আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

১৮- তাহাজ্জুদ - নফল নামাযের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ১২০৬
৭৬৩. মা তার নামাযরত সন্তানকে ডাকলে ।
১১৩৩। লাইস (রাহঃ) বলেন, জা’ফর (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ এক মহিলা তার ছেলেকে ডাকল। তখন তার ছেলে গীর্জায় ছিল। বলল, হে জুরাইজ! ছেলে মনে মনে বলল, ইয়া আল্লাহ! (এক দিকে) আমার মা (এর ডাক) আর (অপর দিকে) আমার নামায! মা আবার ডাকলেন, হে জুরাইজ! ছেলে বলল, ইয়া আল্লাহ! আমার মা ও আমার নামায! মা আবার ডাকলেন, হে জুরাইজ! ছেলে বলল, ইয়া আল্লাহ! আমার মা ও আমার নামায! মা (বিরক্ত হয়ে) বললেন, ইয়া আল্লাহ! পতিতাদের সামনে দেখা না যাওয়া পর্যন্ত যেন জুরাইজের মৃত্যু না হয়। এক রাখালিনী যে বকরি চরাতো, সে জুরাইজের গীর্জায় আসা যাওয়া করত। সে একটি সন্তান প্রসব করল। তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, এ সন্তান কার ঔরষজাত? সে জবাব দিল, জুরাইজের ঔরষের। জুরাইজ তার গীর্জা থেকে নেমে এসে জিজ্ঞাসা করলো, কোথায় সে মেয়েটি, যে বলল যে, তাঁর সন্তান আমার? (সন্তানসহ মেয়েটিকে উপস্থিত করা হলে, নিজে নির্দোষ প্রমাণের উদ্দেশ্যে শিশুটিকে লক্ষ্য করে) জুরাইজ বলেন, হে বাবূস! তোমার পিতা কে? সে বলল, বকরীর অমুক রাখাল।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এই শিশুটি দোলনায় থাকার বয়সে কথা বলেছে, যে বয়সে শিশুদের মুখে কথা ফোটে না। এটা ছিল আল্লাহ তাআলার কুদরতের প্রকাশ। তিনি চাইলে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুকে দিয়েও কথা বলাতে পারেন। এমনকি তিনি চাইলে গাছ ও পাথরকেও বাকশক্তি দিতে পারেন। কিয়ামতের আগে এমন ঘটবে যে, এক গাছের আড়ালে ইহুদী আত্মগোপন করে থাকবে আর সেই গাছ মুসলিম মুজাহিদকে ডেকে বলবে, এই এখানে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। হাদীছে একটি গরু সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তার পিঠে এক ব্যক্তি আরোহন করলে সেটি বলে উঠেছিল, আমাকে এইজন্য সৃষ্টি করা হয়নি। হাদীছ ও ইতিহাস গ্রন্থসমূহে এরকম আরও বহু ঘটনা বর্ণিত আছে।

জুরায়জ রহ ছিলেন বনী ইসরাঈলের এক ব্যবসায়ী। ব্যবসায় কখনও লাভ ও কখনও লোকসান হওয়ায় একপর্যায়ে তার বিরক্তি ধরে যায়। শেষে তিনি একটি উপাসনালয় বানিয়ে তাতে নিভৃত জীবনযাপন করতে থাকেন এবং দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে পুরোপুরি 'রাহিব' (বৈরাগী) হয়ে যান। বৈরাগ্যবাস আগে ছিল না। এটা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের অনুসারীরা বাড়াবাড়িমূলকভাবে উদ্ভাবন করে নেয়। এর দ্বারা বোঝা যায় জুরায়জ রহ. হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের পরবর্তী জমানার লোক এবং তাঁর অনুসারীদের একজন।
কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, তার মা রোজ একবার এসে তার খোঁজ নিয়ে যেতেন। তার মা নিচ থেকে জুরায়জ বলে ডাক দিলে তিনি উপর থেকে উঁকি মেরে তার সঙ্গে কথা বলতেন। বরাবরের মত একদিন যখন তার মা এসে ডাক দিলেন, তখন তিনি নামাযরত ছিলেন। তিনি চিন্তা করছিলেন মায়ের ডাকে সাড়া দেবেন, না নামায চালিয়ে যাবেন! শেষপর্যন্ত নামাযকেই অগ্রাধিকার দিলেন। তারপর যা ঘটেছে, হাদীছে তার বিস্তারিত উল্লেখ আছে।
ব্যভিচারিণী স্ত্রীলোকটি রাখালের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে বাচ্চা প্রসবের পর যখন জুরায়জের নামে অপবাদ দিল, তখন আমলোক সাধারণত যা করে থাকে, এ ক্ষেত্রেও তাই করল। তারা যাচাই করে দেখল না অভিযোগ সত্য কি না। এক মিথ্যা অপবাদকে চরম সত্য ধরে নিয়ে এতদিনকার ভক্তি-শ্রদ্ধা সব বিসর্জন দিল। তাঁর ইবাদত-বন্দেগী, বুযুর্গী সবকিছুই মুহূর্তের মধ্যে ভুলে গেল। তারপর যে নির্মম আচরণ তার প্রতি করল, হাদীছে তার উল্লেখ আছে। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, তারা জুরায়জ রহ.-কে তার ইবাদতখানা থেকে টেনে-হেঁচড়ে নামানোর পর গলায় রশি লাগিয়ে পথে-ঘাটে ঘোরাল। তারা তাকে একজন ভণ্ড ও লোকদেখানো আবেদ বলে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করল ও মারধর করতে থাকল। তাকে রাজার কাছেও নিয়ে গেল। রাজা তাকে কতক্ষণ তিরস্কার করল, তারপর তাকে শূলে চড়ানোর হুকুম দিল।
যাহোক জুরায়জ রহ. যখন এ কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন, তখন আল্লাহ তাআলা তাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করলেন। আল্লাহ তাআলার ইশারায় তিনি তাকে শিশুটির কাছে নিয়ে যেতে বললেন এবং সেখানে গিয়ে দু'রাকআত নামায পড়লেন। তারপর শিশুটির পেটে খোঁচা দিয়ে যেই না বললেন- রে বাবু! তোমার বাবা কে? অমনি শিশুটি বলে উঠল- অমুক রাখাল।
জুরায়জের এ কারামত দেখে মুহূর্তেই পরিস্থিতি বদলে গেল। এতক্ষণ যারা তাকে ঘৃণা করছিল, ফের তারা ভক্তি-শ্রদ্ধায় বিগলিত হল। কেউ ভক্তিতে চুমু দেয়, কেউ বরকতের আশায় শরীর স্পর্শ করে ইত্যাদি। এমনকি তারা স্বর্ণ দিয়ে তার উপাসনালয়টি নতুনভাবে তৈরি করে দেওয়ারও প্রস্তাব করল। কিন্তু তিনি ছিলেন খাঁটি আল্লাহওয়ালা। অর্থবিত্তের লোভ-লালসা তো আগেই ত্যাগ করেছেন। এখন তাতে আরও পরিপক্কতা এসেছে। তিনি প্রলোভনের শিকার হলেন না। আগের মতই মাটির ঘর তৈরি করে দিতে বললেন।
জুরায়জ রহ. এ বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন মায়ের বদ্দুআয়। তার কর্তব্য ছিল মায়ের ডাকে সাড়া দেওয়া। নফল ইবাদত-বন্দেগী অপেক্ষা পিতামাতার হুকুম পালন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন لو كان جريج الراهب فقيها عالما لعلم أن إجابته أنه أفضل من عبادة ربه “সংসারত্যাগী জুরায়জ ফকীহ আলেম হলে জানতেন যে, তার পক্ষে মায়ের ডাকে সাড়া দেওয়া তার রব্বের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম ছিল।
পিতামাতার আদেশ শরীআতবিরোধী না হলে মানা ফরয। জুরায়জ রহ.-এর দ্বারা এ ব্যাপারে ত্রুটি হয়ে গেছে। তার এ ত্রুটি মা ক্ষমা করে দিলে হয়তো কিছুই হত না, আল্লাহ তাআলাও ক্ষমা করে দিতেন। মায়ের পক্ষে সেটাই শ্রেয় ছিল। সন্তানকে বদদুআ দিতে নেই । মায়ের বদ্দুআ অমোঘ। তা লেগেই যায়। সুতরাং জুরায়জের প্রতি মায়ের বদ্দুআ লেগে গেল এবং তার সাধু জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ঘটে গেল।
বাহ্যদৃষ্টিতে যদিও জুরায়জ রহ.-কে এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটাও তার প্রতি আল্লাহ তাআলার রহমতই ছিল। দুনিয়ায় তো এর ফায়দা হয়েছে এই যে, ঘটনার পর মানুষের চোখে তিনি একজন সত্যিকারের আবেদ ও সাধকরূপে সমাদৃত হয়ে গেছেন। আর আখেরাতের ফায়দা হল মায়ের ডাকে সাড়া না দেওয়ার অপরাধ থেকে মুক্তি। এ ঘটনা দ্বারা তার অপরাধের প্রতিকার হয়ে গেছে। ফলে আশা করা যায় আখেরাতে এজন্য তাকে ধরা হবে না। আল্লাহ তাআলা তার নেক বান্দাদেরকে অনেক সময় তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতির একরকম প্রতিফল দুনিয়াতেই দিয়ে দেন, যাতে আখেরাতে পরিপূর্ণ মুক্তি পেয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানে নিরাপত্তা দান করুন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

এ হাদীছটির মধ্যে শিক্ষণীয় আছে অনেক কিছুই। তার মধ্যে বিশেষ কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা যাচ্ছে।

ক. এ হাদীছ দ্বারা আল্লাহ তাআলার অসীম কুদরত সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। নবীগণের মু'জিযা এবং ওলী-বুযুর্গদের কারামত তাঁর সে কুদরতেরই প্রকাশ।

খ. নফল ইবাদত অপেক্ষা পিতামাতার হুকুম পালন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই নফল ইবাদতকালে পিতামাতার কেউ ডাক দিলে সে ডাকে সাড়া দেওয়া কর্তব্য।

গ. পিতামাতার বদ্দুআ অব্যর্থ। তাই এমন কোনও কাজ করা উচিত নয়, যাতে পিতামাতা কষ্ট পেতে পারে ও তাদের মনে বদ্দুআ আসতে পারে।

ঘ. খাঁটি ঈমানদারকে আল্লাহ তাআলা বিপদ-আপদে সাহায্য করে থাকেন, বিশেষত দীন ও ঈমান বিষয়ক ফিতনার সময়। ফলে ফিতনা তাদের ক্ষতি করতে পারে না, যেমন জুরায়জকে ব্যভিচারীনী নারী প্রলোভনে ফেলতে পারেনি।

ঙ. কোনও ব্যক্তি নিজে নির্দোষ ও খাঁটি হলে তার নামে অপবাদ ও মিথ্যা অভিযোগ বেশি দিন স্থায়ী হয় না। সত্য একদিন না একদিন প্রকাশ পেয়েই যায়।

চ. যাচাই-বাছাই ছাড়া কারও সম্পর্কিত কোনও অভিযোগে কান দিতে নেই। তাতে অনেক সময়ই নির্দোষ ব্যক্তিকে অহেতুক হয়রানি করা হয়।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন