আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
১৯- জানাযার অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ১২৭৪
৮০৮. মৃত ব্যক্তির সমস্ত সম্পদ থেকে কাফন দেওয়া। আতা, যুহরী, আমর ইবনে দীনার এবং কাতাদা (রাহঃ) একথা বলেছেন।
আমর ইবনে দীনার (রাহঃ) আরও বলেছেন, সুগন্ধিও সমস্ত সম্পদ থেকে দিতে হবে।
ইবরাহীম (রাহঃ) বলেছেন, (সম্পদ থেকে) প্রথমে কাফন, তারপর ঋণ পরিশোধ, তারপর অসিয়ত পূরণ করতে হবে। সুফিয়ান (রাহঃ) বলেছেন, কবর ও গোসল দেওয়ার খরচও কাফনের অন্তর্ভুক্ত।
আমর ইবনে দীনার (রাহঃ) আরও বলেছেন, সুগন্ধিও সমস্ত সম্পদ থেকে দিতে হবে।
ইবরাহীম (রাহঃ) বলেছেন, (সম্পদ থেকে) প্রথমে কাফন, তারপর ঋণ পরিশোধ, তারপর অসিয়ত পূরণ করতে হবে। সুফিয়ান (রাহঃ) বলেছেন, কবর ও গোসল দেওয়ার খরচও কাফনের অন্তর্ভুক্ত।
১২০০। আহমদ ইবনে মুহাম্মাদ মক্কী (রাহঃ) ......... সা’দ (রাহঃ) এর পিতা ইবরাহীম ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রাহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রাযিঃ) কে খাবার দেওয়া হল। তখন তিনি বললেন, মুসআব ইবনে উমাইর (রাযিঃ) শহীদ হন আর তিনি আমার চাইতে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। অথচ তাঁর কাফনের জন্যও একখানি চাঁদর ছাড়া কিছুই পাওয়া যায়নি। তাই আমার আশঙ্কা হয়, আমাদের নেক আমলের বিনিময় আমাদের এ পার্থিব জীবনে আগেই দেয়া হল। তারপর তিনি কাঁদতে লাগলেন।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
হাদীছটি দ্বারা আমরা জানতে পারি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবায়ে কেরাম কী কঠিন অভাব-অনটনের ভেতর জীবনযাপন করেছেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরও তারা দুনিয়ার প্রতি কতটা নির্মোহ ছিলেন। হযরত মুসআব ইবনে উমায়র রাযি ছিলেন ধনীর সন্তান। মক্কায় আরাম-আয়েশের জীবনযাপন করতেন। ইসলামগ্রহণের পর সবরকম বিলাসিতা পরিত্যাগ করে কষ্ট. ক্লেশের জীবন বেছে নেন। তিনি উহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন মাত্র একটি চাদর পরিহিত অবস্থায়। আর তা-ও এত ছোট ছিল যে, সে চাদরটি দিয়ে যখন তার কাফন পরানো হচ্ছিল, তখন সেটি দিয়ে তাঁর গোটা শরীর ঢাকা যাচ্ছিল না।
হযরত আব্দুর রহমান ইবন আওফ রাযি. ধনী ছিলেন বটে, তাই বলে বিলাসিতাপূর্ণ জীবনযাপন করেননি। তিনি তাঁর ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে খরচ করতেই ভালোবাসতেন। তারপরও যে প্রাচুর্য তাঁর হাতে এসে গিয়েছিল, সেজন্য আমোদিত না হয়ে বরং না জানি তাঁর সৎকর্মের বদলা ইহজীবনেই দিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেই ভয়ে ভীত থেকেছেন।
মৃত্যুর আগে অসুস্থতাকালে একদিন তিনি রোযাদার ছিলেন। অসুস্থ শরীরে রোখা রাখতে কষ্ট হচ্ছে দেখে পরিবারের লোকজন তাঁর সামনে খাবার পেশ করে। এ অবস্থায় তাঁর হযরত মুস'আব ইবনে উমায়র রাযি.-এর কষ্ট-ক্লেশপূর্ণ জীবনের কথা মনে পড়ে যায়। সেই স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তাঁর বর্তমান আর্থিক সচ্ছলতা তাঁর জন্য পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে। তাঁর দৃষ্টিতে হযরত মুস'আব ইবন উমায়র রাযি. তারচে' উত্তম ছিলেন। তিনি মন্তব্য করেন, তিনি আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। অথচ হযরত আব্দুর রহমান ইবন আওফ রাযি. আশারায়ে মুবাশশারার একজন। অর্থাৎ একইসঙ্গে যে দশজন সাহাবীকে জান্নাতবাসী হওয়ার সুসংবাদ দেওয়া হয়েছিল, হযরত আব্দুর রহমান ইবন আওফ রাযি.-ও তাদের একজন। সাধারণভাবেই এ দশজন সাহাবীকে অন্যদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ গণ্য করা হয়। তা সত্ত্বেও হযরত মুসআব রাযি.-কে শ্রেষ্ঠ বলাটা সম্ভবত তাঁর বিনয়ের প্রকাশ। এরকম বিনয় ছিল সাহাবায়ে কেরামের চরিত্রের বিশেষত্ব।
একবার হযরত সা'দ ইবনুর রাবী রাযি.-এর একটি ছোট মেয়ে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-এর পাশে বসা ছিল। এ অবস্থায় এক ব্যক্তি সেখানে এসে উপস্থিত হল। লোকটি জিজ্ঞেস করল, এই মেয়েটি কে? হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. বললেন, এ মেয়েটি আমার চেয়ে উৎকৃষ্ট এক ব্যক্তির কন্যা। তিনি সা'দ ইবনুর রবী', যিনি আকাবার বায়'আতের একজন প্রতিনিধি ছিলেন, বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তারপর উহুদের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেছেন। এমনও হতে পারে, যেসকল সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গী হয়ে জিহাদ করেছেন এবং তাতে শাহাদাত বরণ করেছেন, তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে তাদের জানাযা পড়েছেন, অন্যদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করতেন।
প্রকাশ থাকে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর সাহাবায়ে কেরামের যে আর্থিক সচ্ছলতা লাভ হয়েছিল, তা লাভ হয়েছিল সাধারণ পথে। তাদের হাতে রোম ও পারস্য-শক্তি পর্যুদস্ত হয়েছিল। সমগ্র পারস্য, রোম সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চল এবং মিশর ও আফ্রিকার বিস্তীর্ণ এলাকা মুসলিম মুজাহিদদের হস্তগত হয়েছিল। তাদের যাবতীয় অর্থ-সম্পদ মূলত এ সুবাদেই অর্জিত হয়েছিল।
বলাবাহুল্য, জিহাদ এক পবিত্র ইবাদত। এ ইবাদত আদায়ের সুবাদে পার্থিব যা-কিছু অর্জিত হয়ে যায়, তাও পবিত্রই বটে। কিন্তু যে মহান সাহাবীদেরকে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত ও আখিরাতমুখী আল্লাহপ্রেমিকরূপে গড়ে তুলেছিলেন, পার্থিব প্রাচুর্য কখনওই তাদেরকে মোহমুগ্ধ করতে পারেনি। বরং প্রাচুর্যের কারণে তাদের অন্তরে এই ভয় দেখা দিয়েছে যে, না জানি এর কারণে আখিরাতের পুরস্কার থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়। তিনি বলেন- (আমাদের ভয় হয়, না জানি আমাদের নেক কাজসমূহের বদলা নগদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে)। অর্থাৎ নেক কাজসমূহের বদলা দুনিয়ায় দিয়ে দেওয়া হলে আখিরাতে তো আমাদের জন্য কিছুই থাকবে না। বস্তুত এটা ছিল তাঁর আল্লাহভীতির তীব্রতার বহিঃপ্রকাশ। তিনি ভেবেছিলেন, যে আর্থিক প্রাচুর্য তার হাতে এসে গেছে, বুঝি বা তা তাঁর কৃত সৎকর্মসমূহের প্রতিদান। প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি তা নয়। মূলত সে আর্থিক সচ্ছলতাও তো তাঁর বহু সৎকর্মের উৎস ছিল। তিনি তাঁর সচ্ছলতা দ্বারা পরকালীন লাভজনক ব্যবসায় লিপ্ত হতে পেরেছিলেন। তিনি আল্লাহর পথে দান করতেন প্রচুর। তিনি তাঁর সম্পদ দ্বারা আল্লাহর বান্দাদের সেবা করতেন।
যারা প্রকৃত আল্লাহভীরু হয়ে থাকে, তাদের নজর নিজেদের সৎকর্মের দিকে বিশেষ থাকে না। বরং তারা তাদের সৎকর্মের ভেতরও ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখতে পান এবং সে কারণে নিজেদের সৎকর্ম নিয়েও ভীত থাকেন। সেইসঙ্গে আল্লাহ তা'আলার নিকট থেকে যেসব নি'আমত লাভ করেন, সে ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম পালনে গাফলাতি ও আল্লাহর শোকর আদায়ে অবহেলা নিয়েও চিন্তিত থাকেন। তারা আরও ভাবেন, আমি তো এসব নি'আমতের উপযুক্ত নই। তা সত্ত্বেও যে আমাকে এসব দেওয়া হচ্ছে এতে আমার টুটাফাটা আমলের নগদ বদলা নয় তো? তাই তো হযরত উমর ফারুক রাযি. এর মত ব্যক্তিকেও দেখি যখনই সামনে ভালো খাবার আসত, এই ভেবে কান্না শুরু করে দিতেন যে, না জানি এটা নেককাজের নগদ দিয়ে দেওয়া বদলা। কুরআন মাজীদের একটি আয়াত তাকে এরকম ভয়ে ভীত করে তুলত। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
و يَوْمَ يُعْرَضُ الَّذِيْنَ كَفَرُوا عَلَى النَّارِ أَذْهَبْتُمْ.....
এবং সেই দিনকে স্মরণ রেখ, যেদিন কাফেরদেরকে আগুনের সামনে পেশ করা হবে (এবং বলা হবে,) তোমরা নিজেদের অংশের উৎকৃষ্ট জিনিসসমূহ পার্থিব জীবনে (ভোগ করে) নিঃশেষ করে ফেলেছ এবং তা বেজায় ভোগ করেছ। সুতরাং আজ বিনিময়রূপে তোমরা পাবে লাঞ্ছনাকর শাস্তি, যেহেতু তোমরা পৃথিবীতে নাহক গৌরব করতে এবং যেহেতু তোমরা নাফরমানি করতে।
একবার হযরত উমর রাযি. হযরত জাবির রাযি.-এর হাতে গোশত দেখে জিজ্ঞেস করলেন, হে জাবির, এটা কী? তিনি বললেন, আমার গোশত খেতে মনে চেয়েছে, তাই কিনে এনেছি। তিনি বললেন, হে জাবির, তোমার যখনই যা মনে চায় তা কিনে নিয়ে আস? তুমি কি এ আয়াতকে ভয় কর না যে, আল্লাহ বলছেন- (তোমরা নিজেদের অংশের উৎকৃষ্ট জিনিসসমূহ পার্থিব জীবনে (ভোগ করে) নিঃশেষ করে ফেলেছ এবং তা বেজায় ভোগ করেছ?
যাহোক, হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রাযি. তারপর কাদতে থাকলেন। তিনি ভয় করছিলেন, দুনিয়ায় এসব নি'আমত ভোগ করার পর না জানি আখিরাতে খালি হাতে উঠতে হয়। শেষপর্যন্ত তিনি আর সে খাবার খেলেন না।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা যুহদ ও দুনিয়াবিমুখতার গুরুত্ব বোঝা যায়।
খ. দীনদারদের উচিত দুনিয়ার ভোগ-বিলাস থেকে দূরে থাকা।
গ. সর্বাবস্থায় আখিরাতের পুরস্কারকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
ঘ. দুনিয়ার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য অর্জিত হলে এই ভয়ে ভীত থাকা চাই যে, না জানি এটা সৎকর্মসমূহের পার্থিব বদলা।
ঙ. আল্লাহওয়ালা ও নেককার ব্যক্তিবর্গের জীবনাচরণ চর্চা করা উচিত। তাতে পার্থিব মোহ হ্রাস পায়। নিজের চেয়ে অন্যকে উৎকৃষ্ট গণ্য করা প্রকৃত আল্লাহওয়ালার শান।
হযরত আব্দুর রহমান ইবন আওফ রাযি. ধনী ছিলেন বটে, তাই বলে বিলাসিতাপূর্ণ জীবনযাপন করেননি। তিনি তাঁর ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে খরচ করতেই ভালোবাসতেন। তারপরও যে প্রাচুর্য তাঁর হাতে এসে গিয়েছিল, সেজন্য আমোদিত না হয়ে বরং না জানি তাঁর সৎকর্মের বদলা ইহজীবনেই দিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেই ভয়ে ভীত থেকেছেন।
মৃত্যুর আগে অসুস্থতাকালে একদিন তিনি রোযাদার ছিলেন। অসুস্থ শরীরে রোখা রাখতে কষ্ট হচ্ছে দেখে পরিবারের লোকজন তাঁর সামনে খাবার পেশ করে। এ অবস্থায় তাঁর হযরত মুস'আব ইবনে উমায়র রাযি.-এর কষ্ট-ক্লেশপূর্ণ জীবনের কথা মনে পড়ে যায়। সেই স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তাঁর বর্তমান আর্থিক সচ্ছলতা তাঁর জন্য পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে। তাঁর দৃষ্টিতে হযরত মুস'আব ইবন উমায়র রাযি. তারচে' উত্তম ছিলেন। তিনি মন্তব্য করেন, তিনি আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। অথচ হযরত আব্দুর রহমান ইবন আওফ রাযি. আশারায়ে মুবাশশারার একজন। অর্থাৎ একইসঙ্গে যে দশজন সাহাবীকে জান্নাতবাসী হওয়ার সুসংবাদ দেওয়া হয়েছিল, হযরত আব্দুর রহমান ইবন আওফ রাযি.-ও তাদের একজন। সাধারণভাবেই এ দশজন সাহাবীকে অন্যদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ গণ্য করা হয়। তা সত্ত্বেও হযরত মুসআব রাযি.-কে শ্রেষ্ঠ বলাটা সম্ভবত তাঁর বিনয়ের প্রকাশ। এরকম বিনয় ছিল সাহাবায়ে কেরামের চরিত্রের বিশেষত্ব।
একবার হযরত সা'দ ইবনুর রাবী রাযি.-এর একটি ছোট মেয়ে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-এর পাশে বসা ছিল। এ অবস্থায় এক ব্যক্তি সেখানে এসে উপস্থিত হল। লোকটি জিজ্ঞেস করল, এই মেয়েটি কে? হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. বললেন, এ মেয়েটি আমার চেয়ে উৎকৃষ্ট এক ব্যক্তির কন্যা। তিনি সা'দ ইবনুর রবী', যিনি আকাবার বায়'আতের একজন প্রতিনিধি ছিলেন, বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তারপর উহুদের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেছেন। এমনও হতে পারে, যেসকল সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গী হয়ে জিহাদ করেছেন এবং তাতে শাহাদাত বরণ করেছেন, তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে তাদের জানাযা পড়েছেন, অন্যদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করতেন।
প্রকাশ থাকে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর সাহাবায়ে কেরামের যে আর্থিক সচ্ছলতা লাভ হয়েছিল, তা লাভ হয়েছিল সাধারণ পথে। তাদের হাতে রোম ও পারস্য-শক্তি পর্যুদস্ত হয়েছিল। সমগ্র পারস্য, রোম সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চল এবং মিশর ও আফ্রিকার বিস্তীর্ণ এলাকা মুসলিম মুজাহিদদের হস্তগত হয়েছিল। তাদের যাবতীয় অর্থ-সম্পদ মূলত এ সুবাদেই অর্জিত হয়েছিল।
বলাবাহুল্য, জিহাদ এক পবিত্র ইবাদত। এ ইবাদত আদায়ের সুবাদে পার্থিব যা-কিছু অর্জিত হয়ে যায়, তাও পবিত্রই বটে। কিন্তু যে মহান সাহাবীদেরকে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত ও আখিরাতমুখী আল্লাহপ্রেমিকরূপে গড়ে তুলেছিলেন, পার্থিব প্রাচুর্য কখনওই তাদেরকে মোহমুগ্ধ করতে পারেনি। বরং প্রাচুর্যের কারণে তাদের অন্তরে এই ভয় দেখা দিয়েছে যে, না জানি এর কারণে আখিরাতের পুরস্কার থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়। তিনি বলেন- (আমাদের ভয় হয়, না জানি আমাদের নেক কাজসমূহের বদলা নগদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে)। অর্থাৎ নেক কাজসমূহের বদলা দুনিয়ায় দিয়ে দেওয়া হলে আখিরাতে তো আমাদের জন্য কিছুই থাকবে না। বস্তুত এটা ছিল তাঁর আল্লাহভীতির তীব্রতার বহিঃপ্রকাশ। তিনি ভেবেছিলেন, যে আর্থিক প্রাচুর্য তার হাতে এসে গেছে, বুঝি বা তা তাঁর কৃত সৎকর্মসমূহের প্রতিদান। প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি তা নয়। মূলত সে আর্থিক সচ্ছলতাও তো তাঁর বহু সৎকর্মের উৎস ছিল। তিনি তাঁর সচ্ছলতা দ্বারা পরকালীন লাভজনক ব্যবসায় লিপ্ত হতে পেরেছিলেন। তিনি আল্লাহর পথে দান করতেন প্রচুর। তিনি তাঁর সম্পদ দ্বারা আল্লাহর বান্দাদের সেবা করতেন।
যারা প্রকৃত আল্লাহভীরু হয়ে থাকে, তাদের নজর নিজেদের সৎকর্মের দিকে বিশেষ থাকে না। বরং তারা তাদের সৎকর্মের ভেতরও ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখতে পান এবং সে কারণে নিজেদের সৎকর্ম নিয়েও ভীত থাকেন। সেইসঙ্গে আল্লাহ তা'আলার নিকট থেকে যেসব নি'আমত লাভ করেন, সে ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম পালনে গাফলাতি ও আল্লাহর শোকর আদায়ে অবহেলা নিয়েও চিন্তিত থাকেন। তারা আরও ভাবেন, আমি তো এসব নি'আমতের উপযুক্ত নই। তা সত্ত্বেও যে আমাকে এসব দেওয়া হচ্ছে এতে আমার টুটাফাটা আমলের নগদ বদলা নয় তো? তাই তো হযরত উমর ফারুক রাযি. এর মত ব্যক্তিকেও দেখি যখনই সামনে ভালো খাবার আসত, এই ভেবে কান্না শুরু করে দিতেন যে, না জানি এটা নেককাজের নগদ দিয়ে দেওয়া বদলা। কুরআন মাজীদের একটি আয়াত তাকে এরকম ভয়ে ভীত করে তুলত। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
و يَوْمَ يُعْرَضُ الَّذِيْنَ كَفَرُوا عَلَى النَّارِ أَذْهَبْتُمْ.....
এবং সেই দিনকে স্মরণ রেখ, যেদিন কাফেরদেরকে আগুনের সামনে পেশ করা হবে (এবং বলা হবে,) তোমরা নিজেদের অংশের উৎকৃষ্ট জিনিসসমূহ পার্থিব জীবনে (ভোগ করে) নিঃশেষ করে ফেলেছ এবং তা বেজায় ভোগ করেছ। সুতরাং আজ বিনিময়রূপে তোমরা পাবে লাঞ্ছনাকর শাস্তি, যেহেতু তোমরা পৃথিবীতে নাহক গৌরব করতে এবং যেহেতু তোমরা নাফরমানি করতে।
একবার হযরত উমর রাযি. হযরত জাবির রাযি.-এর হাতে গোশত দেখে জিজ্ঞেস করলেন, হে জাবির, এটা কী? তিনি বললেন, আমার গোশত খেতে মনে চেয়েছে, তাই কিনে এনেছি। তিনি বললেন, হে জাবির, তোমার যখনই যা মনে চায় তা কিনে নিয়ে আস? তুমি কি এ আয়াতকে ভয় কর না যে, আল্লাহ বলছেন- (তোমরা নিজেদের অংশের উৎকৃষ্ট জিনিসসমূহ পার্থিব জীবনে (ভোগ করে) নিঃশেষ করে ফেলেছ এবং তা বেজায় ভোগ করেছ?
যাহোক, হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রাযি. তারপর কাদতে থাকলেন। তিনি ভয় করছিলেন, দুনিয়ায় এসব নি'আমত ভোগ করার পর না জানি আখিরাতে খালি হাতে উঠতে হয়। শেষপর্যন্ত তিনি আর সে খাবার খেলেন না।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা যুহদ ও দুনিয়াবিমুখতার গুরুত্ব বোঝা যায়।
খ. দীনদারদের উচিত দুনিয়ার ভোগ-বিলাস থেকে দূরে থাকা।
গ. সর্বাবস্থায় আখিরাতের পুরস্কারকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
ঘ. দুনিয়ার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য অর্জিত হলে এই ভয়ে ভীত থাকা চাই যে, না জানি এটা সৎকর্মসমূহের পার্থিব বদলা।
ঙ. আল্লাহওয়ালা ও নেককার ব্যক্তিবর্গের জীবনাচরণ চর্চা করা উচিত। তাতে পার্থিব মোহ হ্রাস পায়। নিজের চেয়ে অন্যকে উৎকৃষ্ট গণ্য করা প্রকৃত আল্লাহওয়ালার শান।
