মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

مشكاة المصابيح للتبريزي

গ্রন্থকারের ভূমিকা - এর পরিচ্ছেদসমূহ

মোট হাদীস টি

অনুসন্ধান করুন

details icon

পরিচ্ছেদঃ মিশকাত গ্রন্থকারের ভূমিকা
অনুবাদ: সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ তা'আলার। আমরা তাঁরই প্রশংসা করছি, তাঁরই সাহায্য চাচ্ছি এবং অন্তরের যাবতীয় কুমন্ত্রণা ও অন্যায় কর্মসমূহ হতে তাঁরই নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। যাকে মহান আল্লাহ পথ প্রদর্শন করেন, তাকে কেউই পথভ্রষ্ট করতে পারে না। আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন তাকে পথ দেখাবার শক্তিও করো নেই।আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ তা'আলা ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। আর এ সাক্ষ্যই হলো (আমার) মুক্তি লাভের একমাত্র উপায় এবং উঁচু মর্যাদা লাভের মাধ্যম। আমি আরও ঘোষণা করছি যে, হযরত মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। আল্লাহ তা'আলা তাঁকে এমন এক সময় প্রেরণ করেছেন, যখন জ্যোতিসমূহ নিভে গেছে, তার স্তম্ভসমূহ দুর্বল হয়ে গেছে এবং তার স্থানসমূহ পর্যন্তও বিস্তৃত হয়ে গেছে। অতঃপর তিনি নবী করীম (ﷺ) এসে সেই স্তম্ভ ও নিশানাগুলোকে দৃঢ়ভাবে স্থাপন করলেন, যেগুলো ইতঃপূর্বে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। আর যারা গোমরাহীর আবর্তে পড়ে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল তাদেরকে তিনি তাওহীদের কালিমার সাহায্যে আরোগ্য করলেন। আর যারা হিদায়েতের পথ অন্বেষণ করছিল তাঁদেরকে তিনি সরল পথের সন্ধান দিলেন এবং যারা সৌভাগ্য ভাণ্ডারের অধিকারী হতে ইচ্ছা করেছিল তিনি তাঁদেরকে তা লাভের পথ উন্মুক্ত করে দিলেন।

অতঃপর [মনে রাখতে হবে যে] মহানবী (ﷺ) এর আদর্শ আঁকড়ে ধরা যথার্থ হয় না যতক্ষণ না তাঁর আলোকদান তথা মুখনিঃসৃত বাণীসমূহের পরিপূর্ণ অনুসরণ করা হয়। আর আল্লাহ তা'আলার রশি (তথা কুরআন]-কে শক্ত করে ধারণ করা পরিপূর্ণ হবে না যতক্ষণ না তাঁর পক্ষ হতে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়। আর ইমাম মুহিউস সুন্নাহ (সুন্নত পুনর্জীবন দানকারী) কামিউল বিদআহ বিদআত নির্মূলকারী আবু মুহাম্মাদ হুসাইন ইবনে মাসউদ আল-ফাররা আল-বাগাবী [আল্লাহ তা'আলা তাঁর মর্যাদা উঁচু করুন।] কর্তৃক সংকলিত 'মাসাবীহ' নামক হাদীসের কিতাবটি তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়ে রচিত একখানা সমৃদ্ধ গ্রন্থ এবং [হাদীসের বিভিন্ন গ্রন্থাবলিতে] আপাত বিক্ষিপ্ত ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন বিষয়ের হাদীসমূহের একটি সুবিন্যস্ত ও সুলিখিত কিতাব। গ্রন্থকার যখন সংক্ষিপ্ততার পথ অবলম্বন করলেন এবং সনদসমূহকে বিলুপ্ত করে দিলেন, তখন কিছু সংখ্যক সমালোচক এর সমালোচনায় প্রবৃত্ত হন। যদিও তাঁর মতো একজন নির্ভরশীল ব্যক্তির হাদীসের উৎকলন ও সংকলনই সনদতুল্য তবু এটা অনস্বীকার্য যে, চিহ্নযুক্ত পথ বা জায়গা অপরিচিত ও চিহ্নবিহীন জায়গার মতো নয়। [অর্থাৎ 'সনদবিহীন' গ্রন্থ সনদবিশিষ্ট গ্রন্থের মতো হতে পারে না।] অতএব আমি আল্লাহ তা'আলার নিকট কল্যাণ কামনা করলাম এবং [এ ব্যাপারে একটি সমাধানের জন্য] তাঁর নিকট তৌফিক প্রার্থনা করলাম। অতঃপর তিনি যা উল্লেখ করেননি, আমি তার যথাস্থান নির্দেশ করেছি এবং মাসাবীহ]-এর প্রতিটি হাদীসকে তার স্বস্থানে সন্নিবেশীত করেছি। যেমনিভাবে সুদৃঢ় প্রজ্ঞার অধিকারী ইমামগণ [শাস্ত্রজ্ঞগণ] এবং আস্থা ভাজন ও লব্ধ প্রতিষ্ঠ হাদীসবিদগণ বর্ণনা করেছেন। যেমন- ১. আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী (জন্ম ১৯৪ হি: মৃঃ ২৫৬ হি:। ২. আবুল হুসাইন মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ আল-কুশায়রী (জন্ম ২০৪ হিঃ মৃ: ২৬১ হি.]। ৩. আবু আব্দুল্লাহ মালিক ইবনে আনাস আল-আসবাহী (জন্ম ৯৩ হি: মৃঃ ১৭৯ হিঃ ]। ৪. আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে ইদ্রীস শাফেয়ী (জন্ম ১৫০ হি: মৃ: ২০৪ হিঃ ]। ৫.আবু আব্দুল্লাহ আহমদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে হাম্বল আশ-শায়বানী জন্ম ১৬৪ হি: মৃ: ২৪১ হিঃ।। ৬.আবু ঈসা মুহাম্মাদ ইবনে ঈসা আত-তিরমিযী (জন্ম ২০৯ হি: মৃ: ২৭৯ হিঃ ]। ৭.আবু দাউদ সুলাইমান ইবনে আশআছ আস-সিজিস্তানী (জন্ম ২০২ হিঃ মৃঃ ২৭৫ হিঃ।।
৮. আবু আব্দুর রহমান আহমদ ইবনে শোয়াইব আন-নাসাঈ (জন্ম ২১৫ হি: মৃঃ ৩০৩ হি:] ৯. | আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াযীদ ইবনে মাজাহ আল-কাযবীনী (জন্ম ২০৯ হিঃ মৃ: ২৭৩ হিঃ ]। ১০.আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান আদ-দারিমী (জন্ম ১৮১ হি: মৃঃ ২৫৫ হি: ১১. আবুল হাসান আলী ইবনে ওমর আদ-দারাকুতনী (জন্ম ৩০৬ হি: মৃ: ৩৮৫ হি: ১২, আবু বকর আহমদ ইবনে হুসাইন আল-বায়হাকী (জন্ম ৩৮৪ হিঃ মুঃ ৪৫৮ হিঃ। ১৩. এবং আবুল হাসান রাযীন ইবনে মুয়াবিয়া আল-আব্দারী [মৃত্যু ৫৩৫ হি:) প্রমুখ মুহাদ্দেসীনে কেরাম। আর এ ছাড়া স্বল্প সংখ্যক অন্য বর্ণনাকারীও রয়েছেন। আর যখন আমি কোনো হাদীসকে কোনো ইমামের দিকে সম্পর্কিত করেছি (অর্থাৎ হাদীসের শেষে কোনো ইমামের নাম উল্লেখ করেছি। তখন [পাঠকের] বুঝতে হবে যে, আমি উক্ত হাদীসকে নবী করীম (ﷺ)পর্যন্ত সনদ নির্ভর করে দিয়েছি। কেননা, তাঁরা তাঁদের গ্রন্থে উক্ত কার্য সুসম্পন্ন করেছেন এবং আমাদেরকেও অব্যাহতি দান করেছেন। আর আমি পর্ব এবং অধ্যায়সমূহকে সেভাবে সাজিয়েছি যেভাবে মাসাবীহ গ্রন্থকার সাজিয়েছিলেন এবং এ ব্যাপারে তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছি। আর আমি প্রায় প্রতিটি অধ্যায়কে তিনটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত করেছি। প্রথম পরিচ্ছেদে সেসব হাদীস সন্নিবেশীত করেছি যা ইমাম বুখারী ও মুসলিম অথবা তাঁদের কোনো একজন বর্ণনা করেছেন। তাঁরা ছাড়া ঐ হাদীসগুলো অন্যান্যরা বর্ণনা করলেও তাঁদের সুউচ্চ মর্যাদার প্রতি দৃষ্টি রেখে কেবলমাত্র তাঁদের দু'জনের নাম উল্লেখ করাটাকেই আমি যথেষ্ট মনে করেছি। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বুখারী-মুসলিম ব্যতীত উল্লিখিত অন্যান্য ইমামগণের বর্ণনাকৃত হাদীস এনেছি। আর তৃতীয় পরিচ্ছেদে আমি আলোচ্য অধ্যায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট ও সাদৃশ্যপূর্ণ হাদীসসমূহ বর্ণনা করেছি। অবশ্য এ ব্যাপারে হাদীস বর্ণনার যাবতীয় শর্তাবলি বজায় রেখেছি। [অর্থাৎ প্রতিটি হাদীসের সাথে রাবীর নাম এবং যে কিতাব হতে নেওয়া হয়েছে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে।] যদিও এর কিছু পূর্ববর্তী [সাহাবী) এবং পরবর্তীদের [তাবেয়ীদের] থেকে বর্ণিত।

অতঃপর যদি তুমি (ইমাম বাগাবীর) সংগৃহীত কোনো হাদীস [আমার গ্রন্থের] কোনো অধ্যায়ে না পাও, তখন মনে রাখবে যে, অন্য অধ্যায়ে এরূপ হাদীস রয়েছে বলেই আমি তা বাদ দিয়েছি। আবার যদি সংক্ষিপ্ততার কারণে কোনো হাদীসের কিছু অংশ পরিত্যক্ত অথবা পরিপূর্ণতার লক্ষ্যে অতিরিক্ত সংযোজন দেখতে পাও, তবে বুঝতে হবে যে, বিশেষ কোনো প্রয়োজনের তাগিদেই বাদ দিয়েছি বা সংযোজন করেছি। এমনিভাবে ইমাম বাগাবীর সাথে যদি আমার কোথাও কোনো মতভেদ বুঝতে পার। যেমন- দু' পরিচ্ছেদের প্রথম পরিচ্ছেদে শায়খাইন ব্যতীত অন্য কারো নাম উল্লেখ করেছি এবং দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে উক্ত দু'জনের কারো নাম উল্লেখ করেছি; তবে জেনে রাখবে যে, ইমাম হুমাইদী কৃত الجمع بين الصحيحين এবং ইমাম জাযারী কৃত جامع الأصول কিতাবদ্বয়ের মধ্যে অনুসন্ধানের পরই ইমাম বুখারী ও মুসলিমের সহীহ কিতাবদ্বয়ের মূলগ্রন্থ ও মতনের উপর নির্ভর করেছি। আর যদি তুমি মূল হাদীসে কোনো প্রকার পার্থক্য দেখতে পাও তাহলে বুঝতে হবে যে, হাদীসের সনদের বিভিন্নতার কারণেই তা হয়েছে। অথবা এ কারণে যে, সম্ভবত ইমাম বাগাবী (র.) যে রিওয়ায়াত বর্ণনা করেছেন আমি তা অবগত হইনি। আর এরূপ স্থান খুব কমই দেখতে পাবে যে, আমি বলেছি “হাদীসের প্রসিদ্ধ কিতাবসমূহে এটা পাইনি" অথবা “এর বিপরীত পেয়েছি"। যখন তুমি এরূপ পাও তখন দোষত্রুটি আমার দিকেই ফিরিয়ে দেবে যে, আমার অনুসন্ধানের সীমাবদ্ধতার কারণেই এরূপ হয়েছে; এটার ত্রুটি ইমাম বাগাবীর দিকে ফিরাবে না। আল্লাহ তা'আলা উভয় জাহানে তাঁর মর্যাদাকে উঁচু করুন। এরূপ অভিযোগ উত্থাপন থেকে আল্লাহর পানাহ। সে ব্যক্তির উপর আল্লাহ রহম করুন, যে এরূপ কোনো ত্রুটি সম্পর্কে অবগত হলে সে আমাকে তা জানাবে এবং সঠিক বিষয়ের দিকে পথ দেখাবে। তবে এটা সত্য যে, আমি আমার সাধ্য ও সামর্থ্য মুতাবিক তাহকীক ও অনুসন্ধানের কাজে কোনোরূপ ত্রুটি করিনি।
আর এ [হাদীস বর্ণনার] ক্ষেত্রে আমি রিওয়ায়াতের বিভিন্নতা যেভাবে পেয়েছি সেভাবে বর্ণনা করেছি। আর তিনি যেসব হাদীসের ব্যাপারে ‘গারীব’ অথবা 'যা'ঈফ' ইত্যাদির দিকে ইশারা করেছেন, অধিকাংশ স্থানে আমি তার কারণ বর্ণনা করেছি। আর যেসব হাদীসকে প্রসিদ্ধ কিতাবসমূহে 'গারীব', 'যা'ঈফ' বলা সত্ত্বেও তিনি তার প্রতি কোনো প্রকার ইঙ্গিত করেননি আমি তাতে তার অনুসরণ করেছি। তবে কোনো কোনো স্থানে প্রয়োজনবোধে আমি এর ব্যতিক্রমও করেছি। আর কোনো কোনো স্থানে এরূপও দেখতে পাবে, যেখানে আমি কারও উদ্ধৃতি দেইনি। এর কারণ এই যে, আমি কোথাও এর বর্ণনাকারীর সন্ধান পাইনি। ফলে আমি স্থানটি খালি রেখে দিয়েছি। অতএব যদি আপনি কোথাও তার সন্ধান পেয়ে থাকেন তবে [অনুগ্রহপূর্বক] আপনি যথাস্থানে তা যুক্ত করে দিন। আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। আর আমি এ কিতাবের নামকরণ করলাম মেশকাতুল মাসাবীহ'। আল্লাহর নিকট শক্তি, সাহায্য, সুপথ এবং হেফাজত ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি এবং স্বীয় মঞ্জিলে মাকসুদে পৌছার ক্ষেত্রে তিনি যেন আমাকে সহজ-সরল পথ প্রদর্শন করেন। তিনি যেন এর দ্বারা আমার এবং সমগ্র মুসলমান নারী-পুরুষের ইহকাল ও পরকালে কল্যাণ সাধন করেন। আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট এবং সর্বোৎকৃষ্ট কার্যনির্বাহী। মহাপরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহ ছাড়া কারো কোনো শক্তি ও সামর্থ্য নেই।

tahqiq

তাহকীক:

তাহকীক চলমান