আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

১৮- তাহাজ্জুদ - নফল নামাযের অধ্যায়

হাদীস নং: ১১১৪
আন্তর্জতিক নং: ১১৮৫

পরিচ্ছেদঃ ৭৫০. নফল নামায জামাআতে আদায় করা।
এ বিষয়ে আনাস ও আয়িশা (রাযিঃ) নবী করীম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেছেন।

১১১৪। ইসহাক (রাহঃ) ......... ইবনে শিহাব (রাহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মাহমুদ ইবনে রবী’ আনসারী (রাযিঃ) আমাকে খবর দিয়েছেন, (শৈশবে তাঁর দেখা) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কথা তাঁর ভাল স্মরণ আছে এবং নবী (ﷺ) তাঁদের বাড়ির কূপ থেকে পানি মুখে নিয়ে (বরকতের জন্য) তার মুখমণ্ডলে যে ছিটিয়ে দিচ্ছিলেন সে কথাও তার ভাল স্মরণ আছে।
মাহমুদ (রাযিঃ) বলেন যে, ইতবান ইবনে মালিক আনসারী (রাযিঃ)-কে [যিনি ছিলেন বদর জিহাদে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সঙ্গে উপস্থিত বদরী সাহাবীগণের অন্যতম] বলতে শুনেছেন যে, আমি আমার কওম বনু সালিমের নামাযে ইমামতি করতাম। আমার ও তাদের (কওমের মসজিদের) মধ্যে বিদ্যমান একটি উপত্যকা। উপত্যকায় বৃষ্টি হলে আমার মসজিদ গমনে তা অন্তরায় সৃষ্টি করতো এবং এ উপত্যকা অতিক্রম করে তাদের মসজিদে যাওয়া আমার জন্য কষ্টকর হতো। তাই আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর খিদমতে হাজির হয়ে আরয করলাম, (ইয়া রাসূলাল্লাহ!) আমি আমার দৃষ্টিশক্তির ঘাটতি অনুভব করছি, (এ ছাড়া) আমার ও আমার গোত্রের মধ্যকার উপত্যকাটি বৃষ্টি হলে প্লাবিত হয়ে যায়। তখন তা পার হওয়া আমার জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ে। তাই আমার একান্ত আশা যে, আপনি শুভাগমন করে (বরকত স্বরূপ) আমার ঘরের কোন স্থানে নামায আদায় করবেন; আমি সে স্থানটিকে মুসল্লা (নামাযের স্থানরূপে নির্ধারিত) করে নিব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, অচিরেই তা করবো।
পরের দিন সূর্যের উত্তাপ যখন বেড়ে গেল, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং আবু বকর (রাযিঃ) (আমার বাড়িতে) তাশরীফ আনলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) (ঘরে প্রবেশের) অনুমতি চাইলে আমি তাঁকে স্বাগত জানালাম, তিনি উপবেশন না করেই আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার ঘরের কোন জায়গায় আমার নামায আদায় করা তুমি পছন্দ কর? যে স্থানে তাঁর নামায আদায় করা আমার মনঃপূত ছিল, তাঁকে আমি সে স্থানের দিকে ইশারা করে (দেখিয়ে) দিলাম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দাঁড়িয়ে তাকবীর বললেন, আমরা সারিবদ্ধভাবে তাঁর পিছনে দাঁড়ালাম। তিনি দু’রাকআত নামায আদায় করে সালাম ফিরালেন। তাঁর সালাম ফিরানোর সময় আমরাও সালাম ফিরালাম। এরপর তাঁর উদ্দেশ্যে যে খাযীরা (মাংস ও আটা যোগে রান্নাকৃত খাবার) প্রস্তুত করা হচ্ছিল তা আহারের জন্য তাঁর প্রত্যাগমনে আমি বিলম্ব ঘটালাম।
ইতিমধ্যে মহল্লার লোকেরা আমার বাড়ীতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর অবস্থান সংবাদ শুনতে পেয়ে তাঁদের কিছু লোক এসে গেলেন। এমন কি আমার ঘরে অনেক লোকের সমাগম ঘটলো। তাঁদের একজন বললেন, মালিক (ইবনে দুখায়শিন) করল কি? তাঁকে দেখছি না যে? তাঁদের একজন জবাব দিল, সে মুনাফিক! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মুহাব্বত করে না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করলেনঃ এমন কথা বলবে না। তুমি কি লক্ষ্য করছ না, সে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনায় ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ উচ্চারণ করেছে। সে ব্যক্তি বলল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই সমধিক অবগত। তবে আল্লাহর কসম! আমরা মুনাফিকদের সাথেই তার ভালবাসা ও আলাপ-আলোচনা দেখতে পাই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করলেনঃ আল্লাহ পাক সে ব্যক্তিকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দিয়েছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ উচ্চারণ করে।
মাহমুদ (রাযিঃ) বলেন, এক যুদ্ধ চলাকালিন সময়ে একদল লোকের কাছে এই হাদীস বর্ণনা করলাম তাঁদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সাহাবী আবু আইয়ুব (আনসারী) (রাযিঃ) ছিলেন। তিনি সে যুদ্ধে ওফাত পেয়েছিলেন। আর ইয়াযীদ ইবনে মুআবিয়া (রাযিঃ) রোমানদের দেশে তাদের আমীর ছিলেন। আবু আইয়ুব (রাযিঃ) আমার বর্ণিত হাদীসটি অস্বীকার করে বললেন, আল্লাহর কসম! তুমি যে কথা বলেছ তা যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, তা আমি বিশ্বাস করতে পারি না। ফলে তা আমার কাছে ভারী মনে হল। তখন আমি আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা করলাম যে, যদি এ যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত তিনি আমাকে নিরাপদ রাখেন, তাহলে আমি ইতবান ইবনে মালিক (রাযিঃ)-কে তাঁর কওমের মসজিদের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করবো, যদি তাঁকে জীবিত অবস্থায় পেয়ে যাই। এরপর আমি ফিরে চললাম এবং হজ্জ কিংবা উমরার নিয়তে ইহরাম করলাম। তারপর সফর করতে করতে আমি মদীনায় উপনীত হয়ে বনু সালিম গোত্রে উপস্থিত হলাম। দেখতে পেলাম ইতবান (রাযিঃ) যিনি তখন একজন বৃদ্ধ ও অন্ধ অবস্থায় কওমের নামাযে ইমামতি করছেন। তিনি নামায শেষ করলে আমি তাঁকে সালাম দিলাম এবং আমার পরিচয় দিয়ে উক্ত হাদীস সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি প্রথমবারের মতই অবিকল আমাকে হাদীসখানা শোনালেন।

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ

হযরত ইতবান ইবন মালিক রাযি. নিজ গোত্র বনূ সালিমের মসজিদের ইমাম ছিলেন। তাঁর দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। শেষদিকে তিনি পরিপূর্ণ অন্ধই হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর দৃষ্টিশক্তি যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখনকার কথা এ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। তাঁর বাড়ি থেকে মসজিদে আসতে একটি উপত্যকা পার হতে হতো। বৃষ্টি হলে পাহাড়ি ঢলে উপত্যকা ভরে যেত। ফলে তাঁর পক্ষে সেটি পার হয়ে মসজিদে আসা সম্ভব হতো না, যেমনটা তিনি এ হাদীছে বর্ণনা করেছেন। তিনি চাচ্ছিলেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বাড়িতে এসে নির্দিষ্ট একটি স্থানে নামায পড়লে তিনি বরকতস্বরূপ সে স্থানটিকে নিজ নামাযের স্থানরূপে গ্রহণ করতেন। তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এর জন্য অনুরোধ করলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর অনুরোধ রক্ষা করেন। একদিন তিনি সূর্যোদয়ের পর বেলা চড়ে আসলে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে সঙ্গে নিয়ে তাঁর বাড়িতে আসেন। পরে হযরত উমর ফারূক রাযি.-ও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। দিনটি ছিল শনিবার। তিনি হযরত ইতবান রাযি.-এর দেখানো স্থানে সকলকে নিয়ে দু' রাক'আত নামায আদায় করেন। তারপর তাঁর সামনে খাযীরা পেশ করা হয়। খাযীরা হল আটার সঙ্গে চর্বি মিশিয়ে তৈরি করা এক প্রকার খাদ্য। তিনি তা খেয়ে নেন। ইত্যবসরে মহল্লায় তাঁর আগমনের খবর ছড়িয়ে পড়লে লোকজন জমা হয়ে যায়। হযরত মালিক ইবন দুখশুম রাযি. এ গোত্রেরই একজন সাহাবী। উপস্থিত লোকজনের মধ্যে তাঁকে দেখা না যাওয়ায় তাঁকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। কেউ একজন তাঁকে মুনাফিকও বলে বসে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে মন্তব্যের প্রতিবাদ করেন এবং তাঁর পক্ষে সাক্ষ্য দেন যে, তিনি আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টির জন্যই কালেমায়ে তায়্যিবা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করে থাকেন। এটা তাঁর মুমিন হওয়ার দলীল। এক বর্ণনায় আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বলে মন্তব্যকারীর প্রতিবাদ করেছিলেন যে, সে কি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি? ইবন ইসহাক রহ. তার মাগাযী গ্রন্থে এ কথাও বর্ণনা করেছেন যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মালিক ইবন দুখশুম ও মা'ন ইবন 'আদী রাযি.-কে মুনাফিকদের প্রতিষ্ঠিত মসজিদ- মসজিদে যিরার ধ্বংস করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। তাঁরা সেটি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। এটাও তাঁর খাঁটি মুমিন হওয়া ও মুনাফিকী থেকে মুক্ত থাকার প্রমাণ বহন করে। যারা তাঁকে মুনাফিক বলে মন্তব্য করেছিলেন তারা এর কারণ দেখিয়েছিলেন এই যে, তাঁকে মুনাফিকদের সঙ্গে উঠাবসা করতে দেখা যায়। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের দেখানো এ কারণটিকে তাঁর মুনাফিকীর দলীলরূপে গ্রহণ করেননি। সম্ভবত তাদের সঙ্গে তাঁর উঠাবসা করার বিশেষ কোনও কারণ ছিল। সবশেষে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কালেমায়ে তায়্যিবার ফযীলত বয়ান করেছেন যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এটা পাঠ করে, অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এ ঘোষণা দান করে, আল্লাহ তা'আলা তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দেন। এ হারাম হওয়ার অর্থ ওই ব্যক্তির কবীরা গুনাহ না থাকলে জাহান্নামে আদৌ যাবে না। যদি কবীরা গুনাহ থাকে এবং আল্লাহ তা'আলা ক্ষমা করে দেন, তখনও সে জাহান্নামে যাবে না। আল্লাহ তা'আলা ক্ষমা না করলে নির্দিষ্ট মেয়াদে শাস্তিভোগ করার পর সে জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ করবে। এ কালেমার কারণে তাকে অনন্তকাল জাহান্নামে থাকতে হবে না। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. কারও বিশেষ ওজর থাকলে সে মসজিদে না গিয়ে ফরয নামায নিজ ঘরেও আদায় করতে পারে। খ. তাবাররুকের ধারণা ইসলামবিরোধী নয়। তাবাররুক হিসেবেই হযরত ইতবান ইবন মালিক রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায আদায়ের স্থানকে নিজের জন্য নামাযের স্থানরূপে গ্রহণ করেছিলেন। গ. কারও বাড়িতে বিশেষ কোনও বুযুর্গ ব্যক্তির শুভাগমন হলে মহল্লার লোকজনের উচিত তার সঙ্গে দেখা করতে আসা এবং কিছুক্ষণ তার সাহচর্যে কাটানো। বাড়িওয়ালারও উচিত তাদেরকে সেই সুযোগ দেওয়া। ঘ. অকাট্য কারণ ছাড়া কালেমা পাঠকারী কোনও ব্যক্তিকে মুনাফিক বলা উচিত নয়। কেননা দিলের খবর আল্লাহ তা'আলা ছাড়া কেউ জানে না। ঙ. সঙ্গত কারণ ছাড়া কাফের-মুশরিক ও ফাসেক-ফাজেরদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করা উচিত না। তাতে অন্যদের মনে অহেতুক সন্দেহ সৃষ্টি হয়। অহেতুক সন্দেহ সৃষ্টি হতে দেওয়া সমীচীন নয়। চ. আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে যে ব্যক্তি কালেমা পাঠ করে আর এ অবস্থায় মারা যায়, জাহান্নামের স্থায়ী শাস্তি তার জন্য নয়।


tahqiq

তাহকীক:

তাহকীক নিষ্প্রয়োজন