প্রবন্ধ
রাসুলুল্লাহ সা. কবে থেকে নবী?
ভূমিকা
মানব ইতিহাসের পৃষ্ঠায় সর্বশ্রেষ্ঠ দান, সর্বোত্তম নেআ‘মত ও সর্বমহিমান্বিত অনুগ্রহ হলো নবুওয়্যাত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ’লা মানুষকে একা ফেলে দেননি; বরং যুগে যুগে অন্ধকারে পথ হারানো মানবজাতিকে সত্যের আলোকবর্তিকা দেখানোর জন্য তিনি প্রেরণ করেছেন নবী ও রাসূলগণকে। এ ধারাবাহিকতায় যিনি সর্বশেষ, সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য রহমতস্বরূপ তিনি হলেন আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মাদ ﷺ।
নবুওয়্যাত এমন এক মহামানবিক মর্যাদা, যা জগৎ সংসারের সাধারণ তুলনার ঊর্ধ্বে। এই মর্যাদার অধিকারী কবে থেকে নবী হয়েছেন, তা জানা শুধু কৌতূহলের বিষয় নয়; বরং এটি ঈমান, আকীদাহ ও মহব্বতের গভীর অনুভূতির সাথে জড়িত। কেননা, নবীজি ﷺ–এর নবুওয়্যাতের সূচনাকাল সম্পর্কিত প্রশ্ন আমাদের সামনে নবুওয়্যাতের আদি আলো ও এর রহস্যময় গাম্ভীর্যকে উন্মোচিত করে।
কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা নবীজি ﷺ–কে পরিচয় করিয়েছেন
"وَمَآ أَرْسَلْنَـٰكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَـٰلَمِينَ" “আমি আপনাকে সমগ্র জাহানবাসীর জন্য রহমতস্বরূপই প্রেরণ করেছি।” (সূরা আল-আম্বিয়া, ২১: ১০৭)
এই রহমতের সূচনা কবে থেকে? প্রিয় নবী ﷺ–এর নবুওয়্যাতের আলো কি তাঁর জন্মের পর হেরা গুহায় প্রথম ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় শুরু হয়েছিল, নাকি তারও পূর্বে, আল্লাহর ইলমে ও তাকদীরে তিনি নবী হিসেবে মনোনীত ছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন এবং প্রাচীন-মধ্যযুগীয় আলেমগণ বিভিন্ন হাদীস, ঐতিহাসিক ঘটনা ও বিশ্লেষণ পেশ করেছেন।
রাসূলুল্লাহ ﷺ–এর নবুওয়্যাতের সূচনা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে শুধু একটি সময় নির্ধারণ নয়, বরং এর মাধ্যমে উন্মোচিত হয় এক বিশাল আকীদাগত বাস্তবতা। নবুওয়্যাত মানুষের তৈরি কোনো পদ নয়, বরং এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্বাচিত মর্যাদা, যা আদি কাল থেকেই নির্ধারিত ছিল।
তাহলে নবীজি ﷺ কবে থেকে নবী? তাঁর নবুওত কি পৃথিবীতে জন্ম নেওয়ার পর শুরু হয়েছিল, নাকি আদম (আ.) সৃষ্টি না হওয়ার আগেই আল্লাহ তাঁকে নবী হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে হলে আমাদেরকে কুরআনের আয়াত, সহীহ হাদীস এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ–এর জীবনের প্রমাণনির্ভর ঘটনাবলির দিকে গভীর দৃষ্টি দিতে হবে।
এই আলোচনা শুধু জ্ঞানের পিপাসা মেটানোর জন্য নয়; বরং এটি আমাদের অন্তরে নবীজি ﷺ–এর মর্যাদা সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস, গভীর মহব্বত এবং তাঁর দাওয়াতের প্রতি অটল আনুগত্য সৃষ্টি করবে যা প্রকৃত মুসলমানের পরিচয়।
তিনটি বিষয় বুঝলে বিষয়টি ক্লিয়ার হয়ে যাবে।
১- আমাদের নবী (ﷺ) নবী হওয়াটা নির্ধারিত হয়েছে তাঁর সৃষ্টির অনেক পূর্বে। যা সূরা আলে ইমরানের ৮১ নং আয়াত থেকে বুঝা যায়। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ النَّبِيِّينَ لَمَا آتَيْتُكُم مِّن كِتَابٍ وَحِكْمَةٍ ثُمَّ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مُّصَدِّقٌ لِّمَا مَعَكُمْ لَتُؤْمِنُنَّ بِهِ وَلَتَنصُرُنَّهُ ۚ قَالَ أَأَقْرَرْتُمْ وَأَخَذْتُمْ عَلَىٰ ذَٰلِكُمْ إِصْرِي ۖ قَالُوا أَقْرَرْنَا ۚ قَالَ فَاشْهَدُوا وَأَنَا مَعَكُم مِّنَ الشَّاهِدِينَ
এবং (তাদেরকে সেই সময়ের কথা স্মরণ করাও) যখন আল্লাহ নবীগণ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন, আমি যদি তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত দান করি, তারপর তোমাদের নিকট কোন রাসূল আগমন করে, যে তোমাদের কাছে যে কিতাব আছে তার সমর্থন করে, তবে তোমরা অবশ্যই তার প্রতি ঈমান আনবে এবং অবশ্যই তার সাহায্য করবে। আল্লাহ (সেই নবীদেরকে) বলেছিলেন, তোমরা কি একথা স্বীকার করছ এবং আমার পক্ষ হতে প্রদত্ত এ দায়িত্ব গ্রহণ করছ? তারা বলেছিল, আমরা স্বীকার করছি। আল্লাহ বললেন, তবে তোমরা (একে অন্যের স্বীকারোক্তি সম্পর্কে) সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সঙ্গে সাক্ষী থাকলাম। [সূরা আলে ইমরান-৮১]
২- এবং তিনি কখন থেকে নবী বিষয়টি ফুটে উঠেছে সুনানে তিরমিজির ৩৬০৯ নং হাদীসে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ مَتَى وَجَبَتْ لَكَ النُّبُوَّةُ؟ قَالَ: «وَآدَمُ بَيْنَ الرُّوحِ وَالجَسَدِ» :
আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেনঃ সাহাবীগণ বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ্ ! কবে থেকে আপনার জন্য নবুওয়াত নির্ধারিত হয়েছে? তিনি বললেন : আদম (আঃ) যখন ছিলেন রূহ ও শরীরের মাঝে। (জামে' তিরমিযী, হাদীস নং ৩৬০৯)
৩- দুনিয়াতে আসার পর তাঁর নবুওয়্যাত কখন থেকে প্রকাশ পায়? বিষয়টি ফুটে উঠেছে সহীহুল বুখারীর ৩৬২২নং হাদীসে,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: «بُعِثَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِأَرْبَعِينَ سَنَةً، فَمَكُثَ بِمَكَّةَ ثَلاَثَ عَشْرَةَ سَنَةً يُوحَى إِلَيْهِ، ثُمَّ أُمِرَ بِالهِجْرَةِ فَهَاجَرَ عَشْرَ سِنِينَ، وَمَاتَ وَهُوَ ابْنُ ثَلاَثٍ وَسِتِّينَ»
ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- কে নবুওয়াত দেওয়া হয় চল্লিশ বছর বয়সে, এরপর তিনি তের বছর মক্কায় অবস্থান করেন। এ সময় তাঁর প্রতি ওহী নাযিল হচ্ছিল। তারপর হিজরতের নির্দেশ পান। এবং হিজরতের পর দশ বছর (মদীনায়) অবস্থান করেন। আর তিনি তেষট্টি বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন।—সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৯০২)
অন্য বর্ণনায় আসছে,
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، أَنَّهُ سَمِعَهُ يَقُولُ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لَيْسَ بِالطَّوِيلِ الْبَائِنِ وَلاَ بِالْقَصِيرِ وَلَيْسَ بِالأَبْيَضِ الأَمْهَقِ وَلاَ بِالآدَمِ وَلاَ بِالْجَعْدِ الْقَطَطِ وَلاَ بِالسَّبِطِ بَعَثَهُ اللَّهُ عَلَى رَأْسِ أَرْبَعِينَ سَنَةً فَأَقَامَ بِمَكَّةَ عَشْرَ سِنِينَ وَبِالْمَدِينَةِ عَشْرَ سِنِينَ وَتَوَفَّاهُ اللَّهُ عَلَى رَأْسِ سِتِّينَ سَنَةً وَلَيْسَ فِي رَأْسِهِ وَلِحْيَتِهِ عِشْرُونَ شَعْرَةً بَيْضَاءَ .
আনাস ইবনে মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বেশী লম্বাও ছিলেন না বা বেশী খাটোও ছিলেন না। একেবারে সাদাও ছিলেন না এবং শ্যামলাও ছিলেন না। তার চুল অতিরিক্ত কোঁকড়ানোও ছিলো না এবং একেবারে সোজাও ছিল না। চল্লিশ বছর বয়সে আল্লাহ তাআলা তাঁকে নুবুওয়াত দান করেন। এরপর তিনি মক্কায় দশ বছর অবস্থান করেন এবং মদীনায় দশ বছর। ষাট বছরের মাথায় আল্লাহ তাআলা তাঁকে ওফাত দান করেন। এ সময় তার মাথায় ও দাড়িতে বিশটি চুলও সাদা ছিল না।—সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৮৭৯
ইতিহাস ও সীরাতগ্রন্থ গুলো তালাশ করলেও স্পষ্ট আকারে বুঝে আসে যে, উম্মতদের জন্য তাঁর নবুওয়্যাতী প্রকাশ পায় চল্লিশ বৎসরে।
الرحيق المختوم (ص: 51):
"وبعد النظر والتأمل في القرائن والدلائل يمكن لنا أن نحدد ذلك اليوم بأنه كان يوم الاثنين لإحدى وعشرين مضت من شهر رمضان ليلًا، وقد وافق 10 أغسطس سنة 610 م، وكان عمره صلى الله عليه وسلم إذ ذاك بالضبط أربعين سنةً قمريةً، وستة أشهر، و12 يومًا، وذلك نحو 39 سنةً شمسيةً وثلاثة أشهر وعشرين يومًا"
যখন তিনি (ﷺ) নবুওয়্যাত লাভ করেন, তখন তিঁনার বয়স ছিলো, চন্দ্র বৎসর হিসেবে চল্লিশ বৎসর, ছয় মাস, বার দিন। সূর্যবর্ষ হিসেবে উনচল্লিশ বৎসর,তিনমাস, বিশ দিন।
الأنوار في شمائل النبي المختار (ص: 89)
إمتاع الأسماع بما للنبى من الأحوال والأموال والحفدة والمتاع (1/ 64)
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন