মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা রহঃ

১. ঈমান-আকাঈদ অধ্যায়

হাদীস নং: ২৩
শাফাআতের বর্ণনা
২৩। হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ্ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। নবী করীম (ﷺ) বলেছেনঃ আল্লাহ্ তা'আলা গুনাহগার মুমিনদেরকে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর শাফা'আতে জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রদান করবেন। হযরত জাবির (রাযিঃ)-এর ছাত্র ইয়াযিদ ইবনে সুহাইব (রাহঃ) বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেছেনঃ وَمَا هُمْ بِخَارِجِينَ مِنْهَا “জাহান্নামীদেরকে সেখান থেকে বের করা হবে না।" হযরত জাবির (রাযিঃ) বলেন, একটু পূর্ব থেকেই পাঠ কর- إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا - এখানে কাফিরদের সম্পর্কে জাহান্নাম থেকে বের না হওয়ার কথা বলা হয়েছে।

অন্য এক রিওয়ায়েতে এভাবে বর্ণিত আছে, মুমিনদের থেকে একদলকে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর শাফা'আতে জাহান্নাম হতে বের করা হবে। ইয়াযিদ বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আল্লাহ বলেছেনঃ তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে না। হযরত জাবির (রাযিঃ) বলেন, একটু পূর্ব থেকে অর্থাৎ – إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا থেকে পাঠ কর। এখানে কাফিরদের সম্পর্কে বলা হয়েছে।

অন্য এক রিওয়ায়েতে ইয়াযিদ থেকে এভাবে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, আমি হযরত জাবিরের নিকট শাফাআত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি উত্তরে বলেন, মুমিনদের থেকে একটি দলকে আল্লাহ্ তা'আলা তাদের পাপের কারণে শাস্তি প্রদান করবেন। অতঃপর হযরত মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর শাফা'আতের কারণে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে বা মুক্তি দেওয়া হবে। ইয়াযিদ বলেন, এরপর আমি বললাম, তাহলে আল্লাহর এ বাণীর অর্থ কি হবে? এই বলে তিনি হাদীসের শেষ পর্যন্ত উল্লেখ করেন।
عَنْ يَزِيدَ بْنِ صُهَيْبٍ، عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أَنَّهُ قَالَ: «يُخْرِجُ اللَّهُ تَعَالَى مِنَ النَّارِ مِنْ أَهْلِ الْإِيمَانِ بِشَفَاعَةِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ» ، قَالَ يَزِيدُ: فَقُلْتُ: إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى يَقُولُ: {وَمَا هُمْ بِخَارِجِينَ مِنَ النَّارِ} [البقرة: 167] ، قَالَ جَابِرٌ: اقْرَأْ مَا قَبْلَهَا: {إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا} [البقرة: 161] إِنَّمَا هِيَ فِي الْكُفَّارِ.
وَفِي رِوَايَةٍ: يَخْرُجُ قَوْمٌ مِنْ أَهْلِ الْإِيمَانِ بِشَفَاعَةِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ يَزِيدُ: قُلْتُ: إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى يَقُولُ: {وَمَا هُمْ بِخَارِجِينَ مِنْهَا} [المائدة: 37] ، فَقَالَ جَابِرٌ: اقْرَأْ مَا قَبْلَهَا: {إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا} [المائدة: 36] ، ذَلِكَ الْكُفَّارُ.
وَفِي رِوَايَةٍ عَنْ يَزِيدَ، قَالَ: سَأَلْتُ جَابِرًا عَنِ الشَّفَاعَةِ، فَقَالَ: يُعَذِّبُ اللَّهُ تَعَالَى قَوْمًا مِنْ أَهْلِ الْإِيمَانِ بِذُنُوبِهِمْ، ثُمَّ يُخْرِجُهُمْ بِشَفَاعَةِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: فَأَيْنَ قَوْلُ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ؟ فَذَكَرَ الْحَدِيثَ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ অধ্যায়ে শাফা'আতের বর্ণনা করা হয়েছে। এ হাদীসে সাথে সাথে তাকদীরের উপর ইমান আনয়নের আবশ্যকতা এবং কাদরিয়া দলের প্রতি নিন্দাবাদ করা হয়েছে। সুস্পষ্ট বাক্যের দ্বারা শাফা'আতের অস্তিত্ব ও হাকীকতকে গ্রহণ করার ব্যাপারে দলীল পেশ করা হয়েছে। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ইমাম আযম আবূ হানীফা (র) কাদরিয়া দলের বিরোধী এবং শাফা'আতের জোর সমর্থক ছিলেন। তাঁর এ সমস্ত বর্ণনা প্রত্যক্ষ করার পর যদি কেউ তাঁর প্রতি মু'তাযিলা হওয়ার অপবাদ উত্থাপন করে, তাহলে এটা বেইনসাফী ও যুলুম হবে।

