আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ
২৯- কাসামা-(খুনের ব্যাপারে বিশেষ ধরনের হলফ করা),'মুহারিবীন' (শত্রু সৈন্য), 'কিসাস' (খুনের বদলা) এবং 'দিয়াত' (খুনের শাস্তি স্বরূপ অর্থদন্ড)
হাদীস নং: ৪২০২
আন্তর্জাতিক নং: ১৬৬৯-৮
১. ’কাসামা’ - খুনের ব্যাপারে হলফ করা
৪২০২। ইসহাক ইবনে মানসুর (রাহঃ) ......... সাহল ইবনে আবু হাসমা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, তার সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অন্তর্গত আব্দুল্লাহ ইবনে সাহল এবং মুহায়্যিসা (রাযিঃ) অনটনগ্রস্ত হয়ে খায়বরের দিকে গমন করলেন। এরপর জনৈক ব্যক্তি মুহায়্যিসা (রাযিঃ) এর নিকট এসে খবর দিল যে, আব্দুল্লাহ ইবনে সাহল (রাযিঃ) নিহত হয়েছেন এবং তাকে একটি পস্রবণ অথবা পরিত্যক্ত কূপের মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছে। সুতরাং তিনি সেখানকার ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের কাছে গিয়ে বললেন, আল্লাহর কসম! নিশ্চয়ই তোমরা তাকে হত্যা করেছ। তখন তারা বলল,আল্লাহর কসম! আমরা তাঁকে হত্যা করিনি। এরপর তিনি তার সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে এলেন এবং তাদের কাছে ঐ ঘটনা বর্ণনা করলেন।
পরিশেষে তিনি এবং তার বড় ভাই হুওয়ায়্যিসা ও আব্দুর রহমান ইবনে সাহল (রাযিঃ) (নবীজীর কাছে) আগমন করলেন। এরপর মুহায়্যিসা (রাযিঃ) কথা বলাতে উদ্যত হলেন, যিনি (নিহত ব্যক্তির সঙ্গে) খায়বরে ছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুহায়্যিসা (রাযিঃ) কে লক্ষ্য করে বললেন, বড় জন! বড় জন! (অর্থাৎ বয়স্ক ব্যক্তির কথা বলা চাই)। তখন হুওয়ায়্যিসা (রাযিঃ) কথাবার্তা বললেন, এরপর মুহায়্যিসা (রাযিঃ) বললেন।
তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ হয়ত তারা তোমাদের সাথীর খুনের বদলা (দিয়্যাত) আদায় করে দিবে নতুবা যুদ্ধের জন্য তৈরী হবে।তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের কাছে ঐ ব্যাপারে পত্র লিখলেন। তারা লিখল যে, আল্লাহর শপথ! নিশ্চয়ই আমরা তাকে হত্যা করিনি। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হুওয়ায়্যিসা, মুহায়্যিসা এবং আব্দুর রহমান (রাযিঃ) কে বললেন, তোমরা কি এ ব্যাপারে হলফ করে তোমাদের প্রতিপক্ষের (খুনের) হকদার হবে? তাবা বলল, না।
তখন তিনি বললেনঃ তাহলে ইয়াহুদীরা তোমাদের কাছে হলফ করবে। তারা তখন বলল, তারা তো (ইয়াহুদী) মুসলমান নয়। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজের পক্ষ হতে তার “দিয়্যাত” (খুনের বদলা) আদায় করে দিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের একশ উটনী পাঠিয়ে দিলেন এবং ঐগুলো তাদের বাড়ীতে পৌঁছিয়ে দেয়া হল। সাহল (রাযিঃ) বলেন, ঐগুলোর মধ্য হতে একটি লাল রংগের উটনী আমাকে লাথি মেরেছিল।
পরিশেষে তিনি এবং তার বড় ভাই হুওয়ায়্যিসা ও আব্দুর রহমান ইবনে সাহল (রাযিঃ) (নবীজীর কাছে) আগমন করলেন। এরপর মুহায়্যিসা (রাযিঃ) কথা বলাতে উদ্যত হলেন, যিনি (নিহত ব্যক্তির সঙ্গে) খায়বরে ছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুহায়্যিসা (রাযিঃ) কে লক্ষ্য করে বললেন, বড় জন! বড় জন! (অর্থাৎ বয়স্ক ব্যক্তির কথা বলা চাই)। তখন হুওয়ায়্যিসা (রাযিঃ) কথাবার্তা বললেন, এরপর মুহায়্যিসা (রাযিঃ) বললেন।
তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ হয়ত তারা তোমাদের সাথীর খুনের বদলা (দিয়্যাত) আদায় করে দিবে নতুবা যুদ্ধের জন্য তৈরী হবে।তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের কাছে ঐ ব্যাপারে পত্র লিখলেন। তারা লিখল যে, আল্লাহর শপথ! নিশ্চয়ই আমরা তাকে হত্যা করিনি। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হুওয়ায়্যিসা, মুহায়্যিসা এবং আব্দুর রহমান (রাযিঃ) কে বললেন, তোমরা কি এ ব্যাপারে হলফ করে তোমাদের প্রতিপক্ষের (খুনের) হকদার হবে? তাবা বলল, না।
তখন তিনি বললেনঃ তাহলে ইয়াহুদীরা তোমাদের কাছে হলফ করবে। তারা তখন বলল, তারা তো (ইয়াহুদী) মুসলমান নয়। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজের পক্ষ হতে তার “দিয়্যাত” (খুনের বদলা) আদায় করে দিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের একশ উটনী পাঠিয়ে দিলেন এবং ঐগুলো তাদের বাড়ীতে পৌঁছিয়ে দেয়া হল। সাহল (রাযিঃ) বলেন, ঐগুলোর মধ্য হতে একটি লাল রংগের উটনী আমাকে লাথি মেরেছিল।
باب الْقَسَامَةِ
حَدَّثَنِي إِسْحَاقُ بْنُ مَنْصُورٍ، أَخْبَرَنَا بِشْرُ بْنُ عُمَرَ، قَالَ سَمِعْتُ مَالِكَ بْنَ أَنَسٍ، يَقُولُ حَدَّثَنِي أَبُو لَيْلَى بْنُ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ سَهْلٍ، عَنْ سَهْلِ بْنِ أَبِي حَثْمَةَ، أَنَّهُ أَخْبَرَهُ عَنْ رِجَالٍ، مِنْ كُبَرَاءِ قَوْمِهِ أَنَّ عَبْدَ، اللَّهِ بْنَ سَهْلٍ وَمُحَيِّصَةَ خَرَجَا إِلَى خَيْبَرَ مِنْ جَهْدٍ أَصَابَهُمْ فَأَتَى مُحَيِّصَةُ فَأَخْبَرَ أَنَّ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ سَهْلٍ قَدْ قُتِلَ وَطُرِحَ فِي عَيْنٍ أَوْ فَقِيرٍ فَأَتَى يَهُودَ فَقَالَ أَنْتُمْ وَاللَّهِ قَتَلْتُمُوهُ . قَالُوا وَاللَّهِ مَا قَتَلْنَاهُ . ثُمَّ أَقْبَلَ حَتَّى قَدِمَ عَلَى قَوْمِهِ فَذَكَرَ لَهُمْ ذَلِكَ ثُمَّ أَقْبَلَ هُوَ وَأَخُوهُ حُوَيِّصَةُ وَهُوَ أَكْبَرُ مِنْهُ وَعَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ سَهْلٍ فَذَهَبَ مُحَيِّصَةُ لِيَتَكَلَّمَ وَهُوَ الَّذِي كَانَ بِخَيْبَرَ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لِمُحَيِّصَةَ " كَبِّرْ كَبِّرْ " . يُرِيدُ السِّنَّ فَتَكَلَّمَ حُوَيِّصَةُ ثُمَّ تَكَلَّمَ مُحَيِّصَةُ . فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " إِمَّا أَنْ يَدُوا صَاحِبَكُمْ وَإِمَّا أَنْ يُؤْذِنُوا بِحَرْبٍ " . فَكَتَبَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِلَيْهِمْ فِي ذَلِكَ فَكَتَبُوا إِنَّا وَاللَّهِ مَا قَتَلْنَاهُ . فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لِحُوَيِّصَةَ وَمُحَيِّصَةَ وَعَبْدِ الرَّحْمَنِ " أَتَحْلِفُونَ وَتَسْتَحِقُّونَ دَمَ صَاحِبِكُمْ " . قَالُوا لاَ . قَالَ " فَتَحْلِفُ لَكُمْ يَهُودُ " . قَالُوا لَيْسُوا بِمُسْلِمِينَ . فَوَدَاهُ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مِنْ عِنْدِهِ فَبَعَثَ إِلَيْهِمْ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مِائَةَ نَاقَةٍ حَتَّى أُدْخِلَتْ عَلَيْهِمُ الدَّارَ . فَقَالَ سَهْلٌ فَلَقَدْ رَكَضَتْنِي مِنْهَا نَاقَةٌ حَمْرَاءُ .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এটি খায়বার যুদ্ধপরবর্তী একটি ঘটনা। বিভিন্ন হাদীসে ঘটনাটি সংক্ষেপে/ বিস্তারিত বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় সামান্য গরমিলও পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে কিছুটা ব্যাখ্যা সহকারে ঘটনার বিবরণ তুলে ধরা হলো।
এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল হিজরী ৭ম সালে। এখানকার অধিবাসীগণ ছিল ইহুদী। যুদ্ধে ইহুদীদের পরাজয় হয়। এখানকার সমস্ত দুর্গ ও জমি-জায়েদাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধিকারে চলে আসে। তিনি চাইলে সমস্ত ইহুদীকে এখান থেকে বিতাড়িত করতে পারতেন। তা না করে তিনি তাদের প্রতি দয়াপরবশ হন। তাদেরকে এ শর্তে এখানে থাকার অনুমতি দেন যে, তারা মুসলিমদের পক্ষে চাষাবাদের কাজ করবে। তাতে যে ফল ও ফসল উৎপন্ন হবে তার অর্ধেক তাদেরকে দেওয়া হবে। এভাবে বর্গাচাষের চুক্তিতে তারা এখানে অবস্থানের সুযোগ লাভ করে। কিন্তু ফিতনা-ফাসাদ বিস্তার করাই যাদের স্বভাব, তাদের পক্ষ থেকে শান্তিরক্ষার আশা কিভাবে করা যায়? গোপনে তারা একের পর এক দুষ্কৃতি করে যেতে থাকে। ইতিহাস ও হাদীছ গ্রন্থসমূহে তাদের দুষ্কৃতির নানা ঘটনা বর্ণিত আছে। এ হাদীছেও সেরকম একটা ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
ইহুদী এলাকায় একজন মুসলিম হত্যার ঘটনা
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন সাহল রাযি. ও মুহায়্যিসা ইবন মাস'উদ রাযি. খেজুর কেনার উদ্দেশ্যে খায়বার গিয়েছিলেন। সেখানে পৌঁছার পর তারা দু'জন খেজুরের সন্ধানে দুই দিকে চলে যান। পরে মুহায়্যিসা রাযি. সংবাদ পান যে, কে বা কারা আব্দুল্লাহ রাযি.-কে হত্যা করে ফেলেছে। সংবাদ পাওয়া মাত্র তিনি ছুটে আসেন। এসে দেখতে পান ঠিকই আব্দুল্লাহ রাযি.-কে হত্যা করা হয়েছে। তিনি রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে আছেন। সেখানকার ইহুদীদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাদের কেউ তাঁকে হত্যা করার কথা স্বীকার করল না। অগত্যা তিনি সেখানে তাঁর দাফন-কাফন সম্পন্ন করে মদীনা মুনাউওয়ারায় ফিরে আসলেন।
তারপর আব্দুল্লাহ ইবন সাহল রাযি.-এর ভাই আব্দুর রহমান ইবন সাহল রাযি. এবং মাস'উদের পুত্রদ্বয় মুহায়্যিসা রাযি. ও হুওয়ায়্যিসা রাযি. — এ তিনজন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাজির হলেন। তিনজনই একই গোত্রের লোক। সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা অর্থাৎ মুহায়্যিসা রাযি. ও হুওয়ায়্যিসা রাযি. ছিলেন আব্দুর রহমান রাযি.-এর পিতা সাহলের চাচাতো ভাই।
এদের মধ্যে আব্দুর রহমান ইবন সাহল রাযি. ছিলেন বয়সে সকলের ছোট। তিনি যেহেতু নিহতের ভাই, তাই বিচার প্রার্থনার জন্য সবার আগে তিনি কথা বলতে উদ্যত হলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বলে তাঁকে ক্ষান্ত করে দিলেন যে, বড়দের কথা বলতে দাও। সুতরাং তিনি ক্ষান্ত হয়ে গেলেন এবং অপর দু'জন কথা বললেন। বিভিন্ন বর্ণনা সামনে রাখলে বোঝা যায় মৌলিকভাবে কথা বলেছিলেন হুওয়ায়্যিসা রাযি। তিনি বয়সে সকলের বড় ছিলেন। বিভিন্ন বর্ণনায় যে দু'জনই কথা বলেছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তা এ হিসেবে যে, সম্ভবত হুওয়ায়্যিসা রাযি. -এর কথা বলার মাঝে মাঝে প্রয়োজনে মুহায়্যিসা রাযি.-ও দু’-একটি কথা বলেছিলেন।
