আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
১৯- জানাযার অধ্যায়
১২২৬। আসবাগ (রাহঃ) ......... আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সা’দ ইবনে উবাদাহ (রাযিঃ) রোগাক্রান্ত হলেন। নবী (ﷺ), আব্দুর রহমান ইবনে আওফ, সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস এবং আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) কে সাথে নিয়ে তাকে দেখতে আসলেন। তিনি তাঁর ঘরে প্রবেশ করে তাকে পরিজন-বেষ্টিত দেখতে পেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, তার কি মৃত্যু হয়েছে? তাঁরা বললেন, না ইয়া রাসূলাল্লাহ! তখন নবী (ﷺ) কেঁদে ফেললেন। নবী (ﷺ) এর কান্না দেখে উপস্থিত লোকেরা কাঁদতে লাগলেন। তখন তিনি ইরশাদ করলেনঃ শুনে রাখ! নিঃসন্দেহে আল্লাহ পাক চোখের পানি ও অন্তরের শোক-ব্যথার কারণে আযাব দিবেন না। তিনি আযাব দিবেন এর কারণে, (এ বলে) জিহবার দিকে ইশারা করলেন। অথবা এর কারণেই তিনি রহম করে থাকেন। আর নিশ্চয় মৃত ব্যক্তির জন্য তার পরিজনের বিলাপের কারণে তাকে আযাব দেওয়া হয়।
উমর (রাযিঃ) এ (ধরণের কান্নার) কারণে লাঠি দ্বারা প্রহার করতেন, কংকর নিক্ষেপ করতেন এবং মাটি ছুড়ে মারতেন।
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
হযরত সা'দ ইবন উবাদা রাযি. একজন বিখ্যাত সাহাবী। তিনি আনসারদের খাযরাজ গোত্রের নেতা ছিলেন। তিনি আকাবার বায়'আতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি অনেক বড় দানবীর ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে খুব ভালোবাসতেন এবং বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তিনি একবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। খবর পেয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কয়েকজন সাহাবীকে নিয়ে তাঁকে দেখতে যান, যেমনটা এ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গিয়ে দেখেন তিনি একদম শয্যাশায়ী। অচেতন অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। মনে হচ্ছিল তাঁর মৃত্যুই হয়ে গিয়েছে। তিনি পরিবারের লোকদের জিজ্ঞেস করলেন তাঁর কি মৃত্যু হয়ে গেছে, যেমনটা অন্যান্য বর্ণনায় আছে? তারা উত্তর দিল, না ইয়া রাসূলাল্লাহ! হযরত সা'দ রাযি. মারা যাননি বটে, কিন্তু রোগের তীব্রতায় তিনি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর অবস্থা দেখে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুবই কষ্ট লাগল। তাঁর চোখ থেকে পানি বইতে শুরু করল। তাঁকে কাঁদতে দেখে কাঁদতে শুরু করলেন উপস্থিত সকলেও। তখন তিনি বললেন- أَلَا تَسمعون؟ (তোমরা কি শুনছ না)? এই বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইর ওয়াসাল্লাম উপস্থিত লোকদের সচেতন করলেন এবং তিনি তাদের দৃষ্টি আকর্ষন করলেন, যাতে তিনি যে কথা বলবেন তারা তা মনোযোগ দিয়ে শোনে। অসম্ভব নয় কারও মুখ দিয়ে হয়তো অনুচিত কোনও কথা বের হয়ে গিয়েছিল। তিনি তার সংশোধন জরুরি মনে করলেন। তাই তিনি বললেন- إِنَّ اللهَ لا يُعَذِّبُ بِدَمْعِ الْعَيْنِ، وَلَا بِحُزْنِ الْقَلْبِ (আল্লাহ চোখের অশ্রুর কারণে শাস্তি দেন না, মনের বেদনার কারণেও নয়)। কেননা অন্যের বেদনায় ব্যথিত হওয়া বা কারও মৃত্যুতে শোকার্ত হয়ে পড়া মানুষের স্বভাবগত বিষয়। শোক ও বেদনা একটু বেশি হলে স্বভাবগতভাবেই মানুষের কান্না এসে যায়। সে কান্না মানুষের ইচ্ছাবহির্ভূত। দুঃখ-বেদনাকালে কেউ যতই চেষ্টা করুক