আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

১৯- জানাযার অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ১৩৮১
৮৭৪. মুসলমানদের (না-বালিগ) সন্তানদের বিষয়ে যা বলা হয়েছে।
আবু হুরায়রা (রাযিঃ) নবী (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তির এমন তিনটি সন্তান মারা যায় যারা বালিগ হয়নি, তারা (মাতাপিতার জন্য) জাহান্নাম থেকে আবরণ হয়ে যাবে। অথবা (তিনি বলেছেন) সে ব্যক্তি জান্নাতে দাখিল হবে।
১২৯৮। ইয়াকুব ইবনে ইবরাহীম (রাহঃ) ......... আনাস ইবনে মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ যে কোন মুসলিম ব্যক্তির এমন তিনটি (সন্তান) মারা যাবে, যারা বালিগ হয়নি, আল্লাহ পাক তাদের প্রতি তাঁর রহমতের ফযলে সে ব্যক্তিকে (মা-বাপকে) জান্নাতে দাখিল করবেন।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

الْحِنْث এর শাব্দিক অর্থ গুনাহ। আলোচ্য হাদীছটিতে এর দ্বারা প্রাপ্তবয়স্ক বা বালেগ হওয়া বোঝানো উদ্দেশ্য। বালক যখন বালেগ হয়ে যায়, তখন থেকে তার গুনাহ লেখা শুরু হয়। তাই বালেগ হওয়াকে এ শব্দে প্রকাশ করা হয়েছে। কারও নাবালেগ সন্তান যদি মারা যায় আর তাতে সে ধৈর্যধারণ করে, তবে তার কী ফযীলত তা এ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। নাবালক বা শিশুসন্তানের মৃত্যুতে ধৈর্যধারণের বিশেষ ফযীলত রয়েছে। তা এ কারণে যে, শিশুসন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের স্নেহ-মমতা বেশি থাকে। এ বয়সে তারা বাবা-মায়ের অবাধ্যতা করতে পারে না। ফলে তাদের প্রতি বাবা-মা'র মনে কোনও কষ্ট থাকে না। এ অবস্থায় তাদের মৃত্যু হলে বাবা-মা'র মনে শোকতাপ খুব বেশি লাগে। ফলে ধৈর্যধারণ কঠিন হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও যদি ধৈর্যধারণ করে, তবে তারা আল্লাহ তা'আলার কাছে অপরিমিত পুরস্কারের উপযুক্ত হয়ে যায়।

কেউ কেউ বলেন, ছেলেমেয়ে যদি সুসন্তান হয়, তবে বড় হওয়ার পর তারা মা-বাবার আনুগত্য করে, তাদের খেদমত করে এবং নানাভাবে তাদের উপকারে আসে। কাজেই শিশুসন্তানের মৃত্যুতে ধৈর্যধারণ করলে যখন বিপুল ছাওয়াব পাওয়া যায়, তখন প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের মৃত্যুতে ধৈর্যধারণ করলে অধিকতর ছাওয়াবের আশা রয়েছে। যাহোক আলোচ্য হাদীছটিতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন যে, কারও তিনটি শিশুসন্তান মারা গেলে তার বিনিময়ে আল্লাহ তা'আলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। অপর এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَمُوتُ لَهُ ثَلاَثَةٌ مِنَ الْوَلَدِ لَمْ يَبْلُغُوا الْحِنْثَ، إِلاَّ تَلَقَّوْهُ مِنْ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ الثَّمَانِيَةِ، مِنْ أَيِّهَا شَاءَ دَخَلَ
'যে-কোনও মুসলিমের তিনটি নাবালেগ সন্তান মারা যায়, তাকে তারা অবশ্যই জান্নাতের আট দরজায় স্বাগত জানাবে। সে তার ইচ্ছামতো যে-কোনও দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে’। (সুনানে ইবন মাজাহ: ১৬০৪; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ২৯৪)

কারও শিশুসন্তান মারা গেলে কেন সে জান্নাত লাভ করবে, সে সম্পর্কে হাদীছটিতে ইরশাদ হয়েছে- بِفَضْلِ رَحْمَتِهِ إِيَّاهُمْ (তাদের প্রতি নিজ রহমতের গুণে)। অর্থাৎ শোকে-দুঃখে সবর করার কারণে আল্লাহ তা'আলা তাদের প্রতি দয়ার আচরণ করবেন আর সেজন্যই তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। কেউ কেউ বাক্যটির অর্থ করেছেন- তাদের প্রতি (অর্থাৎ সন্তানদের) প্রতি তার (অর্থাৎ পিতার) রহমতের গুণে। অর্থাৎ সন্তানের প্রতি পিতার যে গভীর মায়া-মমতা আর তা সত্ত্বেও সেই সন্তানের মৃত্যুতে সে ধৈর্যের পরিচয় দেয়, এ কারণে আল্লাহ তা'আলা তাকে জান্নাত দান করবেন। বলাবাহুল্য, সন্তানের প্রতি পিতা অপেক্ষা মায়ের মায়া-মমতা অনেক বেশি। সুতরাং মা যদি সন্তানের মৃত্যুতে ধৈর্যধারণ করে, তবে তার জান্নাতলাভের সম্ভাবনা আরও বেশি।

এ হাদীছটিতে যদিও তিনটি সন্তানের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু অন্য হাদীছ দ্বারা বোঝা যায়, দুটি সন্তানের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। এমনকি কোনও কোনও হাদীছ দ্বারা জানা যায়, একটি নাবালক সন্তানের মৃত্যুতেও ধৈর্যধারণ করলে তার পিতা-মাতাকে জান্নাত দান করা হবে। যেমন এক বর্ণনায় আছে-
أَنَّ رَجُلًا أَتَى النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمَعَهُ ابْنٌ لَهُ فَقَالَ لَهُ: «أَتُحِبُّهُ؟» فَقَالَ: أَحَبَّكَ اللَّهُ كَمَا أُحِبُّهُ، فَمَاتَ، فَفَقَدَهُ، فَسَأَلَ عَنْهُ، فَقَالَ: «مَا يَسُرُّكَ أَنْ لَا تَأْتِيَ بَابًا مِنْ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ إِلَّا وَجَدْتَهُ عِنْدَهُ يَسْعَى يَفْتَحُ لَكَ؟
‘এক ব্যক্তি তার এক শিশুপুত্রকে নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসল। একদিন তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি একে ভালোবাস? সে ব্যক্তি বলল, আমি একে যেমন ভালোবাসি, তেমনি আল্লাহ তা'আলা আপনাকে ভালোবাসুন। ছেলেটি মারা যায়। ফলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকটিকে আর দেখতে পান না। তিনি তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন (লোকে বলল, তার ছেলেটি মারা গেছে)। তারপর সে আসলে তিনি বললেন, তোমার জন্য এটা কি আনন্দদায়ক নয় যে, তুমি জান্নাতের যে দরজায়ই উপস্থিত হবে, সেখানে তাকে দেখতে পাবে যে, সে তোমার জন্য দরজা খুলছে?’ (সুনানে নাসাঈ ১৮৭০; মুসনাদুল বাযযার: ৩৩০২)

আবূ হাসসান নামে এক তাবি'ঈ বলেন, আমি আবু হুরায়রা রাযি.-কে বললাম, আমার দু'টি পুত্র মারা গেছে। আপনি কি এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনও হাদীছ আমাকে শোনাবেন, যাতে করে মৃতদের বিষয়ে আমরা মনে প্রশান্তি পেতে পারি? তিনি বললেন, হাঁ, শোনো-
صِغَارُهُمْ دَعَامِيصُ الْجَنَّةِ, يَتَلَقَّى أَحَدُهُمْ أَبَاهُ, أَوْ قَالَ: أَبَوَيْهِ, فَيَأْخُذُ بِثَوْبِهِ, أَوْ قَالَ: بِيَدِهِ, كَمَا آخُذُ أَنَا بِصَنِفَةِ ثَوْبِكَ هَذَا, فَلاَ يَتَنَاهَى, أَوْ قَالَ: فَلاَ يَنْتَهِي, حَتَّى يُدْخِلَهُ اللهُ وَأَبَاهُ الْجَنَّةَ
'মুমিনদের শিশুরা জান্নাতের ক্ষুদ্র জীব। তাদের একেকজন তাদের বাবা কিংবা বাবা-মা'কে স্বাগত জানাবে। সে তার কাপড় বা হাত ধরবে, যেমন এই আমি তোমার এই কাপড়টির প্রান্ত ধরছি। তারপর সে আর থামবে না, যাবৎ না আল্লাহ তার পিতাকে জান্নাতে প্রবেশ করান’। (সহীহ মুসলিম: ২৬৩৫; মুসনাদুল বাযযার: ৯৫৪৭; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৭১৪২)

প্রকাশ থাকে যে, শোকতাপে সবর দ্বারা যেসব গুনাহ মাফ হয় তা আল্লাহ তা'আলার হক সম্পর্কিত গুনাহ। যেসব গুনাহের সম্পর্ক বান্দার হকের সঙ্গে, তার বেলায় বান্দার পক্ষ থেকেও মাফ পাওয়া জরুরি। বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা এটা প্রমাণিত। তাছাড়া সাধারণভাবে কবীরা গুনাহের ক্ষেত্রেও ক্ষমাপ্রাপ্তির জন্য তাওবা জরুরি।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. সন্তানের মৃত্যুতে শোক যতই গভীর হোক, তথাপি মুমিন নর-নারীর উচিত ধৈর্যের পরিচয় দেওয়া। তাতে জান্নাতলাভের আশা থাকে।

খ. সন্তানের মৃত্যু বাহ্যত কঠিন মসিবত হলেও প্রকৃতপক্ষে পিতা-মাতার পক্ষে তা রহমতস্বরূপ। এটা চিন্তা করলে ধৈর্যধারণ সহজ হয়।

গ. মুমিনদের শিশুসন্তান জান্নাতবাসী হবে।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন