আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৫০- নবীজীর সাঃ যুদ্ধাভিযানসমূহ
৩৭০০। মুসা ইবনে ইসমাঈল (রাহঃ) .... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আসিম ইবনে উমর ইবনে খাত্তাবের নানা আসিম ইবনে সাবিত আনসারীর নেতৃত্বে দশজন সাহাবীর একটি দল গোয়েন্দাগিরির জন্য পাঠালেন। তাঁরা উসফান ও মক্কার মধ্যবর্তী স্থান হান্দায় পৌছলে হুযাইল গোত্রের একটি শাখা বনু লিহয়ানকে তাদের আগমন সম্বন্ধে অবগত করা হয়। (এ সংবাদ শুনে) তারা প্রায় একশ’ জন তীরন্দাজ তৈরী হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে তাদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে পথ চলতে আরম্ভ করে। যেতে যেতে তারা এমন স্থানে পৌছে যায় যেখানে অবস্থান করে তাঁরা (সাহাবীগণ) খেজুর খেয়েছিলেন। এতদৃষ্টে তারা (বনু লিহয়ানের লোকেরা) ইয়াসরিবের খেজুর (এর আটি) বলে তাদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে তাদের খুঁজতে লাগল।
আসিম ও তাঁর সঙ্গীগণ তাদের (আগমন) সম্বন্ধে অনুভব করতে পেরে একটি (পাহাড়ি) স্থানে গিয়ে আশ্রয় নেন। (লিহয়ান) কওমের লোকেরা তাদের বেষ্টন করে ফেলে। তারপর তারা মুসলমানদের নীচে অবতরণ করে আত্মসমর্পণের আহবান জানিয়ে বলল, তোমাদেরকে ওয়াদা দিচ্ছি, আমরা তোমাদের কাউকে হত্যা করব না। তখন আসিম ইবনে সাবিত (রাযিঃ) বললেন, হে আমার সাথী ভাইয়েরা, কাফিরের নিরাপত্তায় আশ্বস্ত হয়ে আমি কখনো নীচে অবতরণ করব না।
তারপর তিনি বললেন, হে আল্লাহ! আমাদের খবর আপনার নবী (ﷺ)- কে জানিয়ে দিন। এরপর তারা মুসলমানদের প্রতি তীর নিক্ষেপ আরম্ভ করল এবং আসিমকে (আরো ছয়জনসহ) শহীদ করে ফেলল। অবশিষ্ট তিনজন, খুবাইব, যায়দ ইবনে দাসিনা এবং অপর একজন (আব্দুল্লাহ ইবনে তারিক) তাদের ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে নীচে নেমে আসলেন। তারা (শত্রুগণ) তাঁদেরকে কাবু করে নিয়ে নিজেদের ধনুকের তার খুলে তা দিয়ে বেঁধে ফেলল। এ দেখে তৃতীয়জন বললেন, এটাই প্রথম বিশ্বাসঘাতকতা। আল্লাহর কসম, আমি তোমাদের সাথে যাব না, আমার জন্য তো এদের (শহীদ সাথীদের) আদর্শই অনুসরণীয়। অর্থাৎ আমিও শহীদ হয়ে যাব। তারা তাকে বহু টানা হেচড়া করল। কিন্তু তিনি তাদের সাথে যেতে অস্বীকার করলেন। (অবশেষে তারা তাঁকে শহীদ করে দিল) এরপর খুবাইব এবং যায়দ ইবনে দাসিনাকে (বন্দী করে) নিয়ে গিয়ে তাদেরকে (মক্কার বাজারে) বিক্রি করে দিল। এটা ছিল বদর যুদ্ধের পরবর্তী ঘটনা।
বদর যুদ্ধে খুবাইব যেহেতু হারিস ইবনে আমিরকে হত্যা করেছিলেন। তাই (প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে) হারিস ইবনে আমির ইবনে নাওফিলের পুত্রগণ তাঁকে খরীদ করে নিল। খুবাইব তাদের নিকট বন্দী অবস্থায় কাটাতে লাগলেন। এরপর তারা সবাই তাকে হত্যা করার দৃঢ় সংকল্প করল। তিনি হারিসের কোন এক কন্যার নিকট থেকে ক্ষৌরকর্মের জন্য একটি ক্ষুর চেয়ে নিলেন। তার (হারিসের কন্যার) অসতর্ক অবস্থায় তার একটি ছোট বাচ্চা খুবাইবের কাছে গিয়ে পৌঁছল। সে (হারিসের কন্যা) দেখতে পেল