আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

১৯- জানাযার অধ্যায়

হাদীস নং: ১২৮৪
আন্তর্জতিক নং: ১৩৬৮

পরিচ্ছেদঃ ৮৬৮. মৃত ব্যক্তির ভালোগুন সম্পর্কে লোকদের আলোচনা।

১২৮৪। আফফান ইবনে মুসলিম (রাহঃ) ......... আবুল আসওয়াদ (রাহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি মদীনায় আসলাম, তখন সেখানে একটি রোগ (মহামারী আকারে) ছড়িয়ে পড়েছিল। আমি উমর ইবনে খাত্তাব (রাযিঃ) এর কাছে বসা ছিলাম। এ সময় তাদের পাশ দিয়ে একটি জানাযা অতিক্রম করল। তখন জানাযার লোকটি সম্পর্কে প্রশংসাসূচক মন্তব্য করা হল। উমর (রাযিঃ) বললেন, ওয়াজিব হয়ে গেল। এরপর অপর একটি (জানাযা) অতিক্রম করল, তখন সে লোকটি সম্পর্কেও প্রশংসাসূচক মন্তব্য করা হল। (এবারও) তিনি বললেন, ওয়াজিব হয়ে গেল। এরপর তৃতীয় একটি (জানাযা) অতিক্রম করল, লোকটি সম্বন্ধে নিন্দাসূচক মন্তব্য করা হল। তিনি বললেন, ওয়াজিব হয়ে গেল। আবুল আসওয়াদ (রাহঃ) বলেন, আমি বললাম, হে আমীরুল মু’মিনীন! কি ওয়াজিব হয়ে গেল? তিনি বললেন, আমি তেমনই বলেছি, যেমন নবী (ﷺ) বলেছিলেন, যে কোন মুসলমান সম্পর্কে চার ব্যক্তি ভাল হওয়ার সাক্ষ্য দিবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে দাখিল করবেন। [উমর (রাযিঃ) বলেন,] তখন আমরা বলেছিলাম, তিন জন হলে? তিনি বললেন, তিনজন হলেও। আমরা বললাম, দু’জন হলে? তিনি বললেন, দু’জন হলেও। তারপর আমরা একজন সম্পর্কে আর তাঁকে জিজ্ঞাসা করি নি।

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ

এবিষয়ে আরেকটি হাদীস হলো- হযরত আনাস রাযি. বলেন, লোকজন এক মায়্যিতকে নিয়ে যাচ্ছিল। উপস্থিত লোকেরা তার প্রশংসা করল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ওয়াজিব হয়ে গেছে। তারপর লোকজন আরেক মায়্যিতকে নিয়ে যাচ্ছিল। উপস্থিত লোকেরা তার দুর্নাম করল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ওয়াজিব হয়ে গেছে। উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি. বললেন, কী ওয়াজিব হয়ে গেছে? তিনি বললেন, তোমরা ওই মায়্যিতের প্রশংসা করেছ। ফলে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেছে। আর এই মায়্যিতের দুর্নাম করেছ। ফলে তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে গেছে। তোমরা পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষী। এ হাদীছদু'টির মূল বিষয়বস্তু একই। এতে জানানো হয়েছে, মৃতব্যক্তির প্রশংসা করার দ্বারা তার জন্য জান্নাত পাওয়া নিশ্চিত হয়ে যায়। আর তার নিন্দা করার দ্বারা তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত হয়ে যায়। একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইতি ওয়াসাল্লামের সম্মুখ দিয়ে এক বাক্তির লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তখন লোকজন তার প্রশংসা করল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- وجبت (ওয়াজিব হয়ে গেছে)। অর্থাৎ তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেছে। এটা নিশ্চিত যে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আরেকবার এক ব্যক্তির লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর তখন লোকজন তার নিন্দা করল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- وجبت (ওয়াজিব হয়ে গেছে)। অর্থাৎ তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে গেছে। সে নিশ্চয়ই জাহান্নামে যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, জীবিতদের প্রশংসা বা নিন্দার কারণে কীভাবে মৃতব্যক্তির জন্য জান্নাত-জাহান্নামের ফয়সালা হতে পারে? কুরআন-হাদীছের সুস্পষ্ট বক্তব্য অনুযায়ী জান্নাত- জাহান্নামের ফয়সালা তো হয় মানুষের আমলের ভিত্তিতে। যে ব্যক্তি নিজে সৎকর্ম করবে এবং তার পাপের তুলনায় সৎকর্ম বেশি হবে আর সে যদি ঈমানদারও হয়, তবে সে জান্নাত লাভ করবে। যদি ঈমানওয়ালা হয় কিন্তু সৎকর্মের তুলনায় অসৎকর্ম বেশি হয়, তবে আল্লাহ মাফ না করলে সে প্রথমে জাহান্নামে যাবে, তারপর শাস্তিভোগের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাত লাভ করবে। যার ঈমান নেই, সে চিরকাল জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। এটাই নিয়ম। মানুষের প্রশংসা বা নিন্দার ভিত্তিতে কারও জান্নাত-জাহান্নামের ফয়সালা হবে না। কিন্তু আলোচ্য হাদীছ দ্বারা তো এরকমই বুঝে আসে। এতে তো স্পষ্টই বলা হয়েছে- هذَا أَثْنيْتُمْ عَلَيْهِ خَيْرًا، فَوَجَبَتْ لَهُ الجنة। (তোমরা ওই মায়্যিতের প্রশংসা করেছ। ফলে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেছে)। এমনিভাবে নিন্দার বেলায় বলা হয়েছে- وَهذَا أَثْنَيْتُمْ عَلَيْهِ شَرًّا، فَوَجَبَتْ لَهُ النار (আর এই মায়্যিতের দুর্নাম করেছ। ফলে তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে গেছে)। তাই এর ব্যাখ্যা কী? আসলে এ প্রশ্নের সমাধান আলোচ্য হাদীছের শেষেই আছে। এতে বলা হয়েছে- أَنتُمْ شُهَدَاءُ اللَّهِ فِي الْأَرْضِ (তোমরা পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষী)। সাক্ষ্য হয় বাস্তব অবস্থা অনুযায়ী। ঘটনা যেমন ঘটে, সত্যবাদী সাক্ষী সেরকমই বিবরণ দিয়ে থাকে। হাদীছটিতে সাহাবায়ে কেরাম এবং ব্যাপকভাবে সমস্ত মুমিনকে আল্লাহর সাক্ষী বলা হয়েছে। যে ব্যক্তি প্রকৃত মুমিন, সে সত্যসাক্ষ্যই দেবে। সে কখনও মিথ্যাসাক্ষ্য দিতে পারে না। কাজেই সে যখন কারও সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে, বিশেষত কোনও মৃতব্যক্তি সম্পর্কে, তখন অবশ্যই সত্যকথাই বলবে। সে মৃতব্যক্তির প্রশংসা করলে বোঝা যাবে যে, সে অবশ্যই ভালো লোক। অর্থাৎ সে একজন নেককার লোক। সে একজন সৎকর্মশীল। নিন্দা করলে বোঝা যাবে সে অবশ্যই মন্দ লোক। অর্থাৎ সে একজন বদকার ও অসৎকর্মশীল লোক। বাস্তবে যে সৎকর্মশীল, সে জান্নাতবাসী হবে। আর যে অসৎকর্মশীল, সে হবে জাহান্নামী। তাহলে তাদের জান্নাত ও জাহান্নামের ফয়সালা তাদের আমল ও কর্মের ভিত্তিতেই হয়ে থাকে, মানুষের প্রশংসা বা নিন্দার ভিত্তিতে নয়। প্রকৃত বিষয় হল আল্লাহ তা'আলা ব্যক্তির কর্ম অনুযায়ী জান্নাত-জাহান্নামের ফয়সালা নিয়ে থাকেন। আর সে হিসেবেই তিনি মুমিনদের মুখ দিয়ে প্রশংসা বা নিন্দামূলক কথা বলিয়ে দেন যা অর্থাৎ প্রশংসা ও নিন্দা একটা বাহ্যিক আলামত, যা সাধারণত প্রকৃত অবস্থার ইঙ্গিত বহন করে। কারও সম্পর্কে জান্নাত বা জাহান্নামের ফয়সালা হয়ে থাকলেই জীবিতদের মুখ দিয়ে তার প্রশংসা বা নিন্দামূলক কথা উচ্চারিত হয়। প্রশংসা বা নিন্দার কারণে জান্নাত-জাহান্নামের ফয়সালা হয় না। তবে মনে রাখতে হবে, যে-কারও প্রশংসা বা নিন্দা আলামতরূপে গণ্য হয় না। তা গণ্য হয় এমন ব্যক্তির প্রশংসা ও নিন্দা, যে প্রকৃত ঈমানদার, যে ঈমানের দাবি অনুযায়ী আমলও করে। ফাসেক ও পাপীর প্রশংসা বা নিন্দায় কিছু আসে যায় না। আজকাল তো একটা রেওয়াজ হয়ে গেছে যে, জানাযার লাশ সামনে রেখে মুখস্থ প্রশংসা করে দেওয়া হয়। প্রশংসাকারীর নিজেরই আমলের ঠিক নেই। তাই তার প্রশংসার কোনও বাছ-বিচারও নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশংসা হয় নিজ দল, মত ও নিজ দৃষ্টিভঙ্গির বিবেচনায়। অনেক ক্ষেত্রে কপট প্রশংসাও হয়ে থাকে। মনে থাকে এক, মুখে বলে আরেক। আল্লাহর কাছে এ জাতীয় প্রশংসার কোনও মূল্য নেই। মৃতব্যক্তি যদি সত্যিকারের ঈমানদার ও নেক আমলওয়ালা হয়ে থাকে আর প্রশংসাকারীও হয় প্রকৃত নেককার, সে ক্ষেত্রেই প্রশংসাবাক্য মৃতব্যক্তির শুভ পরিণামের আলামত বলে গণ্য হতে পারে। অন্যথায় নয়। আরও মনে রাখতে হবে, আলামত আলামতই। তা অকাট্য প্রমাণ নয়। অনেক সময় আলামত ভুলও প্রমাণিত হয়। আলামত দেখে একটা কিছু মনে হয়, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় তা সত্য নয়। কাজেই প্রশংসা যত ভালো মানুষেরই হোক না কেন, তার ভিত্তিতে কখনও মৃতব্যক্তি সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে এটা বলা যাবে না যে, সে একজন জান্নাতবাসী। অনুরূপ নিন্দাবাক্য দ্বারাও কারও সম্পর্কে এই ধারণা করা যাবে না যে, সে একজন জাহান্নামী। এটা সম্পূর্ণ গায়েবী বিষয়। গায়েবের জ্ঞান কেবল আল্লাহ তা'আলারই আছে। তাই কে জান্নাতবাসী আর কে জাহান্নামী, তার জ্ঞান আল্লাহ তা'আলার উপরই ন্যস্ত রাখতে হবে। আলোচ্য হাদীছে দেখা যাচ্ছে মৃতব্যক্তির প্রশংসা করলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেছে। পরোক্ষভাবে এর দ্বারা মায়্যিতের প্রশংসা করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। তাই মৃতব্যক্তি যদি অমুসলিম না হয় এবং সে প্রকাশ্য পাপীও না হয়, তবে তার সদগুণাবলির উল্লেখ করে প্রশংসা করা ভালো। আশা রাখা যায়, আল্লাহ তা'আলা সে প্রশংসা কবুল করবেন। ফলে মায়্যিতের প্রতি তাঁর পক্ষ থেকে বিশেষ রহমতের আচরণ হবে। উল্লেখ্য, কোনও কোনও হাদীছে মৃতব্যক্তির নিন্দা করতে নিষেধ করা হয়েছে। অপরদিকে আলোচ্য হাদীছটিতে দেখা যাচ্ছে সাহাবীগণ মৃতব্যক্তির নিন্দা করলে তিনি তাদেরকে তা করতে নিষেধ করলেন না। উল্টো বললেন, ওই ব্যক্তির জন্য জাহান্নাম অবধারিত হয়ে গেছে। বাহ্যত উভয় হাদীছের মধ্যে বিরোধ মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে কোনও বিরোধ নেই। কেননা নিন্দা করতে নিষেধ করা হয়েছে মুমিন নেককার মায়্যিতের। মায়্যিত যদি অমুসলিম হয় কিংবা মুসলিম হলেও ফাসেক বা প্রকাশ্য পাপাচারী হয়, তবে তার নিন্দা করতে নিষেধ নেই। হাদীছে যে পর্যায়ক্রমে চারজন, তিনজন ও দু'জন সম্পর্কে বলা হয়েছে তারা কোনও মায়্যিতের পক্ষে সাক্ষ্য দিলে আল্লাহ তা'আলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। এ সম্পর্কেও প্রথম কথা হল এ সাক্ষ্য তার জান্নাতবাসী হওয়ার একটা বাহ্যিক আলামত। প্রকৃতপক্ষে তার জান্নাতের ফয়সালা হবে তার আমলের ভিত্তিতে। দ্বিতীয় কথা হল চার, তিন ও দু'জন বলার দ্বারা সুনির্দিষ্ট সংখ্যা বোঝানো উদ্দেশ্য নয়। এর দ্বারা উদ্দেশ্য মূলত প্রশংসা করতে উৎসাহ দেওয়া। বোঝানো হচ্ছে, প্রশংসাকারীর সংখ্যা যত বেশি হয় ততোই ভালো। কিন্তু কমও যদি হয়, তাও মূল্যহীন নয়। তাই তোমরা সংখ্যায় যদি কমও হও, তবুও মায়্যিতের প্রশংসা করতে কার্পণ্য করো না। তার মানে এ নয় যে, অবাস্তব কথা বলে প্রশংসা করা হবে কিংবা প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করা হবে। বাস্তবে মায়্যিতের যে গুণ আছে, কেবল তারই উল্লেখপূর্বক প্রশংসা করতে হবে। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. আল্লাহ তা'আলা বড়ই দয়াময়। তিনি সাধারণ সাধারণ ছলে বান্দার প্রতি দয়া করে থাকেন। খ. আল্লাহ তা'আলার কাছে মুমিনদের অতি উচ্চমর্যাদা রয়েছে। তিনি পৃথিবীতে তাদেরকে নিজ সাক্ষী গণ্য করেন। কাজেই প্রত্যেক মুমিনকে সাক্ষ্যের এ মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। মিথ্যা বলার দ্বারা সে মর্যাদা নষ্ট হয়। গ. মুসলিম মায়্যিতের অহেতুক নিন্দা করতে নেই। ঘ. মৃতব্যক্তির প্রশংসা করা ভালো। তাই তার ভালো ভালো গুণের দিকে লক্ষ করে তার প্রশংসা করা চাই। লক্ষ রাখতে হবে যাতে বাড়াবাড়ি না হয়ে যায় বা অসত্য কথা না বলা হয়। ঙ. মৃতব্যক্তি অমুসলিম বা ফাসেক হলে তার নিন্দা করা নিষেধ নয়।


tahqiq

তাহকীক:

তাহকীক নিষ্প্রয়োজন

সহীহ বুখারী - হাদীস নং ১২৮৪ | মুসলিম বাংলা