আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ

৪১- চিকিৎসা অধ্যায়

হাদীস নং: ৫৫৮৭
আন্তর্জাতিক নং: ২২১৮-৮
৩১. প্লেগ, কুলক্ষণ ও জ্যোতিষীর গণনা ইত্যাদি
৫৫৮৭। মুহাম্মাদ ইবনে মুসান্না (রাহঃ) ......... হাবীব (রাহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা মদীনায় অবস্থান করছিলাম। তখন আমার কাছে খবর পৌছল যে, কুফায় প্লেগ দেখা দিয়েছে। তখন আতা ইবনে ইয়াসার (রাযিঃ) প্রমুখ আমাকে বললেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ তুমি যখন কোন এলাকায় থাকবে, সেখানে তা দেখা দিলে সেখান থেকে বের হয়ো না। আর যদি তোমার কাছে সংবাদ পৌছে যে, তা কোন এলাকায় রয়েছে, তা হলে সেখানে যেও না। রাবী বলেন, আমি বললাম, এ রিওয়ায়াত কার তরফ থেকে? তাঁরা বললেন, আমির ইবনে সা’দ (রাহঃ) থেকে তিনি তা বর্ণনা করে থাকেন। রাবী বলেন, তখন আমি তাঁর কাছে গেলাম। তারা বলল, তিনি বাড়িতে নেই। তখন আমি তার ভাই ইবরাহীম ইবনে সা’দ (রাহঃ) এর সাথে দেখা করে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, উসামা (রাযিঃ) যখন সা’দকে হাদীস শোনাচ্ছিলেন, তখন আমি হাযির ছিলাম।

তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে বলতে শুনেছি। এ ব্যাধি একটি মহামারী কিংবা একটি আযাব কিংবা আযাবের অবশিষ্টাংশ-- যা দিয়ে তোমাদের পূর্বেকার কতক লোককে শাস্তি দেয়া হয়েছিল। সুতরাং কোন এলাকায় তোমাদের অবস্থানকালে যদি তা দেখা দেয়, তখন সেখান থেকে তোমরা বের হয়ো না। আর যদি তোমাদের কাছে সংবাদ পৌছে যে, তা কোন এলাকায় রয়েছে, তাহলে সেখানে যেও না। হাবীব (রাহঃ) বলেন, তখন আমি ইবরাহীম (রাহঃ) কে বললাম, আপনি কি শুনেছেন যখন উসামা (রাযিঃ) সা’দ (রাযিঃ) এর কাছে হাদীস বর্ণনা করছিলেন, আর তিনি তাতে প্রতিবাদ করেননি? বললেন, হ্যাঁ।
باب الطَّاعُونِ وَالطِّيَرَةِ وَالْكَهَانَةِ وَنَحْوِهَا
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ الْمُثَنَّى، حَدَّثَنَا ابْنُ أَبِي عَدِيٍّ، عَنْ شُعْبَةَ، عَنْ حَبِيبٍ، قَالَ كُنَّا بِالْمَدِينَةِ فَبَلَغَنِي أَنَّ الطَّاعُونَ قَدْ وَقَعَ بِالْكُوفَةِ فَقَالَ لِي عَطَاءُ بْنُ يَسَارٍ وَغَيْرُهُ إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " إِذَا كُنْتَ بِأَرْضٍ فَوَقَعَ بِهَا فَلاَ تَخْرُجْ مِنْهَا وَإِذَا بَلَغَكَ أَنَّهُ بِأَرْضٍ فَلاَ تَدْخُلْهَا " . قَالَ قُلْتُ عَمَّنْ قَالُوا عَنْ عَامِرِ بْنِ سَعْدٍ يُحَدِّثُ بِهِ . قَالَ فَأَتَيْتُهُ فَقَالُوا غَائِبٌ - قَالَ - فَلَقِيتُ أَخَاهُ إِبْرَاهِيمَ بْنَ سَعْدٍ فَسَأَلْتُهُ فَقَالَ شَهِدْتُ أُسَامَةَ يُحَدِّثُ سَعْدًا قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ " إِنَّ هَذَا الْوَجَعَ رِجْزٌ أَوْ عَذَابٌ أَوْ بَقِيَّةُ عَذَابٍ عُذِّبَ بِهِ أُنَاسٌ مِنْ قَبْلِكُمْ فَإِذَا كَانَ بِأَرْضٍ وَأَنْتُمْ بِهَا فَلاَ تَخْرُجُوا مِنْهَا وَإِذَا بَلَغَكُمْ أَنَّهُ بِأَرْضٍ فَلاَ تَدْخُلُوهَا " . قَالَ حَبِيبٌ فَقُلْتُ لإِبْرَاهِيمَ آنْتَ سَمِعْتَ أُسَامَةَ يُحَدِّثُ سَعْدًا وَهُوَ لاَ يُنْكِرُ قَالَ نَعَمْ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

'তাউন' প্লেগরোগকেও বলে আবার অন্য যে-কোনও মহামারিকেও বলে, যেমন কলেরা, বসন্ত ইত্যাদি। এ হাদীছে তা'ঊন দ্বারা বিশেষভাবে প্লেগরোগও বোঝানো হতে পারে, আবার অন্যান্য যে-কোনও মহামারিও।
যে এলাকায় প্লেগের মতো কোন মহামারি দেখা দেয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘উলামায়ে কিরামের মতে মৃত্যুভয়ে সে এলাকা থেকে পালানো জায়েয নয় কেননা ঘটবে তো তাই, যা তাকদীরে আছে। তাকদীরে যা আছে তা থেকে বাঁচার সাধ্য কারও নেই। পালাতে গেলে তাকদীর থেকে বাঁচার ব্যর্থ চেষ্টা হবে মাত্র। এরকম চেষ্টা তাকদীরের প্রতি বিশ্বাসকে দুর্বল করে দেয়। তাই এটা জায়েয নয়। এরূপ পলায়ন জিহাদের ময়দান থেকে পলায়নতুল্য, যা নাজায়েয ও কঠিন গুনাহ। এক হাদীছে আছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

إذا سمعتم بالطاعون في أرض فلا تَدْخُلُوهَا، وَإِذا وقع بأرض و أنتم بها فلا تخرُجُوا مِنْهَا.

'যখন কোনও এলাকায় তা'ঊন দেখা দিয়েছে বলে জানতে পার, তখন সেখানে প্রবেশ করো না। আর তুমি যেখানে অবস্থান করছ, সেখানে তা'উন দেখা দিলে সেখান থেকে পলায়ন করো না।
মহামারি-কবলিত এলাকায় প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়েছে এ কারণে যে, এর ফলে তাকদীরে বিশ্বাস ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশংকা থাকে। মূলত ঘটবে তো তাই, যা তাকদীরে আছে। কিন্তু সেখানে প্রবেশ করার পর প্লেগে আক্রান্ত হলে তার মনে এই বিশ্বাস জন্মাতে পারে যে, এখানে প্রবেশ করার কারণেই সে প্লেগে আক্রান্ত হয়েছে। প্রবেশ না করলে আক্রান্ত হত না। এটা তাকদীরে বিশ্বাসের পরিপন্থী। এ কারণেই সতর্কতাস্বরূপ মহামারি-কবলিত এলাকায় প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। তাছাড়া তাকদীরে বিশ্বাসের সংগে সংগে বান্দাকে সতর্ক জীবনযাপনেরও হুকুম দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বান্দা বিশ্বাস তো রাখবে এই যে, তাকদীরে যা আছে কেবল তাই হবে, তবে দুনিয়া যেহেতু আসবাব-উপকরণের স্থান, তাই যেসকল আসবাব-উপকরণের সংগে নিরাপত্তার সম্পর্ক, তা অবলম্বন করবে আর যা-কিছু দ্বারা শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশংকা থাকে, তা থেকে দূরে থাকবে। এ প্রসঙ্গে হযরত ‘উমর ফারূক রাযি.- এর ফিলিস্তীন সফরের ঘটনা উল্লেখযোগ্য।

হিজরী ১৮ সালে হযরত উমর ফারূক রাযি. ফিলিস্তীন এলাকায় সফরের উদ্দেশ্যে বের হন। তিনি যখন 'সারগ' নামক স্থানে পৌঁছান, তখন ওই এলাকার মুসলিম সেনাপতিগণ তাঁর সংগে সাক্ষাত করেন এবং তাঁকে জানান যে, সমগ্র শাম এলাকায় মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে। তখন তিনি প্রথমদিকের মুহাজিরগণকে ডাকালেন এবং তাদের নিয়ে পরামর্শে বসলেন। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এখন আমাদের করণীয় কী? আমরা কি সামনে অগ্রসর হব, না মদীনায় ফিরে যাব? কেউ কেউ বললেন, আমরা যেহেতু একটা উদ্দেশ্যে বের হয়েছি, তখন আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত হবে না। আবার অনেকে বললেন, ইতোমধ্যে কত সাহাবী মারা গেছেন, আপনার সংগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবশিষ্ট সাহাবীগণ রয়েছেন। আমাদের মত, আপনি মদীনায় ফিরে যান। মহামারির ভেতর ঢুকবেন না। এভাবে মতভেদ দেখা দিলে তিনি আনসারগণকে ডাকালেন। তাদের মধ্যেও মুহাজিরদের মত মতভিন্নতা দেখা দিল। শেষে তিনি প্রবীণ কুরায়শ মুহাজিরগণকে ডাকলেন। তারা সবাই একমত হয়ে বললেন, আপনি মহামারি-কবলিত এলাকার দিকে অগ্রসর হবেন না। আপনি লোকজন নিয়ে মদীনায় ফিরে যান। তখন হযরত 'উমর ফারুক রাখি ঘোষণা দিলেন, ঠিক আছে আমি মদীনায় ফিরে যাচ্ছি। এ কথা শুনে ফিলিস্তীন এলাকার প্রধান সেনাপতি বিখ্যাত সাহাবী 'উবাইদা ইবনুল জাররাহ রাযি. বললেন, তাকদীর থেকে পলায়ন? হযরত ফারূক রাযি. বললেন, আহা আবূ উবাইদা, এ কথা যদি আপনি ছাড়া অন্য কেউ হযরত আবূ বলত! আমরা তাকদীর থেকে তাকদীরের দিকেই ফিরে যাচ্ছি। আচ্ছা আপনি বলুন তো, একটি উপত্যকার দুই প্রান্ত আছে, যার একপ্রান্ত খরাকবলিত, অন্য প্রান্ত সবুজ- শ্যামল। আপনি আপনার উটগুলোকে কোন প্রান্তে চড়াবেন? যদি খরাকবলিত প্রান্তে চড়ান, তা যেমন তাকদীর অনুযায়ী হবে, তেমনি সবুজ-শ্যামল প্রান্তে চড়ালেও কি তা তাকদীর অনুযায়ী হবে না? ঠিক এ সময় সুবিখ্যাত ও বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুর রহমান ইবন 'আওফ রাযি. এসে উপস্থিত হলেন। সব শুনে তিনি বললেন, এ বিষয়ে আমার কিছু জানা আছে। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তোমরা যখন কোনও এলাকায় মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে বলে খবর পাও, তখন সেই এলাকায় গমন করো না। আর তোমরা যেখানে অবস্থান করছ, সেখানে মহামারি দেখা দিলে পালানোর উদ্দেশ্যে সেখান থেকে বের হয়ে যেও না। এ হাদীছ শুনে হযরত উমর ফারূক রাযি. আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করলেন, তারপর মদীনার উদ্দেশ্যে ফিরে চললেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

এ হাদীছ দ্বারা এ শিক্ষাও পাওয়া গেল যে, রোগ-ব্যাধি ও বালা-মসিবতকে অকল্যাণ মনে করা উচিত নয়। এর মধ্যেও বান্দার পক্ষে বিশেষ বিশেষ কল্যাণ নিহিত থাকে। সবর অবলম্বন করলে সে কল্যাণ লাভ করা যায়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)