মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা রহঃ

২৪. আহকাম (রাষ্ট্রনীতি) অধ্যায়

হাদীস নং: ৪৯২
আহকামের বর্ণনা
হাদীস নং- ৪৯২

হযরত ইব্ন আব্বাস (রাযিঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: যখন দাবিদার বা ফরিয়াদীর (مدعى) নিকট কোন দলীল পাওয়া না যাবে, তখন বিবাদী (مدعى عليه) থেকে কসম বা শপথ গ্রহণ করা উত্তম।
عَنْ حَمَّادٍ، عَنِ الشَّعْبِيِّ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الْمُدَّعَى عَلَيْهِ أَوْلَى بِالْيَمِينِ إِذَا لَمْ تَكُنْ بَيِّنَةٌ»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

বায়হাকী হযরত উমর (রা) থেকে মরফু হাদীস বর্ণনা করেছেন : المدعى عليه أولى باليمين إلا أن تقوم عليه البينة “বিবাদীর জন্য শপথ কিন্তু এটা তখনই হবে যখন দাবিদার তার দাবির স্বপক্ষে সাক্ষী পেশ করবে।”
দাবিদারের সাক্ষী পেশ করার পর বিবাদী থেকে শপথ নেয়ার কোন প্রয়োজন নেই বায়হাকী। হযরত ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে মরফু হাদীস রিওয়ায়েত করেনঃ
ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال لو يعطى الله بدعواهم لادعى رجال أموال قوم ودمائهم ولكن البينة على المدعي واليمين على من أنكر
“রাসূলূল্লাহ (সা) বলেছেন: যদি আল্লাহ তা'আলা শুধু মানুষের দাবির উপর ফয়সালা দিতেন। তাহলে মানুষ দাবি করে অন্য মানুষের মাল-দৌলত নিয়ে নিত এবং তাদের রক্তমূল্য আদায় করতো। কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে দাবিদারের উপর সাক্ষী পেশ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং অস্বীকারকারীর (مدعى عليه) উপর কসম বা শপথ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এ হাদীস মূলত দু'টি মতবিরোধপূর্ণ মাসয়ালা নিয়ে। ইমাম শাফিঈ (র)-এর বিরুদ্ধে ইমাম আবু হানীফা (র)-এর এতে শক্ত দলীল রয়েছে। মতপার্থক্যের বিষয় হলো এই যে, দাবি পেশ করার পর সবার মতে দাবিদার থেকে সাক্ষী গ্রহণ করতে হবে। যদি সে শপথ ( قسم) করে, তা হলে ফয়সালা তার পক্ষে হবে। যদি সে শপথ করতে অস্বীকার করে, তা হলে ইমাম আবূ হানীফার মতে এরপরও দাবিদারের (مدعى) পক্ষেই ফয়সালা হবে এবং দাবিদার থেকে শপথ নেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। কেননা মোকাদ্দমার অনুসন্ধানের সর্বশেষ যে দিক ছিল, তা সমাপ্ত হয়েছে।
ইমান শাফিঈ (র) বলেন, এ অবস্থায় দাবিদারের শপথ করতে হবে। যদি সে শপথ করে, তাহলে সে বিজয়ী হবে অর্থাৎ তার দাবি বলবৎ হবে। অন্যথায় তার দাবি গ্রহণযোগ্য হবে না। ইমাম মালিক ও ইমাম আহমদও ইমাম শাফিঈ-এর মত পোষণ করেন। ইমাম শাফিঈ (র) বলেন, বিবাদী যখন শপথ গ্রহণে অস্বীকার করে, তখন বাহ্যিক দৃষ্টিতে দাবিদারের (مدعى) অনুকূল হলো, সুতরাং তার থেকে শপথ গ্রহণ করা হবে।
ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মাযহাবের স্বপক্ষে বর্ণিত হাদীসসমূহ অকাট্য দলীল। যাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দাবিদারের যিম্মা শুধু সাক্ষী পেশ করা। শপথের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই এবং বিবাদীর (مدعى عليه) যিম্মায় হলো শুধু শপথ এবং এর সাথেই তার ভাগ্যের সর্বশেষ ফয়সালা। সাক্ষী প্রদানের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ আঁ হযরত (সা) দাবিদার ও বিবাদীর প্রত্যেকের দায়িত্ব বন্টন করে দিয়েছেন। সুতরাং এতে এখন কোন সংযোগ অবশিষ্ট নেই।
তিরমিযী শরীফে হযরত ওয়ায়েল (রা) থেকে বর্ণিত আছে :
قال جاء رجل من حضرموت ورجل كندة إلى النبي صلى الله عليه وسلم فقال الحضرمي يا رسول الله إن هذا غلبني على أرض لي فقال الكندي هي أرضي وفي يدى ليس له فيها حق فقال النبي صلى الله عليه وسلم للحضرمي ألك بينة قال لا قال فلك يمينه قال يا رسول الله إن الرجل فاجر لا يبالي على ما حلف عليه وليس يتورع من شيء قال ليس لك منه إلا ذلك قال انطلق الرجل ليحلف له فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم لما أدبر لئن أدبر على ماله ليأكله ليلقين الله وهو عنه معرض
“তিনি বলেন, হাদরামাউতের একজন বাসিন্দা এবং কিন্দার একজন বাসিন্দা নবী করীম (সা)-এর খেদমতে উপস্থিত হলো। হাদরামী বললোঃ হে আল্লাহর রাসূল! এ ব্যক্তি আমার জমি ছিনিয়ে নিয়েছে। কিন্দাবাসী বললো : এটা আমার জনি, আমার অধিকার আছে, এতে তার কোন অধিকার নেই। তখন হুযুর (সা) হাদরামীকে বললেন : তোমার দাবির স্বপক্ষে তোমার নিকট সাক্ষী আছে কি? সে বললো নেই। তখন তিনি তাকে বললেন এখন এ বিষয়ে তোমার থেকে শপথ (قسم) গ্রহণ করতে হবে। তখন ঐ ব্যক্তি বললোঃ হে আল্লাহর রাসূল। এ লোকটি হলো মন্দ চরিত্রের। সে ভয় বা চিন্তাই করবে না যে, কিসের উপর সে শপথ করলো। এবং কোন বস্তু থেকে সে মুক্ত থাকে না। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন : তোমার জন্য এখন তারপক্ষ থেকে এটাই আছে (আর কি বা থাকতে পারে)। হযরত ওয়ায়েল (রা) বলেন, ঐ ব্যক্তি শপথের জন্য গেল। ফিরে আসার পর রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে বললেন : যদি তার মালের উপর শপথ কর যে, তার মাল হজম (ভোগ) করবে, তা হলে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে এমনিভাবে মিলিত হবে যে, আল্লাহ্ তা'আলা মুখ ফিরিয়ে রাখবেন।
বুখারী ও মুসলিম শরীফে কিছু বাক্যের পরিবর্তন সহ এ হাদীস বর্ণিত আছে। সুতরাং এ হাদীসে হুযূর আকরাম (সা)-এর বাণীঃ ليس لك منه إلا ذلك দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, বিবাদীকেই শপথ গ্রহণ করতে হবে এবং দাবিদারের পক্ষ থেকে সাক্ষী পাওয়া না গেলে এটা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। অতঃপর আরবী ব্যাকরণের নীতিমালা অনুযায়ী হাদীসটি পর্যালোচনা করলেও হানাফী মাযহাবের সত্যতা সুস্পষ্ট হয়ে যায়। হযরত ইব্ন আব্বাসের হাদীসের بينة এবং يمين উভয়ের উপর الف و لام এসেছে। এখানে কোন বিশেষ بينة এবং يمين উদ্দেশ্য নয়। সুতরাং এখানে جنس بينة এবং جنس يمين উদ্দেশ্য হবে। এবং جنس بينة এর সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্ত কিছু দাবিদারের সাথে সুনির্দিষ্ট হবে এবং يمين -এর সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্ত কিছু বিবাদীর জন্য হবে। সুতরাং يمين এর কোন ব্যক্তি বা অংশকে দাবিদারের (مدعى) জন্য দলীল হিসেবে গ্রহণ করা হলো হাদীসের বিরোধিতা করা।
মতপার্থক্যের দ্বিতীয় পর্যায় হলো এই যে, সময়মত যদি দাবিদার সাক্ষী উপস্থিত করতে অসমর্থ হয় এবং একজন মাত্র সাক্ষী উপস্থিত করা সম্ভব হয়, তা হলে ইমাম শাফিঈ-এর মতে তার থেকে শপথ গ্রহণ করতে হবে এবং একজন সাক্ষী ও শপথের কারণে তার পক্ষে রায় দেয়া হবে। ইমাম আবূ হানীফা (র) বলেন, দাবিদারের (مدعى) জন্য মাত্র দু'টি ব্যবস্থা রয়েছে। হয়ত সে সাক্ষী হিসেবে দু'জন পুরুষ অথবা একজন পুরুষ ও দু'জন মহিলা উপস্থিত করবে। যদি এ দুটো ব্যবস্থা করতে অসমর্থ হয়, তা হলে এরপর বিবাদীর উপর কসমের দায়িত্ব পড়বে। কসম বা শপথের সাথে দাবিদারের কোন সম্পর্ক নেই।
শাফিঈ মাযহাবের দলীল হিসেবে মুসলিম শরীফ থেকে বর্ণিত, হযরত ইব্ন আব্বাস (রা) বর্ণিত হাদীস পেশ করেছেন : ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قضى بيمين وشاهد রাসূলুল্লাহ (সা) (দাবিদারের পক্ষ থেকে) কসম ও এক সাক্ষীর উপর ফয়সালা দান করেছেন। হানাফী মাযহাবের জন্য উপরোল্লিখিত হাদীসই শক্তিশালী দলীল। এ ছাড়া পবিত্র কুরআনের আয়াত: وَاسْتَشْهِدُوا شَهِيدَيْنِ مِنْ رِجَالِكُمْ (দু'জন পুরুষ সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত কর)-এর উপর আরো জোঁর সমর্থন করে। উপরোক্ত হাদীসের দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, কোন অবস্থাতেই দাবিদারের শপথের (قسم) সাথে কোন সম্পর্ক নেই, সে সাক্ষী পেশ করুক বা না করুক। না বিবাদীর সাক্ষী পেশ করার সাথে কোন সম্পর্ক আছে, সে শপথ করুক বা না করুক। বুখারী শরীফে ইয়াহুদীর ঘটনা প্রসঙ্গে হযরত ইব্ন মাসঊদ (রা) থেকে বর্ণিত আছে : شاهداك اويمينه "হয় তো হে দাবিদার। তোমার সাক্ষীর উপরই ফয়সালা নির্ভর করে। অথবা বিবাদীর শপথের উপর।
মোট কথা এতদসংক্রান্ত সমস্ত বিষয় এক জায়গায় জমা হতে পারে না। এ ছাড়া মুসলিম ও "তিরমিযীর হাদীস: ليس لك الا فلك এর সমর্থন করে। অতঃপর এ সমস্ত হাদীস হানাফী ও শাফিঈ সবাই সহীহ বলে মেনে নিয়েছেন। তিরমিযী এটাকে হাসান সহীহ বলেছেন। পক্ষান্তরে কসম এবং এক সাক্ষীর হাদীস غريب (গরীব) বলে মেনে নেয়া হয়েছে। ইয়াহহিয়া ইব্ন মুঈন এটাকে বাতিল করে দিয়েছেন। এ ছাড়া হাদীসে দু’স্থানে ইনকিতা প্রমাণিত হয়েছে। কারো মতে হাদীসের সনদে কায়স নামক যে ব্যক্তি রয়েছেন, তিনি আমর ইব্ন দীনার থেকে হাদীস শ্রবণ করেননি এবং কারো মতে আমর ইব্ন দীনার হযরত ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে হাদীস শ্রবণ করেননি। সুতরাং দারে কুতনী আমর এবং হযরত ইব্ন আব্বাস (রা)-এর মধ্যে তাউসকে নিয়ে এসেছেন। সুতরাং হানাফীদের হাদীস ও এ হাদীসের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। সুতরাং হাদীসের মধ্যে হানাফীদের হাদীসই দলীল হিসেবে শক্তিশালী।
এবার সবচেয়ে শক্তিশালী পবিত্র কুরআনের আয়াত দ্বারা দলীল পেশ করা হলো। আল্লাহ পাক বলেছেন : وَاسْتَشْهِدُوا شَهِيدَيْنِ مِنْ رِجَالِكُمْ فَإِنْ لَمْ يَكُونَا رَجُلَيْنِ فَرَجُلٌ وَامْرَأَتَانِ مِمَّنْ تَرْضَوْنَ مِنَ الشُّهَدَاءِ أَنْ تَضِلَّ إِحْدَاهُمَا فَتُذَكِّرَ إِحْدَاهُمَا الْأُخْرَى “তোমাদের পুরুষদের মধ্য থেকে দু'জনকে সাক্ষী হিসেবে ঠিক কর। যদি দু'জন পুরুষ পাওয়া না যায়,তাহলে একজন পুরুষ ও দু’জন মহিলাকে নাও যাদেরকে তোমরা সাক্ষী হিসেবে পসন্দ কর। যাতে এ দু'জন মহিলা থেকে যদি কেউ একজন ভুলে যায়, তাহলে অন্যজন তা স্মরণ করিয়ে দেবে।" (২:২৮২)
সুতরাং কে আছে এরূপ ব্যক্তি যে আল্লাহ পাকের কালাম থেকে এক সাক্ষী ও কসমের কথা বা বর্ণনা বের করে ? অথচ এ সাক্ষীর ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। এতে দু'টি পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে যে, হয়ত দাবিদার দু’জন পুরুষ সাক্ষী পেশ করবে অথবা দুজন পুরুষ সাক্ষী না পাওয়া গেলে একজন পুরুষ এবং দু’জন মহিলা সাক্ষী হিসেবে পেশ করতে হবে। এ ছাড়া তৃতীয় কোন পদ্ধতির কথা ইঙ্গিতেও বলা হয়নি। সুতরাং এ অবস্থাকে জায়েয বলে স্বীকৃতি দেয়া পবিত্র কুরআনের উপর বাড়াবাড়ি করা হবে।
উপরে বর্ণিত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তরজমা পেশ করা হয়েছে। এবার একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। যেমন তৃতীয় পদ্ধতির যদি সামান্যতম সম্ভাবনা থাকত, তাহলে فَإِنْ لَمْ يَكُونَا এর মাসয়ালার দ্বিতীয় অংশ অসম্পূর্ণ ছাড়া হতো না। বরং বাক্য এরূপভাবে সংযোগ হতোঃ
فإن لم يكونوا فرجل ويمين المدعي
যদি একজন পুরুষ এবং দু'জন মহিলা সাক্ষী পাওয়া না যায়, তা হলে একজন পুরুষ এবং দাবিদারের শপথ করতে হবে। অধিকন্তু উভয় পদ্ধতি পেশ করার পর সর্বশেষ আয়াতে বলা হয়েছে : مِمَّنْ تَرْضَوْنَ مِنَ الشُّهَدَاءِ যে সমস্ত সাক্ষীদেরকে তোমরা পছন্দ কর।” (২:২৮২) অথচ বর্ধিত তৃতীয় পদ্ধতিতে সাক্ষী শুধু একটি। কেননা দাবিদার তো কোন অবস্থাতেই সাক্ষী হতে পারবে না। বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে, ইব্ন শিবরামা বলেন, আবূ যিনাদের সাথে কসম ও এক সাক্ষীর ব্যাপারে আমার আলোচনা হয়েছে, তখন আমি এ আয়াত তিলাওয়াত করি এবং বলি, যখন এক সাক্ষী ও কসম দ্বারা কাজ চলে, তা হলে পবিত্র কুরআনের আয়াত : فَتُذَكِّرَ إِحْدَاهُمَا الْأُخْرَى "একজন মহিলার অন্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার কি প্রয়োজন আছে?
মোট কথা আয়াতের মাধ্যমেও হানাফী মাযহাবের প্রাধান্য ও সঠিকতা প্রমাণিত হয়েছে। পরিশেষে এ স্তরে বাস্তবে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে, ইমাম আবূ হানীফা (র) তিনজন আয়িম্মা থেকে পৃথক হয়ে একাকী যে মতামত পেশ করেছেন, এখানেও তাঁর মতামত যথেষ্ট ভারী ও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।