসলাম এক পরিপূর্ণ দীন। আল্লাহ তা'আলা উম্মতের প্রয়োজনীয় যা-কিছু তাঁকে জানিয়েছিলেন, তিনি তা সবই পরিপূর্ণ ও সুস্পষ্টরূপে উম্মতের কাছে প্রকাশ করেছেন । কাজেই হযরত আনাস রাযি.-কে যে কাজে পাঠিয়েছিলেন তা হয়তো তাঁর স্ত্রীদের বা তাঁর নিজের এমন ব্যক্তিগত কোনও বিষয় ছিল, যা অন্যের জানার প্রয়োজন ছিল না। হয়তো জানানো সঙ্গতও ছিল না। তাই তা প্রকাশ করতে বারণ করেছিলেন।

হযরত উম্মু সুলায়ম রাযি. তাঁর সন্তানের এক উত্তম শিক্ষিকাও ছিলেন। তাই তিনি হযরত হযরত আনাস রাযি.-কে সতর্ক করলেন যে, দেখো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কথা গোপন রাখতে বলেছেন, তুমি তা অবশ্যই গোপন রাখবে। কোনও অবস্থায়ই তা কারও কাছে প্রকাশ করবে না। সুতরাং হযরত আনাস রাযি, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সে গোপন কথা জীবনভর গোপনই রেখেছেন। কোনও প্রিয়জনের কাছেও তা কখনও প্রকাশ করেননি। ছাবিত রহ. ছিলেন তাঁর অত্যন্ত প্রিয় শিষ্য। প্রিয় শিষ্যের কাছে শিক্ষক নিজের ব্যক্তিগত অনেক কিছুও বলে থাকে। ঘনিষ্ঠ শিষ্যরা তাদের শিক্ষকের অনেক গোপন কথা জেনে থাকে। কিন্তু হযরত আনাস রাযি, তাঁর প্রিয় শিষ্য ছাবিত রহ.-কে পর্যন্ত এ গোপন কথাটি বলেননি। এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি হযরত আনাস রাযি.-এর পূর্ণ আনুগত্য, পরিপূর্ণ বিশ্বস্ততা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষার পরিচয় বহন করে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা আমরা জানতে পারি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতটা উচ্চপর্যায়ের বিনয়ী ছিলেন। সায়্যিদুল আম্বিয়া হওয়া সত্ত্বেও তিনি খেলাধুলায় রত একদল বালককে সালাম দিয়েছেন।

খ. কারও কাছ দিয়ে অতিক্রমকালে তাকে সালাম দেওয়া চাই, যদিও সে বয়সে ছোট হয়।

গ. নাবালককে কোনও কাজে পাঠানো যেতে পারে, যদি তার নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চয়তা থাকে।

ঘ. কারও গোপন কথা ফাঁস করা জায়েয নয়। এমনকি পিতা-মাতার কাছেও নয়। পিতা-মাতার উচিত নয় তা জানার জন্য পীড়াপীড়ি করা।

ঙ. সন্তান যাতে কর্তব্যকর্ম পালনে যত্নবান থাকে, পিতা-মাতার উচিত সেজন্য তাকে সতর্ক ও সচেতন করা এবং সে কখন কী করে সে বিষয়ে উদাসীন না থাকা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)