আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

১৮- তাহাজ্জুদ - নফল নামাযের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ১১৫১
৭৩২. ইবাদতে কঠোরতা অবলম্বন করা অপছন্দনীয়।
১০৮৪। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসলামা (রাহঃ) ......... উম্মুল মু'মিনীন আয়িশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বনু আসাদের এক মহিলা আমার কাছে উপস্থিত ছিলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমার কাছে আগমন করলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, এ মহিলাটি কে? আমি বললাম, অমুক। তিনি রাতে ঘুমান না। তখন তাঁর নামাযের কথা উল্লেখ করা হলে তিনি (নবী ﷺ) বললেনঃ রেখে দাও। সাধ্যানুযায়ী আমল করতে থাকাই তোমাদের কর্তব্য। কেননা, আল্লাহ্ তাআলা (সাওয়াব প্রদানে) বিরক্ত হন না, যতক্ষণ না তোমরা বিরক্ত ও ক্লান্ত হয়ে পড়।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে যে ইবাদতগুযার মহিলার কথা বলা হয়েছে তার নাম হাওলা বিনত তুয়াইত। তিনি কুরায়শ বংশের বনূ আসাদের লোক ছিলেন। খুব বেশি ইবাদত-বন্দেগী করতেন। রাতে একটুও ঘুমাতেন না, যে কারণে মানুষের মুখে মুখে তার ইবাদতের চর্চা ছিল। লোকে বলত, মদীনার নারীদের মধ্যে সবচে' 'ইবাদত-বন্দেগী তিনিই করে থাকেন।

হযরত ‘আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. যখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশ্নের উত্তরে ওই মহিলার পরিচয় দিলেন এবং তার ইবাদত-বন্দেগীর প্রশংসা করলেন, তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিরক্তি প্রকাশ করে তাঁকে থেমে যেতে বললেন।

তাঁর বিরক্তির কারণ- শরীরের বিশ্রাম ত্যাগ করে এত বেশি ইবাদত-বন্দেগী করা পসন্দনীয় নয়। কেননা তাতে একপর্যায়ে ক্লান্তি আসে এবং শরীর ভেঙে পড়ে। তখন আর ‘ইবাদত-বন্দেগী চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে এতদিন আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিজের পক্ষ থেকে যে আবদিয়াত ও দাসত্ব নিবেদন করা হচ্ছিল এবং তাঁর প্রতি রুজ ও বন্দেগী-আনুগত্যের সিলসিলা জারি ছিল তা বন্ধ হয়ে যায়। এটা একরকম বিমুখতা। এটা যেন আল্লাহর দরবারে কিছুদিন হাজির হওয়ার পর গরহাজির হয়ে যাওয়া, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়। তাই তিরস্কার করে বলেছেন, থাম! অর্থাৎ সে যা করছে তা প্রশংসার বিষয় নয় যে, এত আগ্রহের সাথে বলছ।

অথবা এ তিরস্কার করেছেন ওই মহিলাকে। তাকে বলছেন, থাম। “ইবাদত বন্দেগীতে এত বাড়াবাড়ি করো না; বরং মধ্যপন্থা রক্ষা কর। যতটুকু নিয়মিতভাবে করে যাওয়া সম্ভব অতটুকুই কর।
তারপর বলা হয়েছে- আল্লাহ ক্লান্ত হন না, যাবৎ না তোমরা ক্লান্ত হয়ে পড়। আল্লাহ তা'আলার ক্ষেত্রে ‘ক্লান্ত হয়ে যাওয়া' কথাটির ব্যবহার আক্ষরিক অর্থে হতে পারে না। কেননা আল্লাহ তা'আলার পক্ষে ক্লান্ত হওয়া অসম্ভব। এটা একটা মানবীয় দুর্বলতা। আল্লাহ তা'আলা সমস্ত দুর্বলতার ঊর্ধ্বে। বস্তুত এখানে ক্লান্ত হওয়ার দ্বারা রূপকার্থে ‘কাজের ছাওয়াব ও প্রতিদান দেওয়া বন্ধ করা' বোঝানো উদ্দেশ্য, যেমনটা ইমাম নববী রহ. ব্যাখ্যা করেছেন। এর সমর্থন পাওয়া যায় হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বর্ণিত একটি হাদীছ দ্বারা। তাতে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ-

اكلفوا من العمل ما تطيقون، فإن الله لا يمل من الثواب حتى تملوا من العمل

“তোমরা অতটুকু আমলেরই ভার গ্রহণ কর, যতটুকু তোমরা করতে পারবে। কেননা আল্লাহ তা'আলা ছাওয়াব দেওয়া বন্ধ করেন না, যাবত না তোমরা আমল বন্ধ করে দাও।” তাফসীর ইবন কাছীর, ৮ম খ., ২৫৪ পৃ.
ইমাম মা'যিরী (مأزري) রহ. বলেন, এখানে حتى অব্যয়টি و অর্থে ব্যবহৃত। সে হিসেবে অর্থ হবে- আল্লাহ ক্লান্ত হবেন না, অথচ তোমরা ক্লান্ত হয়ে পড়বে।

সবশেষে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম 'ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে একটি মূলনীতি হিসেবে বলেন যে, আল্লাহ তা'আলার কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় আমল তাই, যা আমলকারী নিয়মিতভাবে করে। কেননা যে ব্যক্তি নিয়মিতভাবে আমল করে সে ওই ব্যক্তির মত, যে বাদশার দরবারে নিয়মিতভাবে আসা-যাওয়া করে। যে ব্যক্তি কখনও হাজির হয় আবার কখনও গরহাজির থাকে, সে বাদশার অতটা প্রিয় হতে পারে না, যতটা নিয়মিত হাজিরাদাতা হয়ে থাকে। অনুরূপ যে ব্যক্তি নিয়মিত ইবাদত বন্দেগী চালিয়ে যায়, সে যেন মাওলার দরবারের একজন নিয়মিত হাজিরাদাতা। স্বাভাবিকভাবেই সে আল্লাহর বেশি প্রিয়ভাজন হবে। তাছাড়া কোনও ইবাদত কিছুদিন করার পর ছেড়ে দেওয়াটা গরহাজির হয়ে পড়ার মত। এতে কেমন যেন বিমুখতা ও অনীহা ভাব প্রকাশ পায়, যা একরকম বেআদবীও বটে। অনুপস্থিতির সে বেআদবী যাতে না হয়ে যায় এবং ছাওয়াব পাওয়ার সিলসিলা যাতে বন্ধ না হয়, সেজন্য উচিত যতটুকু পরিমাণ আমল নিয়মিত করা যাবে অতটুকুই গ্রহণ করা, তা অল্পই হোক না কেন। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছেঃ-

أحب الأعمال إلى الله أدومها وإن قل

“আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় আমল তা-ই, যা স্থায়ী হয়, যদিও সে আমল অল্প পরিমাণ হয়। " সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৮৬১; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৭৮২। সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ১৩৬৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৮৫৬; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৭৬২; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪২৪০. মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৬৩০৮

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কারও কোনও কাজে প্রশংসা করার আগে সে কাজটি কতটুকু সঠিক তা ভালোভাবে বুঝে নেওয়া উচিত।

খ. কোনও জ্ঞানীজনের সামনে কেউ কোনও অনুচিত কথা বললে বা অনুচিত কাজ করলে তার উচিত তা সংশোধন করে দেওয়া।

গ. আল্লাহর কাছে যেহেতু স্থায়ী আমলই বেশি পসন্দনীয়, তাই নফল ইবাদত এতটুকু পরিমাণেই শুরু করা উচিত, যা নিয়মিত চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন