রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৬৩১
সহনশীলতা, ধীরস্থিরতা ও কোমলতা
এ অধ্যায়টি সহনশীলতা, ধীরস্থিরতা ও কোমলতা সম্পর্কে। ইমাম নববী রহ. এখানে তিনটি শব্দ ব্যবহার করেছেন। তা হল- الْحِلْمُ وَالْأَنَاةُ وَالرِّفْقُ
الْحِلْمُ এর অর্থ সহিষ্ণুতা, বিচক্ষণতা, আত্মসংযম, বুদ্ধিমত্তা। এর বহুবচন أَحلَامٌ । যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেন- أَمْ تَأْمُرُهُمْ أَحْلَامُهُمْ بِهَذَا (তাদের বুদ্ধি কি তাদেরকে এসব করতে বলে) (সূরা ত্বর (৫২), আয়াত ৩২)। এরূপ গুণবিশিষ্ট লোককে حَلِيْمٌ বলা হয়। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা'আলা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেন-
إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَأَوَّاهٌ حَلِيمٌ
‘ইবরাহীম তো অত্যধিক উহ্-আহকারী ও বড় সহনশীল ছিল।(সূরা তাওবা (৯), আয়াত ১১৪)
الْأَنَاةُ এর অর্থ ধীরস্থিরতা, তাড়াহুড়া না করা, পরিণাম ভেবে কাজ করা, সহনশীলতা ও গাম্ভীর্য। এরূপ গুণবিশিষ্ট লোককে বলা হয় آن ।
الرِّفْقُ অর্থ কোমলতা। এটা কঠোরতার বিপরীত। ইবনে হাজার রহ. বলেন, কথা, কাজ ও আচরণে কোমলতা প্রদর্শন ও সহজতা অবলম্বনকে الرِّفْقُ বলা হয়। এরূপ গুণবিশিষ্ট লোককে رفيق বলা হয়।
الرِّفْقُ ও الْأَنَاةُ، الْحِلْمُ শব্দ তিনটি কাছাকাছি অর্থ দেয়। এর মধ্যে পার্থক্য সামান্যই। যেমন الْحِلْمُ হল রাগের সময় নিজেকে সংযত করা। অর্থাৎ যদি রাগ ওঠে আর তা কার্যকর করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয় এবং যার উপর রাগ ওঠে তাকে শাস্তি দেওয়া না হয়, তবে একে الْحِلْمُ বলা হয়। আর الْأَنَاةُ হল কোনও কাজে তাড়াহুড়া না করে ধীরস্থিরভাবে তা আঞ্জাম দেওয়া এবং কোনও বিষয়ে তড়িঘড়ি করে বাহ্যিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তে উপনীত না হওয়া। আর الرِّفْقُ হল মানুষের সঙ্গে কোমল আচরণ করা এবং কাউকে শাস্তিদানে তাড়াহুড়া না করে তাকে অবকাশ দেওয়া। সবগুলোরই সারকথা, কোনও বিষয়ে তাড়াহুড়া না করে ধীরস্থিরতা অবলম্বন করা, সহনশীল হওয়া ও নম্র-কোমল আচরণ করা।
কোমলতা ও ধীরস্থিরতা ইসলামের চারিত্রিক শিক্ষার অতি গুরুত্বপূর্ণ ধারা। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে এর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রকৃতপক্ষে পার্থিব প্রতিটি কাজেই কোমলতা ও ধীরস্থিরতা জরুরি। কঠোরতা ও তাড়াহুড়ার ফল কখনও শুভ হয় না। বহু মহৎ উদ্দেশ্য তাড়াহুড়ার কারণে নস্যাৎ হয়ে যায়। একবার এক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপদেশ চাইলে তিনি তাকে বলেছিলেন-
خُذِ الْأَمْرَ بِالتَّدْبِيرِ ، وَإِنْ رَأَيْتَ فِي عَاقِبَتِهِ خَيْرًا فَامْضِ، وَإِنْ خِفْتَ غَيًّا فَأَمْسِكْ
‘কোনও বিষয় ধরবে পরিণাম ভেবে। যদি পরিণাম ভালো দেখ, তবে তা করবে। আর যদি পরিণাম অশুভ হওয়ার আশঙ্কা কর, তবে বিরত থাকবে।(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৪৩২৮; জামে' মা'মার ইবন রাশিদ: ২০২১২; শারহুস সুন্নাহ: ৩৬০০)
হযরত আবুদ দারদা রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, আল্লাহ তা'আলা তাঁর কোনও বান্দাকে ধীরস্থিরতার চেয়ে উৎকৃষ্ট কোনও হার পরাননি।
মানুষ যাতে তাড়াহুড়া করে ক্ষতির শিকার না হয়, সে লক্ষ্যে পরামর্শের বিধান দেওয়া হয়েছে। যে ব্যক্তি কোনও কাজ করার আগে পরামর্শ করবে, স্বাভাবিকভাবেই তার সে কাজটি ধীরস্থিরতার সঙ্গেই করা হবে। সে তাড়াহুড়া থেকে বেঁচে যাবে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনওই কোনও কাজে তাড়াহুড়ার পরিচয় দিতেন না। তাঁর মক্কী জীবন ও মাদানী জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কাজসমূহের উপর দৃষ্টিপাত করলে তাতে পরিণামদর্শিতা ও ধীরস্থিরতার পরিচয় মেলে সুস্পষ্ট। ফলে একের পর এক কৃতকার্যতা তাঁর পদচুম্বন করেছে। সন্দেহ নেই ধীরস্থিরতার মধ্যেই সফলতা নিহিত। তাড়াহুড়া শুধু ব্যর্থতাই ডেকে আনে।
এমনিভাবে কঠোরতা ও অসহিষ্ণুতারও পরিণাম কখনও ভালো হয় না। এতে পারস্পরিক সম্প্রীতি নষ্ট হয়। বিদ্বেষ ও শত্রুতার সৃষ্টি হয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত কোমল চরিত্রের ছিলেন। সাহাবায়ে কেরামের প্রতি তিনি কোনও কাজে কখনও কঠোরতা অবলম্বন করতেন না। তাঁর প্রতি তাদের আত্মনিবেদিত থাকার রহস্য নিহিত ছিল তাঁর চারিত্রিক কোমলতারই ভেতর। তিনি নিজে তো কোমল চরিত্রের ছিলেনই, সাহাবায়ে কেরামকেও এ চরিত্রের উপর গড়ে তুলেছিলেন। উম্মতকেও জোর উৎসাহ দিয়েছেন যাতে তারা নম্রতা ও কোমলতা আত্মস্থ করে নেয়।
মোটকথা সহনশীলতা, কোমলতা ও ধীরস্থিরতা অবলম্বন করা মানবজীবনের শান্তি, সফলতা ও উৎকর্ষের জন্য অতীব জরুরি। তাই কুরআন ও হাদীছে এর প্রতি বিপুল উৎসাহ দান করা হয়েছে। আলোচ্য অধ্যায়ের আয়াত ও হাদীছসমূহ সে সম্পর্কেই।
‘সহনশীলতা…’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ (134)
অর্থ: এবং যারা নিজের ক্রোধ হজম করতে ও মানুষকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত। আল্লাহ এরূপ পুণ্যবানদেরকে ভালোবাসেন।(সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১৩৪)
ব্যাখ্যা
এটি সূরা আলে ইমরানের ১৩৪ নং আয়াতের শেষ অংশ। এটি এ গ্রন্থের ৭৩ নং অধ্যায়ের ২য় আয়াতরূপে উদ্ধৃত হয়েছে। সেখানে এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
দুই নং আয়াত
خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ (199)
অর্থ: তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন করো এবং (মানুষকে) সৎকাজের আদেশ দাও আর অজ্ঞদের অগ্রাহ্য করো।( সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৯৯)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ্য করে তিনটি আদেশ করা হয়েছে। ক. ক্ষমাপরায়ণ হওয়া; খ. সৎকাজের আদেশ দেওয়া ও গ. অজ্ঞজনদের অগ্রাহ্য করা।
প্রথমে ইরশাদ হয়েছে- خُذِ الْعَفْوَ (তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন করো)। الْعَفْوَ শব্দটির বিভিন্ন অর্থ আছে। তার মধ্যে একটি অর্থ হচ্ছে ক্ষমাপরায়ণতা। এ আয়াতটি যখন নাযিল হয়, তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত জিবরীল আলাইহিস-সালামকে এর অর্থ জিজ্ঞেস করেছিলেন। হযরত জিবরীল আলাইহিস-সালাম আল্লাহ তা'আলার কাছ থেকে জেনে এসে তাঁকে বললেন, এ আয়াতে আপনাকে হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, যে ব্যক্তি আপনার উপর জুলুম করবে, আপনি তাকে ক্ষমা করে দেবেন। যে ব্যক্তি আপনাকে বঞ্চিত করবে, আপনি তার প্রতি উদারতা প্রদর্শন করবেন। আর যে ব্যক্তি আপনার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, আপনি তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবেন। এর সারকথা হচ্ছে অন্যের প্রতি ক্ষমাশীলতার আচরণ করা। এটি একটি মহৎ গুণ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা জীবন মানুষের সঙ্গে ক্ষমাশীল হয়েই থেকেছেন। মানুষ কতভাবে তাঁকে কষ্ট দিয়েছে, কিন্তু তিনি কখনও কারও থেকে প্রতিশোধ নেননি; বরং ক্ষমা করে দিয়েছেন। মক্কাবিজয়ের দিন তাঁর প্রতিশোধ গ্রহণের অবারিত সুযোগ ছিল। তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর প্রাণের শত্রুদেরকেও এদিন ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং ঘোষণা করেছেন সাধারণ ক্ষমা।
বস্তুত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উন্নত চরিত্রের সর্বোচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর ক্ষমাশীলতাও ছিল অসাধারণ। তা সত্ত্বেও তাঁকে যে এ আদেশ করা হয়েছে তা মূলত উম্মতকে শেখানোর জন্য।
দ্বিতীয় হুকুম করা হয়েছে সৎকাজের আদেশ দেওয়া সম্পর্কে। ইরশাদ হয়েছে- وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ ‘এবং (মানুষকে) সৎকাজের আদেশ দাও'। الْعُرْفِ শব্দটি প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াতে ব্যবহৃত الْمعْرُوف -এর সমার্থক। সর্বপ্রকার সৎকাজ এর অন্তর্ভুক্ত। ইমাম রাগিব রহ. বলেন, মানুষের বোধ-বুদ্ধি ও শরী'আত যেসকল কাজকে ভালো গণ্য করে, তাকে العُرْفُ বলে। সততা, সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, সহনশীলতা, দানশীলতা, আতিথেয়তা, ন্যায়নিষ্ঠতা, সহমর্মিতা, সৃষ্টির সেবা, পিতা-মাতার খেদমত, চারিত্রিক পবিত্রতা ইত্যাদি বিষয়গুলো এমন, যা প্রত্যেক বিবেক-বুদ্ধিমান লোক ভালো মনে করে। সুতরাং এ সবই الْمَعْرُوف এর অন্তর্ভুক্ত।
আয়াতে অন্যের দেওয়া কষ্ট ও জুলুম ক্ষমা করার পাশাপাশি হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, তাদেরকে সৎকাজের আদেশও করো। কেননা কেবল ক্ষমা দ্বারা জালেম ও কষ্টদাতার সংশোধন নাও হতে পারে। অথচ তার সংশোধনও কাম্য। কেননা সংশোধন যদি না হয়, তবে সে একের পর এক জুলুম করেই যাবে। ফলে তার জুলুম-অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকবে। আর এভাবে অপরাপর মানুষও তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং জুলুম থেকে ফেরানোর জন্য তাকে ন্যায় ও ইনসাফের শিক্ষা দেওয়াও জরুরি। সেজন্যই আদেশ করা হয়েছে যে, সৎকাজের নির্দেশ দাও।
প্রকাশ থাকে যে, সৎকাজের নির্দেশ দেওয়ার জন্য প্রথমে কোনটা সৎকাজ এবং কোনটা অসৎকাজ তা জেনে নেওয়া জরুরি। অন্যথায় আশঙ্কা রয়েছে সৎকাজের নির্দেশ দিতে গিয়ে এমন কোনও কাজের নির্দেশ দেওয়া হবে, যা শরী'আত মোটেই অনুমোদন করে না। এমনিভাবে অসৎকাজে বাধা দিয়ে গিয়ে এমন কাজে বাধা দেওয়া হবে, যা মোটেই নাজায়েয কাজ নয়; বরং শরী'আত তা অনুমোদন করে কিংবা ছাওয়াবের কাজ সাব্যস্ত করে। এরূপ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ প্রকৃত অর্থে হয়ে যায় সৎকাজে নিষেধ ও অসৎকাজের আদেশ, যা কিনা নিজেই একটি কঠিন অন্যায় ও অসৎকাজ। সুতরাং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধকারীদেরকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অবশ্যই ইলম হাসিল করে নিতে হবে। যে বিষয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত ইলম হাসিল করা না হবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত এরূপ বিষয়ে দায়িত্ব পালন করতে যাওয়া কিছুতেই সমীচীন নয়।
এ আয়াতে তৃতীয় নির্দেশ হচ্ছে - وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ (অজ্ঞজনদের অগ্রাহ্য করো)। অর্থাৎ যারা তোমার সঙ্গে মন্দ কথা বলে, তুমি তার উত্তরে তাদের সঙ্গে মন্দ কথা বলো না। যারা তোমার প্রতি দুর্ব্যবহার করে, বিপরীতে তুমি তাদের প্রতি মন্দ আচরণ করো না। যারা তোমার প্রতি জুলুম-অত্যাচার করে, তুমি তাদের প্রতি জুলুম করো না। বরং তুমি ধৈর্যধারণ করবে, উত্তম কথা বলবে ও তাদেরকে ক্ষমা করে দেবে। তোমার ক্ষমাশীল আচরণের পরও যদি দেখা যায় তারা নিজেদের সংশোধন করছে না, এত উন্নত আচরণ করা সত্ত্বেও তাদের জীবনে কোনও পরিবর্তন আসছে না; আগের মতোই অন্যায় ও অসৎকাজ করে যাচ্ছে এবং যথারীতি জেদ ও হঠকারিতার উপর অবিচল রয়েছে, এরূপ ক্ষেত্রেও ধৈর্য না হারিয়ে এবং উত্তেজিত না হয়ে বরং তাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলা কর্তব্য। যেমন অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا (63)
‘এবং অজ্ঞলোক যখন তাদেরকে লক্ষ্য করে (অজ্ঞতাসুলভ) কথা বলে, তখন তারা শান্তিপূর্ণ কথা বলে।(সূরা ফুরকান (২৫), আয়াত ৬৩)
অর্থাৎ তারা অজ্ঞজনদের কটু কথা ও গালিগালাজের জবাব মন্দ কথা দ্বারা দেয় নাঃ বরং ভদ্রোচিত ভাষায় দিয়ে থাকে এবং 'ভাই, সালাম' বলে তাদের এড়িয়ে যায়। একবার এক ব্যক্তি বিখ্যাত তাবি'ঈ ইয়াস ইবন মু'আবিয়া রহ.-কে গালাগাল করছিল। তিনি কোনও জবাব দিচ্ছিলেন না। শেষে লোকটি বলল, ওহে! এসব তো আমি তোমাকেই বলছি। তিনি উত্তর দিলেন, আমি তো উপেক্ষাও তোমাকেই করছি।
ইবন কাছীর রহ. পাশ কাটানোর একটা ব্যাখ্যা এরকমও করেছেন যে, তাদের দুর্ব্যবহারের উত্তর দুর্ব্যবহার দ্বারা নয়; বরং সদ্ব্যবহার দ্বারা করা চাই। এমন নয় যে, তাদের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে সৎকাজের আদেশ করা ছেড়ে দেওয়া হল।
প্রকাশ থাকে যে, ক্ষমাশীলতা অবলম্বন ও পাশ কাটিয়ে চলার আদেশ দ্বারা এটা অনিবার্য হয়ে যায় না যে, যে ক্ষেত্রে জিহাদের প্রয়োজন হবে, সে ক্ষেত্রে জিহাদ করা হবে না। অন্যের দুর্ব্যবহার ও জুলুম-নিপীড়ন ক্ষমা করা এক জিনিস, আর আল্লাহ তা'আলার দীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জিহাদ করা আরেক জিনিস। এ দুইয়ের মধ্যে কোনও বৈপরীত্য নেই। একটির সম্পর্ক নিজ ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে, আরেকটির সম্পর্ক দীনের সঙ্গে। অর্থাৎ ব্যক্তিগত বিষয়ে ক্ষমাশীলতা অবলম্বন করা হবে আর দীনের বিষয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, তা ক্ষেত্রবিশেষে জিহাদ ও কিতালরূপেও হতে পারে। এক হাদীছে আছে-
وَمَا انْتَقَمَ رَسُولُ اللهِ ﷺ لِنَفْسِهِ فِي شَيْءٍ قَط ، إِلَّا أَنْ تُنتَهَكَ حُرْمَةُ اللَّهِ، فَيَنْتَقِمَ لِلَّهِ تَعَالَى
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও নিজ ব্যক্তিগত কোনও বিষয়ে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। কিন্তু আল্লাহ তা'আলার কোনও বিধানের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হলে তিনি অবশ্যই আল্লাহ তা'আলার জন্য প্রতিশোধ নিতেন।(সহীহ বুখারী: ৩৫৬০; সহীহ মুসলিম: ২৩২৭; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৭৮৫; মুআত্তা মালিক: ৩৩৫১; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৪৩৮২; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ১৩২৮৩; বাগাবী শারহুস সুন্নাহ: ৩৭০৩; মুসনাদুল হুমায়দী: ২৬০; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৪২২৩)
আয়াতটির শিক্ষা
ক. ক্ষমাশীলতা একটি মহৎ গুণ। আমাদেরকে এ গুণ আয়ত্ত করতে হবে।
খ. আপন সামর্থ্য অনুযায়ী সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজে নিষেধ করা প্রতিটি মুসলিমের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য।
গ. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা একান্ত জরুরি।
ঘ. অজ্ঞ ও অভদ্র লোকের সঙ্গে কিছুতেই তর্কে জড়ানো উচিত নয়। তাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলা কর্তব্য।
ঙ. মানুষের দুর্ব্যবহারের জবাব কখনও দুর্ব্যবহার দ্বারা দিতে নেই। বরং তা দিতে হবে উত্তম ব্যবহার দ্বারা।
***
হযরত জা'ফর সাদিক রহ. বলেন, উত্তম আখলাক-চরিত্র সম্পর্কে এটি কুরআন মাজীদের সর্বাপেক্ষা পূর্ণাঙ্গ আয়াত। অর্থাৎ উত্তম চরিত্রের সবকিছুই এর মধ্যে এসে গেছে।
***
তিন নং আয়াত
وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ (34) وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الَّذِينَ صَبَرُوا وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ (35)
অর্থ: ভালো ও মন্দ সমান হয় না। তুমি মন্দকে প্রতিহত করো এমন পন্থায়, যা হবে উৎকৃষ্ট। ফলে যার ও তোমার মধ্যে শত্রুতা ছিল, সে সহসাই হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। আর এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয়, যারা সবর করে এবং এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয়, যারা মহাভাগ্যবান।(সূরা ফুসসিলাত (৪১), আয়াত ৩৪-৩৫)
ব্যাখ্যা
এটি সামাজিকতা ও উত্তম চরিত্রের শিক্ষা সম্পর্কিত অতি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত। প্রথমে আল্লাহ তা'আলা বলেন- وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ (ভালো ও মন্দ সমান হয় না)। অর্থাৎ বদলা ও উত্তম পরিণামের দিক থেকে ভালো আচরণ ও মন্দ আচরণ সমান নয় এবং ভালো স্বভাব ও মন্দ স্বভাব সমান নয়। কাজেই মানুষের উচিত যথাসম্ভব মন্দ স্বভাব পরিহার করে ভালো স্বভাব আয়ত্ত করা, এমনিভাবে মন্দ আচার-ব্যবহার ছেড়ে দিয়ে ভালো আচার-ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হওয়া। সুতরাং রাগের বদলে ধৈর্যধারণ করা, দুর্ব্যবহারের ক্ষেত্রে সহনশীলতার পরিচয় দেওয়া, কৃপণতার বদলে বদান্যতা অবলম্বন করা, প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছা দমন করে ক্ষমা প্রদর্শন করা, এমনিভাবে আরও মন্দ যা-কিছু আছে তার বিপরীতে ভালো ও প্রশংসনীয় অবস্থান গ্রহণ করাই হওয়া দরকার একজন মুমিনের শান।
ভালো ও মন্দ যে বরাবর নয়, এ মৌলিক শিক্ষাদানের পর আল্লাহ তা'আলা এর অধীনে ব্যবহারিক শিক্ষাদান করছেন যে- ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ (তুমি মন্দকে প্রতিহত করো এমন পন্থায়, যা হবে উৎকৃষ্ট)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. এর ব্যাখ্যা করেন যে, যে ব্যক্তি তোমার উপর রাগ করবে, তুমি তার মোকাবেলায় ধৈর্যধারণ করবে। যে ব্যক্তি তোমার প্রতি দুর্ব্যবহার করবে, তুমি তার মোকাবেলায় সহনশীল আচরণ করবে। এমনিভাবে যে ব্যক্তি তোমাকে কষ্ট দেবে, তুমি তাকে ক্ষমা করবে। একবার এক ব্যক্তি একজনকে গালাগাল করছিল। এর উত্তরে সে ব্যক্তি বলল, তুমি যদি সত্যবাদী হও, তবে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন। আর যদি মিথ্যাবাদী হও, তবে আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন। এটা মন্দ আচরণের জবাব ভালো আচরণ দ্বারা দেওয়ার একটা দৃষ্টান্ত। এটা উন্নত আখলাকের শিক্ষা। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَى أَكْرَم أَخْلَاقِ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ؟ أَنْ تَعْفُوَ عَمَّنْ ظَلَمَكَ، وَتَصِلَ مَنْ قطعكَ، وَتُعْطِيَ مَنْ حَرَمَكَ
‘আমি কি তোমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতের মহান চরিত্র সম্পর্কে অবহিত করব না? তা হল যে ব্যক্তি তোমার উপর জুলুম করবে, তুমি তাকে ক্ষমা করবে। যে ব্যক্তি তোমার সঙ্গে আত্মীয়তা ছিন্ন করবে, তুমি তার সঙ্গে আত্মীয়তা রক্ষা করবে। যে ব্যক্তি তোমাকে বঞ্চিত করবে, তুমি তাকে তার প্রাপ্য প্রদান করবে।(বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২১০৯১; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত : ৫৫৬৭)
এরূপ মহান চরিত্র অবলম্বন করলে তার কী সুফল পাওয়া যাবে? আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন- فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ (ফলে যার ও তোমার মধ্যে শত্রুতা ছিল, সে সহসাই হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু)। এটা অনেক বড় প্রাপ্তি। মানুষকে শত্রু বানানোর মধ্যে কোনও কল্যাণ নেই। বন্ধু বানানোর মধ্যেই কল্যাণ নিহিত। তাতে পার্থিব জীবন নিরাপদ ও স্বস্তিকর হয়। ফলে দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কাজ নির্বিঘ্নে করা সম্ভব হয়। পারস্পরিক শত্রুতা কেবল দুনিয়ার সুখ ও আরামই নষ্ট করে না, আখিরাতও বরবাদ করে দেয়। কেননা এটা হাজারও গুনাহের উৎস। তাই এর থেকে নিস্তার পাওয়া অতীব জরুরি। এ আয়াতে নিস্তার পাওয়ার উপায় বাতলে দেওয়া হয়েছে। যারাই শত্রু বা যারা শত্রুতামূলক আচরণ করে, তাদের সঙ্গে যদি নিরবচ্ছিন্নভাবে ভালো ব্যবহার করা যায়, তবে একদিন তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবেই। তখন তারা কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে, নিজেদের শোধরাতে চেষ্টা করবে এবং শত্রুতা ছেড়ে দিয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবে; তা বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হবে। এটা কুরআন মাজীদের বাণী। ভুল ও ব্যর্থ হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহান চরিত্রের এ পন্থায়ই শত্রুদের জয় করেছিলেন। যুগে যুগে তাঁর প্রকৃত অনুসারীগণ নিজেদের জীবনে মহান চরিত্রের এ শিক্ষার বাস্তব চর্চা করেছেন। তারা এর সুফলও পেয়েছেন। আমাদেরকেও সামাজিক এবং দ্বিপাক্ষিক সকল ক্ষেত্রে এ নীতির চর্চা করতে হবে। সন্দেহ নেই, এর জন্য দরকার সবর ও ধৈর্যের গুণ আঁকড়ে ধরা। তার মাধ্যমেই এ নীতির চর্চা সম্ভব হয়। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الَّذِينَ صَبَرُوا (আর এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয়, যারা সবর করে)। অর্থাৎ অন্যের মন্দ ব্যবহারের মোকাবেলায় ভালো ব্যবহার করে যাওয়া কেবল তাদের পক্ষেই সম্ভব হয়, যারা সংযম ও ধৈর্যধারণে অভ্যস্ত। কেননা অন্যে যখন মন্দ আচরণ করে, তখন নিজ মনে আবেগ-উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ফলে মন্দের বিপরীতে অধিকতর মন্দ আচরণ করার ইচ্ছা জাগে। গালির জবাব দিতে ইচ্ছা হয় মার দিয়ে। মনের সে ইচ্ছা ও আবেগ সংযত করা না গেলে এভাবে মন্দের জবাব দেওয়া হয় অধিকতর মন্দ দ্বারা। এর থেকে বাঁচার উপায় নিজ আবেগ-উত্তেজনা সংযত করা। এরই নাম সবর। সবর ও সংযমে অভ্যস্ত হতে পারলে উত্তেজনা প্রশমিত করে ক্ষমাপ্রদর্শন করা সম্ভব হয়। সম্ভব হয় উত্তম আচরণ করা। সুতরাং এ আয়াত আমাদেরকে উৎসাহ দিচ্ছে, যেন আমরা সবর করতে অভ্যস্ত হই, আত্মসংযমী হয়ে উঠি। তা হতে পারাটা অনেক বড় সৌভাগ্যের বিষয়। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ (এবং এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয়, যারা মহাভাগ্যবান)। حَظّ শব্দের অর্থ অংশ। আর عَظِيْم এর অর্থ মহা, বিরাট। একত্রে حظ عَظِيم এর অর্থ বিরাট অংশ। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য কল্যাণের বিশাল অংশ। কাতাদা ও মুজাহিদ রহ. বলেন, حظ عَظِيم হল জান্নাত। হাসান বসরী রহ. বলেন, আল্লাহর কসম! কখনও কোনও অংশ জান্নাতের চেয়ে বড় হতে পারে না। এ হিসেবে আয়াতটির সারমর্ম হবে, যারা জান্নাতবাসী হবে, কেবল সেই ভাগ্যবানেরাই সবর ও সংযমের মাধ্যমে মন্দ আচরণের জবাবে ভালো আচরণ করার গুণ অর্জনে সক্ষম হয়। এর দ্বারা বোঝা যায় এরূপ আচরণের প্রতিদান হল জান্নাত। সুতরাং যারা জান্নাতলাভের প্রত্যাশী, তাদেরকে অবশ্যই এ গুণ অর্জন করতে হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. অন্যের প্রতি তার মন্দ আচরণের বিপরীতে কখনও মন্দ আচরণ করতে নেই।
খ. মন্দ আচরণের জবাবে ভালো আচরণ করাটা সংযমী ও ধৈর্যশীল হওয়ার পরিচায়ক।