শাফাআতের মাসয়ালা সম্পর্কে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত এবং মু'তাযিলার মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। মু'তাযিলা দল বলে, ছোট গুনাহ তাওবা অথবা তাওবা ব্যতীত মাফ হয়ে যায়। কবীরা গুনাহ তাওবা ব্যতীত মাফ হয় না। শাফা'আত শুধু সওয়াবের স্তর বৃদ্ধির জন্য, গুনাহে কবীরা মাফের জন্য নয়। আহলে সুন্নত ওয়াল জামা'আতের মতে শাফাআতের দ্বারা কবীরা গুনাহ্ মাফ হয়ে যায়। মু'তাযিলা দল তাদের ভ্রান্ত ও বাতিল ধারণার স্বপক্ষে এ যুক্তি পেশ করে থাকে যে, এর দ্বারা পাপীকে পাপ কাজে সাহসী এবং অন্যায় কাজে প্রেরণা দেওয়া হয়ে থাকে। অধিকন্তু এর দ্বারা শাস্তি থেকে মুক্তিলাভের একটি সুযোগ মিলে যায়।

এর জওয়াব হলো এই যে, গুনাহে কবীরা মাফ হয়ে যাওয়া শাফা'আতের দ্বারা বা শাফাআত ব্যতীত জায়েয আছে, কিন্তু ওয়াজিব নয়। তবে এর উপর পাপীদের ভরসা করার কোন অবকাশ বা সুযোগ নেই। বা মুতাযিলাগণ দ্বিতীয় দলীল হিসেবে এটা পেশ করে যে, যদি ব্যভিচার বা অন্যায়ের শাস্তি প্রদান করা না হয়, তাহলে এক প্রকার ওয়াদা ভঙ্গ এবং ত্রুটিপূর্ণ বর্ণনার মধ্যে গণ্য হবে। যেমনঃ পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ অন্যায় ও অপকর্মের প্রতিদান শাস্তি ছাড়া আর কিছু নয়।

কিন্তু শাফা'আতের দ্বারা মাফ করে অন্যায়কারী ও পাপীকে শাস্তি প্রদান করা না হলে এটা উপরোক্ত আয়াতের ভুল বর্ণনা করা হবে এবং এটা হবে সম্পূর্ণ নীতি বিরোধী। এর জওয়াব হলো এই যে, উত্তম কাজে ওয়াদা ভঙ্গ করা নিন্দনীয়, কিন্তু অন্যায়ের জন্য ক্ষমা করা বা শাস্তি থেকে ক্ষমা প্রদান করায় ওয়াদা ভঙ্গ করা হয় না; বরং এটা মূলত একজন হকদারের তার হক বা অধিকার আদায় থেকে বিরত থাকা। যেমনঃ একজন ঋণদাতা যদি তার প্রদত্ত ঋণ মাফ করে দেয়, তাহলে এতে নিন্দনীয় কিছুই নেই; বরং এটা একটি উত্তম কাজ বলে বিবেচিত হবে।

মুতাযিলাগণ তাদের মতামতের স্বপক্ষে দলীল হিসেবে পবিত্র কুরআনের এ আয়াত পেশ করেঃ لا تقبل منها شفاعة বা ماللظالمين من حميم ولا شفيع يطاع ال বা فما تنفعهم شفاعة الشافعين বা مامن شفيع الأ من بعد اذنه .

এর জওয়াব হলো এই যে, এ সমস্ত আয়াত কাফিরদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে এবং কাফিরদের জন্যই এ আয়াতসমূহ নির্ধারিত। এখানে গুনাহগার মুমিনদের সম্পর্কে আলোচনা চলছে। শাফা'আত ব্যতীতও মুমিনদের গুনাহ মাফ হওয়ার বিষয়টি কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং শাফা'আত দ্বারা কেন মাফ হবে না? পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ অথবা وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ এখানে গুনাহে সগীরা ও কবীরা উভয়কে সংযুক্ত করেছে। এরপর প্রসিদ্ধ হাদীসসমূহে যেহেতু শাফা'আতের প্রমাণ রয়েছে, তাই এতে অন্য কোন চিন্তার অবকাশ নেই। পূর্ববর্তী আয়াতে তাদের সন্দেহ হয়েছে যে, অনুমতি ব্যতীত কারো শাফা'আতের অধিকার নেই। কিন্তু উক্ত আয়াতে এর স্পষ্ট জওয়াব রয়েছে এবং হুযুর (সা)-কে শাফা'আতের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে।
মুসনাদে আবু হানীফা রহঃ - হাদীস নং ২৩ | মুসলিম বাংলা