প্রকাশ থাকে যে, এ ঘটনায় হুওয়ায়্যিসা রাযি. উপস্থিত ছিলেন না। উপস্থিত ছিলেন মুহায়্যিসা রাযি.। তবে মামলার মূল বাদী ছিলেন নিহতের ভাই আব্দুর রহমান রাযি। একই খান্দানের হওয়ায় আব্দুর রহমান রাযি.-এর সহযোগী হিসেবে অপর দু'জন উপস্থিত হয়েছিলেন। তাছাড়া মুহায়্যিসা রাযি. তো আব্দুল্লাহ রাযি.-এর সফরসঙ্গীই ছিলেন এবং দাফন-কাফনের কাজও তিনিই সম্পন্ন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বয়োজ্যেষ্ঠ হুওয়ায়্যিসা রাযি.-কে যে কথা বলতে বলেছিলেন তা মূলত বাদী হিসেবে নয়; বরং কেবলই তাঁর শোনা কথার বর্ণনাদাতা হিসেবে। অর্থাৎ তিনি মুহায়্যিসা রাযি.-এর নিকট যা-কিছু শুনেছেন হুবহু তা বর্ণনা করতে বলেছেন। যখন দাবির পর্যায় আসে, তখন আব্দুর রহমান রাযি.-কেই কথা বলতে বলা হয়েছিল। আবার এমনও হতে পারে যে, আব্দুর রহমান রাযি. তাঁদের দু'জনকে নিজের পক্ষ থেকে ওকিল বানিয়ে দিয়েছিলেন।
যাহোক মামলার পূর্ণ বিবরণ সামনে আসার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন, তোমরা কি কসম করবে এবং তোমাদের নিহত ব্যক্তির রক্তপণের অধিকার লাভ করবে?
বিভিন্ন বর্ণনায় বিস্তারিত আছে। সে অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাদীপক্ষকে বলেছিলেন— তোমাদের মধ্য থেকে ৫০ জন কসম খেয়ে তোমাদের নিহত ব্যক্তির রক্তপণ গ্রহণের অধিকার পেতে পার। তারা আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা কিভাবে হতে পারে? আমরা তো নিজ চোখে তা দেখিনি, সুতরাং কিভাবে কসম করব? তখন তিনি বললেন, তাহলে ইহুদীদের মধ্য থেকে ৫০ জন কসম খেয়ে অভিযোগ থেকে মুক্তি লাভ করুক। তারা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা তো একটি কাফের সম্প্রদায়। অর্থাৎ তারা মিথ্যা কসম করতে দ্বিধাবোধ করবে না। শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের পক্ষ থেকে তাদের রক্তপণ পরিশোধ করে দিলেন। তার পরিমাণ ছিল ১০০ উট। পরিভাষায় এ রক্তপণকে দিয়াত বলা হয়।
লক্ষণীয়, এ মামলায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবল সন্দেহের ভিত্তিতে ফয়সালা দান করেননি। নিহত ব্যক্তি একজন মুসলিম ও সাহাবী। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে ইহুদীদের এলাকায়। স্পষ্ট কথা সন্দেহের তির তাদের দিকেই যায়। তাদেরকে চাপে ফেলার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। দিয়াতের ১০০টি উট সম্মিলিতভাবে তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিপূর্ণ ইনসাফের পরিচয় দিলেন। তিনি দিয়াতের উট নিজের পক্ষ থেকে পরিশোধ করলেন। বাদীপক্ষও বঞ্চিত হলো না এবং বিবাদীরাও হয়রানির শিকার হলো না।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
হাদীছটির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শিক্ষা নিম্নরূপ :
ক. বয়সে যে বড় তাকে সম্মান দেখানো চাই। তার একটা দিক এইও যে, কথা বলার সময় বড়কে আগে বলার সুযোগ দেওয়া হবে।
খ. চাচাতো ভাই বা চাচাতো ভাতিজা কোনও বিপদের সম্মুখীন হলে 'চাচাতো' বলে পাশ কাটাতে নেই; বরং তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া চাই।
গ. সফরসঙ্গীর একটা হক হলো তার মসিবতে সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য-সহযোগিতা করা। সফরসঙ্গী মারা গেলে তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঘ. বিচারকের উচিত বিচারকার্যে পরিপূর্ণ ইনসাফের পরিচয় দেওয়া এবং উভয়পক্ষের উপর মমত্বপূর্ণ আচরণ করা।
এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল হিজরী ৭ম সালে। এখানকার অধিবাসীগণ ছিল ইহুদী। যুদ্ধে ইহুদীদের পরাজয় হয়। এখানকার সমস্ত দুর্গ ও জমি-জায়েদাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধিকারে চলে আসে। তিনি চাইলে সমস্ত ইহুদীকে এখান থেকে বিতাড়িত করতে পারতেন। তা না করে তিনি তাদের প্রতি দয়াপরবশ হন। তাদেরকে এ শর্তে এখানে থাকার অনুমতি দেন যে, তারা মুসলিমদের পক্ষে চাষাবাদের কাজ করবে। তাতে যে ফল ও ফসল উৎপন্ন হবে তার অর্ধেক তাদেরকে দেওয়া হবে। এভাবে বর্গাচাষের চুক্তিতে তারা এখানে অবস্থানের সুযোগ লাভ করে। কিন্তু ফিতনা-ফাসাদ বিস্তার করাই যাদের স্বভাব, তাদের পক্ষ থেকে শান্তিরক্ষার আশা কিভাবে করা যায়? গোপনে তারা একের পর এক দুষ্কৃতি করে যেতে থাকে। ইতিহাস ও হাদীছ গ্রন্থসমূহে তাদের দুষ্কৃতির নানা ঘটনা বর্ণিত আছে। এ হাদীছেও সেরকম একটা ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
ইহুদী এলাকায় একজন মুসলিম হত্যার ঘটনা
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন সাহল রাযি. ও মুহায়্যিসা ইবন মাস'উদ রাযি. খেজুর কেনার উদ্দেশ্যে খায়বার গিয়েছিলেন। সেখানে পৌঁছার পর তারা দু'জন খেজুরের সন্ধানে দুই দিকে চলে যান। পরে মুহায়্যিসা রাযি. সংবাদ পান যে, কে বা কারা আব্দুল্লাহ রাযি.-কে হত্যা করে ফেলেছে। সংবাদ পাওয়া মাত্র তিনি ছুটে আসেন। এসে দেখতে পান ঠিকই আব্দুল্লাহ রাযি.-কে হত্যা করা হয়েছে। তিনি রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে আছেন। সেখানকার ইহুদীদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাদের কেউ তাঁকে হত্যা করার কথা স্বীকার করল না। অগত্যা তিনি সেখানে তাঁর দাফন-কাফন সম্পন্ন করে মদীনা মুনাউওয়ারায় ফিরে আসলেন।
তারপর আব্দুল্লাহ ইবন সাহল রাযি.-এর ভাই আব্দুর রহমান ইবন সাহল রাযি. এবং মাস'উদের পুত্রদ্বয় মুহায়্যিসা রাযি. ও হুওয়ায়্যিসা রাযি. — এ তিনজন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাজির হলেন। তিনজনই একই গোত্রের লোক। সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা অর্থাৎ মুহায়্যিসা রাযি. ও হুওয়ায়্যিসা রাযি. ছিলেন আব্দুর রহমান রাযি.-এর পিতা সাহলের চাচাতো ভাই।
এদের মধ্যে আব্দুর রহমান ইবন সাহল রাযি. ছিলেন বয়সে সকলের ছোট। তিনি যেহেতু নিহতের ভাই, তাই বিচার প্রার্থনার জন্য সবার আগে তিনি কথা বলতে উদ্যত হলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বলে তাঁকে ক্ষান্ত করে দিলেন যে, বড়দের কথা বলতে দাও। সুতরাং তিনি ক্ষান্ত হয়ে গেলেন এবং অপর দু'জন কথা বললেন। বিভিন্ন বর্ণনা সামনে রাখলে বোঝা যায় মৌলিকভাবে কথা বলেছিলেন হুওয়ায়্যিসা রাযি। তিনি বয়সে সকলের বড় ছিলেন। বিভিন্ন বর্ণনায় যে দু'জনই কথা বলেছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তা এ হিসেবে যে, সম্ভবত হুওয়ায়্যিসা রাযি. -এর কথা বলার মাঝে মাঝে প্রয়োজনে মুহায়্যিসা রাযি.-ও দু’-একটি কথা বলেছিলেন।
প্রকাশ থাকে যে, এ ঘটনায় হুওয়ায়্যিসা রাযি. উপস্থিত ছিলেন না। উপস্থিত ছিলেন মুহায়্যিসা রাযি.। তবে মামলার মূল বাদী ছিলেন নিহতের ভাই আব্দুর রহমান রাযি। একই খান্দানের হওয়ায় আব্দুর রহমান রাযি.-এর সহযোগী হিসেবে অপর দু'জন উপস্থিত হয়েছিলেন। তাছাড়া মুহায়্যিসা রাযি. তো আব্দুল্লাহ রাযি.-এর সফরসঙ্গীই ছিলেন এবং দাফন-কাফনের কাজও তিনিই সম্পন্ন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বয়োজ্যেষ্ঠ হুওয়ায়্যিসা রাযি.-কে যে কথা বলতে বলেছিলেন তা মূলত বাদী হিসেবে নয়; বরং কেবলই তাঁর শোনা কথার বর্ণনাদাতা হিসেবে। অর্থাৎ তিনি মুহায়্যিসা রাযি.-এর নিকট যা-কিছু শুনেছেন হুবহু তা বর্ণনা করতে বলেছেন। যখন দাবির পর্যায় আসে, তখন আব্দুর রহমান রাযি.-কেই কথা বলতে বলা হয়েছিল। আবার এমনও হতে পারে যে, আব্দুর রহমান রাযি. তাঁদের দু'জনকে নিজের পক্ষ থেকে ওকিল বানিয়ে দিয়েছিলেন।
যাহোক মামলার পূর্ণ বিবরণ সামনে আসার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন, তোমরা কি কসম করবে এবং তোমাদের নিহত ব্যক্তির রক্তপণের অধিকার লাভ করবে?
বিভিন্ন বর্ণনায় বিস্তারিত আছে। সে অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাদীপক্ষকে বলেছিলেন— তোমাদের মধ্য থেকে ৫০ জন কসম খেয়ে তোমাদের নিহত ব্যক্তির রক্তপণ গ্রহণের অধিকার পেতে পার। তারা আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা কিভাবে হতে পারে? আমরা তো নিজ চোখে তা দেখিনি, সুতরাং কিভাবে কসম করব? তখন তিনি বললেন, তাহলে ইহুদীদের মধ্য থেকে ৫০ জন কসম খেয়ে অভিযোগ থেকে মুক্তি লাভ করুক। তারা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা তো একটি কাফের সম্প্রদায়। অর্থাৎ তারা মিথ্যা কসম করতে দ্বিধাবোধ করবে না। শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের পক্ষ থেকে তাদের রক্তপণ পরিশোধ করে দিলেন। তার পরিমাণ ছিল ১০০ উট। পরিভাষায় এ রক্তপণকে দিয়াত বলা হয়।
লক্ষণীয়, এ মামলায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবল সন্দেহের ভিত্তিতে ফয়সালা দান করেননি। নিহত ব্যক্তি একজন মুসলিম ও সাহাবী। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে ইহুদীদের এলাকায়। স্পষ্ট কথা সন্দেহের তির তাদের দিকেই যায়। তাদেরকে চাপে ফেলার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। দিয়াতের ১০০টি উট সম্মিলিতভাবে তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিপূর্ণ ইনসাফের পরিচয় দিলেন। তিনি দিয়াতের উট নিজের পক্ষ থেকে পরিশোধ করলেন। বাদীপক্ষও বঞ্চিত হলো না এবং বিবাদীরাও হয়রানির শিকার হলো না।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
হাদীছটির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শিক্ষা নিম্নরূপ :
ক. বয়সে যে বড় তাকে সম্মান দেখানো চাই। তার একটা দিক এইও যে, কথা বলার সময় বড়কে আগে বলার সুযোগ দেওয়া হবে।
খ. চাচাতো ভাই বা চাচাতো ভাতিজা কোনও বিপদের সম্মুখীন হলে 'চাচাতো' বলে পাশ কাটাতে নেই; বরং তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া চাই।
গ. সফরসঙ্গীর একটা হক হলো তার মসিবতে সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য-সহযোগিতা করা। সফরসঙ্গী মারা গেলে তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঘ. বিচারকের উচিত বিচারকার্যে পরিপূর্ণ ইনসাফের পরিচয় দেওয়া এবং উভয়পক্ষের উপর মমত্বপূর্ণ আচরণ করা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)


বর্ণনাকারী: