আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ

৪৭- সাহাবায়ে কিরামের রাঃ মানাকিব ও ফাযায়েল

হাদীস নং: ৬০০৭
৪. আলী ইবনে আবু তালিব (রাযিঃ) এর ফযীলত
৬০০৭। যুহাইর ইবনে হারব ও শুজা ইবনে মাখলাদ (রাহঃ) ......... ইয়াযীদ ইবনে হায়্যান (রাহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি, হুসাইন ইবনে সাবুরা এবং উমর ইবনে মুসলিম-- আমরা যায়দ ইবনে আরকাম (রাযিঃ) এর নিকট গেলাম। আমরা যখন তার কাছে বসি, তখন হুসাইন বললেন, হে যায়দ! আপনি তো বহু কল্যাণ প্রত্যক্ষ করেছেন, আল্লাহর রাসুল (ﷺ) কে দেখেছেন, তাঁর হাদীস শুনেছেন, তার পাশে থেকে যুদ্ধ করেছেন এবং তাঁর পেছনে নামায আদায় করেছেন। আপনি বহু কল্যাণ লাভ করেছেন, হে যায়দ! আপনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে যা শুনেছেন, তা আমাদের বলুন না। যায়দ (রাযিঃ) বললেন, ভ্রাতূষ্পূত্র! আমার বয়স হয়েছে, আমি পুরানো যুগের মানুষ। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কাছ থেকে যা আমি সংরক্ষণ করোছিলাম, এর কিছু অংশ ভুলে গিয়েছি। তাই আমি যা বলি, তা কবুল কর আর আমি যা না বলি, সে ব্যাপারে আমাকে কষ্ট দিও না।

তারপর তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদিন মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী “খুম্ম” নামক স্থানে দাঁড়িয়ে আমাদের সামনে ভাষণ দিলেন। আল্লাহর প্রশংসা ও সানা বর্ণনা শেষে ওয়ায-নসীহত করলেন। তারপর বললেন, সাবধান, হে লোক সকল! আমি একজন মানুষ, আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ফিরিশতা আসবে, আর আমিও তাঁর ডাকে সাড়া দেব। আমি তোমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ দুটো জিনিস রেখে যাচ্ছি। এর প্রথমটি হলো আল্লাহর কিতাব। এতে হিদায়াত এবং নূর রয়েছে। সুতরাং তোমরা আল্লাহর কিতাবকে অবলম্বন কর, একে শক্ত করে ধরে রাখো। এরপর কুরআনের প্রতি আগ্রহ ও অনুপ্রেরণা দিলেন।

তারপর বললেনঃ আর হলো আমার আহলে বাইত। আর আমি আহলে বাইতের ব্যাপারে তোমাদের আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, আহলে বাইতের ব্যাপারে তোমাদের আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, আহলে বাইতের ব্যাপারে তোমাদের আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। হুসাইন বললেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর ’আহলে বাইত’ কারা, হে যায়দ? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর বিবিগণ কি আহলে বাইতর অন্তভুক্ত নন?

যায়দ (রাযিঃ) বললেন, বিবিগণও আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত; তবে আহলে বাইত তাঁরাই, যাদের উপর যাকাত গ্রহণ হারাম। হুসাইন বললেন, এ সব লোক কারা? যায়দ (রাযিঃ) বললেন, এরা আলী, আকীল, জাফের ও আব্বাস (রাযিঃ) এর পরিবার-পরিজন। হুসাইন বললেন, এদের সবার জন্য যাকাত হারাম? যায়দ (রাযিঃ) বললেন, হ্যাঁ।
باب مِنْ فَضَائِلِ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ رضى الله عنه
حَدَّثَنِي زُهَيْرُ بْنُ حَرْبٍ، وَشُجَاعُ بْنُ مَخْلَدٍ، جَمِيعًا عَنِ ابْنِ عُلَيَّةَ، قَالَ زُهَيْرٌ حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، حَدَّثَنِي أَبُو حَيَّانَ، حَدَّثَنِي يَزِيدُ بْنُ حَيَّانَ، قَالَ انْطَلَقْتُ أَنَا وَحُصَيْنُ، بْنُ سَبْرَةَ وَعُمَرُ بْنُ مُسْلِمٍ إِلَى زَيْدِ بْنِ أَرْقَمَ فَلَمَّا جَلَسْنَا إِلَيْهِ قَالَ لَهُ حُصَيْنٌ لَقَدْ لَقِيتَ يَا زَيْدُ خَيْرًا كَثِيرًا رَأَيْتَ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَسَمِعْتَ حَدِيثَهُ وَغَزَوْتَ مَعَهُ وَصَلَّيْتَ خَلْفَهُ لَقَدْ لَقِيتَ يَا زَيْدُ خَيْرًا كَثِيرًا حَدِّثْنَا يَا زَيْدُ مَا سَمِعْتَ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم - قَالَ - يَا ابْنَ أَخِي وَاللَّهِ لَقَدْ كَبِرَتْ سِنِّي وَقَدُمَ عَهْدِي وَنَسِيتُ بَعْضَ الَّذِي كُنْتُ أَعِي مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَمَا حَدَّثْتُكُمْ فَاقْبَلُوا وَمَا لاَ فَلاَ تُكَلِّفُونِيهِ . ثُمَّ قَالَ قَامَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَوْمًا فِينَا خَطِيبًا بِمَاءٍ يُدْعَى خُمًّا بَيْنَ مَكَّةَ وَالْمَدِينَةِ فَحَمِدَ اللَّهَ وَأَثْنَى عَلَيْهِ وَوَعَظَ وَذَكَّرَ ثُمَّ قَالَ " أَمَّا بَعْدُ أَلاَ أَيُّهَا النَّاسُ فَإِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ يُوشِكُ أَنْ يَأْتِيَ رَسُولُ رَبِّي فَأُجِيبَ وَأَنَا تَارِكٌ فِيكُمْ ثَقَلَيْنِ أَوَّلُهُمَا كِتَابُ اللَّهِ فِيهِ الْهُدَى وَالنُّورُ فَخُذُوا بِكِتَابِ اللَّهِ وَاسْتَمْسِكُوا بِهِ " . فَحَثَّ عَلَى كِتَابِ اللَّهِ وَرَغَّبَ فِيهِ ثُمَّ قَالَ " وَأَهْلُ بَيْتِي أُذَكِّرُكُمُ اللَّهَ فِي أَهْلِ بَيْتِي أُذَكِّرُكُمُ اللَّهَ فِي أَهْلِ بَيْتِي أُذَكِّرُكُمُ اللَّهَ فِي أَهْلِ بَيْتِي " . فَقَالَ لَهُ حُصَيْنٌ وَمَنْ أَهْلُ بَيْتِهِ يَا زَيْدُ أَلَيْسَ نِسَاؤُهُ مِنْ أَهْلِ بَيْتِهِ قَالَ نِسَاؤُهُ مِنْ أَهْلِ بَيْتِهِ وَلَكِنْ أَهْلُ بَيْتِهِ مَنْ حُرِمَ الصَّدَقَةَ بَعْدَهُ . قَالَ وَمَنْ هُمْ قَالَ هُمْ آلُ عَلِيٍّ وَآلُ عَقِيلٍ وَآلُ جَعْفَرٍ وَآلُ عَبَّاسٍ . قَالَ كُلُّ هَؤُلاَءِ حُرِمَ الصَّدَقَةَ قَالَ نَعَمْ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

আলোচ্য হাদীছটি হযরত যায়দ ইবন আরকাম রাযি. থেকে বর্ণনা করেছেন ইয়াযীদ ইবন হায়্যান রহ.। তিনি, হুসায়ন ইবন সাবরা রহ. ও আমর ইবন মুসলিম রহ.- এ তিনজন মিলে হযরত যায়দ ইবন আরকাম রাযি.-এর সঙ্গে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলেন। তখন হুসায়ন ইবন সাবরা রহ. হযরত যায়দ ইবন আরকাম রাযি.-কে লক্ষ্য করে বলেন-

لقد لقيت يا زيد خيرا كثيرا

(হে যায়দ! আপনি প্রভূত কল্যাণ অর্জন করেছেন)।
তারপর সে কল্যাণসমূহ কী তার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশেষ কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেছেন। আর তা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে পাওয়া, সরাসরি তাঁর হাদীছ ও বাণী শুনতে পাওয়া, তার সঙ্গে জিহাদে শরীক থাকা ও তাঁর পেছনে নামায আদায় করা। সন্দেহ নেই এর প্রত্যেকটিই অতি বড় নি'আমত। ইহজগতে এরচে' বড় কোনও নিআমত কল্পনা করা যায় না।

ঈমানের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখা ও তার সাহাবী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জনের মত অমূল্য সম্পদ আর কী হতে পারে? তারপর আবার সরাসরি নিজ কানে তাঁর মিষ্টিমধুর, জ্ঞান-প্রজ্ঞায় ভরপুর ও প্রাণজুড়ানো নূরাণী কথা শুনতে পাওয়া। চোখেও নূরের বিকিরণ, হৃদয়মনেও নূরের বিচ্ছুরণ। নূরুন আলা নূর। আরও খোশনসীব জিহাদে অংশগ্রহণ, যে জিহাদের আমীর স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর ছায়ায়, তাঁরই কমান্ডে আল্লাহর শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই, দীনের জন্য প্রাণদানের উদ্‌যাপন। এ মহাপ্রাপ্তির কি কোনও তুলনা হয়? রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে নামায। আল্লাহ তাআলার সামনে এবং তাঁর সর্বাপেক্ষা বেশি নৈকট্যে বান্দার হাজিরা। এ নামাযের ইমাম মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে। তাঁর তাকবীর অনুসরণে রুকূ-সিজদা করা, তাঁর 'সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ্' ধ্বনির উত্তরে 'রাব্বানা লাকাল হাম্দ' বলা। একজন বান্দার পক্ষে ইহলোকে এরচে' বেশি পাওয়ার আর কী থাকতে পারে? হযরত যাযদ ইবন আরকাম রাযি. এর সবক'টিই লাভ করেছেন।

হযরত যায়দ ইবন আরকাম রাযি.-কে সম্বোধন করে হুসায়ন রহ. ও তাঁর সঙ্গীদের এ বক্তব্য ছিল তাঁর প্রতি নিজেদের অন্তরে লালিত ভক্তি-শ্রদ্ধার অভিব্যক্তি। এ অভিব্যক্তি পুনর্ব্যক্ত করে তাঁরা আবারও বললেন-

لقد لقيت يا زيد خيرا كثيرا

(হে যায়দ! আপনি প্রভূত কল্যাণ অর্জন করেছেন)।
তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল তাঁর কাছ থেকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছ শোনা। সে লক্ষ্যেই প্রথমে এ ভক্তিমূলক বক্তব্য পেশ করেন। প্রশংসা-প্রশস্তি ক্ষতিকারক না হওয়ার প্রবল ধারণা থাকলে সে ক্ষেত্রে এরূপ সম্মুখ-প্রশংসা দোষের নয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে এরকম সম্মুখ- প্রশংসা অনেকবারই করেছেন। নিশ্চয়ই হযরত যায়দ ইবন আরকাম রাযি.-এর ঈমানী পরিপক্কতা এবং তাঁর জ্ঞান ও তত্ত্বজ্ঞানের গভীরতাদৃষ্টে সামনা-সামনি গুণকীর্তণ তাঁর ক্ষতি করবে না বলে তাদের প্রবল ধারণা ছিল। যাহোক এসব প্রাথমিক কথাবার্তার পর তারা তাদের মূল উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলেন-

حدثنا يا زيد ما سمعت من رسول الله

(হে যায়দ! আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যা শুনেছেন আমাদের কাছে তা বর্ণনা করুন)। এর দ্বারা হাদীছ শিক্ষার প্রতি তাদের গভীর আগ্রহ ফুটে ওঠে। সেইসঙ্গে তাদের এ সতর্কতাও অনুভব করা যায় যে, তারা হাদীছ শিক্ষার জন্য উপযুক্ত লোক বেছে নিয়েছেন। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । অনেক সময় লক্ষ করা যায় দীনী বিষয়ে জানার জন্য অর্থ ও সময় ব্যয় করে উপযুক্ত লোকের কাছে যাওয়ার চিন্তা করা হয় না। ধারেকাছে যাকে পাওয়া যায় তাকেই জিজ্ঞেস করা হয়, তার সে বিষয়ে ভালো জানা থাকুক বা না-ই থাকুক।

ইমাম মুহাম্মাদ ইবন সীরীন রহ. বলেন-

إِنَّ هَذَا الْعِلْمَ دِيْنٌ، فَانظُرُوا عَمَّنْ تَأْخُذُونَ دِينَكُمْ

‘এই ইলম দীনের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং লক্ষ করে দেখ তোমরা তোমাদের দীন কার নিকট থেকে গ্রহণ করছ।’

কোনও আলেমের নিকট দীন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী কোনও ব্যক্তি হাজির হলে সে আলেমের কর্তব্য তার আগ্রহের মূল্যায়ন করা এবং আপন সামর্থ্য অনুযায়ী তার ইলমের পিপাসা নিবারণ করা। এটাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা। সুতরাং হযরত যায়দ ইবন আরকাম রাযি. তাই করলেন। তিনি উপস্থিত শিক্ষার্থীদের হাদীছ শোনালেন । তবে তার আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দিয়ে নিলেন।

তাতে তিনি প্রথমে 'হে ভাতিজা' বলে স্নেহ-সম্বোধন করলেন, যা দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা অনুযায়ী তিনি শিক্ষার্থীর প্রতি নিজ স্নেহ-মমতা প্রকাশ করলেন। শিক্ষার্থীর প্রতি মমত্বপূর্ণ আচরণ করা আদর্শ শিক্ষকের এক অপরিহার্য গুণ।

তারপর তিনি নিজের বার্ধক্য এবং শিক্ষাকাল থেকে এ পর্যন্ত অনেক দীর্ঘ সময় গত হওয়ার উল্লেখপূর্বক স্পষ্ট করে দিলেন যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যা-কিছু শিখেছিলেন তার সবটা মনে নেই, কিছু কিছু ভুলে গেছেন। বয়স বেশি হলে মানুষের স্মরণশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَمِنْكُمْ مَنْ يُرَدُّ إِلَى أَرْذَلِ الْعُمُرِ لِكَيْ لَا يَعْلَمَ بَعْدَ عِلْمٍ شَيْئًا

‘তোমাদের মধ্যে কতক এমন হয়, যাদেরকে বয়সের সর্বাপেক্ষা অকর্মণ্য স্তরে পৌঁছানো হয়, যেখানে পৌঁছার পর তারা সবকিছু জানার পরও কিছুই জানে না।’১৮২

সুতরাং তাঁর যতটুকু মনে আছে কেবল ততটুকুই বলবেন, এর বেশি বলতে যেন তাকে পীড়াপীড়ি করা না হয়। এই ভূমিকার পর তিনি বিদায় হজ্জ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে পবিত্র মক্কা ও মদীনার মাঝখানে ‘গাদীরে খুম’ নামক এক জলাশে তীরে প্রদত্ত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষণের অংশবিশেষ তাদের সামনে বর্ণনা করলেন। তাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা ইরশাদ করেছিলেন-
أَلا أَيُّهَا النَّاسُ، فَإِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ يُوشِكُ أَنْ يَأْتِيَ رسولُ ربِّي فَأُجيبَ
(হে লোক সকল! আমি একজন মানুষমাত্র। হয়তো অচিরেই আমার প্রতিপালকের দূত এসে যাবে এবং আমি তাঁর ডাকে সাড়া দেব)। 'আমি একজন মানুষ মাত্র' বলে তিনি তাঁর সম্পর্কে বাড়াবাড়িমূলক আকীদা-বিশ্বাস তৈরির ব্যাপারে সাবধান করেছেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন মরণশীল মানুষ হওয়া
অন্যান্য নবীদের সত্যতার প্রমাণস্বরূপ যেমন বিভিন্ন মু'জিযা ও অলৌকিক ঘটনাবলী প্রকাশ করা হয়েছিল, তেমনি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাঁর সত্যতা সম্পর্কেও বহু নিদর্শন দেখানো হয়েছে। তাঁর শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন কুরআন মাজীদ। আল্লাহ তাআলার কালাম হওয়ায় কোনও মানুষের পক্ষে কুরআন মাজীদের সর্বপ্রকার ছোট সূরার মত একটি সূরাও তৈরি করা সম্ভব নয়। তাছাড়া তাঁর আঙ্গুলের ফাঁক থেকে পানির ফোয়ারা ছুটেছে, সামান্য এক পেয়ালা দুধে বহু লোকের ক্ষুধা মিটেছে, তাঁর আঙ্গুলের ইশারায় চাঁদ দু'টুকরো হয়েছে, রাতের সামান্য সময়ের মধ্যে পবিত্র মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস এবং সেখান থেকে সপ্তাকাশ সফর করে এসেছেন, ক্ষুধার্ত উট তাঁর কাছে এসে মালিকের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছে, এ জাতীয় আরও বহু মু'জিযা দেখে কারও দ্বারা তাঁর সম্পর্কে এ বিশ্বাস তৈরির আশঙ্কা ছিল যে, তিনি মানুষ নন; বরং আল্লাহর অবতার বা তাঁর ক্ষমতাসম্পন্ন কোনও সত্তা (না'ঊযু বিল্লাহি মিন যালিক), যেমন এক শ্রেণীর লোক এ কালে বলছে যে, তিনি আল্লাহর নূরের সৃষ্টি। এ জাতীয় ভ্রান্ত আকীদা প্রতিরোধকল্পে তাঁর পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, আমি তো একজন মানুষই। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ

‘বলে দাও, আমি তো তোমাদের মত একজন মানুষই। (তবে) আমার প্রতি এই ওহী আসে যে, তোমাদের মাবুদ কেবল একই মাবুদ।'১৮৩
অর্থাৎ মানুষ হওয়ার ব্যাপারে তোমাদের সঙ্গে আমার পার্থক্য নেই। তবে হাঁ, আমি যেহেতু একজন নবী বরং শ্রেষ্ঠতম ও সর্বশেষ নবী এবং আমার প্রতি ওহী নাযিল হয়, তাই নবুওয়াতের অপরিহার্য গুণাবলী আমার মধ্যে বিদ্যমান আছে। যেমন গুনাহ না করা, সর্বোচ্চ পর্যায়ের আখলাক-চরিত্রের অধিকারী হওয়া, নিখুঁত জ্ঞানবুদ্ধি থাকা, সাহসিকতা ও আল্লাহনির্ভরতার সর্বোচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত থাকা ইত্যাদি।

মানুষ মাত্রই মরণশীল। তিনি যখন একজন মানুষ তখন স্বাভাবিকভাবেই একদিন তাঁরও মৃত্যু হবে। তাঁর আগেও যত নবী-রাসূল এসেছিলেন তাদের মৃত্যু হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ

'আর মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একজন রাসূল বৈ তো নন। তাঁর পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছে ।১৮৪

অন্যত্র ইরশাদ-

إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ

(হে রাসূল!) নিশ্চয় তুমি মরণশীল এবং তারাও অবশ্যই মরণশীল।১৮৫

সুতরাং সৃষ্টি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার এ চিরন্তন বিধান অনুযায়ী একদিন তাঁরও মৃত্যু হবে। সে কথাই তিনি স্পষ্ট করে দেন যে, অচিরেই আমার প্রতিপালকের দূত মালাকুল মাওত এসে যাবে। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে আমি তোমাদের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে কবরের জগতে চলে যাব।

কুরআন মাজীদ আঁকড়ে ধরে রাখার তাগিদ
তাঁর এ ঘোষণায় শ্রোতামণ্ডলীর অন্তরে ভয় জাগার কথা যে, তিনি যতদিন জীবিত আছেন মানুষকে হিদায়াতের পথ দেখাচ্ছেন। তাঁর দ্বারা যে-কোনও জটিলতার সমাধান হয়ে যাচ্ছে। তিনি চলে যাওয়ার পর কে তাদের পথ দেখাবে? আপতিত সমস্যার সমাধান তখন কিভাবে নেওয়া যাবে? তিনি এ ভয় ও শঙ্কার নিরসনকল্পে ইরশাদ করেন-
انا تارك فيكم ثقلين (আমি তোমাদের মধ্যে দু'টি ভার রেখে যাচ্ছি)। ভার মানে মর্যাদাবান ও গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। আরবীতে যে-কোনও মূল্যবান ও মর্যাদাপূর্ণ বস্তু ও বিষয়কে ثقل (ভার) বলে। বাংলায়ও বলা হয়, ওজনদার কথা বা ওজনদার লোক। অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ কথা ও মর্যাদাবান লোক। এ হাদীছে যে দু'টি বিষয় রেখে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে, অত্যন্ত মর্যাদাবান হওয়ায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে দু'টোকে ثقل শব্দে ব্যক্ত করেছেন। কী সে দু'টো বিষয়? সামনে তিনি এর ব্যাখ্যা করছেন-
أَوَّلهُما كِتابُ اللَّهِ، فِيهِ الهُدى وَالنُّورُ (তার প্রথমটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব। তাতে আছে হিদায়াত ও আলো)। অর্থাৎ প্রথমটি হচ্ছে কুরআন মাজীদ। তাতে কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের জন্য হিদায়াত ও পথনির্দেশ আছে। তাতে আছে পথচলার আলো। আমি দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পরও এ হিদায়াত ও আলো তোমাদের মধ্যে থাকবে। কিয়ামত পর্যন্ত তা সুরক্ষিত থাকার নিশ্চয়তা আছে। কেউ তা বিকৃত করতে পারবে না। তোমাদের দোজাহানের মুক্তি ও সফলতার লক্ষ্যে অনুসরণীয় সবকিছুই এতে বিদ্যমান আছে। যে-কোনও পরিস্থিতিতেই এ কিতাব তোমাদের পথ দেখাবে। যত জটিল সমস্যাই হোক না কেন, এর আলোকে তোমরা তার সমাধান করতে পারবে। এর অনুসরণ করলে তোমাদের পথ হারানোর কোনও ভয় নেই। কোনও জটিলতার আবর্তে পড়ে থাকার কোনও আশঙ্কা নেই। যেমন অপর এক বর্ণনায় আছে-

وَهُو حبْلُ اللَّه، منِ اتَّبَعه كَانَ عَلَى الهُدى، ومَنْ تَرَكَهُ كانَ عَلَى ضَلالَةٍ

(আর তা হচ্ছে আল্লাহর রশি। যে ব্যক্তি তার অনুসরণ করবে সে হিদায়াতের উপর থাকবে। আর যে তা পরিত্যাগ করবে সে পথভ্রষ্ট হবে)। সুতরাং তোমাদের কাজ কেবল সর্বাবস্থায় এ কিতাব আঁকড়ে ধরে থাকা।
অতঃপর তিনি কুরআন মাজীদ আঁকড়ে ধরে রাখার প্রতি উৎসাহ দান করেন। কোনও অবস্থায়ই তা থেকে বিচ্যুত না হওয়ার তাগিদ দেন। প্রকাশ থাকে যে, কুরআন আঁকড়ে ধরার জন্য হাদীছের অনুসরণ অপরিহার্য। কুরআনের সঙ্গে হাদীছের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কাজেই কুরআনের পাশাপাশি হাদীছকেও আঁকড়ে ধরতে হবে। বিদায় হজ্জেরই অপর এক ভাষণে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ، لَنْ تَضِلُّوْا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا: كِتَابَ اللَّهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ

‘আমি তোমাদের মধ্যে দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি। যতক্ষণ তোমরা তা আঁকড়ে ধরে রাখবে, কস্মিনকালেও পথভ্রষ্ট হবে না –আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নত।১৮৬

তারপর দ্বিতীয় বিষয়টি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন-

وأَهْلُ بَيْتِي، أُذكِّركم اللَّه في أهلِ بيْتي، أذكِّرُكم اللَّه في أهل بيتي

(আমার আহলে বায়ত। আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বায়তের ব্যাপারে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বায়তের ব্যাপারে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি)। অর্থাৎ দ্বিতীয় যে মর্যাদাপূর্ণ বিষয় তোমাদের মধ্যে রেখে যাচ্ছি তা হচ্ছে আমার আহলে বায়ত। সাবধান! তোমরা তাদের মর্যাদা রক্ষা করো। কিছুতেই তাদের অমর্যাদা করো না।

হযরত যায়দ ইবন আরকাম রাযি, যখন হাদীছটি বর্ণনা করা শেষ করলেন, তখন হুসায়ন ইবন সাবরা রহ. তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ তাঁর আহলে বায়ত কি না। তিনি স্বীকার করলেন যে, তারাও আহলে বায়ত। তবে তিনি আরও বৃহত্তর অর্থে আহলে বায়তের ব্যাখ্যা দিলেন। বললেন- তবে (সাধারণভাবে) আহলে বায়ত বলতে তাদেরকে বোঝানো হয়, যাদের জন্য সদাকা (খাওয়া) হারাম করা হয়েছে। আর তারা হচ্ছেন- আলীর বংশধরগণ, আকীলের বংশধরগণ, জাফরের বংশধরগণ এবং আব্বাসের বংশধরগণ। পরিভাষায় তাদেরকে সায়্যিদ বলা হয়। তাদের জন্য সদাকা অর্থাৎ যাকাত, ফিতরা, মানত ইত্যাদি খাওয়া জায়েয নয়। আরও বৃহত্তর পরিসরে বনূ হাশিমের জন্যও সদাকা যাকাত খাওয়া খারাম।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

এ হাদীছটির মধ্যে আমাদের জন্য বহু শিক্ষা রয়েছে। যেমন-
ক. মুসলিম উম্মাহ'র মধ্যে আহলে বায়তের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। তাদের সে মর্যাদা রক্ষা করা সকলের অবশ্যকর্তব্য।

খ. কুরআন মাজীদ আল্লাহর কিতাব, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিজের রচনা নয়।

গ. যে ব্যক্তি কুরআন মাজীদ শক্ত করে ধরে রাখবে, সে হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, পথভ্রষ্টতার শিকার হবে না।

ঘ. কুরআনই আলো। সর্বপ্রকার অন্ধকার ও পাশববৃত্তি থেকে মুক্ত আলোকিত জীবন গড়ার একমাত্র উপায় কুরআনের অনুসরণ।

ঙ. বক্তব্য ও ভাষণ দেওয়ার আগে আল্লাহ তাআলার হাম্দ ও ছানা পড়ে নেওয়া চাই।

চ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ আহলে বায়তের অন্তর্ভুক্ত। তাঁরা আমাদের মা। তাঁদের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা-ভক্তি বজায় রাখতে হবে।

ছ. আহলে বায়ত ও বনূ হাশিমের জন্য যাকাত-সদাকা ভোগ করা হারাম।

জ. দীনী ইলম শেখার জন্য গভীর জ্ঞানসম্পন্ন মুত্তাকী-পরহেযগার উস্তায বেছে নেওয়া চাই।

ঝ. দীনী ইলম অর্জনের জন্য উস্তাযের কাছে যাওয়া চাই। এ মহামূল্যবান সম্পদ ঘরে বসে অর্জন করা যায় না।

ঞ. শিক্ষার্থীকে অবশ্যই উস্তাযের আদব-সম্মান বজায় রাখতে হবে।

ট. তালিবে ইলম ও শিক্ষার্থীর প্রতি মমতাশীল থাকা দীনী ইলমের উস্তাযের একটি অপরিহার্য গুণ ।

ঠ. বৃদ্ধকালে স্মরণশক্তি দুর্বল হয়ে যায়। তাই এ বয়সে মুখস্থ বিষয় বর্ণনা করার ব্যাপারে অত্যধিক সতর্কতা জরুরি।

ড. যে বিষয় পুরোপুরি স্মরণ নেই তা কিছুতেই বর্ণনা করা উচিত নয়।

১৮০. সূরা মুনাফিকূন (৬৩), আয়াত ১-২ এবং ৭-৮

১৮১. ইবন হিশাম, আস্ সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ, গাযওয়া বনুল মুস্তালিক দ্র.।

১৮২. সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৭০

১৮৩. সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ১১০

১৮৪. সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১৪৪

১৮৫. সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৩০

১৮৬. মুআত্তা মালিক, হাদীছ নং ৬৭৮
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
সহীহ মুসলিম - হাদীস নং ৬০০৭ | মুসলিম বাংলা