আল-আদাবুল মুফরাদ- ইমাম বুখারী রহঃ
আল-আদাবুল মুফরাদের পরিচ্ছেদসমূহ
হাদীস নং: ৯২৯
৪১৭. যে হাঁচি দেয় তাহার জবাব দেওয়া
৯২৯. হযরত আব্দুর রহমান ইব্ন যিয়াদ আফ্রীকী তাঁহার পিতার প্রমুখাৎ বর্ণনা করেন যে, তিনি বলিয়াছেন, তাঁহারা হযরত মু’আবিয়া (রাযিঃ)-এর আমলে নৌ-যুদ্ধে যোদ্ধা ছিলেন। (তিনি বলেন) একদা যখন আমাদের জাহাজ হযরত আবু আইয়ুব আনসারীর জাহাজের নিকটবর্তী হইল এবং আমাদের দুপুরের খাওয়ার সময় হইল, তখন আমরা তাঁহাকে আনার জন্য তাঁহার জাহাজে লোক পাঠাইলাম। তিনি আসিয়া বলিলেনঃ তোমরা আমাকে দাওয়াত করিয়াছ অথচ আমি রোযা অবস্থায় আছি। এতদসত্ত্বেও আমি যে তোমাদের আহবানে সাড়া দিলাম, তাহার কারণ হইতেছে আমি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কে বলিতে শুনিয়াছি, এক মুসলমানের উপর তাহার অপর মুসলমান ভাইয়ের ছয়টি অনিবার্য কাজ রহিয়াছে। যদি তাহার একটাও কেহ লংঘন করে তবে সে একটি ওয়াজিব হক লঙ্ঘন যাহা তাহার উপর তাহার ভাইয়ের হক ছিল।
১. যখন তাহার সাথে সাক্ষাৎ করিবে তখন তাহাকে সালাম দিবে।
২. যখন সে তাহাকে আহবান করিবে বা দাওয়াত করিবে তখন তাহার আহ্বানে সাড়া দিবে।
৩. সে যখন হাঁচি দিবে তখন (ইয়ারহামুকাল্লাহ্) বলিয়া তাহার হাঁচির জবাব দিবে।
৪. যখন সে রোগগ্রস্ত হইবে, তখন তাহাকে দেখিতে যাইবে।
৫. সে যখন ইন্তিকাল করিবে, তখন তাহার দাফন-কাফনে অংশগ্রহণ করিবে এবং
৬. সে যখন পরামর্শ চাহিবে, তখন তাহাকে উত্তম পরামর্শ দিবে।
বর্ণনাকারী বলেনঃ আমাদের সাথে (ঐ অভিযানে) একজন হাস্যরসিক লোকও ছিলেন। সে আমাদের সাথে ভোজনে শামিল এক ব্যক্তিকে বলিল, ‘জাযাকাল্লাহু খায়রান ওবার্রান’ --আল্লাহ্ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দিন। কিন্তু বারবার তাহাকে এইরূপ বলিলে সে ব্যক্তি ক্ষেপিয়া যাইত। তখন সেই হাস্যরসিক ব্যক্তিটি হযরত আবু আইয়ুব (রাযিঃ)-কে জিজ্ঞাসা করিল (হুযুর) এই লোকটি সম্পর্কে আপনি কী বলেন, যদি আমি তাহাকে জাযাকাল্লাহু খায়রান ও বার্রান’ বলি তখন সে ক্ষেপিয়া যায় এবং আমাকে গালি দিতে শুরু করে। হযরত আবু আইয়ুব (রাযিঃ) বলেনঃ আমি বলি মঙ্গলে যাহাকে সাজে না অমঙ্গলেই তাহাকে সাজে, সুতরাং তাহার জন্য উহা পাল্টাইয়া দাও। তখন ঐ লোকটি তাহার নিকটে আসিলে তাহাকে বলিল, ‘জাযাকাল্লাহু ওয়া শার্রান ওয়া আর্রা’ “আল্লাহ্ তোমাকে অমঙ্গল ও কঠোর প্রতিদান দিন!” তখন সে ব্যক্তি হাসিয়া উঠিল এবং প্রসন্ন হইয়া গেল এবং বলিয়া উঠিল, তুমি বুঝি তোমার হাস্য-রসিকতা ছাড়িতে পার না! তখন সে বলিলঃ আল্লাহ্ আবু আইয়ুব আনসারীকে উত্তম প্রতিদান দিন! (কেননা তাঁহার পরামর্শেই তো ইহা হইল!)
১. যখন তাহার সাথে সাক্ষাৎ করিবে তখন তাহাকে সালাম দিবে।
২. যখন সে তাহাকে আহবান করিবে বা দাওয়াত করিবে তখন তাহার আহ্বানে সাড়া দিবে।
৩. সে যখন হাঁচি দিবে তখন (ইয়ারহামুকাল্লাহ্) বলিয়া তাহার হাঁচির জবাব দিবে।
৪. যখন সে রোগগ্রস্ত হইবে, তখন তাহাকে দেখিতে যাইবে।
৫. সে যখন ইন্তিকাল করিবে, তখন তাহার দাফন-কাফনে অংশগ্রহণ করিবে এবং
৬. সে যখন পরামর্শ চাহিবে, তখন তাহাকে উত্তম পরামর্শ দিবে।
বর্ণনাকারী বলেনঃ আমাদের সাথে (ঐ অভিযানে) একজন হাস্যরসিক লোকও ছিলেন। সে আমাদের সাথে ভোজনে শামিল এক ব্যক্তিকে বলিল, ‘জাযাকাল্লাহু খায়রান ওবার্রান’ --আল্লাহ্ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দিন। কিন্তু বারবার তাহাকে এইরূপ বলিলে সে ব্যক্তি ক্ষেপিয়া যাইত। তখন সেই হাস্যরসিক ব্যক্তিটি হযরত আবু আইয়ুব (রাযিঃ)-কে জিজ্ঞাসা করিল (হুযুর) এই লোকটি সম্পর্কে আপনি কী বলেন, যদি আমি তাহাকে জাযাকাল্লাহু খায়রান ও বার্রান’ বলি তখন সে ক্ষেপিয়া যায় এবং আমাকে গালি দিতে শুরু করে। হযরত আবু আইয়ুব (রাযিঃ) বলেনঃ আমি বলি মঙ্গলে যাহাকে সাজে না অমঙ্গলেই তাহাকে সাজে, সুতরাং তাহার জন্য উহা পাল্টাইয়া দাও। তখন ঐ লোকটি তাহার নিকটে আসিলে তাহাকে বলিল, ‘জাযাকাল্লাহু ওয়া শার্রান ওয়া আর্রা’ “আল্লাহ্ তোমাকে অমঙ্গল ও কঠোর প্রতিদান দিন!” তখন সে ব্যক্তি হাসিয়া উঠিল এবং প্রসন্ন হইয়া গেল এবং বলিয়া উঠিল, তুমি বুঝি তোমার হাস্য-রসিকতা ছাড়িতে পার না! তখন সে বলিলঃ আল্লাহ্ আবু আইয়ুব আনসারীকে উত্তম প্রতিদান দিন! (কেননা তাঁহার পরামর্শেই তো ইহা হইল!)
بَابُ تَشْمِيتِ الْعَاطِسِ
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ سَلامٍ , قَالَ : أَخْبَرَنَا الْفَزَارِيُّ ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ زِيَادِ بْنِ أَنْعَمَ الإِفْرِيقِيِّ , قَالَ : حَدَّثَنِي أَبِي ، أَنَّهُمْ كَانُوا غُزَاةً فِي الْبَحْرِ زَمَنَ مُعَاوِيَةَ ، فَانْضَمَّ مَرْكَبُنَا إِلَى مَرْكَبِ أَبِي أَيُّوبَ الأَنْصَارِيِّ ، فَلَمَّا حَضَرَ غَدَاؤُنَا أَرْسَلْنَا إِلَيْهِ ، فَأَتَانَا , فَقَالَ : دَعَوْتُمُونِي وَأَنَا صَائِمٌ ، فَلَمْ يَكُنْ لِي بُدٌّ مِنْ أَنْ أُجِيبَكُمْ ، لأَنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ : " إِنَّ لِلْمُسْلِمِ عَلَى أَخِيهِ سِتَّ خِصَالٍ وَاجِبَةٍ ، إِنْ تَرَكَ مِنْهَا شَيْئًا فَقَدْ تَرَكَ حَقًّا وَاجِبًا لأَخِيهِ عَلَيْهِ : يُسَلِّمُ عَلَيْهِ إِذَا لَقِيَهُ ، وَيُجِيبُهُ إِذَا دَعَاهُ ، وَيُشَمِّتُهُ إِذَا عَطَسَ ، وَيَعُودُهُ إِذَا مَرِضَ ، وَيَحْضُرُهُ إِذَا مَاتَ ، وَيَنْصَحُهُ إِذَا اسْتَنْصَحَهُ " ، قَالَ : وَكَانَ مَعَنَا رَجُلٌ مَزَّاحٌ , يَقُولُ لِرَجُلٍ أَصَابَ طَعَامَنَا : جَزَاكَ اللَّهُ خَيْرًا وَبِرًّا ، فَغَضِبَ عَلَيْهِ حِينَ أَكْثَرَ عَلَيْهِ ، فَقَالَ لأَبِي أَيُّوبَ : مَا تَرَى فِي رَجُلٍ إِذَا قُلْتُ لَهُ : جَزَاكَ اللَّهُ خَيْرًا وَبِرًّا ، غَضِبَ وَشَتَمَنِي ؟ ، فَقَالَ أَبُو أَيُّوبَ : إِنَّا كُنَّا نَقُولُ : إِنَّ مَنْ لَمْ يُصْلِحْهُ الْخَيْرُ أَصْلَحْهُ الشَّرُّ ، فَاقْلِبْ عَلَيْهِ ، فَقَالَ لَهُ حِينَ أَتَاهُ : جَزَاكَ اللَّهُ شَرًّا وَعَرًّا ، فَضَحِكَ وَرَضِيَ ، وَقَالَ : مَا تَدَعُ مُزَاحَكَ ، فَقَالَ الرَّجُلُ : جَزَى اللَّهُ أَبَا أَيُّوبَ الأَنْصَارِيَّ خَيْرًا
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এখানে মুসলিমের উপর আরেক মুসলিমের কয়েকটি হকের বর্ণনা আছে। অর্থাৎ এ বিষয়গুলো এক মুসলিমের কাছে অপর মুসলিমের প্রাপ্য, যা আদায় করা কর্তব্য।
সালাম দেওয়া
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিম ব্যক্তির একটি হক বলেছেন সালাম দেওয়া। সালাম দেওয়া ইসলামের একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এটা ইসলামেরই বৈশিষ্ট্য যে, কারও সঙ্গে দেখা হলে প্রথমে সালাম দেবে। এটা সুন্নত। এর মাধ্যমে উদ্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে নিরাপত্তা দান করা হয়। বোঝানো হয়, আমি তোমার বা তোমাদের শত্রু নই, বন্ধু। তোমাদের জান, মাল ও ইজ্জত আমার দিক থেকে নিরাপদ। কাজেই আমার ব্যাপারে তোমরা আশ্বস্ত থাক। সালাম না দিলে সন্দেহ সৃষ্টি হয় যে, সে তাদের পক্ষে নিরাপদ কি না। কাউকে এরকম সন্দেহে রাখা উচিত নয়।
সকল মুসলিম ভাই ভাই। ইসলামী ভ্রাতৃত্বের দাবি একজন অন্যজনের প্রতি জুলুম করবে না। কেউ কারও জান, মাল ও ইজ্জতের ক্ষতি করবে না। এ নিরাপত্তা পাওয়া প্রত্যেকের হক ও অধিকার। সালামের মাধ্যমে তাদের সে অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। কাজেই এটা দেওয়া চাই। মুখোমুখি সাক্ষাতকালে যে প্রথমে সালাম দেবে সেই উত্তম। সাধারণ নিয়ম হচ্ছে ছোট বড়কে সালাম দেবে, চলন্ত ব্যক্তি বসে থাকা ব্যক্তিকে সালাম দেবে এবং ছোট দল বড় দলকে সালাম দেবে।
তবে ছোটকে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে বড়র পক্ষ থেকে তাকে সালাম দেওয়া ভালো। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরকম করতেন। এটা বিনয়েরও আলামত।
শুধু السلام عليكم বললে দশ নেকী। السلام عليكم ورحمة الله বললে বিশ নেকী, আর السلام عليكم ورحمة الله وبركاته বললে ত্রিশ নেকী।
অনেকে এর পর ومغفرته যোগ করে থাকে। সহীহ হাদীছে এর প্রমাণ নেই। হাদীছ দ্বারা যা প্রমাণিত, কেবল তার উপরই আমল করা উচিত।
দাওয়াত কবুল করা
এক মুসলিমের উপর আরেক মুসলিমের আরেকটি হক হচ্ছে দাওয়াত কবুল করা। এর আক্ষরিক অর্থ ডাকে সাড়া দেওয়া। ডাকে সাড়া দেওয়ার বিষয়টি ব্যাপক। আরবীতে এর দ্বারা সাধারণত অনুষ্ঠানের দাওয়াত বোঝায়। তবে কেউ যদি কাউকে কোনও প্রয়োজনে ডাকে, তা বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য ডাকা হোক বা অন্য কোনও সাহায্যের প্রয়োজনে ডাকা হোক, তবে যাকে ডাকা হয় তার কর্তব্য সে ডাকে সাড়া দেওয়া এবং নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী তাকে সাহায্য করা। এটাও এক মুসলিমের উপর আরেক মুসলিমের হক, যেমন পেছনে একাধিক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।
আরেক হচ্ছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে ডাকা অর্থাৎ দাওয়াত করা। হাদীসের ভাষ্যকারগণ এ শব্দের সেই অর্থই গ্রহণ করেছেন। কেউ যদি কাউকে বৈধ দাওয়াতে অংশগ্রহণের অনুরোধ করে, তবে তা কবুল করা উচিত। এর দ্বারা পরস্পরে মহব্বত সৃষ্টি হয়। দুই মুমিনের মধ্যে মহব্বত সৃষ্টি অত্যন্ত জরুরি। এটা জান্নাত লাভের উপায়। জান্নাত লাভ করা মুমিনদের পরম লক্ষ্য।যে দাওয়াতগ্রহণ তা লাভের পক্ষে সহায়ক হয়, তা কবুল করতে কুণ্ঠাবোধ করা উচিত নয়। এ হাদীছে তো দাওয়ার কবুলকে মুমিন ব্যক্তির হক বলা হয়েছে। অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- إذا دعي أحدكم إلى الوليمة فليأتها 'কাউকে যদি ওলীমার দাওয়াত দেওয়া হয়, তবে সে যেন তাতে আসে।
নির্দোষ দাওয়াত কবুল না করাটা অপরাধ। এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- ومن دعي إلى وليمة فلم يجب فقد عصى الله ورسوله 'যে ব্যক্তিকে ওলীমায় দাওয়াত দেওয়া হয় আর সে তা কবুল না করে, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করল।
অবশ্য দাওয়াত কবুল করা জরুরি কেবল তখনই, যখন তাতে আপত্তিকর কিছু না থাকে। যদি তাতে আপত্তিকর কিছু থাকে অথবা দাওয়াতটাই কোনও অবৈধ উপলক্ষ্যে হয়, তখন তা কবুল করা জরুরি নয়।।
ইদানীংকার অধিকাংশ দাওয়াতই এমন, যাতে যাওয়ার পরিবেশ থাকে না। সুন্নত দাওয়াতকেও নানারকম পাপাচারে পঙ্কিল করে ফেলা হয়েছে। ওলীমার দাওয়াত সুন্নত। কিন্তু আজকাল অধিকাংশ ওলীমার অনুষ্ঠান সহীহ পন্থায় হয় না।তাতে গানবাদ্য থাকে, পর্দার পরিবর্তে থাকে পর্দাহীনতার প্রতিযোগিতা, নারী-পুরুষ একই জায়গায় বসে খাওয়া-দাওয়া করা হয়, থাকে উপহারের প্রদর্শনী ও উপহার লেনদেনের সামাজিক বাধ্যবাধকতা, এছাড়াও নানারকম অনুচিত উপসর্গ। দীনদার ব্যক্তির এ জাতীয় দাওয়াতে যাওয়ার কোনও উপায় থাকে না। তাদের বরং না যাওয়াই উচিত। হাঁ, যদি সেখানে গিয়ে আপত্তিকর বিষয়গুলো অপসারণ করতে পারবে বলে আত্মবিশ্বাস থাকে, তবে ভিন্ন কথা। আগেও এরকম শর্ত দেওয়া যেতে পারে যে, অনুষ্ঠানে আপত্তিকর কিছু করা চলবে না। তারপর যাওয়ার পর যদি দেখা যায় যথাযথভাবে কথা রাখা হয়নি, তবে কোনওকিছুর পরওয়া না করে ফিরে আসবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার ছবিযুক্ত পর্দা দেখে নিজ ঘরেই ঢোকা হতে বিরত থেকেছিলেন। একবার মেয়ে-জামাতা হযরত ফাতিমা রাযি. ও হযরত আলী রাযি.-এর বাড়ি থেকেও ফিরে এসেছিলেন। একবার হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাযি. এক দাওয়াতে গিয়ে দেখতে পান দেওয়ালে পর্দা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কেন অর্থের এ অপচয়, এ কারণে তিনি সেখান থেকে ফিরে আসেন। তাঁরা আমাদের আদর্শ। তাঁদের পথে চলাতেই সঠিক সমাজগঠন ও সমাজ সংস্কারে সফলতা নির্ভর করে।
সাম্প্রতিক দাওয়াতসমূহের আরও একটি বড় দোষ হচ্ছে গরীব-ধনীর ভেদাভেদ করা। অনেকেই গরীব আত্মীয় বা গরীব প্রতিবেশীকে অবজ্ঞা করে থাকে। তারা তাদের অনুষ্ঠানসমূহে অনাত্মীয় ধনী বন্ধু-বান্ধবকে তো দাওয়াত করে, কিন্তু গরীব আত্মীয় ও গরীব প্রতিবেশীর কথা মনে করে না। এ জাতীয় অনুষ্ঠান অতি নিকৃষ্ট। এর খানাদানায় বরকত থাকে না। এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ- بئس الطعام طعام الوليمة يدعى إليها الأغنياء ويترك الفقراء ‘অতি নিকৃষ্ট খাবার সে ওলীমার খাবার, যাতে ধনীদের দাওয়াত দেওয়া হয়, গরীবদের ত্যাগ করা হয়।
সমস্ত মুসলিম যখন ভাই-ভাই; বরং একদেহতুল্য, তখন গরীব-ধনী ভেদাভেদ করা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়। এ প্রভেদ একরকম বর্ণবাদ ও জাহিলিয়াত। আলোর ধর্ম ইসলামের অনুসারীদেরকে এরকম জাহিলী ভেদনীতি থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
কল্যাণকামিতা প্রদর্শন করা
এ হাদীছে আরেকটি হক বলা হয়েছে মানুষের প্রতি কল্যাণকামিতা। নবী-রাসূলগণ উম্মতের পক্ষে শ্রেষ্ঠতম কল্যাণকামী হতেন। তাই তাঁরা নিজেদেরকে ناصح (কল্যাণকামী) বলে পরিচয় দিতেন। যেমন হযরত হূদ আলাইহিস সালাম তাঁর কওমকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন- وانا لكم ناصح امين 'আমি তোমাদের এক বিশ্বস্ত কল্যাণকামী।
যারা মানুষের মধ্যে ওয়াজ ও নসীহত করে থাকে, তাদের অন্তরে কল্যাণকামিতার গুণ থাকা অতি জরুরি। অন্যথায় এ কাজটি নিজের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
মুসলিম ভাইয়ের প্রতি কল্যাণকামিতা প্রদর্শনকে এ হাদীছে তার একটি হক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য, যখন কোনও মুসলিম ভাই তার কাছে কল্যাণকামিতামূলক আচরণ আশা করে, তখন এদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া চাই। অন্যথায় এটা সবসময়কার কর্তব্য। যেমন আছেঃ- وينصح له إذا غاب أو شهد 'সে অনুপস্থিত থাকুক বা উপস্থিত, সর্বাবস্থায় তার প্রতি কল্যাণকামিতার আচরণ করবে।'
উপস্থিত অবস্থায় কল্যাণকামিতা হতে পারে এরকম যে, সে কোনও ক্ষতিকর কাজে লিপ্ত হলে সে ব্যাপারে তাকে সতর্ক করা, কোনও গুনাহে লিপ্ত হলে তা থেকে ফেরানোর চেষ্টা করা, বিপদে পড়লে তা থেকে উদ্ধারের চেষ্টা করা, অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, পানাহারের কষ্টে পড়লে তা লাঘবের চেষ্টা করা ইত্যাদি। এরকম যে-কোনও অবস্থায় নিজ ভাইয়ের ক্ষেত্রে যা-কিছু করা কর্তব্য বলে মনে হয়, যে-কোনও মুসলিমের সঙ্গেও সেরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করাই হচ্ছে কল্যাণকামিতার দাবি।
অনেক সময় চোখের সামনে কেউ এমন কোনও কাজ করে বসে, যাতে তার দীন দুনিয়া উভয়ের ক্ষতি, কিন্তু তা দেখেও না দেখার ভান করা হয়। ভাবটা এমন- তার কী হল না হল তাতে আমার কী আসে যায়? এমনকি চোখের সামনে একজন আরেকজনকে মারধর করলেও পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। আমার আপন কাউকে তো মারা হচ্ছে না। কাজেই কোনও দায়িত্বও নেই। পাশের ঘরের পুরুষটি তার স্ত্রীকে পেটাচ্ছে। নিয়মিতই পেটায়। জানা সত্ত্বেও কোনও যিম্মাদারী বোধ করা হয় না। এরকম হাজারও ঘটনা আছে, যাতে আমরা চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে থাকি। নিঃসন্দেহে এসব কল্যাণকামিতামূলক আচরণের পরিপন্থী।
এমনিভাবে মুসলিম ভাই যখন অনুপস্থিত থাকে, তখনও কল্যাণকামিতার ব্যাপারটা এসে যায়। উদাহরণত তার পেছনে যদি কেউ তার গীবত ও বদনাম করে, তখন কল্যাণকামিতার দাবি তাতে বাধা দেওয়া এবং তার ভালো গুণসমূহ আলোচনায় নিয়ে আসা। কেউ যদি কারও পেছনে তার জান-মালের পক্ষে ক্ষতিকর কোনও তৎপরতা চালায়, তবে সাধ্য অনুযায়ী তা প্রতিহত করার চেষ্টা করা। তার পদ বা পদমর্যাদার পক্ষে ক্ষতিকর কোনও তৎপরতা নজরে আসলে সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এসবই কল্যাণকামিতার দাবি।
নিকট বা দূরপ্রতিবেশীর ক্ষেত্রে এটা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবেশী বাড়িতে না থাকলে যাতে তার অর্থ-সম্পদ ও মান-সম্ভ্রমের ক্ষতি না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা একান্ত কর্তব্য। সে বাড়িতে না থাকায় ঘরের লোকজন যাতে কষ্টে না পড়ে সেদিকে লক্ষ রাখা চাই। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করা চাই। গৃহকর্তা বাড়ি নেই বলে তারা যেন অসহায়ত্ব বোধ না করে, সেরকম আচরণ তাদের প্রতি করতে হবে। গৃহকর্তাও দূরে থেকে যেন নিশ্চিন্ত থাকতে পারে যে, আমার সৎ প্রতিবেশী তো আছে, কোনও সমস্যা দেখা দিলে সে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।
প্রকাশ থাকে যে, কারও অনুপস্থিতিতে এসকল দায়িত্ব পালন করতে হবে অত্যন্ত সতর্কতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে, যাতে নিজ ইজ্জতের উপর আঘাত আসতে না পারে। প্রতিবেশীর অনুপস্থিতিতে তার বাড়িতে প্রবেশ বাঞ্ছনীয় নয়। খোঁজখবর রাখতে হবে বাড়িতে না ঢুকেই। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে সে বাড়ির মহিলাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা যাবে না, এমনকি ফোনেও কথা বলা সমীচীন নয়। কথা বলার প্রয়োজন সমাধা করা চাই শিশুদের মাধ্যমে কিংবা নিজ ঘরের মহিলাদের মাধ্যমে। সারকথা মুসলিম ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে কল্যাণকামিতামূলক যিম্মাদারীও পালন করতে হবে এবং নিজ মান-সম্ভ্রমও রক্ষা করতে হবে।
প্রচলিত ওয়াজ-নসীহতে কল্যাণকামিতা প্রসঙ্গ
প্রচলিত অর্থে ওয়াজ ও উপদেশকে যে নসীহত বলা হয় তাও মূলত এ কারণে যে, সত্যিকারের উপদেশ তাই, যা দরদ ও কল্যাণকামিতায় পূর্ণ অন্তর থেকে উৎসারিত হয়। যে উপদেশে কল্যাণকামিতার স্পর্শ নেই, প্রকৃত অর্থে তাকে নসীহত বলা যায় না। কাজেই যারা ওয়াজ-নসীহত করে থাকে, তাদের এ বিষয়ের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ রাখা দরকার। এটা মূলত আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের দাওয়াতের পদ্ধতি। তাই এর আছে আলাদা মহিমা। সতর্ক থাকা দরকার যাতে নিজ কর্মপন্থা দ্বারা সে মহিমা ক্ষুণ্ণ না হয়। এর উত্তম ব্যবস্থা হল কুরআন মাজীদের শিক্ষা দেওয়া মূলনীতি ও নবী-রাসূলগণের আদর্শ সামনে রেখে ওয়াজ-নসীহত করা। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ- ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ “তুমি নিজ প্রতিপালকের পথে মানুষকে ডাকবে হিকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে আর (যদি কখনও বিতর্কের দরকার পড়ে, তবে) তাদের সাথে বিতর্ক করবে উৎকৃষ্ট পন্থায়।
এ আয়াতে আল্লাহর পথে ডাকার পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এতে বর্ণিত মূলনীতি হল তিনটিঃ-
ক. হিকমত;
খ. সদুপদেশ ও
গ. উৎকৃষ্ট পন্থায় বিতর্ক।
হিকমতের মর্ম হল, সত্য-সঠিক বিষয়বস্তুকে অকাট্য দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে স্থান-কাল-পাত্রকে বিবেচনায় রেখে উপস্থাপন করা। সদুপদেশের অর্থ, যাকে দাওয়াত দেওয়া হবে তার ইজ্জত-সম্মানের প্রতি লক্ষ রেখে তার কল্যাণ কামনার্থে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় ও নম্রতার সাথে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা। আর উৎকৃষ্ট পন্থায় বিতর্ক করার অর্থ সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা ও প্রতিপক্ষকে তা বোঝানোর নিয়তে সত্যনিষ্ঠার সাথে ভদ্রোচিত ভাষায় যথোপযুক্ত যুক্তি-তর্ক ও দলীল-প্রমাণ পেশ করা, প্রতিপক্ষের মনে আঘাত লাগতে পারে বা জিদ সৃষ্টি হতে পারে এ জাতীয় আচরণ পরিহার করা এবং সর্বাবস্থায় মাত্রাবোধ ও ন্যায়-ইনসাফের পরিচয় দেওয়া।
ওয়াজ-নসীহতে ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের রীতিনীতি রক্ষা করাও জরুরি। লক্ষ রাখা দরকার যাতে কারও আবেগ-অনুভূতি আহত না হয় ও কারও আত্মসম্মানে আঘাত না লাগে। অন্যথায় উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইব্ন হাজার আসকালানী রহ.-এর বক্তব্য উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেনঃ-
“আদেশ-উপদেশ দেওয়ার উদ্দেশ্য যদি থাকে তার প্রতি কল্যাণকামনা আর সে লক্ষ্যেই তার অবস্থা (তার দোষত্রুটি) তুলে ধরা হয়, তবেই সে আদেশ-উপদেশ জায়েয। পক্ষান্তরে যদি উদ্দেশ্য হয় কেবলই তার নিন্দা করা, তার দোষ প্রকাশ করা ও তাকে কষ্ট দেওয়া, তবে তা জায়েয হবে না। কেননা শরীআতের পক্ষ থেকে আদেশ হচ্ছে অপরাধীর দোষ গোপন করা, তাকে শিক্ষাদান করা ও উত্তম পন্থায় তাকে নসীহত করা। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত নম্র-কোমলতার দ্বারা এটা সম্ভব, ততক্ষণ পর্যন্ত তার প্রতি কঠোর আচরণ ও নিন্দা-ধিক্কারের পন্থা অবলম্বন জায়েয নয়। কেননা তা অনেক সময় তাকে আরও বেশি অন্যায়-অপরাধের প্রতি উস্কানি দেওয়ার এবং তার আপন কাজে জেদী হয়ে ওঠার কারণ হয়। কিছু মানুষ স্বভাবগতভাবেই আত্মাভিমানী হয়ে থাকে, বিশেষত যাকে আদেশ-উপদেশ দেওয়া হয়, আদেশদাতা যদি মর্যাদায় তার তুলনায় নিচে হয় (তখন নিন্দা-তিরস্কারে তার আত্মাভিমান জেগে ওঠে, ফলে সে তার কৃত অন্যায়-অপরাধে আরও জেদী হয়ে ওঠে)।
আদেশ-উপদেশদাতার নিজ আমলেরও তদারকি করা উচিত। কেননা সে যদি মুত্তাকী-পরহেযগার হয় এবং তার আখলাক-চরিত্র উন্নত হয়, তখন তার মুখের কথা অপেক্ষা তার কর্ম ও চরিত্র দ্বারাই মানুষ আত্মসংশোধনে বেশি উৎসাহ পায় এবং তার বয়ান-বক্তব্য অপেক্ষা তার আমল-আখলাক দ্বারাই মানুষের উপকার বেশি হয়।
কল্যাণকামিতা প্রদর্শনের গুরুত্ব
যাহোক কল্যাণকামিতামূলক আচরণ দীনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, ঈমান, নামায ও যাকাতের মত এ বিষয়েও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের নিকট থেকে বাইআত গ্রহণ করতেন। যেমন হযরত জারীর রাযি. থেকে বর্ণিত আছেঃ- بايعت رسول اللہ ﷺ على إقام الصلاة وإيتاء الزكاة والنُصح لكل مسلم 'আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট বাইআত হলাম নামায কায়েম করা, যাকাত দেওয়া ও প্রত্যেক মুসলিমের প্রতি কল্যাণকামনার ব্যাপারে।
এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত জারীর রাযি.-কে বলেছিলেন, আমি তোমার বাইআত গ্রহণ করব না, যতক্ষণ না তুমি প্রত্যেক মুসলিমের প্রতি কল্যাণকামিতার আচরণ করবে বলে অঙ্গীকার কর। সুতরাং তিনি এ বিষয়টাও তাঁর বাইআতের অন্তর্ভুক্ত করলেন।
মুসলিম-সাধারণের প্রতি কল্যাণকামিতা যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা আরও একটি হাদীছ দ্বারা পরিস্ফুট হয়। তাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কল্যাণকামিতাকেই 'দীন' নামে অভিহিত করেছেন। হাদীছটি নিম্নরূপ— الدين النصيحة ثلاث مرار، قالوا: يا رسول الله لمن؟ قال: الله، وكتابه، ورسوله، وأئمة المسلمين وعامتهم‘দীন তো কল্যাণকামিতাই। তিনি এ কথা তিনবার বললেন। সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কার প্রতি? তিনি বললেন, আল্লাহর প্রতি, তাঁর কিতাবের প্রতি, তাঁর রাসূলের প্রতি, মুসলিম শাসকদের প্রতি এবং আমজনগণের প্রতি।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এসকল হাদীছের উপর আমল করার তাওফীক দান করুন, যাতে আমরা সর্বাবস্থায় মুসলিম-সাধারণের প্রতি কল্যাণকামী হয়ে থাকতে পারি এবং সকলের প্রতি কল্যাণকামিতার দাবি অনুযায়ী আচরণ করতে পারি – আমীন।
জানাযায় অংশগ্রহণ করা।
সমস্ত মুসলিম ভাই-ভাই। বরং সব মুসলিম মিলে একদেহতুল্য। কাজেই কোনও মুসলিমের মৃত্যু হওয়া যেন কারও দেহের একটি অঙ্গ ছিন্ন হওয়া। অঙ্গের ছিন্ন হওয়া যেমন প্রত্যেকের জন্য শোকের বিষয়, তেমনি কোনও মুসলিম ভাইয়ের মৃত্যুতেও শোক ও দুঃখ বোধ করা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের দাবি। সবচে' বড় কথা যার মৃত্যু হল সে এতদিন দুনিয়ায় আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মিলেমিশে ছিল। এখন সে একা হয়ে গেছে। কারও পক্ষে এখন তার পাশে দাঁড়ানো সম্ভবই নয়। তবে কি তাকে এভাবে নিঃসঙ্গ ছেড়ে দেওয়া হবে? তার জন্য কিছুই করার সুযোগ নেই? হাঁ, সুযোগ আছে। কারও শারীরিক বা আর্থিক সাহায্যই বড় সাহায্য নয়। এরচে'ও বড় সাহায্য হল দীনী ও ঈমানী সাহায্য। যে সাহায্য কবর ও হাশরে কাজে আসে, তার মত উপকার আর হয় না। মৃত্যু দ্বারা যে ব্যক্তি একা হয়ে গেল, এখন সে সাহায্যই তার প্রয়োজন। ইসলাম আমাদেরকে সেরকম সাহায্যের পথ দেখিয়েছে। এরকম সাহায্যের সর্বপ্রধান ব্যবস্থা জানাযার নামায়। এটা কবরযাত্রীর জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ। আল্লাহ যেন তাকে মাফ করে দেন সে দুআই জানাযায় নামাযে করা হয়ে থাকে। মুমিনগণ নামাযের রূপে তার জন্য এ দুআ করলে অবশ্যই তা কবুল হওয়ার আশা থাকে। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- ما من ميت تصلي عليه أمة من المسلمين يبلغون مائة، كلهم يشفعون له، إلا شفعوا فيه “একশ সংখ্যক মুসলিমের একটি দল যে মায়্যিতের জানাযার নামায আদায় করে এবং তারা তার জন্য সুপারিশ করে, তার জন্য তাদের সুপারিশ অবশ্যই কবুল হয়।
হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- ما من رجل مسلم يموت، فيقوم على جنازته أربعون رجلا، لا يشركون بالله شيئا، إلا شفعهم الله فيه “কোনও মুসলিম ব্যক্তি যদি মারা যায়, তারপর আল্লাহর সঙ্গে কোনওকিছুকে শরীক করে না এমন চল্লিশ জন লোক তার জানাযা পড়ে, তবে আল্লাহ তাআলা তার পক্ষে তাদের সুপারিশ অবশ্যই কবুল করেন।
জীবিতদের যে আমল দ্বারা মৃত ব্যক্তির এত বড় উপকার হয়, অত্যন্ত আগ্রহ উদ্দীপনার সঙ্গেই তাতে শরীক হওয়া চাই। এর ফযীলতও অনেক। যেমন হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- من شهد الجنازة حتى يصلي فله قيراط، ومن شهد حتى تدفن كان له قيراطان، قيل : وما القيراطان؟ قال: مثل الجبلين العظيمين “যে ব্যক্তি মায়্যিতের সাথে তার জানাযার নামায আদায় করা পর্যন্ত হাজির থাকে,সে এক কীরাত ছাওয়াব লাভ করে। আর যে ব্যক্তি তাকে দাফন করা পর্যন্ত হাজির থাকে, সে দুই কীরাত ছাওয়াব লাভ করে। জিজ্ঞেস করা হল, দুই কীরাত কী? তিনি বললেন, দুটি বড় বড় পাহাড়ের সমান।
রোগী দেখতে যাওয়া
عيادة المريض - রোগীর ইয়াদত করা। অর্থাৎ কারও অসুস্থতার সংবাদ শুনলে তাকে দেখতে যাওয়া ও তার খোঁজখবর নেওয়া। এটা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের দাবি। এর দ্বারা পারস্পরিক ঐক্য ও সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়। এটা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজও বটে। হযরত আলী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- ما من مسلم يعود مسلما غدوة إلا صلى عليه سبعون ألف ملك حتى يمسي، وإن عادة عشية إلا صلى عليه سبعون ألف ملك حتى يصبح، وكان له خريف في الجنة “যে-কোনও মুসলিম ব্যক্তি সকালবেলা কোনও অসুস্থ মুসলিমকে দেখতে গেলে সত্তর হাজার ফিরিশতা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য মাগফিরাতের দুআ করে। যদি সন্ধ্যাবেলা তাকে দেখতে যায় তবে সত্তর হাজার ফিরিশতা সকাল পর্যন্ত তার জন্য মাগফিরাতের দুআ করে এবং তার জন্য জান্নাতে একটি বাগান করা হয়।
হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- أيما رجل يعود مريضا، فإنما يخوض في الرحمة، فإذا قعد عند المريض غمرته الرحمة». قال: فقلت: يا رسول الله، هذا للصحيح الذي يعود المريض، فالمريض ما له؟ قال: تحط عنه ذنوبه “যে ব্যক্তি কোনও রোগী দেখতে যায় সে রহমতের ভেতর ডুব দিতে থাকে। যখন সে রোগীর কাছে গিয়ে বসে তখন রহমত তাকে নিমজ্জিত করে ফেলে। বর্ণনাকারী (হযরত আনাস রাযি.) বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা তো ওই সুস্থ ব্যক্তির জন্য, যে রোগী দেখতে যায়। তা অসুস্থ ব্যক্তি কী পাবে? তিনি বললেন, তার পাপরাশি মিটিয়ে দেওয়া হয়।
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- من عاد مريضا أو زار أخا له في الله ناداه مناد أن طبت وطاب ممشاك وتبوأت من الجنة منزلاً যে ব্যক্তি কোনও রোগী দেখতে যায় বা তার কোনও মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাত করতে যায়, তার উদ্দেশে এক ঘোষক ঘোষণা করে, তুমি শুভ হও, তোমার যাত্রা শুভ হোক এবং জান্নাতে তোমার ঠিকানা হোক।
হযরত ছাওবান রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- عائد المريض في مخرفة الجنة “যে ব্যক্তি রোগী দেখতে যায় সে জান্নাতের ফলের বাগানে (অথবা এর অর্থ, সে জান্নাতের পথে) থাকে।
সুবহানাল্লাহ, রোগী দেখতে যাওয়া এমন কিছু কঠিন কাজ নয়, অথচ এর ছাওয়াব ও পুরস্কার কত বিশাল! এক তো এর দ্বারা মুসলিম ভাইয়ের হক আদায় হয়, পরস্পরে মহব্বত সৃষ্টি হয় এবং সবচে' বড় কথা এ আমল জান্নাতে যাওয়ার পথ সুগম করে। এত বড় ফযীলতের কাজেও আমাদের কতইনা গাফলাতি! আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এ গাফলাতি ঝেড়ে ফেলে আমলে উদ্যোগী হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।
রোগী দেখার কয়েকটি দুআ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোগী দেখার বিভিন্ন দুআও শিক্ষা দিয়েছেন। যেমন, হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন আমর ইবনুল আস রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, কেউ যখন কোনও রোগী দেখতে যাবে তখন বলবেঃ- اللَّهُمَّ اشْفِ عَبْدَكَ ، يَنْكَأُ لَكَ عَدُوًّا ، وَيَمْشِي لَكَ إِلَى الصَّلاَةِ “হে আল্লাহ! তোমার বান্দাকে সুস্থ করে দাও, যাতে সে তোমার শত্রুর উপর আঘাত হানতে পারে এবং তোমার জন্য নামাযে যেতে পারে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কোনও ব্যক্তি রোগী দেখতে গিয়ে যদি সাতবার বলেঃ- أَسْأَلُ اللَّهَ الْعَظِيمَ رَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ أَنْ يَشْفِيَكَ (যিনি মহান আরশের মালিক সেই মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, যেন তিনি তোমাকে শিফা দান করেন), তবে আল্লাহ তাকে আরোগ্য দান করেন, যদি তার হায়াত থাকে।
হযরত ইব্ন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনও রোগী দেখতে গেলে বলতেনঃ- لا بأس، طهور إن شاء الله “এতে তোমার কোনও অনিষ্ট নেই। আল্লাহ চাহেন তো এটা পাপরাশি থেকে তোমার পবিত্রতার কারণ হবে।
উম্মুল মু'মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনও রোগী দেখতে গেলে বলতেন— «أَذْهِبِ الْبَاسَ رَبَّ النَّاسِ، اشْفِ أَنْتَ الشَّافِي، لَا شِفَاءَ إِلَّا شِفَاؤُكَ، شِفَاءً لَا يُغَادِرُ سَقَمًا» 'হে মানুষের প্রতিপালক! অসুস্থতা দূর করে দিন। আপনিই শেফাদাতা। আপনার দেওয়া শেফা ছাড়া কোনও শেফা নেই। আপনি এমন শেফা দান করুন, যা কোনও রোগ বাকি রাখবে না।
হাঁচিদাতাকে يرحمك الله বলা
হাদীছটিতে বর্ণিত মুসলিম ব্যক্তির পঞ্চম হক হল تشميت العاطس হাঁচিদাতাকে يرحمك الله বলা, অর্থাৎ আল্লাহ তোমার প্রতি রহমত বর্ষণ করুন। تشميت العاطس অর্থ কল্যাণ ও বরকতের দু'আ করা। শব্দটির উৎপত্তি شماتة থেকে। যার অর্থ অন্যের বিপদে আনন্দিত হওয়া।تشميت অর্থ সেই আনন্দ প্রতিহত করা। যার প্রতি আল্লাহর রহমত হয় তার বিপদও কেটে যায়। ফলে শত্রুর আনন্দ ঘুচে যায়। যেহেতু এ দু'আটি পরিণামে শত্রুর আনন্দ ঘুচিয়ে দেয় তাই একে تشميت নামে অভিহিত করা হয়েছে।
কারও মতে تشميت এর উৎপত্তি شواميت থেকে। شواميت অর্থ হাত-পা, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। সেই হিসেবে تشميت অর্থ স্থিত ও প্রতিষ্ঠিত রাখা। يرحمك الله বলার দ্বারা হাঁচিদাতার জন্য তাকে দীনের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার দু'আ করা হয়। তাই এ দু'আকে تشميت নাম দেওয়া হয়েছে।
