আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ

৩৭- পানাহার ও পানীয় দ্রব্যাদীর বিবরণ

হাদীস নং: ৫০৪৬
আন্তর্জাতিক নং: ১৭৩৩-৭
৭. নেশা সৃষ্টিকারী সকল বস্তুই মদ; আর সর্বপ্রকার মদই হারাম
৫০৪৬। ইসহাক ইবনে ইবরাহীম ও মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ ইবনে আবু খালাফ (রাহঃ) ......... আবু বুরদা তাঁর পিতা (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে ও মু’আয (রাযিঃ) কে ইয়ামানে পাঠালেন এবং বললেনঃ তোমরা মানুষকে (দ্বীনের) দাওয়াত দেবে, সুসংবাদ দেবে, কাউকে বিতৃষ্ণ করে দেবে না। সহজ করবে, কঠিন করবে না। তিনি বলেন, অতঃপর আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! ইয়ামানে আমরা দুধরনের শরাব প্রস্তুত করি, আপনি সে সম্বন্ধে আমাদেরকে অবহিত করুন। এক, “আল-বিত” যা মধু পাকিয়ে গাঢ় করে তৈরী করা হয়; দুই, “আল-মিরয” যা ভুট্রা ও যব পাকিয়ে গাঢ় করে প্রস্তুত করা হয়। বর্ণনাকারী বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে অল্প শব্দ অথচ ব্যাপক অর্থবোধক ও পরিপূর্ণতার সাথে প্রকাশ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেনঃ আমি প্রত্যেক নেশা সৃষ্টিকারী বস্তু যা নামায থেকে বিমুখ করে, তাই হারাম করছি।
باب بَيَانِ أَنَّ كُلَّ مُسْكِرٍ خَمْرٌ وَأَنَّ كُلَّ خَمْرٍ حَرَامٌ
وَحَدَّثَنَا إِسْحَاقُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، وَمُحَمَّدُ بْنُ أَحْمَدَ بْنِ أَبِي خَلَفٍ، - وَاللَّفْظُ لاِبْنِ أَبِي خَلَفٍ - قَالاَ حَدَّثَنَا زَكَرِيَّاءُ بْنُ عَدِيٍّ، حَدَّثَنَا عُبَيْدُ اللَّهِ، - وَهُوَ ابْنُ عَمْرٍو - عَنْ زَيْدِ بْنِ، أَبِي أُنَيْسَةَ عَنْ سَعِيدِ بْنِ أَبِي بُرْدَةَ، حَدَّثَنَا أَبُو بُرْدَةَ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ بَعَثَنِي رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَمُعَاذًا إِلَى الْيَمَنِ فَقَالَ " ادْعُوَا النَّاسَ وَبَشِّرَا وَلاَ تُنَفِّرَا وَيَسِّرَا وَلاَ تُعَسِّرَا " . قَالَ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفْتِنَا فِي شَرَابَيْنِ كُنَّا نَصْنَعُهُمَا بِالْيَمَنِ الْبِتْعُ وَهُوَ مِنَ الْعَسَلِ يُنْبَذُ حَتَّى يَشْتَدَّ وَالْمِزْرُ وَهُوَ مِنَ الذُّرَةِ وَالشَّعِيرِ يُنْبَذُ حَتَّى يَشْتَدَّ قَالَ وَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَدْ أُعْطِيَ جَوَامِعَ الْكَلِمِ بِخَوَاتِمِهِ فَقَالَ " أَنْهَى عَنْ كُلِّ مُسْكِرٍ أَسْكَرَ عَنِ الصَّلاَةِ " .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু'টি বিষয়ে আদেশ করেছেন এবং দু'টি বিষয়ে নিষেধ করেছেন। সর্বপ্রথম আদেশ করেছেন- (তোমরা সহজতা প্রদর্শন করো)। অর্থাৎ সহজ ও সহনীয় আচরণ করো নিজের প্রতিও এবং অন্যের প্রতিও। আল্লাহ তা'আলা সহজ দীন দিয়েছেন। দীনের কোনও বিধানই পালন করা মানুষের পক্ষে সাধ্যের অতীত নয়। ইরশাদ হয়েছে-
وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ
তিনি দীনের ব্যাপারে তোমাদের প্রতি কোনও সংকীর্ণতা আরোপ করেননি। (সূরা হজ্জ (২২), আয়াত ৭৮)

এ কারণেই সফরে নামায কসর করার বিধান দেওয়া হয়েছে। সফর অবস্থায় রোযা না রেখে পরে রাখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কোনও কারণে দাঁড়িয়ে নামায পড়তে না পারলে বসে পড়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। ওযু করতে না পারলে তায়াম্মুম করার বিধান দেওয়া হয়েছে ইত্যাদি। কাজেই প্রত্যেকের কর্তব্য দীনের দেওয়া এ সহজতা অবলম্বন করা। শুধু শুধু নিজের প্রতি বা অন্যের প্রতি কঠোরতা আরোপ করা কিছুতেই উচিত নয়। যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে নামায পড়তে না পারে, সে বসেই পড়বে। হাজার কষ্ট হলেও দাঁড়িয়ে পড়তে হবে, এমন কোনও কথা নেই; বরং তা বাঞ্ছনীয়ও নয়। এমনিভাবে অন্যের প্রতি আচরণও সহজ হওয়া কাম্য। শিক্ষকের কর্তব্য ছাত্রকে শিক্ষাদান করা সহজ পন্থায়। শিক্ষাদান পদ্ধতিও যেমন সহজ হওয়া চাই, তেমনি শিক্ষাদানের সময়টাও হওয়া চাই সহনীয় মাত্রায়। দলনেতা ও আমীরেরও কর্তব্য অধীনস্থদের পরিচালনায় কঠোরতা পরিহার করে সহজ কর্মপন্থা অবলম্বন করা। এটা শিক্ষা গ্রহণ করা, শিক্ষ অনুযায়ী আমল করা, আদেশ পালন করা এবং আনুগত্য বজায় রাখার পক্ষে অনেক বেশি সহায়ক।

সহজতা অবলম্বনের আদেশদানের পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করছেন- (কঠোরতা প্রদর্শন করো না)। এ নিষেধাজ্ঞাটি আগের আদেশ দ্বারা এমনিই বোঝা যায়। কেননা যে-কোনও বিষয়ের আদেশ করা হলে তার বিপরীত বিষয়টি আপনা-আপনিই নিষিদ্ধ হয়ে যায়। সুতরাং যখন সহজতা অবলম্বনের আদেশ করা হয়েছে, তখন কঠোরতা অবলম্বন যে নিষিদ্ধ তা বলার প্রয়োজন পড়ে না। তা সত্ত্বেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ নিষেধাজ্ঞা স্বতন্ত্রভাবেও ব্যক্ত করে দিয়েছেন। এর দ্বারা উদ্দেশ্য সহজতা অবলম্বনের আদেশকে জোরদার করা এবং কোনও অবস্থায়ই যেন কঠোরতা অবলম্বন না করা হয়, সে বিষয়ে বাড়তি সতর্কতা আরোপ করা। এর দ্বারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সহজ পন্থা অবলম্বন করা, তা নিজের প্রতি হোক বা অন্যের প্রতি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

তৃতীয় পর্যায়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ করেছেন- (সুসংবাদ শোনাও)। অর্থাৎ মানুষকে আল্লাহ তা'আলার দয়া ও অনুগ্রহের কথা শোনাও। তাদেরকে তাঁর মহাপ্রতিদান ও অকল্পনীয় পুরস্কারের সুসংবাদ দাও। তাদেরকে জানাও তিনি কত বড় ক্ষমাশীল এবং তাঁর মাগফিরাত ও দয়া-অনুগ্রহ কত ব্যাপক। এসব শোনালে মানুষ মনে আনন্দ পাবে। তারা আমলে উৎসাহী হবে। দাওয়াত ও ওয়াজ- নসীহতের মূল উদ্দেশ্যই মানুষকে নেক আমলের প্রতি উৎসাহিত করা। সুসংবাদ শোনানো এ উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক হয়ে থাকে।

চতুর্থ পর্যায়ে তিনি নিষেধ করেন যে- (অনাগ্রহ সৃষ্টি করো না)। অর্থাৎ এমনকিছু বলো না, যা দ্বারা মানুষ নেক আমলের প্রতি আগ্রহ হারায়। যেমন দীনের কোনও বিধানকে কঠিনরূপে তুলে ধরা, মানুষের মনে হতাশা সৃষ্টি করা, রহমত ও মাগফিরাতের উল্লেখ ব্যতিরেকে কেবল গজব ও শাস্তির কথা বর্ণনা করতে থাকা।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. প্রত্যেকের উচিত ইবাদত-বন্দেগীসহ যাবতীয় কাজকর্মে কঠোর-কঠিন পন্থা বাদ দিয়ে সহজ পন্থা ও সহজ মাত্রা অবলম্বন করা।

খ. অভিভাবক, শিক্ষক ও নেতৃবর্গের তাদের সংশ্লিষ্টজনদের প্রতি সর্বদা সহজ ও কোমল আচরণ করা উচিত। কিছুতেই কঠোরতা প্রদর্শন করা উচিত নয়।

গ. শিক্ষাগ্রহণ ও আমলে প্রস্তুত করার পক্ষে সুসংবাদ শোনানো ও উৎসাহদান অনেক বেশি সহায়ক হয়ে থাকে। তাই শিক্ষক ও উপদেশদাতাদের এ পন্থাই অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়।

ঘ. কারও আপন কর্মপন্থা দ্বারা অন্যকে নেক আমলের প্রতি নিরুৎসাহিত করে তোলা উচিত নয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)