না কেন, চোখের পানি সে আটকাতে পারবে না। এটা যখন ইচ্ছাবহির্ভূত, তখন এটা শরী'আতের আদেশ-নিষেধেরও বাইরে। ইচ্ছাবহির্ভূত বিষয়ে শরী'আত আদেশ বা নিষেধ করে না। তাই এ কান্না এবং এ অশ্রু ঝরানো নিষিদ্ধ নয় যে, নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করার কারণে শাস্তি দেওয়া হবে। কিন্তু কোনও কোনও হাদীছে তো কান্নার কারণে শাস্তি দেওয়া হয় বলে জানানো হয়েছে। তার উত্তর পাওয়া যায় এ হাদীছটির পরবর্তী অংশে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- وَلَكِنْ يُعَذِّبُ بِهذَا أَوْ يَرْحَمُ، وَأَشَارَ إِلَى لِسَانِهِ (বরং তিনি এটার কারণে শাস্তি দেন অথবা দয়া করেন। তিনি ইশারা করলেন নিজ জিহ্বার দিকে)। অর্থাৎ মানুষের মুখ দিয়ে যা বের হয় তা গুরুত্বপূর্ণ। কথা বলাটা মানুষের ইচ্ছাধীন। কেউ চাইলে কথা বলতেও পারে, নাও বলতে পারে। তা যেমন সুখের বেলায়, তেমনি শোকতাপের বেলায়ও। যখন যে অবস্থায় মানুষ যাই বলে, সঙ্গে সঙ্গে তা লেখা হয়ে যায়। ইরশাদ হয়েছে- مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ 'মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তার জন্য একজন প্রহরী নিযুক্ত আছে, যে (লেখার জন্য) সদা প্রস্তুত’। (সূরা কাফ, আয়াত ১৮) সব কথাই যখন লেখা হয়, তখন আখিরাতে তার হিসাবও নেওয়া হবে। কথা ভালো হলে পুরস্কার দেওয়া হবে আর মন্দ হলে দেওয়া হবে শাস্তি। সুতরাং কথা বলতে খুব সাবধান থাকতে হবে। শোক ও দুঃখের বেলায় সতর্ক থাকতে হবে যাতে অনুচিত কোনও কথা মুখ দিয়ে বের না হয়ে যায়। কেননা মনের দুঃখ ও চোখের পানি তো মাফ, মুখের অনুচিত কথা মাফ হবে না। সেজন্য শাস্তি দেওয়া হবে। সে শাস্তি যে ব্যক্তি অনুচিত কথা বলবে কেবল তাকেই যে ভোগ করতে হবে এমন নয়; বরং ক্ষেত্রবিশেষে যার জন্য কাঁদে তাকেও ভোগ করতে হতে পারে। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে- الْمَيِّتَ يُعَذَّبُ بِبُكَاءِ أَهْلِهِ عَلَيْهِ 'মায়্যিতকে তার প্রতি তার পরিবারের কান্নার কারণে শাস্তি দেওয়া হয়’। (সহীহ মুসলিম: ৯২৭; জামে তিরমিযী: ১০০২; সুনানে নাসাঈ ১৮৪৮; মুসনাদুল বাযযার: ১০৪; মুসনাদে আবূ দাঊদ তয়ালিসী: ৩৩; মুসনাদে আবু ইয়া'লা : ১৫৫; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৩১৩৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১৩২৬২) এর উপর প্রশ্ন হতে পারে যে, কুরআন মাজীদে তো ইরশাদ হয়েছে- ولَا تَزِرُ وَازرَةٌ وِزْرَ أُخرى (এবং কোনও ভার-বহনকারী অন্য কারও ভার বহন করবে না) (সূরা আন'আম, আয়াত ১৬৪) অর্থাৎ - একজনের অপরাধের কারণে আরেকজনকে দায়ী করা হবে না, যদি দায়ী করা নাই হয়, তবে শাস্তি কেন দেওয়া হবে? ক্রন্দন করেছে পরিবার, সেজন্য মায়্যিত কেন শাস্তি পাবে? এর উত্তর হল, মায়্যিত শাস্তি পাবে তখনই, যখন সে পরিবারের কান্নার কারণ হয়। এখানে দু'টি কথা। এক হল কান্নামাত্রই শাস্তির কারণ নয়। শাস্তির কারণ ওই কান্না, যার সঙ্গে অনুচিত কথা যুক্ত থাকে। দ্বিতীয় কথা হল, পরিবারের অনুচিত কথাযুক্ত কান্নার কারণে মায়্যিত শাস্তি পাবে কেবল তখনই, যখন তাতে মায়্যিতের কোনও ভূমিকা থাকে। যেমন সে নিজেও হয়তো জীবদ্দশায় অন্যের মৃত্যুতে এমন করত অথবা সে হয়তো জীবিতকালে পরিবারবর্গকে এরকম শরী'আতবিরোধী কান্নায় অসিয়ত করে গেছে কিংবা হয়তো সে জানত তার মৃত্যুর পর তার পরিবার এরকম বেসামালভাবে কান্নাকাটি করবে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে তাদেরকে তা না করার জন্য অসিয়ত করে যায়নি। এ সকল ক্ষেত্রেই পরিবারের সীমালঙ্ঘনে মায়্যিতের কিছু না কিছু ভূমিকা থাকে। সে কারণেই তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। উল্লেখ্য, স্বাভাবিক কান্না তো দোষের নয়: বরং তা প্রশংসনীয় এবং তা মনের কোমলতা ও মায়া-মমতার প্রকাশ। কিন্তু কান্নায় সীমালঙ্ঘন করা অবশ্যই দূষণীয়। কেননা তা থেকে বাঁচা মানুষের পক্ষে সম্ভব। তা মানুষের এখতিয়ারাধীন। এখতিয়ারাধীন হওয়ায় তা থেকে অবশ্যই বাঁচতে হবে। এরূপ কান্না দুই রকম। (ক) বিলাপ করে কান্না এবং (খ) মৃতব্যক্তির এক একটা গুণ বলা আর চিৎকার করে কাঁদতে থাকা। বিলাপ করে কাঁদার অর্থ সুর দিয়ে কাঁদা। ছন্দযুক্ত কথা বলে বলে কাঁদা। এরূপ কান্না সম্পূর্ণ নিষেধ। এরূপ কান্নায় মায়্যিতের সায় থাকলে তাকেও শাস্তি পেতে হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- الْمَيِّتُ يُعَذِّبُ فِي قَبْرِهِ بِمَا نِيْحَ عَلَيْهِ 'মৃতব্যক্তিকে কবরে আযাব দেওয়া হয় তার প্রতি বিলাপ করে কাঁদার কারণে।’ (সহীহ বুখারী: ১২৯১; সহীহ মুসলিম: ৯২৭; জামে' তিরমিযী: ১০০০; মুসনাদে আহমাদ: ৩৬৬; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১২০৯৯; মুসনাদুল বাযযার: ৪৫৭৯; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১৩০৮৭; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৭১৬৪; শু'আবুল ঈমান: ৪৪৮৭) এমনিভাবে মৃতব্যক্তির গুনাবলি উল্লেখপূর্বক চিৎকার করতে থাকলে সেজন্যও মায়্যিতকে দায়ী করা হয়। হযরত নু'মান ইবন বাশীর রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবন রাওয়াহা রাযি. একবার বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন। তাতে তাঁর বোন কাঁদছিল আর বলছিল, হায়রে আমার পাহাড়, হায়রে অমুক। এমনিভাবে তাঁকে বিভিন্ন বিশেষণে বিশেষিত করে কান্নাকাটি করছিল। তারপর হযরত আব্দুল্লাহ ইবন রাওয়াহা রাযি. চেতনা ফিরে পান। তখন তিনি তাঁর বোনকে বললেন, তুমি আমাকে যাই বলেছ তাতেই আমাকে (তিরস্কার করে) বলা হয়েছে- তুমি এমন, তুমি এমন? এতে তাঁর বোন সতর্ক হয়ে যান। পরে ভাইয়ের মৃত্যু হলে তিনি আর কাঁদেননি। (সহীহ বুখারী: ৪২৬৭; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৪৩৫২; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩৪৭২৬; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৭১২২; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৫৩৮) সারকথা, কান্নায় কোনও দোষ নেই। সীমালঙ্ঘন করাই দোষের। সুতরাং কাঁদতে হবে যথাসম্ভব সংযত আওয়াজে। চিৎকার করে কাঁদা, সুর করে কাঁদা কিংবা কান্নার ভেতর মায়্যিতের গুণগাঁথা বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. কারও অসুস্থতার সংবাদ পেলে তাকে দেখতে যাওয়া উচিত। খ. অসুস্থ ব্যক্তি মর্যাদায় নিজের তুলনায় নিচের হলে অবজ্ঞা করতে নেই। তাকেও দেখতে যাওয়া চাই। গ. শোকে-দুঃখে স্বাভাবিক কান্না দূষণীয় নয়। ইসলাম মানুষের স্বভাবগত আবেগ-অনুভূতির মর্যাদা দেয়। তাই এরূপ কান্নায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। বরং এরূপ কান্না নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনেও অনেক দেখতে পাওয়া যায়। ঘ. শোকে-দুঃখে খুব সতর্ক থাকতে হবে যাতে কান্নার আওয়াজে বা কথাবার্তায় সীমালঙ্ঘন না হয়ে যায়। ঙ. কেউ সীমালঙ্ঘন করলে তাকে বোঝানো ও সতর্ক করা উচিত।

তাহকীক:
তাহকীক নিষ্প্রয়োজন