আল মুওয়াত্তা - ইমাম মালিক রহঃ

৩৭. ওসীয়্যত সম্পর্কিত অধ্যায়

হাদীস নং: ১৪৮৫
১. ওসীয়্যতের নির্দেশ
রেওয়ায়ত ১. আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) হইতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলিয়াছেন, কোন মুসলমানের নিকট কিছু সম্পদ থাকিলে যাহার সম্বন্ধে ওসীয়াত করা তাহার কর্তব্য, তবে সেই ক্ষেত্রে তাহার জন্য দুই রাত্রিও দেরী করা উচিত না (কেননা মৃত্যু আসার আশঙ্কা রহিয়াছে)।

মালিক (রাহঃ) বলেনঃ ইহা আমাদের নিকট সর্বসম্মত বিষয় যে, যদি কোন মুসলমান সুস্থ অথবা অসুস্থ অবস্থায় কোন ওসীয়্যত করিয়া যায় যেমন গোলাম আযাদ করা কিংবা অন্যান্য বিষয়, তবে সে মারা যাওয়ার পূর্বে তাহার মধ্যে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করিতে পরিবে এবং ওসীয়্যতকে মউকুফও করিতে পরিবে। অন্য কোন ওসীয়্যতও করিতে পারবে। কিন্তু কোন গোলামকে যদি মুদাব্বের করিয়া থাকে তবে তাহাতে আর কোন পরিবর্তন করিতে পারবে না, কেননা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিয়াছেন যে, কোন মুসলমানের এমন কিছু থাকিলে যাহা ওসীয়াত করা কর্তব্য, তবে ওসীয়্যত করা ব্যতীত দুই রাত অতিবাহিত করা তাহার উচিত নয়।

মালিক (রাহঃ) বলেনঃ যদি ওসীয়াতকারীর নিজ ওসীয়্যতে পরিবর্তন করার ক্ষমতা না থাকিত তবে তাহার ইখতিয়ার হইতে বাহির হইয়া আটক থাকিত। যেমন গোলাম আযাদের কথা অথচ মানুষ কোন সময় ভ্রমণে যাওয়ার সময় ওসীয়্যত করে আবার সুস্থ থাকাকালীন ওসীয়্যত করে।

মালিক (রাহঃ) বলেনঃ আমাদের নিকট প্রত্যেক ওসীয়্যতই বদলানো যায় কিন্তু গোলামকে মুদাব্বের করা হইলে তাহা পরিবর্তনের ইখতিয়ার নাই।
بَاب الْأَمْرِ بِالْوَصِيَّةِ
حَدَّثَنِي مَالِك عَنْ نَافِعٍ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَا حَقُّ امْرِئٍ مُسْلِمٍ لَهُ شَيْءٌ يُوصَى فِيهِ يَبِيتُ لَيْلَتَيْنِ إِلَّا وَوَصِيَّتُهُ عِنْدَهُ مَكْتُوبَةٌ
قَالَ مَالِك الْأَمْرُ الْمُجْتَمَعُ عَلَيْهِ عِنْدَنَا أَنَّ الْمُوصِيَ إِذَا أَوْصَى فِي صِحَّتِهِ أَوْ مَرَضِهِ بِوَصِيَّةٍ فِيهَا عَتَاقَةُ رَقِيقٍ مِنْ رَقِيقِهِ أَوْ غَيْرُ ذَلِكَ فَإِنَّهُ يُغَيِّرُ مِنْ ذَلِكَ مَا بَدَا لَهُ وَيَصْنَعُ مِنْ ذَلِكَ مَا شَاءَ حَتَّى يَمُوتَ وَإِنْ أَحَبَّ أَنْ يَطْرَحَ تِلْكَ الْوَصِيَّةَ وَيُبْدِلَهَا فَعَلَ إِلَّا أَنْ يُدَبِّرَ مَمْلُوكًا فَإِنْ دَبَّرَ فَلَا سَبِيلَ إِلَى تَغْيِيرِ مَا دَبَّرَ وَذَلِكَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَا حَقُّ امْرِئٍ مُسْلِمٍ لَهُ شَيْءٌ يُوصَى فِيهِ يَبِيتُ لَيْلَتَيْنِ إِلَّا وَوَصِيَّتُهُ عِنْدَهُ مَكْتُوبَةٌ قَالَ مَالِك فَلَوْ كَانَ الْمُوصِي لَا يَقْدِرُ عَلَى تَغْيِيرِ وَصِيَّتِهِ وَلَا مَا ذُكِرَ فِيهَا مِنْ الْعَتَاقَةِ كَانَ كُلُّ مُوصٍ قَدْ حَبَسَ مَالَهُ الَّذِي أَوْصَى فِيهِ مِنْ الْعَتَاقَةِ وَغَيْرِهَا وَقَدْ يُوصِي الرَّجُلُ فِي صِحَّتِهِ وَعِنْدَ سَفَرِهِ قَالَ مَالِك فَالْأَمْرُ عِنْدَنَا الَّذِي لَا اخْتِلَافَ فِيهِ أَنَّهُ يُغَيِّرُ مِنْ ذَلِكَ مَا شَاءَ غَيْرَ التَّدْبِيرِ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটি অন্তরে মৃত্যুচিন্তা জাগ্রত রাখা ও মৃত্যুর প্রস্তুতিস্বরূপ অসিয়তনামা লিখে রাখার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বলা হয়েছে-
مَا حَقٌّ امْرِئٍ مُسْلِمٍ (কোনও মুসলিম ব্যক্তির উচিত নয়)। অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দেয়, যার বিশ্বাস এ জীবন স্থায়ী নয়, এর পর মৃত্যু আছে, মৃত্যুর পর দীর্ঘকাল কবরে অবস্থান করার রয়েছে, তারপর আখিরাতে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে হবে এবং সেখানে ইহজীবনের যাবতীয় কাজকর্মের হিসাব দিতে হবে, তার ইসলামের দাবি সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত। তার কিছুতেই উচিত নয়...

