মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

২৬- আদাব - শিষ্টাচার অধ্যায়

হাদীস নং: ৪৬৩৮
১. প্রথম অনুচ্ছেদ - সালাম
৪৬৩৮। হযরত আয়েশা (রাঃ) হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা একদল ইহুদী নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসিতে অনুমতি চাহিল এবং বলিল, 'আস্সামু আলাই কুম'। তখন আমি (আয়েশা) জওয়াবে বলিলাম, 'বাল আলাইকুমুস্ সাম ওয়াল্লা'নাৎ'। (অর্থঃ বরং তোমাদেরই শীঘ্র মৃত্যু হউক এবং আল্লাহর অভিশাপ তোমাদের উপরই বর্ষিত হউক। তখন নবী (ছঃ) বলিলেন: হে আয়েশা। আল্লাহ সহনশীল, তিনি প্রত্যেক কাজে সহনশীলতাকেই পছন্দ করেন। তখন আমি বলিলাম, আপনি শুনেন নাই তাহারা কি বলিয়াছিল? তিনি বলিলেন ! আমিও তো তাহাদের জওয়াবে ওয়া আলাইকুম' বলিয়াছি। অপর এক রেওয়ায়তে কেবল 'আলাইকুম' রহিয়াছে। (অর্থাৎ) এ, অক্ষরটি উল্লেখ নাই। মোত্তা:

বুখারীর অপর এক রেওয়ায়তে আছে— তিনি [হযরত আয়েশা (রাঃ)] বলেন, একবার ইহুদী গণ নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে আসিল এবং বলিল, 'আস্সামু আলাইকা'। উত্তরে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিলেন: 'ওয়া আলাইকুম'। কিন্তু হযরত আয়েশা বলিলেন, 'আসামু আলাইকুম ওয়া লা'নাকুমুল্লাহু ওয়া গাযিবা আলাইকুম'। (অর্থ: তোমাদের মৃত্যু ঘটুক এবং তোমাদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত ও অসন্তুষ্টি বর্ষিত হউক।) রাসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিলেনঃ হে আয়েশা থাম, কোমলতা অবলম্বন কর, কঠোরতা পরিহার কর এবং অশোভন উক্তি হইতে বাচিয়া থাক। তখন আয়েশা (রাঃ) বলিলেন, আপনি কি শুনেন নাই তাহারা কি বলিয়াছে? তখন হুযুর ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিলেন: তুমি কি শুন নাই আমি কি বলিয়াছি? আমি তো তাহাদের বাক্য তাহাদের উপরই ফিরাইয়া দিয়াছি এবং (জানিয়া রাখ) আমার দো'আ তাহাদের বিরুদ্ধে গৃহীত। কিন্তু আমার উপর তাহাদের দো'আ অগৃহীত। আর মুসলিম শরীফের অপর এক বর্ণনায় ইহাও উল্লেখ রহিয়াছে যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন: হে আয়েশা। তুমি অশ্লীল বাক্য উচ্চারণকারিণী হইও না। কেননা, আল্লাহ্ তা'আলা অশ্লীলতা ও অশালীন বাক্য ব্যবহার আদৌ পছন্দ করেন না।
وَعَن عائشةَ قَالَتْ: اسْتَأْذَنَ رَهْطٌ مِنَ الْيَهُودِ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالُوا السَّامُ عَلَيْكُمْ. فَقُلْتُ: بَلْ عَلَيْكُمُ السَّامُ وَاللَّعْنَةُ. فَقَالَ: «يَا عَائِشَةُ إِنَّ اللَّهَ رَفِيقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ فِي الْأَمْرِ كُلِّهِ» قُلْتُ: أَوَلَمْ تَسْمَعْ مَا قَالُوا؟ قَالَ: «قَدْ قُلْتُ وَعَلَيْكُمْ» . وَفِي رِوَايَةٍ: «عَلَيْكُمْ» وَلم يذكر الْوَاو

وَفِي رِوَايَةٍ لِلْبُخَارِيِّ. قَالَتْ: إِنَّ الْيَهُودَ أَتَوُا النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فَقَالُوا: السَّام عَلَيْكَ. قَالَ: «وَعَلَيْكُمْ» فَقَالَتْ عَائِشَةُ: السَّامُ عَلَيْكُمْ وَلَعَنَكُمُ اللَّهُ وَغَضِبَ عَلَيْكُمْ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَهْلًا يَا عَائِشَةُ عليكِ بالرِّفق وإِياك والعنفَ والفُحْشَ» . قَالَت: أَو لم تسمع مَا قَالُوا؟ قَالَ: «أَو لم تَسْمَعِي مَا قُلْتُ رَدَدْتُ عَلَيْهِمْ فَيُسْتَجَابُ لِي فِيهِمْ وَلَا يُسْتَجَابُ لَهُمْ فِيَّ»

وَفِي رِوَايَةٍ لِمُسْلِمٍ. قَالَ: «لَا تَكُونِي فَاحِشَةً فَإِنَّ اللَّهَ لَا يُحبُّ الفُحْشَ والتفحُّش»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

১. ইহুদীদের ধৃষ্টতামূলক উক্তি সুচতুরা হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়াইয়া যাইতে পারে নাই। তাই তিনি সঙ্গে সঙ্গেই কঠোরভাবে উহার জওয়াব দিয়াছিলেন। কিন্তু ইসলামের শিক্ষা হইল, কেহ অন্যায় করিলে যে পরিমাণ সে অন্যায় করিয়াছে সেই পরিমাণই প্রতিশোধ নিতে পার। তাহার উপর অধিক অন্যায় করা জায়েয নহে। তাই নবী (ﷺ) হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে বাড়াবাড়ি হইতে বিরত থাকার জন্য উপদেশ দিলেন।

২. কোমলতার বিষয়ে দুটি হাদীস দেখুন-

১. হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা'আলা মমত্বশীল। তিনি সকল বিষয়ে কোমলতা ভালোবাসেন।

২. হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা'আলা দয়ালু। তিনি কোমলতা পসন্দ করেন। কোমলতায় তিনি দিয়ে থাকেন, যা কঠোরতায় দেন না, এমনকি এছাড়া অন্য কিছুতেই তিনি তা দেন না।

হাদীছটিতে বলা হয়েছে- إِنَّ اللهَ رَفِيْقٌ (আল্লাহ তা'আলা দয়ালু)। আল্লাহ তা'আলাকে যে رَفِيْقٌ বলা হয়েছে, তা প্রকৃত অর্থে নয়; বরং রূপক অর্থে। বোঝানো উদ্দেশ্য তিনি বান্দার প্রতি দয়ালু ও মমতাবান। তিনি দয়ালু বলেই বান্দার প্রতি অবিরত দয়ার আচরণ করে থাকেন। কারও মতে এর মানে তিনি সহনশীল। তিনি বান্দাকে তড়িঘড়ি করে শাস্তি দেন না। অবকাশ দেন, যাতে সে তাওবা করে নিজেকে সংশোধন করে ফেলতে পারে অথবা দুর্ভাগা হলে আরও বেশি পাপাচার করে নিজের অশুভ পরিণাম নিশ্চিত করতে পারে।

প্রকাশ থাকে যে, এ হাদীছটিতে আল্লাহ তা'আলাকে رَفِيْقٌ বলা হলেও এটি তাঁর কোনও গুণবাচক নাম নয়। কেননা এটি তাঁর নাম হিসেবে কোথাও বর্ণিত হয়নি। আল্লাহ তা'আলার জন্য এটি ব্যবহার করা হয়েছে কেবলই কোমলতা প্রদর্শনে উৎসাহদানের উদ্দেশ্যে একটা ভূমিকাস্বরূপ। এতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে যে, বান্দার প্রতি যেহেতু আল্লাহ তা'আলার আচরণ কোমল ও সদয়, তাই বান্দার জন্যও তিনি এ গুণ পসন্দ করেন। বলা হয়েছে- يُحِبُّ الرِّفْقَ فِي الْأَمْرِ كُلّهِ (তিনি সকল বিষয়ে কোমলতা ভালোবাসেন)। কোমলতা ভালোবাসেন বলেই তিনি শরী'আতের যাবতীয় বিষয়ে লক্ষ রেখেছেন যাতে বান্দার প্রতি তা কঠোর ও কঠিন না হয়ে যায়; বরং সহজে তারা তা পালন করতে পারে। বান্দার প্রতি তাঁর নিজ আচরণ কোমল হওয়ায় তিনি চান বান্দাও অন্যের প্রতি তার যাবতীয় আচার-আচরণে দয়া ও কোমলতা দেখাক। আল্লাহর প্রকৃত বান্দাকে তো তা দেখাতেই হবে। কেননা একজন প্রকৃত বান্দা আল্লাহ তা'আলাকেই সবচে' বেশি ভালোবেসে থাকে। আর সে যখন আল্লাহ তা'আলাকে সবচে বেশি ভালোবাসে, তখন আল্লাহ যা ভালোবাসেন, সে তো তাই করবে। সুতরাং আল্লাহ যখন কোমলতা ভালোবাসেন, তখন তার তো অবশ্যই কোমল আচরণকারী হতে হবে।

বস্তুত কোমলতার উপকার বহুবিধ। সুতরাং হাদীছে বলা হয়েছে- وَيُعْطِي عَلَى الرّفْقِ مَا لَا يُعْطِي عَلَى الْعُنْفِ (কোমলতায় তিনি দিয়ে থাকেন, যা কঠোরতায় দেন না)। এর দ্বারা পরস্পরে ভালোবাসা সৃষ্টি হয় ও শত্রুতা দূর হয়। আপনজনদের মধ্যে কোমল আচরণ দ্বারা ভালোবাসা সুদৃঢ় হয় ও বৃদ্ধি পায়। কোমল আচরণ দ্বারা সামাজিক বন্ধন মজবুত হয়। এর ফলে অনুচর ও অনুসারীগণ নেতার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ হয়ে ওঠে আর তখন তারা সে নেতার আদেশ অনেক বেশি আগ্রহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালন করে থাকে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, একজন কোমল আচরণকারী শিক্ষকের কাছ থেকে তার ছাত্র যত বেশি উপকৃত হতে পারে, কঠোর ও রূঢ় ব্যবহারকারী শিক্ষকের কাছ থেকে ততোটা হতে পারে না। শিক্ষকের কোমল ও মমতাপূর্ণ আচরণের ফলে পড়াশোনায় শিক্ষার্থীর অগ্রগতিও অনেক বেশি হয়। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ
'(হে নবী! এসব ঘটনার পর) আল্লাহর রহমতই ছিল, যদ্দরুন তাদের প্রতি তুমি কোমল আচরণ করেছ। তুমি যদি রূঢ় প্রকৃতির ও কঠোর হৃদয় হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেত। (সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১৫৯)

সারকথা, পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সংহতি প্রতিষ্ঠায় কোমলতা অনেক বড় সহায়ক। কঠোরতার ফল হয় তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এ কারণেই হাদীছে ইরশাদ হয়েছে- কোমলতায় তিনি দিয়ে থাকেন, যা কঠোরতায় দেন না। অর্থাৎ কোমলতা দ্বারা যে সুফল পাওয়া যায়, কঠোরতা দ্বারা তা কখনও পাওয়া যায় না।

وَمَا لَا يُعْطِي عَلَى مَا سِوَاهُ (এমনকি এছাড়া অন্য কিছুতেই তিনি তা দেন না)। এর দ্বারা মূলত কঠোরতাই বোঝানো উদ্দেশ্য। কোমলতার বিপরীত তো কঠোরতাই। তা সত্ত্বেও এ বাক্যটি অতিরিক্ত ব্যবহার করা হয়েছে কেবলই বক্তব্যবিষয়কে সুদৃঢ় করার জন্য। অর্থাৎ ভালো ফল পাওয়ার জন্য কোমলতা অবলম্বনই জরুরি। এর বিপরীত কিছু দ্বারা সেরকম ফল পাওয়া যায় না। কঠোরতা দ্বারাও নয় এবং অন্য কিছু যদি থাকত, তা দ্বারাও সে সুফল পাওয়া যেত না।

প্রকাশ থাকে যে, কোমলতার অর্থ এ নয় যে, যে ব্যক্তি যাই করুক তা মানা হবে এবং যাই চাক তা দেওয়া হবে, যদি তা শরী'আতের বিরোধীও হয়। এর নাম কোমলতা নয়; বরং এটা শিথিলতা, যা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। কোমলতার অর্থ হল মানুষের প্রতি যাবতীয় আচার-আচরণ করা হবে শরী'আতের আদেশ-নিষেধ অনুযায়ী। তবে সে আদেশ-নিষেধ পালন করা বা করানোর ক্ষেত্রে তাদের প্রতি আচরণ হবে কোমল ও মমতাপূর্ণ। কোমল আচরণ করতে গিয়ে নিজ আদর্শ জলাঞ্জলি দেওয়া যাবে না। আদর্শের উপর অটুট থেকে অন্যের প্রতি তার প্রকাশে থাকবে সহৃদয়তা। এটাই প্রকৃত রিফ্ক ও কোমলতা।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. একজন আল্লাহপ্রেমিক বান্দাকে অবশ্যই কোমল চরিত্রের অধিকারী হতে হবে।

খ. অভিভাবকত্ব ও শিক্ষকতায় কোমল পন্থা অবলম্বনের বিকল্প নেই।

গ. কঠোরতা ও রূঢ়তা কখনও ভালো ফল দেয় না।

ঘ. কোমলতা অবলম্বনের অর্থ আদর্শ জলাঞ্জলি দেওয়া নয়।
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ৪৬৩৮ | মুসলিম বাংলা