তিনি (খুবাইব) তার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে রানের উপর বসিয়ে ক্ষুরখানা হাতে ধরে আছেন। সে (হারিসের কন্যা) বর্ণনা করেছে, (এ দেখে) আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম, খুবাইব তা বুঝতে পারলেন, তিনি বললেন, আমি তাকে (শিশুটিকে) হত্যা করে ফেলব বলে তুমি কি ভয় পেয়েছ? আমি কখনো এ কাজ করব না। সে আরো বলেছে, আল্লাহর কসম! আমি খুবাইবের মত উত্তম বন্দী আর কখনো দেখেনি।
আল্লাহর কসম একদিন আমি তাকে আঙ্গুরের গুচ্ছ হাতে নিয়ে আঙ্গুর খেতে দেখেছি। অথচ সে লোহার শিকলে বাঁধা ছিল এবং সে সময় মক্কায় কোন ফলও ছিল না। সে (হারিসের কন্যা) বলত, ঐ আঙ্গুর গুলো আল্লাহ তাআলা খুবাইবকে রিযকস্বরূপ দান করেছিলেন। অবশেষে একদিন তারা খুবাইবকে হত্যা করার জন্য যখন হারামের সীমানার বাইরে নিয়ে গেল। তখন খুবাইব (রাযিঃ) তাদেরকে বললেন, আমাকে দু’রাকআত নামায আদায় করার সুযোগ দাও, তারা সুযোগ করে দিলে তিনি দু ‘রাকআত নামায আদায় করে বললেন, আল্লাহর কসম! আমি (মৃত্যুর ভয়ে) ভীত হয়ে পড়েছি, তোমরা এ কথা না ভাবলে আমি নামায আরো দীর্ঘায়িত করতাম।
এরপর তিনি এ বলে দুআ করলেন, হে আল্লাহ! তাদেরকে এক এক করে গুণে রাখ, তাদেরকে বিক্ষিপ্তভাবে হত্যা কর এবং তাদের একজনকেও অবশিষ্ট রেখ না। তারপর তিনি আবৃত্তি করলেনঃ “আমি যখন মুসলমান হিসাবে মৃত্যু বরণ করার সৌভাগ্য লাভ করেছি, তাই আমার কোনই ভয় নেই। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যে কোন অবস্থাতেই আমার মৃত্যু হউক। আর তা যেহেতু একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই, তিনি ইচ্ছা করলে আমার প্রতিটি কর্তিত অঙ্গে বরকত প্রদান করতে পারেন। ”এরপর (হারিসের পুত্র) আবু সারুআ উকবা (উকবা ইবনে হারিস) তাঁর দিকে দাঁড়াল এবং তাঁকে শহীদ করে দিল। এভাবেই খুবাইব (রাযিঃ) সে সব মুসলমানদের জন্য দু’রাকআত নামাযের নিয়ম (সুন্নত) চালু করে গেলেন যারা ধৈর্যের সাথে শাহাদত বরণ করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঐদিনই সাহাবীদেরকে অবহিত করেছিলেন যে দিন তাঁরা শত্রু কবলিত হয়ে শাহাদাত বরণ করেছিলেন।
কুরাইশদের নিকট তাঁর (আসিম (রাযিঃ)- এর) নিহত হওয়ার খবর পৌঁছলে তারা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আসিমের শরীরের কোন অঙ্গ কেটে আনার উদ্দেশ্যে কতিপয় কুরাইশ কাফিরকে প্রেরণ করল। যেহেতু (বদর যুদ্ধের দিন) আসিম ইবনে সাবিত তাদের (কুরাইশদের) একজন বড় নেতাকে হত্যা করেছিল। এদিকে আল্লাহ আসিমের লাশকে হিফাযত করার জন্য মেঘখণ্ডের ন্যায় এক ঝাঁক মৌমাছি পাঠিয়ে দিলেন। মৌমাছিগুলো আসিম (রাযিঃ)- এর লাশকে শত্রু সেনাদের হাত থেকে রক্ষা করল। ফলে তাঁর দেহের কোন অঙ্গ কেটে নিতে সক্ষম হল না। কা‘ব ইবনে মালিক (রাযিঃ) বলেন, মুরারা ইবনে রাবী আল উমরী এবং হিলাল ইবনে উমাইয়া আল ওয়াকিফী সম্বন্ধে লোকেরা বলেছেন যে, তারা উভয়ই আল্লাহর নেক বান্দা ছিলেন এবং দু’জনই বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

তাহকীক:
তাহকীক নিষ্প্রয়োজন