গ. শত্রুকে বন্ধু বানানোর মোক্ষম উপায় তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে থাকা।
ঘ. জান্নাতলাভের একটি শ্রেষ্ঠ উপায় ধৈর্য ধরা ও অন্যের প্রতি তার মন্দ আচরণ সত্ত্বেও ভালো আচরণ করা।
চার নং আয়াত
وَلَمَنْ صَبَرَ وَغَفَرَ إِنَّ ذَلِكَ لَمِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ
অর্থ: প্রকৃতপক্ষে যে সবর অবলম্বন করে ও ক্ষমা প্রদর্শন করে, তো এটা অবশ্যই অত্যন্ত হিম্মতের কাজ। (সূরা শূরা (৪২), আয়াত ৪৩)
ব্যাখ্যা
কারও উপর যদি জুলুম করা হয় আর তার প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা থাকে, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিশোধ না নিয়ে তাকে ক্ষমা করে দেয় ও ধৈর্যধারণ করে, তবে তা অতি বড় পুণ্যের কাজ। এরূপ করা কেবল উঁচু হিম্মত ও দৃঢ় মনোবলসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। যে ব্যক্তি ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ ও মনকে সংযত করার মতো ক্ষমতা রাখে না, তার পক্ষে সহজে ক্ষমা করা সম্ভব হয় না। সে উত্তেজনাবশে প্রতিশোধ নিয়ে ফেলে এবং সেই প্রতিশোধ নিতে গিয়ে অনেক সময়ই তার দ্বারা বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। ফলে মজলুম ব্যক্তি উল্টো জালেমে পরিণত হয়। জালেম হওয়া অপেক্ষা মজলুম হয়ে থাকা ঢের ভালো। কারণ মজলুম ব্যক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত হয় আর জালেমের প্রতি আল্লাহর ক্রোধ নিপতিত হয়। সেই ক্রোধ থেকে বাঁচা ও আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্তির লক্ষ্যে প্রত্যেকের কর্তব্য ক্ষমাপ্রবণ হওয়া ও ধৈর্যধারণ করা, যদিও এটা কঠিন এবং নফস ও মনের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করার বিষয়। একবার হাসান বসরী রহ.-এর মজলিসে এক ব্যক্তি আরেক ব্যক্তিকে গালমন্দ করছিল। সে তা সহ্য করছিল এবং নিজ রাগ হজম করছিল। কিন্তু তাতে তার বেশ কষ্ট হচ্ছিল। সে কষ্টে তার শরীর থেকে ঘাম ঝরতে শুরু করল। শেষপর্যন্ত সে ঘাম মুছে এই আয়াত পড়তে পড়তে উঠে যায় যে- وَلَمَنْ صَبَرَ وَغَفَرَ إِنَّ ذَلِكَ لَمِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ (প্রকৃতপক্ষে যে সবর অবলম্বন করে ও ক্ষমা প্রদর্শন করে, তো এটা অবশ্যই অত্যন্ত হিম্মতের কাজ)।
প্রকাশ থাকে যে, ক্ষমা প্রদর্শনের ফলে জালেম ও অপরাধী ব্যক্তির স্পর্ধা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবে সে ক্ষেত্রে ক্ষমা না করে প্রতিশোধ গ্রহণও জায়েয; বরং ক্ষেত্র বিশেষে প্রতিশোধ নেওয়া উত্তম, যেমন এক আয়াতে বর্ণিত হয়েছে-
وَالَّذِينَ إِذَا أَصَابَهُمُ الْبَغْيُ هُمْ يَنْتَصِرُونَ (39) وَجَزَاءُ سَيِّئَةٍ سَيِّئَةٌ مِثْلُهَا
‘এবং যখন তাদের প্রতি কোনও জুলুম করা হয় তখন তারা তা প্রতিহত করে। মন্দের বদলা অনুরূপ মন্দ।(সূরা শূরা (৪২), আয়াত ৩৯-৪০)
তবে মন্দের বদলা যেহেতু অনুরূপ মন্দ অর্থাৎ জালেম যে পরিমাণ জুলুম ও কষ্টদান করে, প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষেত্রে তাকেও সমপরিমাণ কষ্টই দেওয়া যাবে, এর বেশি নয়। তাই প্রতিশোধ গ্রহণে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি, যাতে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে গিয়ে জুলুম না হয়ে যায়। সেজন্যই সাধারণ অবস্থায় প্রতিশোধগ্রহণ অপেক্ষা ক্ষমা করাই শ্রেয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য উলামায়ে কেরামের শরণাপন্ন হওয়া কর্তব্য।
আয়াতটির শিক্ষা
কেউ কষ্ট-ক্লেশ দিলে তাতে ধৈর্য ধরা ও ক্ষমাপ্রদর্শন করা উচিত। এটা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ।
এ অধ্যায়টি সহনশীলতা, ধীরস্থিরতা ও কোমলতা সম্পর্কে। ইমাম নববী রহ. এখানে তিনটি শব্দ ব্যবহার করেছেন। তা হল- الْحِلْمُ وَالْأَنَاةُ وَالرِّفْقُ
الْحِلْمُ এর অর্থ সহিষ্ণুতা, বিচক্ষণতা, আত্মসংযম, বুদ্ধিমত্তা। এর বহুবচন أَحلَامٌ । যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেন- أَمْ تَأْمُرُهُمْ أَحْلَامُهُمْ بِهَذَا (তাদের বুদ্ধি কি তাদেরকে এসব করতে বলে) (সূরা ত্বর (৫২), আয়াত ৩২)। এরূপ গুণবিশিষ্ট লোককে حَلِيْمٌ বলা হয়। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা'আলা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেন-
إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَأَوَّاهٌ حَلِيمٌ
‘ইবরাহীম তো অত্যধিক উহ্-আহকারী ও বড় সহনশীল ছিল।(সূরা তাওবা (৯), আয়াত ১১৪)
الْأَنَاةُ এর অর্থ ধীরস্থিরতা, তাড়াহুড়া না করা, পরিণাম ভেবে কাজ করা, সহনশীলতা ও গাম্ভীর্য। এরূপ গুণবিশিষ্ট লোককে বলা হয় آن ।
الرِّفْقُ অর্থ কোমলতা। এটা কঠোরতার বিপরীত। ইবনে হাজার রহ. বলেন, কথা, কাজ ও আচরণে কোমলতা প্রদর্শন ও সহজতা অবলম্বনকে الرِّفْقُ বলা হয়। এরূপ গুণবিশিষ্ট লোককে رفيق বলা হয়।
الرِّفْقُ ও الْأَنَاةُ، الْحِلْمُ শব্দ তিনটি কাছাকাছি অর্থ দেয়। এর মধ্যে পার্থক্য সামান্যই। যেমন الْحِلْمُ হল রাগের সময় নিজেকে সংযত করা। অর্থাৎ যদি রাগ ওঠে আর তা কার্যকর করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয় এবং যার উপর রাগ ওঠে তাকে শাস্তি দেওয়া না হয়, তবে একে الْحِلْمُ বলা হয়। আর الْأَنَاةُ হল কোনও কাজে তাড়াহুড়া না করে ধীরস্থিরভাবে তা আঞ্জাম দেওয়া এবং কোনও বিষয়ে তড়িঘড়ি করে বাহ্যিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তে উপনীত না হওয়া। আর الرِّفْقُ হল মানুষের সঙ্গে কোমল আচরণ করা এবং কাউকে শাস্তিদানে তাড়াহুড়া না করে তাকে অবকাশ দেওয়া। সবগুলোরই সারকথা, কোনও বিষয়ে তাড়াহুড়া না করে ধীরস্থিরতা অবলম্বন করা, সহনশীল হওয়া ও নম্র-কোমল আচরণ করা।
কোমলতা ও ধীরস্থিরতা ইসলামের চারিত্রিক শিক্ষার অতি গুরুত্বপূর্ণ ধারা। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে এর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রকৃতপক্ষে পার্থিব প্রতিটি কাজেই কোমলতা ও ধীরস্থিরতা জরুরি। কঠোরতা ও তাড়াহুড়ার ফল কখনও শুভ হয় না। বহু মহৎ উদ্দেশ্য তাড়াহুড়ার কারণে নস্যাৎ হয়ে যায়। একবার এক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপদেশ চাইলে তিনি তাকে বলেছিলেন-
خُذِ الْأَمْرَ بِالتَّدْبِيرِ ، وَإِنْ رَأَيْتَ فِي عَاقِبَتِهِ خَيْرًا فَامْضِ، وَإِنْ خِفْتَ غَيًّا فَأَمْسِكْ
‘কোনও বিষয় ধরবে পরিণাম ভেবে। যদি পরিণাম ভালো দেখ, তবে তা করবে। আর যদি পরিণাম অশুভ হওয়ার আশঙ্কা কর, তবে বিরত থাকবে।(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৪৩২৮; জামে' মা'মার ইবন রাশিদ: ২০২১২; শারহুস সুন্নাহ: ৩৬০০)
হযরত আবুদ দারদা রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, আল্লাহ তা'আলা তাঁর কোনও বান্দাকে ধীরস্থিরতার চেয়ে উৎকৃষ্ট কোনও হার পরাননি।
মানুষ যাতে তাড়াহুড়া করে ক্ষতির শিকার না হয়, সে লক্ষ্যে পরামর্শের বিধান দেওয়া হয়েছে। যে ব্যক্তি কোনও কাজ করার আগে পরামর্শ করবে, স্বাভাবিকভাবেই তার সে কাজটি ধীরস্থিরতার সঙ্গেই করা হবে। সে তাড়াহুড়া থেকে বেঁচে যাবে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনওই কোনও কাজে তাড়াহুড়ার পরিচয় দিতেন না। তাঁর মক্কী জীবন ও মাদানী জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কাজসমূহের উপর দৃষ্টিপাত করলে তাতে পরিণামদর্শিতা ও ধীরস্থিরতার পরিচয় মেলে সুস্পষ্ট। ফলে একের পর এক কৃতকার্যতা তাঁর পদচুম্বন করেছে। সন্দেহ নেই ধীরস্থিরতার মধ্যেই সফলতা নিহিত। তাড়াহুড়া শুধু ব্যর্থতাই ডেকে আনে।
এমনিভাবে কঠোরতা ও অসহিষ্ণুতারও পরিণাম কখনও ভালো হয় না। এতে পারস্পরিক সম্প্রীতি নষ্ট হয়। বিদ্বেষ ও শত্রুতার সৃষ্টি হয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত কোমল চরিত্রের ছিলেন। সাহাবায়ে কেরামের প্রতি তিনি কোনও কাজে কখনও কঠোরতা অবলম্বন করতেন না। তাঁর প্রতি তাদের আত্মনিবেদিত থাকার রহস্য নিহিত ছিল তাঁর চারিত্রিক কোমলতারই ভেতর। তিনি নিজে তো কোমল চরিত্রের ছিলেনই, সাহাবায়ে কেরামকেও এ চরিত্রের উপর গড়ে তুলেছিলেন। উম্মতকেও জোর উৎসাহ দিয়েছেন যাতে তারা নম্রতা ও কোমলতা আত্মস্থ করে নেয়।
মোটকথা সহনশীলতা, কোমলতা ও ধীরস্থিরতা অবলম্বন করা মানবজীবনের শান্তি, সফলতা ও উৎকর্ষের জন্য অতীব জরুরি। তাই কুরআন ও হাদীছে এর প্রতি বিপুল উৎসাহ দান করা হয়েছে। আলোচ্য অধ্যায়ের আয়াত ও হাদীছসমূহ সে সম্পর্কেই।
‘সহনশীলতা…’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ (134)
অর্থ: এবং যারা নিজের ক্রোধ হজম করতে ও মানুষকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত। আল্লাহ এরূপ পুণ্যবানদেরকে ভালোবাসেন।(সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১৩৪)
ব্যাখ্যা
এটি সূরা আলে ইমরানের ১৩৪ নং আয়াতের শেষ অংশ। এটি এ গ্রন্থের ৭৩ নং অধ্যায়ের ২য় আয়াতরূপে উদ্ধৃত হয়েছে। সেখানে এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
দুই নং আয়াত
خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ (199)
অর্থ: তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন করো এবং (মানুষকে) সৎকাজের আদেশ দাও আর অজ্ঞদের অগ্রাহ্য করো।( সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৯৯)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ্য করে তিনটি আদেশ করা হয়েছে। ক. ক্ষমাপরায়ণ হওয়া; খ. সৎকাজের আদেশ দেওয়া ও গ. অজ্ঞজনদের অগ্রাহ্য করা।
প্রথমে ইরশাদ হয়েছে- خُذِ الْعَفْوَ (তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন করো)। الْعَفْوَ শব্দটির বিভিন্ন অর্থ আছে। তার মধ্যে একটি অর্থ হচ্ছে ক্ষমাপরায়ণতা। এ আয়াতটি যখন নাযিল হয়, তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত জিবরীল আলাইহিস-সালামকে এর অর্থ জিজ্ঞেস করেছিলেন। হযরত জিবরীল আলাইহিস-সালাম আল্লাহ তা'আলার কাছ থেকে জেনে এসে তাঁকে বললেন, এ আয়াতে আপনাকে হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, যে ব্যক্তি আপনার উপর জুলুম করবে, আপনি তাকে ক্ষমা করে দেবেন। যে ব্যক্তি আপনাকে বঞ্চিত করবে, আপনি তার প্রতি উদারতা প্রদর্শন করবেন। আর যে ব্যক্তি আপনার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, আপনি তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবেন। এর সারকথা হচ্ছে অন্যের প্রতি ক্ষমাশীলতার আচরণ করা। এটি একটি মহৎ গুণ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা জীবন মানুষের সঙ্গে ক্ষমাশীল হয়েই থেকেছেন। মানুষ কতভাবে তাঁকে কষ্ট দিয়েছে, কিন্তু তিনি কখনও কারও থেকে প্রতিশোধ নেননি; বরং ক্ষমা করে দিয়েছেন। মক্কাবিজয়ের দিন তাঁর প্রতিশোধ গ্রহণের অবারিত সুযোগ ছিল। তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর প্রাণের শত্রুদেরকেও এদিন ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং ঘোষণা করেছেন সাধারণ ক্ষমা।
বস্তুত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উন্নত চরিত্রের সর্বোচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর ক্ষমাশীলতাও ছিল অসাধারণ। তা সত্ত্বেও তাঁকে যে এ আদেশ করা হয়েছে তা মূলত উম্মতকে শেখানোর জন্য।
দ্বিতীয় হুকুম করা হয়েছে সৎকাজের আদেশ দেওয়া সম্পর্কে। ইরশাদ হয়েছে- وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ ‘এবং (মানুষকে) সৎকাজের আদেশ দাও'। الْعُرْفِ শব্দটি প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াতে ব্যবহৃত الْمعْرُوف -এর সমার্থক। সর্বপ্রকার সৎকাজ এর অন্তর্ভুক্ত। ইমাম রাগিব রহ. বলেন, মানুষের বোধ-বুদ্ধি ও শরী'আত যেসকল কাজকে ভালো গণ্য করে, তাকে العُرْفُ বলে। সততা, সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, সহনশীলতা, দানশীলতা, আতিথেয়তা, ন্যায়নিষ্ঠতা, সহমর্মিতা, সৃষ্টির সেবা, পিতা-মাতার খেদমত, চারিত্রিক পবিত্রতা ইত্যাদি বিষয়গুলো এমন, যা প্রত্যেক বিবেক-বুদ্ধিমান লোক ভালো মনে করে। সুতরাং এ সবই الْمَعْرُوف এর অন্তর্ভুক্ত।
আয়াতে অন্যের দেওয়া কষ্ট ও জুলুম ক্ষমা করার পাশাপাশি হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, তাদেরকে সৎকাজের আদেশও করো। কেননা কেবল ক্ষমা দ্বারা জালেম ও কষ্টদাতার সংশোধন নাও হতে পারে। অথচ তার সংশোধনও কাম্য। কেননা সংশোধন যদি না হয়, তবে সে একের পর এক জুলুম করেই যাবে। ফলে তার জুলুম-অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকবে। আর এভাবে অপরাপর মানুষও তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং জুলুম থেকে ফেরানোর জন্য তাকে ন্যায় ও ইনসাফের শিক্ষা দেওয়াও জরুরি। সেজন্যই আদেশ করা হয়েছে যে, সৎকাজের নির্দেশ দাও।
প্রকাশ থাকে যে, সৎকাজের নির্দেশ দেওয়ার জন্য প্রথমে কোনটা সৎকাজ এবং কোনটা অসৎকাজ তা জেনে নেওয়া জরুরি। অন্যথায় আশঙ্কা রয়েছে সৎকাজের নির্দেশ দিতে গিয়ে এমন কোনও কাজের নির্দেশ দেওয়া হবে, যা শরী'আত মোটেই অনুমোদন করে না। এমনিভাবে অসৎকাজে বাধা দিয়ে গিয়ে এমন কাজে বাধা দেওয়া হবে, যা মোটেই নাজায়েয কাজ নয়; বরং শরী'আত তা অনুমোদন করে কিংবা ছাওয়াবের কাজ সাব্যস্ত করে। এরূপ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ প্রকৃত অর্থে হয়ে যায় সৎকাজে নিষেধ ও অসৎকাজের আদেশ, যা কিনা নিজেই একটি কঠিন অন্যায় ও অসৎকাজ। সুতরাং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধকারীদেরকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অবশ্যই ইলম হাসিল করে নিতে হবে। যে বিষয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত ইলম হাসিল করা না হবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত এরূপ বিষয়ে দায়িত্ব পালন করতে যাওয়া কিছুতেই সমীচীন নয়।
এ আয়াতে তৃতীয় নির্দেশ হচ্ছে - وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ (অজ্ঞজনদের অগ্রাহ্য করো)। অর্থাৎ যারা তোমার সঙ্গে মন্দ কথা বলে, তুমি তার উত্তরে তাদের সঙ্গে মন্দ কথা বলো না। যারা তোমার প্রতি দুর্ব্যবহার করে, বিপরীতে তুমি তাদের প্রতি মন্দ আচরণ করো না। যারা তোমার প্রতি জুলুম-অত্যাচার করে, তুমি তাদের প্রতি জুলুম করো না। বরং তুমি ধৈর্যধারণ করবে, উত্তম কথা বলবে ও তাদেরকে ক্ষমা করে দেবে। তোমার ক্ষমাশীল আচরণের পরও যদি দেখা যায় তারা নিজেদের সংশোধন করছে না, এত উন্নত আচরণ করা সত্ত্বেও তাদের জীবনে কোনও পরিবর্তন আসছে না; আগের মতোই অন্যায় ও অসৎকাজ করে যাচ্ছে এবং যথারীতি জেদ ও হঠকারিতার উপর অবিচল রয়েছে, এরূপ ক্ষেত্রেও ধৈর্য না হারিয়ে এবং উত্তেজিত না হয়ে বরং তাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলা কর্তব্য। যেমন অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا (63)
‘এবং অজ্ঞলোক যখন তাদেরকে লক্ষ্য করে (অজ্ঞতাসুলভ) কথা বলে, তখন তারা শান্তিপূর্ণ কথা বলে।(সূরা ফুরকান (২৫), আয়াত ৬৩)
অর্থাৎ তারা অজ্ঞজনদের কটু কথা ও গালিগালাজের জবাব মন্দ কথা দ্বারা দেয় নাঃ বরং ভদ্রোচিত ভাষায় দিয়ে থাকে এবং 'ভাই, সালাম' বলে তাদের এড়িয়ে যায়। একবার এক ব্যক্তি বিখ্যাত তাবি'ঈ ইয়াস ইবন মু'আবিয়া রহ.-কে গালাগাল করছিল। তিনি কোনও জবাব দিচ্ছিলেন না। শেষে লোকটি বলল, ওহে! এসব তো আমি তোমাকেই বলছি। তিনি উত্তর দিলেন, আমি তো উপেক্ষাও তোমাকেই করছি।
ইবন কাছীর রহ. পাশ কাটানোর একটা ব্যাখ্যা এরকমও করেছেন যে, তাদের দুর্ব্যবহারের উত্তর দুর্ব্যবহার দ্বারা নয়; বরং সদ্ব্যবহার দ্বারা করা চাই। এমন নয় যে, তাদের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে সৎকাজের আদেশ করা ছেড়ে দেওয়া হল।
প্রকাশ থাকে যে, ক্ষমাশীলতা অবলম্বন ও পাশ কাটিয়ে চলার আদেশ দ্বারা এটা অনিবার্য হয়ে যায় না যে, যে ক্ষেত্রে জিহাদের প্রয়োজন হবে, সে ক্ষেত্রে জিহাদ করা হবে না। অন্যের দুর্ব্যবহার ও জুলুম-নিপীড়ন ক্ষমা করা এক জিনিস, আর আল্লাহ তা'আলার দীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জিহাদ করা আরেক জিনিস। এ দুইয়ের মধ্যে কোনও বৈপরীত্য নেই। একটির সম্পর্ক নিজ ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে, আরেকটির সম্পর্ক দীনের সঙ্গে। অর্থাৎ ব্যক্তিগত বিষয়ে ক্ষমাশীলতা অবলম্বন করা হবে আর দীনের বিষয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, তা ক্ষেত্রবিশেষে জিহাদ ও কিতালরূপেও হতে পারে। এক হাদীছে আছে-
وَمَا انْتَقَمَ رَسُولُ اللهِ ﷺ لِنَفْسِهِ فِي شَيْءٍ قَط ، إِلَّا أَنْ تُنتَهَكَ حُرْمَةُ اللَّهِ، فَيَنْتَقِمَ لِلَّهِ تَعَالَى
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও নিজ ব্যক্তিগত কোনও বিষয়ে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। কিন্তু আল্লাহ তা'আলার কোনও বিধানের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হলে তিনি অবশ্যই আল্লাহ তা'আলার জন্য প্রতিশোধ নিতেন।(সহীহ বুখারী: ৩৫৬০; সহীহ মুসলিম: ২৩২৭; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৭৮৫; মুআত্তা মালিক: ৩৩৫১; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৪৩৮২; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ১৩২৮৩; বাগাবী শারহুস সুন্নাহ: ৩৭০৩; মুসনাদুল হুমায়দী: ২৬০; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৪২২৩)
আয়াতটির শিক্ষা
ক. ক্ষমাশীলতা একটি মহৎ গুণ। আমাদেরকে এ গুণ আয়ত্ত করতে হবে।
খ. আপন সামর্থ্য অনুযায়ী সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজে নিষেধ করা প্রতিটি মুসলিমের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য।
গ. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা একান্ত জরুরি।
ঘ. অজ্ঞ ও অভদ্র লোকের সঙ্গে কিছুতেই তর্কে জড়ানো উচিত নয়। তাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলা কর্তব্য।
ঙ. মানুষের দুর্ব্যবহারের জবাব কখনও দুর্ব্যবহার দ্বারা দিতে নেই। বরং তা দিতে হবে উত্তম ব্যবহার দ্বারা।
***
হযরত জা'ফর সাদিক রহ. বলেন, উত্তম আখলাক-চরিত্র সম্পর্কে এটি কুরআন মাজীদের সর্বাপেক্ষা পূর্ণাঙ্গ আয়াত। অর্থাৎ উত্তম চরিত্রের সবকিছুই এর মধ্যে এসে গেছে।
***
তিন নং আয়াত
وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ (34) وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الَّذِينَ صَبَرُوا وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ (35)
অর্থ: ভালো ও মন্দ সমান হয় না। তুমি মন্দকে প্রতিহত করো এমন পন্থায়, যা হবে উৎকৃষ্ট। ফলে যার ও তোমার মধ্যে শত্রুতা ছিল, সে সহসাই হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। আর এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয়, যারা সবর করে এবং এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয়, যারা মহাভাগ্যবান।(সূরা ফুসসিলাত (৪১), আয়াত ৩৪-৩৫)
ব্যাখ্যা
এটি সামাজিকতা ও উত্তম চরিত্রের শিক্ষা সম্পর্কিত অতি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত। প্রথমে আল্লাহ তা'আলা বলেন- وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ (ভালো ও মন্দ সমান হয় না)। অর্থাৎ বদলা ও উত্তম পরিণামের দিক থেকে ভালো আচরণ ও মন্দ আচরণ সমান নয় এবং ভালো স্বভাব ও মন্দ স্বভাব সমান নয়। কাজেই মানুষের উচিত যথাসম্ভব মন্দ স্বভাব পরিহার করে ভালো স্বভাব আয়ত্ত করা, এমনিভাবে মন্দ আচার-ব্যবহার ছেড়ে দিয়ে ভালো আচার-ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হওয়া। সুতরাং রাগের বদলে ধৈর্যধারণ করা, দুর্ব্যবহারের ক্ষেত্রে সহনশীলতার পরিচয় দেওয়া, কৃপণতার বদলে বদান্যতা অবলম্বন করা, প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছা দমন করে ক্ষমা প্রদর্শন করা, এমনিভাবে আরও মন্দ যা-কিছু আছে তার বিপরীতে ভালো ও প্রশংসনীয় অবস্থান গ্রহণ করাই হওয়া দরকার একজন মুমিনের শান।
ভালো ও মন্দ যে বরাবর নয়, এ মৌলিক শিক্ষাদানের পর আল্লাহ তা'আলা এর অধীনে ব্যবহারিক শিক্ষাদান করছেন যে- ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ (তুমি মন্দকে প্রতিহত করো এমন পন্থায়, যা হবে উৎকৃষ্ট)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. এর ব্যাখ্যা করেন যে, যে ব্যক্তি তোমার উপর রাগ করবে, তুমি তার মোকাবেলায় ধৈর্যধারণ করবে। যে ব্যক্তি তোমার প্রতি দুর্ব্যবহার করবে, তুমি তার মোকাবেলায় সহনশীল আচরণ করবে। এমনিভাবে যে ব্যক্তি তোমাকে কষ্ট দেবে, তুমি তাকে ক্ষমা করবে। একবার এক ব্যক্তি একজনকে গালাগাল করছিল। এর উত্তরে সে ব্যক্তি বলল, তুমি যদি সত্যবাদী হও, তবে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন। আর যদি মিথ্যাবাদী হও, তবে আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন। এটা মন্দ আচরণের জবাব ভালো আচরণ দ্বারা দেওয়ার একটা দৃষ্টান্ত। এটা উন্নত আখলাকের শিক্ষা। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَى أَكْرَم أَخْلَاقِ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ؟ أَنْ تَعْفُوَ عَمَّنْ ظَلَمَكَ، وَتَصِلَ مَنْ قطعكَ، وَتُعْطِيَ مَنْ حَرَمَكَ
‘আমি কি তোমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতের মহান চরিত্র সম্পর্কে অবহিত করব না? তা হল যে ব্যক্তি তোমার উপর জুলুম করবে, তুমি তাকে ক্ষমা করবে। যে ব্যক্তি তোমার সঙ্গে আত্মীয়তা ছিন্ন করবে, তুমি তার সঙ্গে আত্মীয়তা রক্ষা করবে। যে ব্যক্তি তোমাকে বঞ্চিত করবে, তুমি তাকে তার প্রাপ্য প্রদান করবে।(বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২১০৯১; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত : ৫৫৬৭)
এরূপ মহান চরিত্র অবলম্বন করলে তার কী সুফল পাওয়া যাবে? আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন- فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ (ফলে যার ও তোমার মধ্যে শত্রুতা ছিল, সে সহসাই হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু)। এটা অনেক বড় প্রাপ্তি। মানুষকে শত্রু বানানোর মধ্যে কোনও কল্যাণ নেই। বন্ধু বানানোর মধ্যেই কল্যাণ নিহিত। তাতে পার্থিব জীবন নিরাপদ ও স্বস্তিকর হয়। ফলে দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কাজ নির্বিঘ্নে করা সম্ভব হয়। পারস্পরিক শত্রুতা কেবল দুনিয়ার সুখ ও আরামই নষ্ট করে না, আখিরাতও বরবাদ করে দেয়। কেননা এটা হাজারও গুনাহের উৎস। তাই এর থেকে নিস্তার পাওয়া অতীব জরুরি। এ আয়াতে নিস্তার পাওয়ার উপায় বাতলে দেওয়া হয়েছে। যারাই শত্রু বা যারা শত্রুতামূলক আচরণ করে, তাদের সঙ্গে যদি নিরবচ্ছিন্নভাবে ভালো ব্যবহার করা যায়, তবে একদিন তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবেই। তখন তারা কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে, নিজেদের শোধরাতে চেষ্টা করবে এবং শত্রুতা ছেড়ে দিয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবে; তা বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হবে। এটা কুরআন মাজীদের বাণী। ভুল ও ব্যর্থ হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহান চরিত্রের এ পন্থায়ই শত্রুদের জয় করেছিলেন। যুগে যুগে তাঁর প্রকৃত অনুসারীগণ নিজেদের জীবনে মহান চরিত্রের এ শিক্ষার বাস্তব চর্চা করেছেন। তারা এর সুফলও পেয়েছেন। আমাদেরকেও সামাজিক এবং দ্বিপাক্ষিক সকল ক্ষেত্রে এ নীতির চর্চা করতে হবে। সন্দেহ নেই, এর জন্য দরকার সবর ও ধৈর্যের গুণ আঁকড়ে ধরা। তার মাধ্যমেই এ নীতির চর্চা সম্ভব হয়। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الَّذِينَ صَبَرُوا (আর এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয়, যারা সবর করে)। অর্থাৎ অন্যের মন্দ ব্যবহারের মোকাবেলায় ভালো ব্যবহার করে যাওয়া কেবল তাদের পক্ষেই সম্ভব হয়, যারা সংযম ও ধৈর্যধারণে অভ্যস্ত। কেননা অন্যে যখন মন্দ আচরণ করে, তখন নিজ মনে আবেগ-উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ফলে মন্দের বিপরীতে অধিকতর মন্দ আচরণ করার ইচ্ছা জাগে। গালির জবাব দিতে ইচ্ছা হয় মার দিয়ে। মনের সে ইচ্ছা ও আবেগ সংযত করা না গেলে এভাবে মন্দের জবাব দেওয়া হয় অধিকতর মন্দ দ্বারা। এর থেকে বাঁচার উপায় নিজ আবেগ-উত্তেজনা সংযত করা। এরই নাম সবর। সবর ও সংযমে অভ্যস্ত হতে পারলে উত্তেজনা প্রশমিত করে ক্ষমাপ্রদর্শন করা সম্ভব হয়। সম্ভব হয় উত্তম আচরণ করা। সুতরাং এ আয়াত আমাদেরকে উৎসাহ দিচ্ছে, যেন আমরা সবর করতে অভ্যস্ত হই, আত্মসংযমী হয়ে উঠি। তা হতে পারাটা অনেক বড় সৌভাগ্যের বিষয়। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ (এবং এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয়, যারা মহাভাগ্যবান)। حَظّ শব্দের অর্থ অংশ। আর عَظِيْم এর অর্থ মহা, বিরাট। একত্রে حظ عَظِيم এর অর্থ বিরাট অংশ। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য কল্যাণের বিশাল অংশ। কাতাদা ও মুজাহিদ রহ. বলেন, حظ عَظِيم হল জান্নাত। হাসান বসরী রহ. বলেন, আল্লাহর কসম! কখনও কোনও অংশ জান্নাতের চেয়ে বড় হতে পারে না। এ হিসেবে আয়াতটির সারমর্ম হবে, যারা জান্নাতবাসী হবে, কেবল সেই ভাগ্যবানেরাই সবর ও সংযমের মাধ্যমে মন্দ আচরণের জবাবে ভালো আচরণ করার গুণ অর্জনে সক্ষম হয়। এর দ্বারা বোঝা যায় এরূপ আচরণের প্রতিদান হল জান্নাত। সুতরাং যারা জান্নাতলাভের প্রত্যাশী, তাদেরকে অবশ্যই এ গুণ অর্জন করতে হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. অন্যের প্রতি তার মন্দ আচরণের বিপরীতে কখনও মন্দ আচরণ করতে নেই।
খ. মন্দ আচরণের জবাবে ভালো আচরণ করাটা সংযমী ও ধৈর্যশীল হওয়ার পরিচায়ক।
গ. শত্রুকে বন্ধু বানানোর মোক্ষম উপায় তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে থাকা।
ঘ. জান্নাতলাভের একটি শ্রেষ্ঠ উপায় ধৈর্য ধরা ও অন্যের প্রতি তার মন্দ আচরণ সত্ত্বেও ভালো আচরণ করা।
চার নং আয়াত
وَلَمَنْ صَبَرَ وَغَفَرَ إِنَّ ذَلِكَ لَمِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ
অর্থ: প্রকৃতপক্ষে যে সবর অবলম্বন করে ও ক্ষমা প্রদর্শন করে, তো এটা অবশ্যই অত্যন্ত হিম্মতের কাজ। (সূরা শূরা (৪২), আয়াত ৪৩)
ব্যাখ্যা
কারও উপর যদি জুলুম করা হয় আর তার প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা থাকে, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিশোধ না নিয়ে তাকে ক্ষমা করে দেয় ও ধৈর্যধারণ করে, তবে তা অতি বড় পুণ্যের কাজ। এরূপ করা কেবল উঁচু হিম্মত ও দৃঢ় মনোবলসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। যে ব্যক্তি ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ ও মনকে সংযত করার মতো ক্ষমতা রাখে না, তার পক্ষে সহজে ক্ষমা করা সম্ভব হয় না। সে উত্তেজনাবশে প্রতিশোধ নিয়ে ফেলে এবং সেই প্রতিশোধ নিতে গিয়ে অনেক সময়ই তার দ্বারা বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। ফলে মজলুম ব্যক্তি উল্টো জালেমে পরিণত হয়। জালেম হওয়া অপেক্ষা মজলুম হয়ে থাকা ঢের ভালো। কারণ মজলুম ব্যক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত হয় আর জালেমের প্রতি আল্লাহর ক্রোধ নিপতিত হয়। সেই ক্রোধ থেকে বাঁচা ও আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্তির লক্ষ্যে প্রত্যেকের কর্তব্য ক্ষমাপ্রবণ হওয়া ও ধৈর্যধারণ করা, যদিও এটা কঠিন এবং নফস ও মনের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করার বিষয়। একবার হাসান বসরী রহ.-এর মজলিসে এক ব্যক্তি আরেক ব্যক্তিকে গালমন্দ করছিল। সে তা সহ্য করছিল এবং নিজ রাগ হজম করছিল। কিন্তু তাতে তার বেশ কষ্ট হচ্ছিল। সে কষ্টে তার শরীর থেকে ঘাম ঝরতে শুরু করল। শেষপর্যন্ত সে ঘাম মুছে এই আয়াত পড়তে পড়তে উঠে যায় যে- وَلَمَنْ صَبَرَ وَغَفَرَ إِنَّ ذَلِكَ لَمِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ (প্রকৃতপক্ষে যে সবর অবলম্বন করে ও ক্ষমা প্রদর্শন করে, তো এটা অবশ্যই অত্যন্ত হিম্মতের কাজ)।
প্রকাশ থাকে যে, ক্ষমা প্রদর্শনের ফলে জালেম ও অপরাধী ব্যক্তির স্পর্ধা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবে সে ক্ষেত্রে ক্ষমা না করে প্রতিশোধ গ্রহণও জায়েয; বরং ক্ষেত্র বিশেষে প্রতিশোধ নেওয়া উত্তম, যেমন এক আয়াতে বর্ণিত হয়েছে-
وَالَّذِينَ إِذَا أَصَابَهُمُ الْبَغْيُ هُمْ يَنْتَصِرُونَ (39) وَجَزَاءُ سَيِّئَةٍ سَيِّئَةٌ مِثْلُهَا
‘এবং যখন তাদের প্রতি কোনও জুলুম করা হয় তখন তারা তা প্রতিহত করে। মন্দের বদলা অনুরূপ মন্দ।(সূরা শূরা (৪২), আয়াত ৩৯-৪০)
তবে মন্দের বদলা যেহেতু অনুরূপ মন্দ অর্থাৎ জালেম যে পরিমাণ জুলুম ও কষ্টদান করে, প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষেত্রে তাকেও সমপরিমাণ কষ্টই দেওয়া যাবে, এর বেশি নয়। তাই প্রতিশোধ গ্রহণে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি, যাতে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে গিয়ে জুলুম না হয়ে যায়। সেজন্যই সাধারণ অবস্থায় প্রতিশোধগ্রহণ অপেক্ষা ক্ষমা করাই শ্রেয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য উলামায়ে কেরামের শরণাপন্ন হওয়া কর্তব্য।
আয়াতটির শিক্ষা
কেউ কষ্ট-ক্লেশ দিলে তাতে ধৈর্য ধরা ও ক্ষমাপ্রদর্শন করা উচিত। এটা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ।
আল্লাহ তা'আলার পসন্দনীয় দু'টি গুণ
হাদীছ নং: ৬৩১
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্দুল কায়স গোত্রের আশাজ্জ রাযি.-কে বললেন, নিশ্চয়ই তোমার মধ্যে দু'টি স্বভাব আছে, যা আল্লাহ পসন্দ করেন। সহনশীলতা ও ধীরস্থিরতা। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম : ১৭; জামে' তিরমিযী: ২০১১; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৮৮; মুসনাদে আহমাদ: ১১১৭৫; সহীহ ইবন হিব্বান: ৭২০৪; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ১২৯৬৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২০২৭৩; সুনানে আবূ দাউদ: ৫২২৫; মুসনাদুল বাযযার: ১)
হাদীছ নং: ৬৩১
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্দুল কায়স গোত্রের আশাজ্জ রাযি.-কে বললেন, নিশ্চয়ই তোমার মধ্যে দু'টি স্বভাব আছে, যা আল্লাহ পসন্দ করেন। সহনশীলতা ও ধীরস্থিরতা। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম : ১৭; জামে' তিরমিযী: ২০১১; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৮৮; মুসনাদে আহমাদ: ১১১৭৫; সহীহ ইবন হিব্বান: ৭২০৪; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ১২৯৬৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২০২৭৩; সুনানে আবূ দাউদ: ৫২২৫; মুসনাদুল বাযযার: ১)
74 - باب الحلم والأناة والرفق
قَالَ الله تَعَالَى: {وَالكَاظِمِينَ الغَيْظَ وَالعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللهُ يُحِبُّ المُحْسِنينَ} [آل عمران: 134]، وقال تَعَالَى: {خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الجَاهِلينَ} [الأعراف: 199]، وقال تَعَالَى: {وَلاَ تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلاَ السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أحْسَنُ فَإذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ وَمَا يُلَقَّاهَا إِلاَّ الَّذِينَ صَبَرُوا وَمَا يُلَقَّاهَا إِلاَّ ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ} [فصلت: 34 - 35]، وقال تَعَالَى: {وَلَمنْ صَبَرَ وَغَفَرَ إنَّ ذَلِكَ لَمِنْ عَزْمِ الأُمُورِ}
[الشورى: 43].
قَالَ الله تَعَالَى: {وَالكَاظِمِينَ الغَيْظَ وَالعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللهُ يُحِبُّ المُحْسِنينَ} [آل عمران: 134]، وقال تَعَالَى: {خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الجَاهِلينَ} [الأعراف: 199]، وقال تَعَالَى: {وَلاَ تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلاَ السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أحْسَنُ فَإذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ وَمَا يُلَقَّاهَا إِلاَّ الَّذِينَ صَبَرُوا وَمَا يُلَقَّاهَا إِلاَّ ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ} [فصلت: 34 - 35]، وقال تَعَالَى: {وَلَمنْ صَبَرَ وَغَفَرَ إنَّ ذَلِكَ لَمِنْ عَزْمِ الأُمُورِ}
[الشورى: 43].
631 - وعن ابن عباس رضي الله عنهما، قَالَ: قَالَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - لأَشَجِّ عَبْدِ القَيْسِ: «إنَّ فيكَ خَصْلَتَيْنِ يُحِبُّهُمَا اللهُ: الْحِلْمُ وَالأنَاةُ». رواه مسلم. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছটিতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আশাজ্জ রাযি.-এর দু'টি সদগুণের প্রশংসা করে বলেন যে, এ দু'টি আল্লাহ তা'আলা পসন্দ করেন। গুণদু'টি হল- الحِلْمُ وَالْأَنَاةُ (সহনশীলতা ও ধীরস্থিরতা)। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রশংসা করলে হযরত আশাজ্জ রাযি. জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এ দু'টি গুণ কি আমার মধ্যে নতুন জন্ম নিয়েছে, নাকি আগে থেকেই ছিল? তিনি বললেন, আগে থেকেই ছিল। তখন তিনি এই বলে আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করলেন যে, সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে এমন দু'টি স্বভাব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, যা তিনি পসন্দ করেন।
হযরত আশাজ্জ রাযি.-এর চরিত্রে সহনশীলতা ও ধীরস্থিরতার গুণ বিদ্যমান ছিল। এ কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রশংসা করেছেন। বোঝা গেল এ দু'টি প্রশংসনীয় গুণ, যা প্রত্যেক মুমিনের অর্জন করা উচিত।
এক বর্ণনায় আছে-
الْأَنَاةُ مِنَ اللَّهِ تَعَالَى، وَالْعَجَلَةُ مِنَ الشَّيْطَانِ
‘ধীরস্থিরতা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে আর তাড়াহুড়া করাটা শয়তানের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। (জামে' তিরমিযী: ২০১২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ৫৭০২; তাবারানী, মাকারিমুল আখলাক: ২৭; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৯৮)
বলা হয়ে থাকে, তাড়াহুড়া করাটা শয়তানের প্ররোচনায় হয়ে থাকে পাঁচটি ক্ষেত্র ছাড়া- অতিথি উপস্থিত হলে খাবার পরিবেশন করা, কেউ মারা গেলে তার দাফন-কাফন করা, কন্যাসন্তান বালেগা হলে তার বিবাহ সম্পন্ন করা, দেনা পরিশোধ করা এবং কোনও গুনাহ হয়ে গেলে তা থেকে তাওবা করা।
প্রকাশ থাকে যে, তাড়াহুড়া নিন্দনীয় দুনিয়াবী কাজে। দীনের কাজে বিলম্ব করতে নেই। সুযোগ হওয়া মাত্রই করে ফেলা উচিত। হযরত উমর রাযি. বলেন, ধীরস্থিরতা সব কাজেই ভালো, তবে আখিরাতের কাজে নয়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কোনও কাজে তাড়াহুড়া করতে নেই। ধীরস্থিরভাবে করলেই কাজ সুন্দর ও সঠিক হয়।
খ. অন্যের প্রতি সহনশীল থাকা একান্ত কর্তব্য। এটা পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে সহায়ক।
হযরত আশাজ্জ রাযি.-এর চরিত্রে সহনশীলতা ও ধীরস্থিরতার গুণ বিদ্যমান ছিল। এ কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রশংসা করেছেন। বোঝা গেল এ দু'টি প্রশংসনীয় গুণ, যা প্রত্যেক মুমিনের অর্জন করা উচিত।
এক বর্ণনায় আছে-
الْأَنَاةُ مِنَ اللَّهِ تَعَالَى، وَالْعَجَلَةُ مِنَ الشَّيْطَانِ
‘ধীরস্থিরতা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে আর তাড়াহুড়া করাটা শয়তানের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। (জামে' তিরমিযী: ২০১২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ৫৭০২; তাবারানী, মাকারিমুল আখলাক: ২৭; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৯৮)
বলা হয়ে থাকে, তাড়াহুড়া করাটা শয়তানের প্ররোচনায় হয়ে থাকে পাঁচটি ক্ষেত্র ছাড়া- অতিথি উপস্থিত হলে খাবার পরিবেশন করা, কেউ মারা গেলে তার দাফন-কাফন করা, কন্যাসন্তান বালেগা হলে তার বিবাহ সম্পন্ন করা, দেনা পরিশোধ করা এবং কোনও গুনাহ হয়ে গেলে তা থেকে তাওবা করা।
প্রকাশ থাকে যে, তাড়াহুড়া নিন্দনীয় দুনিয়াবী কাজে। দীনের কাজে বিলম্ব করতে নেই। সুযোগ হওয়া মাত্রই করে ফেলা উচিত। হযরত উমর রাযি. বলেন, ধীরস্থিরতা সব কাজেই ভালো, তবে আখিরাতের কাজে নয়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কোনও কাজে তাড়াহুড়া করতে নেই। ধীরস্থিরভাবে করলেই কাজ সুন্দর ও সঠিক হয়।
খ. অন্যের প্রতি সহনশীল থাকা একান্ত কর্তব্য। এটা পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে সহায়ক।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
