মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা রহঃ

১. ঈমান-আকাঈদ অধ্যায়

হাদীস নং: ১৪
মুমিন অনন্তকালের জন্য জাহান্নামী হবে না
১৪। হযরত আবু হানীফা (রাহঃ) বলেন, আমরা হযরত আলকামা (রাহঃ) ও হযরত ইবনে আবী রাবাহ্ (রাহঃ)-সহ একত্রে উপবিষ্ট ছিলাম। তখন হযরত আলকামা (রাহঃ) হযরত আতা (রাহঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আবু মুহাম্মাদ! আমাদের শহরে (কৃষ্ণা ও ইরাক) এরূপ লোক বাস করে যারা তাদের ঈমানের ব্যাপারে দৃঢ়তা পোষণ করে না এবং "নিশ্চয়ই আমরা মুমিন” দৃঢ়তার সাথে এটা বলাও পছন্দ করে না। বরং তারা এটা বলে যে, ইনশা আল্লাহ্ আমরা মুমিন। হযরত আতা (রাহঃ) বলেন, তাদের কি হল যে, তারা এরূপ বলে না যে, নিশ্চয়ই আমরা মুসলমান ?

হযরত আলকামা (রাযিঃ) উত্তরে বলেন, আমরা যখন নিজেদেরকে ঈমানদার বলে বিশ্বাস করি, তাহলে আমরা যেন নিজেদেরকে জান্নাতী বলে দাবি করছি। কেননা আল্লাহ প্রত্যেক বিশ্বাসী ও মুমিন নর-নারীর জন্য জান্নাতের ওয়াদা করেছেন (ওয়াদা ভঙ্গ করা আল্লাহর জন্য নিন্দনীয়)। কারণ তিনি সকল প্রকার নিন্দা ও দোষ-ত্রুটি থেকে পবিত্র ও মুক্ত। হযরত আতা (রাহঃ) বলেন, এটা তো শয়তানের ধোঁকা ও প্রতারণা। শয়তান তাদেরকে আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ ইহসান- অর্থাৎ ইসলামের ইহসানকে না মানা এবং রাসুলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর সুন্নত মান্য না করার জন্য বাধ্য করেছে। আমি হুযূর (ﷺ)-এর সাহাবাদেরকে দেখছি তাঁরা নিজেদের মধ্যে ঈমানের দাবি প্রমাণ করেছেন এবং হযরত (ﷺ)-এর নিকট তা বর্ণনা করতেন। হযরত আতা (রাহঃ) বলেন, তাঁরা বলতেন, আমরা মুমিন, কিন্তু এটা বলতেন না যে, আমরা জান্নাতী। কেননা আল্লাহ্ তা'আলা যদি আকাশ ও যমীনে বসবাসকারী সবাইকে শাস্তি প্রদান করেন, তাহলেও তাঁকে যালিম বা অত্যাচারী বলা যাবে না।

তখন হযরত আলকামা (রাহঃ) হযরত আতা (রাহঃ)-কে বললেন, হে আবু মুহাম্মাদ । যদি আল্লাহ্ ঐ ফিরিশতাদেরকে শাস্তি প্রদান করেন যারা এক মুহূর্তের জন্য নাফরমানী করে না, তাহলে কি আল্লাহকে যালিম বলা যাবে না? হযরত আতা (রাহঃ) বলেন, তখন আলকামা (রাহঃ) বলেন, এটাতো আমাদের জন্য অত্যন্ত সূক্ষ্ম ব্যাপার। আমরা এটা কিভাবে উপলব্ধি করব! তখন হযরত আতা (রাহঃ) বলেন, মু'তাযিলীগণ ভ্রান্তপথে রয়েছে। সুতরাং তাদের মত ধারণা ও উক্তি থেকে মুক্ত ও বিব্রত থাক। কেননা তারা হল আল্লাহর শত্রু এবং আল্লাহর বাণীকে তারা মিথ্যা প্রমাণিত করার চেষ্টা করে। আল্লাহ্ কি তাঁর নবীকে বলেননি যে, “হে নবী! আপনি বলুন, আল্লাহর নিকট সুস্পষ্ট দলীল রয়েছে, যদি আল্লাহ্ ইচ্ছা প্রকাশ করতেন তাহলে সবাইকে হিদায়তের পথ প্রদর্শন করতেন।

তখন হযরত আলকামা (রাহঃ) বলেন, হে আবু মুহাম্মাদ ! এ বিষয়টি আরো বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করুন যাতে আমাদের অন্তর থেকে এ ধরনের সন্দেহ দূরীভূত হয়ে যায় এবং তা পবিত্রতা অর্জন করতে পারে। এরপর হযরত আতা (রাহঃ) বলেন, আল্লাহ্ কি ফিরিশতাদেরকে তাঁর আনুগত্যের প্রতি পথ প্রদর্শন করেননি এবং তাদের অন্তরে স্বীয় মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব স্থায়ী করে দেননি? হযরত আলকামা (রাহঃ) বলেন, নিশ্চয়ই। হযরত আতা (রাহঃ) বলেন, এটা আল্লাহর ঐ নিয়ামত যা তিনি তাদেরকে দান করেছেন। হযরত আলকামা (রাহঃ) বলেন, জি হ্যাঁ, এটা সত্য। হযরত আতা (রাহঃ) বলেন, যদি আল্লাহ তা'আলা তাদের থেকে এ সমস্ত নিয়ামতের শুকরিয়া কামনা করতেন, তাহলে তারা এর শুকরিয়া আদায় করতে সক্ষম হতো না; বরং এটা তাদের জন্য অসম্ভব হতো। ফলে শুকরিয়া আদায়ের অক্ষমতার কারণে যদি আল্লাহ্ তাদেরকে শাস্তি প্রদান করতেন, তাহলে এরজন্য আল্লাহকে যালিম বলে বিবেচনা করা কখনো সঠিক হতো না।
قَالَ: كُنَّا مَعَ عَلْقَمَةَ، وَعَطَاءِ بْنِ أَبِي رَبَاحٍ، فَسَأَلَهُ عَلْقَمَةُ، فَقَالَ: " يَا أَبَا مُحَمَّدٍ، إِنَّ بِبِلَادِنَا لَا يُثْبِتُونَ الْإِيمَانَ لِأَنْفُسِهِمْ، وَيَكْرَهُونَ أَنْ يَقُولُوا: إِنَّا مُؤْمِنُونَ، بَلْ يَقُولُونَ: إِنَّا مُؤْمِنُونَ إِنْ شَاءَ اللَّهُ، فَقَالَ: وَمَا لَهُمْ لَا يَقُولُونَ؟ قَالَ: يَقُولُونَ: إِنَّا إِذَا شِئْنَا لِأَنْفُسِنَا الْإِيمَانَ، جَعَلْنَا لِأَنْفُسِنَا الْجَنَّةَ، قَالَ: سُبْحَانَ اللَّهِ، هَذَا مِنْ خِدَعِ الشَّيْطَانِ وَحَبَائِلِهِ، وَحِيَلِهِ أَلْجَأَهُمْ إِلَى أَنْ دَفَعُوا أَعْظَمَ مِنَّةِ اللَّهِ تَعَالَى عَلَيْهِمْ، وَهُوَ الْإِسْلَامُ، وَخَالَفُوا سُنَّةَ رَسُولِ اللَّهِ تَعَالَى صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، رَأَيْتُ أَصْحَابَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَرَضِيَ عَنْهُمْ، يُثْبِتُونَ الْإِيمَانَ لِأَنْفُسِهِمْ، وَيَذْكُرُونَ ذَلِكَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقُلْ لَهُمْ: يَقُولُونَ: إِنَّا مُؤْمِنُونَ، وَلَا يَقُولُوا: إِنَّا مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ، فَإِنَّ اللَّهَ تَعَالَى لَوْ عَذَّبَ أَهْلَ سَمَاوَاتِهِ وَأَهْلَ أَرْضِهِ لَعَذَّبَهُمْ، وَهُوَ غَيْرُ ظَالِمٍ لَهُمْ، فَقَالَ لَهُ عَلْقَمَةُ: يَا أَبَا مُحَمَّدٍ، إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى لَوْ عَذَّبَ الْمَلَائِكَةَ الَّذِينَ لَمْ يَعْصُوهُ طَرْفَةَ عَيْنٍ عَذَّبَهُمْ وَهُوَ غَيْرُ ظَالِمٍ لَهُمْ؟ قَالَ: نَعَمْ، قَالَ: هَذَا عِنْدَنَا عَظِيمٌ، فَكَيْفَ نَعْرِفُ هَذَا؟ قَالَ: يَابْنَ أَخِي، مِنْ هُنَا ضَلَّ أَهْلُ الْقَدَرِ، فَإِيَّاكَ أَنْ تَقُولَ بِقَوْلِهِمْ، فَإِنَّهُمْ أَعْدَاءُ اللَّهِ الرَّادُّونَ عَلَى اللَّهِ، أَلَيْسَ يَقُولُ اللَّهُ تَعَالَى لِنَبِيِّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: {قُلْ فَلِلَّهِ الْحُجَّةُ الْبَالِغَةُ فَلَوْ شَاءَ لَهَدَاكُمْ أَجْمَعِينَ} [الأنعام: 149] ، فَقَالَ لَهُ عَلْقَمَةُ: اشْرَحْ يَا أبَا مُحَمَّدٍ شَرْحًا يُذِهْبُ عَنْ قُلُوبِنَا هَذِهِ الشُّبْهَةَ، فَقَالَ: أَلَيْسَ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى دَلَّ الْمَلَائِكَةَ عَلَى تِلْكَ الطَّاعَةِ، وَأَلْهَمَهُمْ إِيَّاهَا، وَعَزَمَهُمْ عَلَيْهَا، وَجَبَرَهُمْ عَلَى ذَلِكَ؟ قَالَ: نَعَمْ، قَالَ: فَلَوْ طَالَبَهُمْ بِشُكْرِ هَذِهِ النِّعَمِ مَا قَدَرُوا عَلَى ذَلِكَ وَقَصَّرُوا، وَكَانَ لَهُ أَنْ يُعَذِّبَهُمْ بِتَقْصِيرِ الشُّكْرِ، وَهُوَ غَيْرُ ظَالِمٍ لَهُمْ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