لَهُ شيءٌ يُوصِي فِيهِ (যার কাছে অসিয়ত করার মতো কিছু আছে)। অর্থাৎ যার কাছে এমন অর্থ-সম্পদ আছে, যে সম্পর্কে চাইলে সে অসিয়ত করতে পারে। তার সম্পদ এত কম নয় যে, তাতে অসিয়ত করা যাবে না, তা করতে গেলে ওয়ারিছদের জন্য কিছু থাকবে না। এরূপ ব্যক্তির কী করণীয়, সে সম্পর্কে সামনে বলা হচ্ছে-
(সেই মুসলিম ব্যক্তির) নিজের কাছে লিখিত অসিয়তপত্র রাখা ছাড়া দু'রাতও কাটানো (উচিত নয়)'। কোন কোন বর্ণনায় আছে তিন রাত্রের কথা। কোন কোন বর্ণনায় আছে দু'রাত্রের কথা। দু'-তিন রাত দ্বারা মূলত অল্পকাল বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ সেই মুসলিম ব্যক্তির কর্তব্য সর্বদা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা এবং সে প্রস্তুতি হিসেবে সর্বদা নিজের কাছে তার সম্পদ সম্পর্কে অসিয়তনামা লিখে রাখা। অসিয়তনামা ছাড়া সে অল্পকালও কাটাবে না। কেননা মৃত্যু তো যে-কোনও সময়ই এসে যেতে পারে। যদি হঠাৎ করে মৃত্যু এসে যায় আর অসিয়তনামা লেখা না থাকে, তবে ওয়ারিছগণ তার সম্পদ নিজেদের মধ্যে ভাগ-ভাটোয়ারা করে নেবে। হয়তো এমন কোনও সৎকর্মে তার কোনও অংশ খরচ করবে না, যা আখিরাতে তার কাজে আসবে। এমনও হতে পারে যে, সে হয়তো তার সম্পদের অংশবিশেষে অসিয়ত করেছিল, কিন্তু কোনও সাক্ষী নেই। ফলে তার মৃত্যুর পর সে অসিয়ত কার্যকর করা হবে না। যদি লেখা থাকত, তবে কার্যকর করা হতো। সে ক্ষেত্রে লেখাটা সাক্ষীরই বিকল্প বলে গণ্য হতো। তাছাড়া সাক্ষী থাকলেও লিখিত অসিয়তের বাড়তি ফায়দা আছে। তা মৃত্যুর স্মারকরূপে কাজ করে। যখনই অসিয়তনামায় নজর পড়বে, তখনই মৃত্যুর কথা স্মরণ হবে।

উল্লেখ্য, যদি আল্লাহ তা'আলার বা বান্দার কোনও হক আদায় করা বাকি থাকে, তবে সে হক আদায় সম্পর্কে অসিয়ত করা ফরয ও অবশ্যকর্তব্য। অন্যথায় তা ফরয নয়। তা সত্ত্বেও প্রয়োজনের বেশি সম্পদ থাকলে অসিয়ত করা ভালো, যাতে সে অসিয়ত অনুযায়ী সম্পদের একটা অংশ ভালো কাজে ব্যয় করা হয় এবং মৃত্যুর পর তার আমলনামায় ছাওয়াব লেখা জারি থাকে। সে অসিয়ত লিখে রাখার দ্বারা যেহেতু মৃত্যুর কথাও স্মরণ হয়, তাই এর বাড়তি গুরুত্ব রয়েছে। সে কারণেই এ হাদীছে এটাকে মুসলিম ব্যক্তির অবশ্যকর্তব্যরূপে ব্যক্ত করা হয়েছে।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ-উপদেশ পালনের ক্ষেত্রে খুবই অগ্রগামী ছিলেন। যেসব কাজ ফরয নয়; বরং নফল পর্যায়ের, সেসব কাজও তিনি সর্বদা গুরুত্বের সঙ্গে পালন করতেন। এ হাদীছটিতে যেহেতু অসিয়তনামা সঙ্গে রাখার প্রতি উৎসাহ দান করা হয়েছে, তাই তিনি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে এর উপর আমলে যত্নবান থেকেছেন। একটি রাতও তিনি অসিয়তনামা সঙ্গে রাখা ছাড়া কাটাননি। বস্তুত সব সাহাবীই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ-উপদেশ মানার ক্ষেত্রে এরকম যত্নবান থাকতেন। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আদর্শ অনুসরণ করা। আল্লাহ তা'আলা তাওফীক দান করুন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দেওয়াই যথেষ্ট নয়; ইসলামের দাবি পূরণেও তৎপর থাকতে হবে।

খ. মৃত্যুর দিনক্ষণ কারও জানা নেই। যে-কোনও সময়ই তা হাজির হয়ে যেতে পারে। তাই প্রত্যেকের সর্বক্ষণ এর জন্য প্রস্তুত থাকা দরকার।

গ. অসিয়তপত্র মৃত্যুর এক উত্তম স্মারক। তাই প্রত্যেক মুসলিমের অসিয়তনামা সঙ্গে রাখা দরকার।

ঘ. প্রয়োজনের বেশি সম্পদ থাকলে তার সবটা ওয়ারিছদের জন্য না রেখে অংশবিশেষ কোনও দীনী খাতে খরচ করার জন্য অসিয়ত করে যাওয়া উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মুওয়াত্তা মালিক - হাদীস নং ১৪৮৫ | মুসলিম বাংলা