আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ

৩৪- ইসলামী রাষ্ট্রনীতির অধ্যায়

হাদীস নং: ৪৫৬৮
আন্তর্জাতিক নং: ১৮২৫
৪. বিনা প্রয়োজনে ক্ষমতা গ্রহণ করা অনভিপ্রেত
৪৫৬৮। আব্দুল মালিক ইবনে শুআইব ইবনে লাইস (রাহঃ) ......... আবু যর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আরয করলাম ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি কি আমাকে কোন কাজে (দায়িত্বে) নিযুক্তি করবেন না? রাবী বলেন, তিনি তখন তার পবিত্র হাতে আমার কাঁধে আঘাত করে বললেনঃ হে আবু যর! তুমি দূর্বল অথচ এটা হচ্ছে একটা আমানত। আর কিয়ামতের দিন এ হবে লাঞ্ছনা ও অনুশোচনা। তবে যে এটি যথাযথ রূপে গ্রহণ করবে এবং তার দায়িত্ব যথাযথ পালন করবে (তার কথা স্বতন্ত্র)।
باب كَرَاهَةِ الإِمَارَةِ بِغَيْرِ ضَرُورَةٍ
حَدَّثَنَا عَبْدُ الْمَلِكِ بْنُ شُعَيْبِ بْنِ اللَّيْثِ، حَدَّثَنِي أَبِي شُعَيْبُ بْنُ اللَّيْثِ، حَدَّثَنِي اللَّيْثُ، بْنُ سَعْدٍ حَدَّثَنِي يَزِيدُ بْنُ أَبِي حَبِيبٍ، عَنْ بَكْرِ بْنِ عَمْرٍو، عَنِ الْحَارِثِ بْنِ يَزِيدَ الْحَضْرَمِيِّ، عَنِ ابْنِ حُجَيْرَةَ الأَكْبَرِ، عَنْ أَبِي ذَرٍّ، قَالَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَلاَ تَسْتَعْمِلُنِي قَالَ فَضَرَبَ بِيَدِهِ عَلَى مَنْكِبِي ثُمَّ قَالَ " يَا أَبَا ذَرٍّ إِنَّكَ ضَعِيفٌ وَإِنَّهَا أَمَانَةٌ وَإِنَّهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ خِزْىٌ وَنَدَامَةٌ إِلاَّ مَنْ أَخَذَهَا بِحَقِّهَا وَأَدَّى الَّذِي عَلَيْهِ فِيهَا " .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হযরত আবূ যার্র রাযি. রাষ্ট্রীয় কোনও পদ ও দায়িত্ব প্রার্থনা করলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে আদর করে তাঁর কাঁধে চাপড় মারলেন। উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে তাঁর প্রার্থিত বিষয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা এবং তার বিপদ ও ঝুঁকি সম্পর্কে তাঁকে সাবধান করে দেওয়া। তারপর তাঁর দুর্বলতার বিষয়টিও তাঁর সামনে তুলে ধরলেন, যেমনটা হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।

রাষ্ট্রীয় পদের গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- وَإِنَّهَا أَمَانة (আর এটা এক আমানত)। অর্থাৎ পদ ও নেতৃত্ব আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে অর্পিত আমানত। তাতে যাকে নিয়োগদান করা হয়, তাকে কিয়ামতের দিন এ আমানত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। এটা মানুষেরও আমানত। সে পদ বা নেতৃত্বের সঙ্গে মানুষের যেসব কাজকর্ম জড়িত, পূর্ণ বিশ্বস্ততা ও আমানতদারির সঙ্গে তা সম্পন্ন করা জরুরি। অন্যথায় তা আমানতের খেয়ানত। ব্যক্তিবিশেষের আমানতও আমানত বটে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় পদ বা নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে বহু লোকের। তাই এ আমানতের পরিসরও অনেক বড়। এ ক্ষেত্রে খেয়ানত হলে তার প্রতিকার অনেক কঠিন। সেজন্যই এর গুরুভারের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু যার্র রাযি.-কে সতর্ক করেন যে, দেখো, এটা এক আমানত। বড় ভারী আমানত! সকলের পক্ষে এটা বহন করা সম্ভব নয়। অযোগ্য ব্যক্তি যদি এ গুরুভার নিজ কাঁধে তুলে নেয়, কিংবা যোগ্যতা থাকলেও এ আমানতের সংরক্ষণে অবহেলা করে, তবে তার পরিণাম বড় ভয়াবহ। সে পরিণাম সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
وَإِنَّهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ خِزْيٌ وَنَدَامَةٌ (নিশ্চয়ই এটা কিয়ামতের দিন লাঞ্ছনা ও অনুতাপের কারণ হবে)। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আমানতের হেফাজত করবে না; বরং খেয়ানতের পরিচয় দেবে এবং মানুষের অধিকার আদায়ে অবহেলা করবে, কিয়ামতের দিন তার জন্য এটা কঠিন লাঞ্ছনার কারণ হবে। এক তো লাঞ্ছনা করা হবে একজন খেয়ানতকারী ও বিশ্বাসঘাতকরূপে সমস্ত মানুষের সামনে তাকে পরিচিত করে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেন-
لِكُلِّ غَادِرٍ لِوَاءٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يُعْرَفُ بِهِ
প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের কিয়ামতের দিন একটি পতাকা থাকবে, যা দিয়ে তাকে চেনা যাবে (যে, সে একজন বিশ্বাসঘাতক)। (সহীহ বুখারী: ৬৯৬৬; সহীহ মুসলিম ১৭৩৬; জামে তিরমিযী ১৫৮১; সুনানে ইবন মাজাহ: ২৮৭২; মুসনাদে আবূ দাউদ তয়ালিসী ২২৭৩; মুসনাদু ইবনুল জা'দ ১৩৬৩; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৩৩৪১০; মুসনাদে আহমাদ ৫৯৬৭; মুসনাদুল বাযযার ৬৮৪৮; সহীহ ইবনে হিব্বান : ৭৩৪১)

দ্বিতীয়ত তাকে লাঞ্ছিত করা হবে জাহান্নামের আযাব দিয়ে। ফলে তাকে সেদিন দায়িত্ব যারপরনাই অনুতপ্ত হতে হবে। অনুতাপ করবে এ কারণে যে, দুনিয়ায় সে কেন দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল আর দায়িত্ব গ্রহণ করলেও কেন বিশ্বস্ততার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করল না!

সুতরাং কোনও বুদ্ধিমানেরই নেতৃত্ব গ্রহণ করা উচিত নয়। এমনিভাবে বিশেষ প্রয়োজন না হলে রাষ্ট্রীয় পদগ্রহণ থেকেও দূরে থাকা উচিত। হাঁ, যদি নিজের পক্ষ থেকে আগ্রহ প্রকাশ না করা হয় আর এ অবস্থায় কোনও দায়িত্ব এসে যায় আর সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনও করা হয়, তবে ভিন্ন কথা। সে সম্পর্কে হাদীছটির পরবর্তী বাক্যে জানানো হয়েছে-
إِلَّا مَنْ أَخَذَهَا بِحَقِّهَا، وَأَدَّى الَّذِي عَلَيْهِ فِيهَا (অবশ্য যে ব্যক্তি এটা ন্যায়সঙ্গতভাবে গ্রহণ করবে এবং এতে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে, তার কথা ভিন্ন)। অর্থাৎ যদি নিজের মধ্যে যোগ্যতা ও উপযুক্ততা থাকে, এ অবস্থায় সে নেতৃত্ব ও কোনও পদ গ্রহণ করে, তারপর দায়িত্বপালনেও সতর্ক ও সচেষ্ট থাকে, কোনওরকম খেয়ানত ও পক্ষপাত না করে, বরং ন্যায় ও ইনসাফের সঙ্গে যিম্মাদারী পালন করে, তবে তাকে লাঞ্ছিত ও অনুতপ্ত হতে হবে না। বরং কিয়ামতের দিন তাকে বিশেষভাবে সম্মানিত ও পুরস্কৃত করা হবে। যেমন এক হাদীছে সাত ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলার রহমতের ছায়ায় স্থান পাবে। তাদের মধ্যে একজন হল ওই ব্যক্তি, যে ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে মানুষের নেতৃত্বদান করে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কোনও অবস্থায়ই নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় বিশেষ পদ পাওয়ার লোভ করতে নেই।

খ. কেউ নেতৃত্বের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করলে জ্ঞানীজনদের তাকে তার পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে দেওয়া উচিত।

গ. যে ব্যক্তি যে পদের উপযুক্ত নয়, তাকে কিছুতেই উচিত নয়। সে পদে নিয়োগদান করা।

ঘ. নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় পদ এক কঠিন আমানত। সংশ্লিষ্ট লোকদের এ কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়।

ঙ. নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় আমানতের খেয়ানতকারীকে আখিরাতে লাঞ্ছিত ও অনুতপ্ত হতে হবে। সুতরাং দুনিয়ায় থাকতেই এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া দরকার।

চ. নিজ যোগ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত থাকলে নেতৃত্বগ্রহণ দোষের নয়।

ছ. নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় পদের দায়-দায়িত্ব বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
সহীহ মুসলিম - হাদীস নং ৪৫৬৮ | মুসলিম বাংলা