উপরোক্ত হাদীসে দু'টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। প্রথম বিষয়টি হলো এই যে, انا مؤمن إنشاء الله বলা সঠিক কিনা, দ্বিতীয়ত হলো 'কদর' বা তাকদীরের মাসয়ালা। প্রথম বিষয়ে সঠিক মাযহাব হলো এই যে, এরূপ বলার কোন প্রয়োজন নেই এবং এরূপ বলা জায়েয নয়। প্রথম দলীল হলো এই যে, নবী করীম (সা) ও সাহাবায়ে কিরাম (রা) থেকে কোন প্রমাণ নেই এবং তাঁরা স্বীয় ঈমানের সাথে কখনো ইনশা আল্লাহ্ শব্দ যুক্ত করেননি। অতঃপর পবিত্র কুরআনে যেখানে মুমিনদের প্রশংসা করা হয়েছে সেখানে বলা হয়েছেঃ أُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ حَقًّا অথবা কাফিরদের তিরস্কার বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে أُولَئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا মূলত এ সময় যিনি মু'মিন, আল্লাহ তাঁকে মুমিন বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং যে কাফির, তাকে কাফির বলে আখ্যা দিয়েছেন। যেহেতু বর্তমানে তিনি মুমিন বলে আখ্যায়িত, তাই তাঁর উপর ঈমানের হুকুমসমূহ আবর্তিত হবে এবং সাথে এর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হবে। সুতরাং যখন হুকুমসমূহ বাস্তবায়িত হবে এবং এর প্রভাব ও ফলাফল প্রকাশ পাবে, তখন ঈমানের প্রকৃত অস্তিত্ব কেন নিশ্চিতভাবে মান্য করা হবে না?

দ্বিতীয় যুক্তি হলো এই যে, ঈমানের মধ্যে সন্দেহের কারণে যদি 'ইন্‌শা আল্লাহ’ শব্দ বলা হয়, তাহলে এটা স্পষ্ট কুফরী হবে। যদি আদব ও শেষ পরিণতির দিকে লক্ষ্য করে অথবা বিনয়ের কারণে অথবা আত্মপ্রশংসা থেকে মুক্ত থাকার জন্য এ বাক্য উচ্চারণ করে, তবুও এটা সঠিক হবে। না। কেননা এ শব্দ মূলত সন্দেহ প্রকাশ করে থাকে এবং খাঁটি মু'মিনের জন্য স্বীয় ঈমানের মধ্যে সন্দেহ পোষণ করা জায়েয নয়।

যে দল 'ইনশা আল্লাহ্' বলা জায়েয মনে করেন, তাঁরা এ দলীল পেশ করে থাকেন যা হযরত আলকামা (র)-এর বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে। তা হলো এই যে, ঈমানের উপর দৃঢ়তা প্রকাশ করা নিজকে জান্নাতী বলে নির্ধারণ করারই নামান্তর। কেননা আল্লাহ তা'আলা মুমিনদের জন্য জান্নাতের ওয়াদা করেছেন। যেহেতু আল্লাহর জন্য ওয়াদা ভঙ্গের অভিযোগ আরোপ করা কুফরী, তাই নিজেকে মুমিন বলা ‘নিজেকে জান্নাতী বলারই সমার্থক'। অথচ পৃথিবীতে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম এবং আশারায়ে মুবাশ্শারা ব্যতীত শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে নিজেকে জান্নাতী বলার অধিকার কারো নেই।

উপরোক্ত বিষয়ে কখনো এ দলীলও পেশ করা হয়ে থাকে যে, এখনও ঈমানের উপর এজন্য স্থায়ী নয়; কেননা এটা তার জানা নেই যে, সর্বশেষ পরিণতি কি হবে। অথচ সর্বশেষ পরিণতির উপরই সবকিছু নির্ভর করে। এর সুস্পষ্ট জওয়াব হলো এই যে, যদি এই সময় দৃঢ় ঈমান না থাকে, তা হলে ঈমানের আহকাম কিভাবে প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন হলো? প্রথম দলীলের জওয়াব হাদীসে হযরত আতা (র) নিজেই বর্ণনা করেছেনঃ “তারা এটা বলে যে, আমরা হলাম মু'মিন" কিন্তু এটা বলেনি যে, “আমরা হলাম জান্নাতী।”

প্রকাশ থাকে যে, এটা ঐ সময় বলতে পারে যখন সর্বশেষ পরিণতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা ও জ্ঞান থাকে। কিন্তু সর্বশেষ পরিণতি ভাল হলেও জান্নাত লাভ করা আমলের উপর নির্ভর করে না; বরং এটা সম্পূর্ণ আল্লাহর রহমতের উপর নির্ভর করে। তাই হযরত আতা (র) বলেছেন, যদি আল্লাহ্ তা'আলা কোন নিষ্পাপ বান্দাকে অথবা ফিরিশতাদেরকে শাস্তি প্রদান করেন, তবুও এটা তাঁর জন্য যুলুম হবে না। কেননা প্রত্যেক বান্দার উপর আল্লাহর এত অসংখ্য করুণা ও দয়া রয়েছে, যেগুলোর শুকরিয়া আদায় করা কখনো সম্ভব নয়। ফিরিশতাগণ যদিও নিষ্পাপ ও পবিত্র এবং তাদের পবিত্রতা দেখে তাদেরকে শাস্তি প্রদান করা যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে যুলুম মনে হয় কিন্তু এরপরও আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামত, করুণা ও দয়া তাদের উপর বিদ্যমান। এ পবিত্রতা তাঁরই করুণায়, তিনিই আনুগত্যের তাওফীক ও ক্ষমতা দিয়েছেন। যদি এখন আল্লাহ্ এ সমস্ত নিয়ামতের শুকরিয়া কামনা করেন, তা হলে ফিরিশতাগণ কিভাবে বা কতটুকু শুকরিয়া আদায়ের ক্ষমতা রাখেন? সুতরাং এ অপরাধে তিনি তাদেরকে পাকড়াও করতে পারেন। যেহেতু তিনি সৃষ্টিকর্তা ও মালিক, তাই তিনি এ ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মুসনাদে আবু হানীফা রহঃ - হাদীস নং ১৪ | মুসলিম বাংলা