হাঁচি দেওয়া একটি নিআমত। এর দ্বারা আলস্য কাটে ও শরীর ঝরঝরে হয়। ফলে কাজকর্মে স্ফুর্তি আসে। তখন ইবাদত-বন্দেগী করতে ভালো লাগে। তাই হাঁচিদাতার কর্তব্য হাঁচি দেওয়ার পর আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা। অর্থাৎ আলহামদুল্লিাহ বলা আলহামদুল্লিাহ শোকর আদায়ের ভাষা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে হাঁচির এ দু'আ শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি হাঁচির ব্যাপারে আমাদের জন্য এক পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা রেখে গেছেন। হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে তিনি ইরশাদ করেনঃ- إذا عطس أحدكم، فليقل: الحمد لله، فإذا قال: الحمد لله، قال له أخوه يرحمك الله، فإذا قيل له يرحمك الله : فليقل: يهديكم الله ويصلح بالكم 'তোমাদের কেউ হাঁচি দিলে সে যেন বলে الْحَمْدُ لِلَّهِ (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর)। সে যখন الْحَمْدُ لِلَّهِ বলবে তখন উপস্থিত ভাই যেন বলে يَرْحَمُكَ اللَّهُ (আল্লাহ তোমার প্রতি রহমত করুন)। তাকে লক্ষ্য করে يَرْحَمُكَ اللَّهُ বললে সে যেন বলে يَهْدِيكُمُ اللَّهُ وَيُصْلِحُ بَالَكُمْ (আল্লাহ তোমাদের হেদায়েত দান করুন এবং তোমাদের অবস্থা দুরস্ত করে দিন)।
হাঁচিদাতা আলহামদুল্লিাহ বললে তার জবাবে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা ওয়াজিব। অনেকেই এই ওয়াজিব পালনে অবহেলা করে। তা করা উচিত নয়। তাতে এক তো ওয়াজিব তরকের গুনাহ হয়। দ্বিতীয়ত, হাঁচিদাতাকেও হেলা করা হয়, বিশেষত সে যদি গরীব হয় বা তথাকথিত সামাজিক দৃষ্টিতে নিম্নস্তরের হয়। কোনও মুসলিম ব্যক্তিকে হেলা করা কঠিন অপরাধ। এ ব্যাপারে সতর্কতা জরুরি। সুতরাং হাঁচিদাতার উত্তরে ইয়ারহামুকাল্লাহ অবশ্যই বলতে হবে, সে যেই হোক না কেন। অবশ্য যদি বারবার হাঁচি দেয়, তিনবার বা তারও বেশি তবে সেটা সর্দির আলামত। সেক্ষেত্রে বারবার উত্তর দেওয়ার জরুরত নেই।
উপস্থিত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে যখন ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা হবে তখন আবার হাঁচিদাতার কাজ তাদের জন্য দুআ করা। তারা তার জন্য দুআ করে তার প্রতি যেই ইহসান করেছে তার বদলা দেওয়া তার কর্তব্য। উপকারীর উপকার করাও ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। কেউ কারও উপকার করলে সে উপকারের বদলা দেওয়া কর্তব্য। বৈষয়িক উপকারও উপকার বটে। তবে কারও জন্য দু'আ করা বা কারও দীনী কল্যাণ সাধন করা আরও বড় উপকার। কাজেই উপস্থিত ব্যক্তিগণ দু'আ দ্বারা হাঁচিদাতার যে বিরাট উপকার করল তার বিনিময়ে কিছু করা তো চাই। সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা হল সেও তাদের জন্য এই বলে দু'আ করবে- (আল্লাহ তোমাদের হেদায়েত দান করুন এবং তোমাদের অবস্থা দুরস্ত করে দিন)।
“এই যে হকসমূহের কথা উল্লেখ করা হল, এর সবগুলোই সকল মুসলিমের প্রাপ্য। এ ব্যাপারে কোনওরকম ভেদাভেদ ও বৈষম্য করার সুযোগ নেই। ইবনুল আরাবী রহ. বলেন, ইসলাম সকল মুসলিমকে সমান মর্যাদা দিয়েছে। সুতরাং এসব হকেও সকল মুসলিমের প্রতি সমান আচরণ জরুরি। তুমি কখনও এরকম ভাববে না যে, ইনি একজন শাসক, একজন প্রভাবশালী ও একজন বিত্তবান, আর সে একজন গরীব ও তুচ্ছলোক। তুমি কাউকেই তুচ্ছ গণ্য করবে না। তুমি মনে করবে ইসলাম যেন এক ব্যক্তি আর সমস্ত মুসলিম তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। কেননা মুসলিমসাধারণ ছাড়া ইসলামের অস্তিত্ব কোথায় পাবে? যেমন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও প্রকাশ্য-গুপ্ত শক্তি-ক্ষমতা ছাড়া কোনও ব্যক্তির অস্তিত্ব পেতে পার না।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা আমরা কর্তব্যবোধের শিক্ষা পাই। কোনও মুসলিম কেবল তার নিজের জন্য নয়; অন্যদের উপরও তার অনেক দায়-দায়িত্ব রয়েছে। প্রকৃত মুসলিম হওয়ার জন্য সেসব দায়িত্ব পালন করা অপরিহার্য।
খ. এক মুসলিমের প্রতি আরেক মুসলিমের একটি কর্তব্য সালাম দেওয়া। এটা তার হক, যা আদায় করা আবশ্যক।
গ. মুসলিম ব্যক্তির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ হক হচ্ছে তার প্রতি কল্যাণকামিতার আচরণ করা।
ঘ. রোগীর ইয়াদাত করা অর্থাৎ তার খোঁজখবর নেওয়াও ইসলামী হকসমূহের একটি এবং এটা অত্যন্ত ফযীলতের কাজ।
ঙ. জানাযায় অংশগ্রহণ করা একটি অবশ্যপালনীয় আমল এবং এটা মৃতব্যক্তি ও তার পরিবারবর্গের হক।
চ. দাওয়াত কবুল করা এবং অন্যের ডাকে সাড়া দেওয়াও একটি হক, যা রক্ষা করা অবশ্যকর্তব্য।
ছ. তাশমীত অর্থাৎ হাঁচিদাতার আলহামদুলিল্লাহ বলার জবাবে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা তার হক ও অবশ্যপ্রাপ্য।
সালাম দেওয়া
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিম ব্যক্তির একটি হক বলেছেন সালাম দেওয়া। সালাম দেওয়া ইসলামের একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এটা ইসলামেরই বৈশিষ্ট্য যে, কারও সঙ্গে দেখা হলে প্রথমে সালাম দেবে। এটা সুন্নত। এর মাধ্যমে উদ্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে নিরাপত্তা দান করা হয়। বোঝানো হয়, আমি তোমার বা তোমাদের শত্রু নই, বন্ধু। তোমাদের জান, মাল ও ইজ্জত আমার দিক থেকে নিরাপদ। কাজেই আমার ব্যাপারে তোমরা আশ্বস্ত থাক। সালাম না দিলে সন্দেহ সৃষ্টি হয় যে, সে তাদের পক্ষে নিরাপদ কি না। কাউকে এরকম সন্দেহে রাখা উচিত নয়।
সকল মুসলিম ভাই ভাই। ইসলামী ভ্রাতৃত্বের দাবি একজন অন্যজনের প্রতি জুলুম করবে না। কেউ কারও জান, মাল ও ইজ্জতের ক্ষতি করবে না। এ নিরাপত্তা পাওয়া প্রত্যেকের হক ও অধিকার। সালামের মাধ্যমে তাদের সে অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। কাজেই এটা দেওয়া চাই। মুখোমুখি সাক্ষাতকালে যে প্রথমে সালাম দেবে সেই উত্তম। সাধারণ নিয়ম হচ্ছে ছোট বড়কে সালাম দেবে, চলন্ত ব্যক্তি বসে থাকা ব্যক্তিকে সালাম দেবে এবং ছোট দল বড় দলকে সালাম দেবে।
তবে ছোটকে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে বড়র পক্ষ থেকে তাকে সালাম দেওয়া ভালো। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরকম করতেন। এটা বিনয়েরও আলামত।
শুধু السلام عليكم বললে দশ নেকী। السلام عليكم ورحمة الله বললে বিশ নেকী, আর السلام عليكم ورحمة الله وبركاته বললে ত্রিশ নেকী।
অনেকে এর পর ومغفرته যোগ করে থাকে। সহীহ হাদীছে এর প্রমাণ নেই। হাদীছ দ্বারা যা প্রমাণিত, কেবল তার উপরই আমল করা উচিত।
দাওয়াত কবুল করা
এক মুসলিমের উপর আরেক মুসলিমের আরেকটি হক হচ্ছে দাওয়াত কবুল করা। এর আক্ষরিক অর্থ ডাকে সাড়া দেওয়া। ডাকে সাড়া দেওয়ার বিষয়টি ব্যাপক। আরবীতে এর দ্বারা সাধারণত অনুষ্ঠানের দাওয়াত বোঝায়। তবে কেউ যদি কাউকে কোনও প্রয়োজনে ডাকে, তা বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য ডাকা হোক বা অন্য কোনও সাহায্যের প্রয়োজনে ডাকা হোক, তবে যাকে ডাকা হয় তার কর্তব্য সে ডাকে সাড়া দেওয়া এবং নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী তাকে সাহায্য করা। এটাও এক মুসলিমের উপর আরেক মুসলিমের হক, যেমন পেছনে একাধিক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।
আরেক হচ্ছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে ডাকা অর্থাৎ দাওয়াত করা। হাদীসের ভাষ্যকারগণ এ শব্দের সেই অর্থই গ্রহণ করেছেন। কেউ যদি কাউকে বৈধ দাওয়াতে অংশগ্রহণের অনুরোধ করে, তবে তা কবুল করা উচিত। এর দ্বারা পরস্পরে মহব্বত সৃষ্টি হয়। দুই মুমিনের মধ্যে মহব্বত সৃষ্টি অত্যন্ত জরুরি। এটা জান্নাত লাভের উপায়। জান্নাত লাভ করা মুমিনদের পরম লক্ষ্য।যে দাওয়াতগ্রহণ তা লাভের পক্ষে সহায়ক হয়, তা কবুল করতে কুণ্ঠাবোধ করা উচিত নয়। এ হাদীছে তো দাওয়ার কবুলকে মুমিন ব্যক্তির হক বলা হয়েছে। অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- إذا دعي أحدكم إلى الوليمة فليأتها 'কাউকে যদি ওলীমার দাওয়াত দেওয়া হয়, তবে সে যেন তাতে আসে।
নির্দোষ দাওয়াত কবুল না করাটা অপরাধ। এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- ومن دعي إلى وليمة فلم يجب فقد عصى الله ورسوله 'যে ব্যক্তিকে ওলীমায় দাওয়াত দেওয়া হয় আর সে তা কবুল না করে, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করল।
অবশ্য দাওয়াত কবুল করা জরুরি কেবল তখনই, যখন তাতে আপত্তিকর কিছু না থাকে। যদি তাতে আপত্তিকর কিছু থাকে অথবা দাওয়াতটাই কোনও অবৈধ উপলক্ষ্যে হয়, তখন তা কবুল করা জরুরি নয়।।
ইদানীংকার অধিকাংশ দাওয়াতই এমন, যাতে যাওয়ার পরিবেশ থাকে না। সুন্নত দাওয়াতকেও নানারকম পাপাচারে পঙ্কিল করে ফেলা হয়েছে। ওলীমার দাওয়াত সুন্নত। কিন্তু আজকাল অধিকাংশ ওলীমার অনুষ্ঠান সহীহ পন্থায় হয় না।তাতে গানবাদ্য থাকে, পর্দার পরিবর্তে থাকে পর্দাহীনতার প্রতিযোগিতা, নারী-পুরুষ একই জায়গায় বসে খাওয়া-দাওয়া করা হয়, থাকে উপহারের প্রদর্শনী ও উপহার লেনদেনের সামাজিক বাধ্যবাধকতা, এছাড়াও নানারকম অনুচিত উপসর্গ। দীনদার ব্যক্তির এ জাতীয় দাওয়াতে যাওয়ার কোনও উপায় থাকে না। তাদের বরং না যাওয়াই উচিত। হাঁ, যদি সেখানে গিয়ে আপত্তিকর বিষয়গুলো অপসারণ করতে পারবে বলে আত্মবিশ্বাস থাকে, তবে ভিন্ন কথা। আগেও এরকম শর্ত দেওয়া যেতে পারে যে, অনুষ্ঠানে আপত্তিকর কিছু করা চলবে না। তারপর যাওয়ার পর যদি দেখা যায় যথাযথভাবে কথা রাখা হয়নি, তবে কোনওকিছুর পরওয়া না করে ফিরে আসবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার ছবিযুক্ত পর্দা দেখে নিজ ঘরেই ঢোকা হতে বিরত থেকেছিলেন। একবার মেয়ে-জামাতা হযরত ফাতিমা রাযি. ও হযরত আলী রাযি.-এর বাড়ি থেকেও ফিরে এসেছিলেন। একবার হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাযি. এক দাওয়াতে গিয়ে দেখতে পান দেওয়ালে পর্দা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কেন অর্থের এ অপচয়, এ কারণে তিনি সেখান থেকে ফিরে আসেন। তাঁরা আমাদের আদর্শ। তাঁদের পথে চলাতেই সঠিক সমাজগঠন ও সমাজ সংস্কারে সফলতা নির্ভর করে।
সাম্প্রতিক দাওয়াতসমূহের আরও একটি বড় দোষ হচ্ছে গরীব-ধনীর ভেদাভেদ করা। অনেকেই গরীব আত্মীয় বা গরীব প্রতিবেশীকে অবজ্ঞা করে থাকে। তারা তাদের অনুষ্ঠানসমূহে অনাত্মীয় ধনী বন্ধু-বান্ধবকে তো দাওয়াত করে, কিন্তু গরীব আত্মীয় ও গরীব প্রতিবেশীর কথা মনে করে না। এ জাতীয় অনুষ্ঠান অতি নিকৃষ্ট। এর খানাদানায় বরকত থাকে না। এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ- بئس الطعام طعام الوليمة يدعى إليها الأغنياء ويترك الفقراء ‘অতি নিকৃষ্ট খাবার সে ওলীমার খাবার, যাতে ধনীদের দাওয়াত দেওয়া হয়, গরীবদের ত্যাগ করা হয়।
সমস্ত মুসলিম যখন ভাই-ভাই; বরং একদেহতুল্য, তখন গরীব-ধনী ভেদাভেদ করা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়। এ প্রভেদ একরকম বর্ণবাদ ও জাহিলিয়াত। আলোর ধর্ম ইসলামের অনুসারীদেরকে এরকম জাহিলী ভেদনীতি থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
কল্যাণকামিতা প্রদর্শন করা
এ হাদীছে আরেকটি হক বলা হয়েছে মানুষের প্রতি কল্যাণকামিতা। নবী-রাসূলগণ উম্মতের পক্ষে শ্রেষ্ঠতম কল্যাণকামী হতেন। তাই তাঁরা নিজেদেরকে ناصح (কল্যাণকামী) বলে পরিচয় দিতেন। যেমন হযরত হূদ আলাইহিস সালাম তাঁর কওমকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন- وانا لكم ناصح امين 'আমি তোমাদের এক বিশ্বস্ত কল্যাণকামী।
যারা মানুষের মধ্যে ওয়াজ ও নসীহত করে থাকে, তাদের অন্তরে কল্যাণকামিতার গুণ থাকা অতি জরুরি। অন্যথায় এ কাজটি নিজের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
মুসলিম ভাইয়ের প্রতি কল্যাণকামিতা প্রদর্শনকে এ হাদীছে তার একটি হক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য, যখন কোনও মুসলিম ভাই তার কাছে কল্যাণকামিতামূলক আচরণ আশা করে, তখন এদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া চাই। অন্যথায় এটা সবসময়কার কর্তব্য। যেমন আছেঃ- وينصح له إذا غاب أو شهد 'সে অনুপস্থিত থাকুক বা উপস্থিত, সর্বাবস্থায় তার প্রতি কল্যাণকামিতার আচরণ করবে।'
উপস্থিত অবস্থায় কল্যাণকামিতা হতে পারে এরকম যে, সে কোনও ক্ষতিকর কাজে লিপ্ত হলে সে ব্যাপারে তাকে সতর্ক করা, কোনও গুনাহে লিপ্ত হলে তা থেকে ফেরানোর চেষ্টা করা, বিপদে পড়লে তা থেকে উদ্ধারের চেষ্টা করা, অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, পানাহারের কষ্টে পড়লে তা লাঘবের চেষ্টা করা ইত্যাদি। এরকম যে-কোনও অবস্থায় নিজ ভাইয়ের ক্ষেত্রে যা-কিছু করা কর্তব্য বলে মনে হয়, যে-কোনও মুসলিমের সঙ্গেও সেরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করাই হচ্ছে কল্যাণকামিতার দাবি।
অনেক সময় চোখের সামনে কেউ এমন কোনও কাজ করে বসে, যাতে তার দীন দুনিয়া উভয়ের ক্ষতি, কিন্তু তা দেখেও না দেখার ভান করা হয়। ভাবটা এমন- তার কী হল না হল তাতে আমার কী আসে যায়? এমনকি চোখের সামনে একজন আরেকজনকে মারধর করলেও পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। আমার আপন কাউকে তো মারা হচ্ছে না। কাজেই কোনও দায়িত্বও নেই। পাশের ঘরের পুরুষটি তার স্ত্রীকে পেটাচ্ছে। নিয়মিতই পেটায়। জানা সত্ত্বেও কোনও যিম্মাদারী বোধ করা হয় না। এরকম হাজারও ঘটনা আছে, যাতে আমরা চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে থাকি। নিঃসন্দেহে এসব কল্যাণকামিতামূলক আচরণের পরিপন্থী।
এমনিভাবে মুসলিম ভাই যখন অনুপস্থিত থাকে, তখনও কল্যাণকামিতার ব্যাপারটা এসে যায়। উদাহরণত তার পেছনে যদি কেউ তার গীবত ও বদনাম করে, তখন কল্যাণকামিতার দাবি তাতে বাধা দেওয়া এবং তার ভালো গুণসমূহ আলোচনায় নিয়ে আসা। কেউ যদি কারও পেছনে তার জান-মালের পক্ষে ক্ষতিকর কোনও তৎপরতা চালায়, তবে সাধ্য অনুযায়ী তা প্রতিহত করার চেষ্টা করা। তার পদ বা পদমর্যাদার পক্ষে ক্ষতিকর কোনও তৎপরতা নজরে আসলে সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এসবই কল্যাণকামিতার দাবি।
নিকট বা দূরপ্রতিবেশীর ক্ষেত্রে এটা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবেশী বাড়িতে না থাকলে যাতে তার অর্থ-সম্পদ ও মান-সম্ভ্রমের ক্ষতি না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা একান্ত কর্তব্য। সে বাড়িতে না থাকায় ঘরের লোকজন যাতে কষ্টে না পড়ে সেদিকে লক্ষ রাখা চাই। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করা চাই। গৃহকর্তা বাড়ি নেই বলে তারা যেন অসহায়ত্ব বোধ না করে, সেরকম আচরণ তাদের প্রতি করতে হবে। গৃহকর্তাও দূরে থেকে যেন নিশ্চিন্ত থাকতে পারে যে, আমার সৎ প্রতিবেশী তো আছে, কোনও সমস্যা দেখা দিলে সে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।
প্রকাশ থাকে যে, কারও অনুপস্থিতিতে এসকল দায়িত্ব পালন করতে হবে অত্যন্ত সতর্কতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে, যাতে নিজ ইজ্জতের উপর আঘাত আসতে না পারে। প্রতিবেশীর অনুপস্থিতিতে তার বাড়িতে প্রবেশ বাঞ্ছনীয় নয়। খোঁজখবর রাখতে হবে বাড়িতে না ঢুকেই। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে সে বাড়ির মহিলাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা যাবে না, এমনকি ফোনেও কথা বলা সমীচীন নয়। কথা বলার প্রয়োজন সমাধা করা চাই শিশুদের মাধ্যমে কিংবা নিজ ঘরের মহিলাদের মাধ্যমে। সারকথা মুসলিম ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে কল্যাণকামিতামূলক যিম্মাদারীও পালন করতে হবে এবং নিজ মান-সম্ভ্রমও রক্ষা করতে হবে।
প্রচলিত ওয়াজ-নসীহতে কল্যাণকামিতা প্রসঙ্গ
প্রচলিত অর্থে ওয়াজ ও উপদেশকে যে নসীহত বলা হয় তাও মূলত এ কারণে যে, সত্যিকারের উপদেশ তাই, যা দরদ ও কল্যাণকামিতায় পূর্ণ অন্তর থেকে উৎসারিত হয়। যে উপদেশে কল্যাণকামিতার স্পর্শ নেই, প্রকৃত অর্থে তাকে নসীহত বলা যায় না। কাজেই যারা ওয়াজ-নসীহত করে থাকে, তাদের এ বিষয়ের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ রাখা দরকার। এটা মূলত আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের দাওয়াতের পদ্ধতি। তাই এর আছে আলাদা মহিমা। সতর্ক থাকা দরকার যাতে নিজ কর্মপন্থা দ্বারা সে মহিমা ক্ষুণ্ণ না হয়। এর উত্তম ব্যবস্থা হল কুরআন মাজীদের শিক্ষা দেওয়া মূলনীতি ও নবী-রাসূলগণের আদর্শ সামনে রেখে ওয়াজ-নসীহত করা। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ- ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ “তুমি নিজ প্রতিপালকের পথে মানুষকে ডাকবে হিকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে আর (যদি কখনও বিতর্কের দরকার পড়ে, তবে) তাদের সাথে বিতর্ক করবে উৎকৃষ্ট পন্থায়।
এ আয়াতে আল্লাহর পথে ডাকার পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এতে বর্ণিত মূলনীতি হল তিনটিঃ-
ক. হিকমত;
খ. সদুপদেশ ও
গ. উৎকৃষ্ট পন্থায় বিতর্ক।
হিকমতের মর্ম হল, সত্য-সঠিক বিষয়বস্তুকে অকাট্য দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে স্থান-কাল-পাত্রকে বিবেচনায় রেখে উপস্থাপন করা। সদুপদেশের অর্থ, যাকে দাওয়াত দেওয়া হবে তার ইজ্জত-সম্মানের প্রতি লক্ষ রেখে তার কল্যাণ কামনার্থে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় ও নম্রতার সাথে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা। আর উৎকৃষ্ট পন্থায় বিতর্ক করার অর্থ সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা ও প্রতিপক্ষকে তা বোঝানোর নিয়তে সত্যনিষ্ঠার সাথে ভদ্রোচিত ভাষায় যথোপযুক্ত যুক্তি-তর্ক ও দলীল-প্রমাণ পেশ করা, প্রতিপক্ষের মনে আঘাত লাগতে পারে বা জিদ সৃষ্টি হতে পারে এ জাতীয় আচরণ পরিহার করা এবং সর্বাবস্থায় মাত্রাবোধ ও ন্যায়-ইনসাফের পরিচয় দেওয়া।
ওয়াজ-নসীহতে ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের রীতিনীতি রক্ষা করাও জরুরি। লক্ষ রাখা দরকার যাতে কারও আবেগ-অনুভূতি আহত না হয় ও কারও আত্মসম্মানে আঘাত না লাগে। অন্যথায় উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইব্ন হাজার আসকালানী রহ.-এর বক্তব্য উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেনঃ-
“আদেশ-উপদেশ দেওয়ার উদ্দেশ্য যদি থাকে তার প্রতি কল্যাণকামনা আর সে লক্ষ্যেই তার অবস্থা (তার দোষত্রুটি) তুলে ধরা হয়, তবেই সে আদেশ-উপদেশ জায়েয। পক্ষান্তরে যদি উদ্দেশ্য হয় কেবলই তার নিন্দা করা, তার দোষ প্রকাশ করা ও তাকে কষ্ট দেওয়া, তবে তা জায়েয হবে না। কেননা শরীআতের পক্ষ থেকে আদেশ হচ্ছে অপরাধীর দোষ গোপন করা, তাকে শিক্ষাদান করা ও উত্তম পন্থায় তাকে নসীহত করা। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত নম্র-কোমলতার দ্বারা এটা সম্ভব, ততক্ষণ পর্যন্ত তার প্রতি কঠোর আচরণ ও নিন্দা-ধিক্কারের পন্থা অবলম্বন জায়েয নয়। কেননা তা অনেক সময় তাকে আরও বেশি অন্যায়-অপরাধের প্রতি উস্কানি দেওয়ার এবং তার আপন কাজে জেদী হয়ে ওঠার কারণ হয়। কিছু মানুষ স্বভাবগতভাবেই আত্মাভিমানী হয়ে থাকে, বিশেষত যাকে আদেশ-উপদেশ দেওয়া হয়, আদেশদাতা যদি মর্যাদায় তার তুলনায় নিচে হয় (তখন নিন্দা-তিরস্কারে তার আত্মাভিমান জেগে ওঠে, ফলে সে তার কৃত অন্যায়-অপরাধে আরও জেদী হয়ে ওঠে)।
আদেশ-উপদেশদাতার নিজ আমলেরও তদারকি করা উচিত। কেননা সে যদি মুত্তাকী-পরহেযগার হয় এবং তার আখলাক-চরিত্র উন্নত হয়, তখন তার মুখের কথা অপেক্ষা তার কর্ম ও চরিত্র দ্বারাই মানুষ আত্মসংশোধনে বেশি উৎসাহ পায় এবং তার বয়ান-বক্তব্য অপেক্ষা তার আমল-আখলাক দ্বারাই মানুষের উপকার বেশি হয়।
কল্যাণকামিতা প্রদর্শনের গুরুত্ব
যাহোক কল্যাণকামিতামূলক আচরণ দীনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, ঈমান, নামায ও যাকাতের মত এ বিষয়েও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের নিকট থেকে বাইআত গ্রহণ করতেন। যেমন হযরত জারীর রাযি. থেকে বর্ণিত আছেঃ- بايعت رسول اللہ ﷺ على إقام الصلاة وإيتاء الزكاة والنُصح لكل مسلم 'আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট বাইআত হলাম নামায কায়েম করা, যাকাত দেওয়া ও প্রত্যেক মুসলিমের প্রতি কল্যাণকামনার ব্যাপারে।
এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত জারীর রাযি.-কে বলেছিলেন, আমি তোমার বাইআত গ্রহণ করব না, যতক্ষণ না তুমি প্রত্যেক মুসলিমের প্রতি কল্যাণকামিতার আচরণ করবে বলে অঙ্গীকার কর। সুতরাং তিনি এ বিষয়টাও তাঁর বাইআতের অন্তর্ভুক্ত করলেন।
মুসলিম-সাধারণের প্রতি কল্যাণকামিতা যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা আরও একটি হাদীছ দ্বারা পরিস্ফুট হয়। তাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কল্যাণকামিতাকেই 'দীন' নামে অভিহিত করেছেন। হাদীছটি নিম্নরূপ— الدين النصيحة ثلاث مرار، قالوا: يا رسول الله لمن؟ قال: الله، وكتابه، ورسوله، وأئمة المسلمين وعامتهم‘দীন তো কল্যাণকামিতাই। তিনি এ কথা তিনবার বললেন। সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কার প্রতি? তিনি বললেন, আল্লাহর প্রতি, তাঁর কিতাবের প্রতি, তাঁর রাসূলের প্রতি, মুসলিম শাসকদের প্রতি এবং আমজনগণের প্রতি।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এসকল হাদীছের উপর আমল করার তাওফীক দান করুন, যাতে আমরা সর্বাবস্থায় মুসলিম-সাধারণের প্রতি কল্যাণকামী হয়ে থাকতে পারি এবং সকলের প্রতি কল্যাণকামিতার দাবি অনুযায়ী আচরণ করতে পারি – আমীন।
জানাযায় অংশগ্রহণ করা।
সমস্ত মুসলিম ভাই-ভাই। বরং সব মুসলিম মিলে একদেহতুল্য। কাজেই কোনও মুসলিমের মৃত্যু হওয়া যেন কারও দেহের একটি অঙ্গ ছিন্ন হওয়া। অঙ্গের ছিন্ন হওয়া যেমন প্রত্যেকের জন্য শোকের বিষয়, তেমনি কোনও মুসলিম ভাইয়ের মৃত্যুতেও শোক ও দুঃখ বোধ করা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের দাবি। সবচে' বড় কথা যার মৃত্যু হল সে এতদিন দুনিয়ায় আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মিলেমিশে ছিল। এখন সে একা হয়ে গেছে। কারও পক্ষে এখন তার পাশে দাঁড়ানো সম্ভবই নয়। তবে কি তাকে এভাবে নিঃসঙ্গ ছেড়ে দেওয়া হবে? তার জন্য কিছুই করার সুযোগ নেই? হাঁ, সুযোগ আছে। কারও শারীরিক বা আর্থিক সাহায্যই বড় সাহায্য নয়। এরচে'ও বড় সাহায্য হল দীনী ও ঈমানী সাহায্য। যে সাহায্য কবর ও হাশরে কাজে আসে, তার মত উপকার আর হয় না। মৃত্যু দ্বারা যে ব্যক্তি একা হয়ে গেল, এখন সে সাহায্যই তার প্রয়োজন। ইসলাম আমাদেরকে সেরকম সাহায্যের পথ দেখিয়েছে। এরকম সাহায্যের সর্বপ্রধান ব্যবস্থা জানাযার নামায়। এটা কবরযাত্রীর জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ। আল্লাহ যেন তাকে মাফ করে দেন সে দুআই জানাযায় নামাযে করা হয়ে থাকে। মুমিনগণ নামাযের রূপে তার জন্য এ দুআ করলে অবশ্যই তা কবুল হওয়ার আশা থাকে। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- ما من ميت تصلي عليه أمة من المسلمين يبلغون مائة، كلهم يشفعون له، إلا شفعوا فيه “একশ সংখ্যক মুসলিমের একটি দল যে মায়্যিতের জানাযার নামায আদায় করে এবং তারা তার জন্য সুপারিশ করে, তার জন্য তাদের সুপারিশ অবশ্যই কবুল হয়।
হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- ما من رجل مسلم يموت، فيقوم على جنازته أربعون رجلا، لا يشركون بالله شيئا، إلا شفعهم الله فيه “কোনও মুসলিম ব্যক্তি যদি মারা যায়, তারপর আল্লাহর সঙ্গে কোনওকিছুকে শরীক করে না এমন চল্লিশ জন লোক তার জানাযা পড়ে, তবে আল্লাহ তাআলা তার পক্ষে তাদের সুপারিশ অবশ্যই কবুল করেন।
জীবিতদের যে আমল দ্বারা মৃত ব্যক্তির এত বড় উপকার হয়, অত্যন্ত আগ্রহ উদ্দীপনার সঙ্গেই তাতে শরীক হওয়া চাই। এর ফযীলতও অনেক। যেমন হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- من شهد الجنازة حتى يصلي فله قيراط، ومن شهد حتى تدفن كان له قيراطان، قيل : وما القيراطان؟ قال: مثل الجبلين العظيمين “যে ব্যক্তি মায়্যিতের সাথে তার জানাযার নামায আদায় করা পর্যন্ত হাজির থাকে,সে এক কীরাত ছাওয়াব লাভ করে। আর যে ব্যক্তি তাকে দাফন করা পর্যন্ত হাজির থাকে, সে দুই কীরাত ছাওয়াব লাভ করে। জিজ্ঞেস করা হল, দুই কীরাত কী? তিনি বললেন, দুটি বড় বড় পাহাড়ের সমান।
রোগী দেখতে যাওয়া
عيادة المريض - রোগীর ইয়াদত করা। অর্থাৎ কারও অসুস্থতার সংবাদ শুনলে তাকে দেখতে যাওয়া ও তার খোঁজখবর নেওয়া। এটা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের দাবি। এর দ্বারা পারস্পরিক ঐক্য ও সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়। এটা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজও বটে। হযরত আলী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- ما من مسلم يعود مسلما غدوة إلا صلى عليه سبعون ألف ملك حتى يمسي، وإن عادة عشية إلا صلى عليه سبعون ألف ملك حتى يصبح، وكان له خريف في الجنة “যে-কোনও মুসলিম ব্যক্তি সকালবেলা কোনও অসুস্থ মুসলিমকে দেখতে গেলে সত্তর হাজার ফিরিশতা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য মাগফিরাতের দুআ করে। যদি সন্ধ্যাবেলা তাকে দেখতে যায় তবে সত্তর হাজার ফিরিশতা সকাল পর্যন্ত তার জন্য মাগফিরাতের দুআ করে এবং তার জন্য জান্নাতে একটি বাগান করা হয়।
হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- أيما رجل يعود مريضا، فإنما يخوض في الرحمة، فإذا قعد عند المريض غمرته الرحمة». قال: فقلت: يا رسول الله، هذا للصحيح الذي يعود المريض، فالمريض ما له؟ قال: تحط عنه ذنوبه “যে ব্যক্তি কোনও রোগী দেখতে যায় সে রহমতের ভেতর ডুব দিতে থাকে। যখন সে রোগীর কাছে গিয়ে বসে তখন রহমত তাকে নিমজ্জিত করে ফেলে। বর্ণনাকারী (হযরত আনাস রাযি.) বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা তো ওই সুস্থ ব্যক্তির জন্য, যে রোগী দেখতে যায়। তা অসুস্থ ব্যক্তি কী পাবে? তিনি বললেন, তার পাপরাশি মিটিয়ে দেওয়া হয়।
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- من عاد مريضا أو زار أخا له في الله ناداه مناد أن طبت وطاب ممشاك وتبوأت من الجنة منزلاً যে ব্যক্তি কোনও রোগী দেখতে যায় বা তার কোনও মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাত করতে যায়, তার উদ্দেশে এক ঘোষক ঘোষণা করে, তুমি শুভ হও, তোমার যাত্রা শুভ হোক এবং জান্নাতে তোমার ঠিকানা হোক।
হযরত ছাওবান রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- عائد المريض في مخرفة الجنة “যে ব্যক্তি রোগী দেখতে যায় সে জান্নাতের ফলের বাগানে (অথবা এর অর্থ, সে জান্নাতের পথে) থাকে।
সুবহানাল্লাহ, রোগী দেখতে যাওয়া এমন কিছু কঠিন কাজ নয়, অথচ এর ছাওয়াব ও পুরস্কার কত বিশাল! এক তো এর দ্বারা মুসলিম ভাইয়ের হক আদায় হয়, পরস্পরে মহব্বত সৃষ্টি হয় এবং সবচে' বড় কথা এ আমল জান্নাতে যাওয়ার পথ সুগম করে। এত বড় ফযীলতের কাজেও আমাদের কতইনা গাফলাতি! আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এ গাফলাতি ঝেড়ে ফেলে আমলে উদ্যোগী হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।
রোগী দেখার কয়েকটি দুআ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোগী দেখার বিভিন্ন দুআও শিক্ষা দিয়েছেন। যেমন, হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন আমর ইবনুল আস রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, কেউ যখন কোনও রোগী দেখতে যাবে তখন বলবেঃ- اللَّهُمَّ اشْفِ عَبْدَكَ ، يَنْكَأُ لَكَ عَدُوًّا ، وَيَمْشِي لَكَ إِلَى الصَّلاَةِ “হে আল্লাহ! তোমার বান্দাকে সুস্থ করে দাও, যাতে সে তোমার শত্রুর উপর আঘাত হানতে পারে এবং তোমার জন্য নামাযে যেতে পারে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কোনও ব্যক্তি রোগী দেখতে গিয়ে যদি সাতবার বলেঃ- أَسْأَلُ اللَّهَ الْعَظِيمَ رَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ أَنْ يَشْفِيَكَ (যিনি মহান আরশের মালিক সেই মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, যেন তিনি তোমাকে শিফা দান করেন), তবে আল্লাহ তাকে আরোগ্য দান করেন, যদি তার হায়াত থাকে।
হযরত ইব্ন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনও রোগী দেখতে গেলে বলতেনঃ- لا بأس، طهور إن شاء الله “এতে তোমার কোনও অনিষ্ট নেই। আল্লাহ চাহেন তো এটা পাপরাশি থেকে তোমার পবিত্রতার কারণ হবে।
উম্মুল মু'মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনও রোগী দেখতে গেলে বলতেন— «أَذْهِبِ الْبَاسَ رَبَّ النَّاسِ، اشْفِ أَنْتَ الشَّافِي، لَا شِفَاءَ إِلَّا شِفَاؤُكَ، شِفَاءً لَا يُغَادِرُ سَقَمًا» 'হে মানুষের প্রতিপালক! অসুস্থতা দূর করে দিন। আপনিই শেফাদাতা। আপনার দেওয়া শেফা ছাড়া কোনও শেফা নেই। আপনি এমন শেফা দান করুন, যা কোনও রোগ বাকি রাখবে না।
হাঁচিদাতাকে يرحمك الله বলা
হাদীছটিতে বর্ণিত মুসলিম ব্যক্তির পঞ্চম হক হল تشميت العاطس হাঁচিদাতাকে يرحمك الله বলা, অর্থাৎ আল্লাহ তোমার প্রতি রহমত বর্ষণ করুন। تشميت العاطس অর্থ কল্যাণ ও বরকতের দু'আ করা। শব্দটির উৎপত্তি شماتة থেকে। যার অর্থ অন্যের বিপদে আনন্দিত হওয়া।تشميت অর্থ সেই আনন্দ প্রতিহত করা। যার প্রতি আল্লাহর রহমত হয় তার বিপদও কেটে যায়। ফলে শত্রুর আনন্দ ঘুচে যায়। যেহেতু এ দু'আটি পরিণামে শত্রুর আনন্দ ঘুচিয়ে দেয় তাই একে تشميت নামে অভিহিত করা হয়েছে।
কারও মতে تشميت এর উৎপত্তি شواميت থেকে। شواميت অর্থ হাত-পা, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। সেই হিসেবে تشميت অর্থ স্থিত ও প্রতিষ্ঠিত রাখা। يرحمك الله বলার দ্বারা হাঁচিদাতার জন্য তাকে দীনের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার দু'আ করা হয়। তাই এ দু'আকে تشميت নাম দেওয়া হয়েছে।
হাঁচি দেওয়া একটি নিআমত। এর দ্বারা আলস্য কাটে ও শরীর ঝরঝরে হয়। ফলে কাজকর্মে স্ফুর্তি আসে। তখন ইবাদত-বন্দেগী করতে ভালো লাগে। তাই হাঁচিদাতার কর্তব্য হাঁচি দেওয়ার পর আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা। অর্থাৎ আলহামদুল্লিাহ বলা আলহামদুল্লিাহ শোকর আদায়ের ভাষা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে হাঁচির এ দু'আ শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি হাঁচির ব্যাপারে আমাদের জন্য এক পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা রেখে গেছেন। হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে তিনি ইরশাদ করেনঃ- إذا عطس أحدكم، فليقل: الحمد لله، فإذا قال: الحمد لله، قال له أخوه يرحمك الله، فإذا قيل له يرحمك الله : فليقل: يهديكم الله ويصلح بالكم 'তোমাদের কেউ হাঁচি দিলে সে যেন বলে الْحَمْدُ لِلَّهِ (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর)। সে যখন الْحَمْدُ لِلَّهِ বলবে তখন উপস্থিত ভাই যেন বলে يَرْحَمُكَ اللَّهُ (আল্লাহ তোমার প্রতি রহমত করুন)। তাকে লক্ষ্য করে يَرْحَمُكَ اللَّهُ বললে সে যেন বলে يَهْدِيكُمُ اللَّهُ وَيُصْلِحُ بَالَكُمْ (আল্লাহ তোমাদের হেদায়েত দান করুন এবং তোমাদের অবস্থা দুরস্ত করে দিন)।
হাঁচিদাতা আলহামদুল্লিাহ বললে তার জবাবে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা ওয়াজিব। অনেকেই এই ওয়াজিব পালনে অবহেলা করে। তা করা উচিত নয়। তাতে এক তো ওয়াজিব তরকের গুনাহ হয়। দ্বিতীয়ত, হাঁচিদাতাকেও হেলা করা হয়, বিশেষত সে যদি গরীব হয় বা তথাকথিত সামাজিক দৃষ্টিতে নিম্নস্তরের হয়। কোনও মুসলিম ব্যক্তিকে হেলা করা কঠিন অপরাধ। এ ব্যাপারে সতর্কতা জরুরি। সুতরাং হাঁচিদাতার উত্তরে ইয়ারহামুকাল্লাহ অবশ্যই বলতে হবে, সে যেই হোক না কেন। অবশ্য যদি বারবার হাঁচি দেয়, তিনবার বা তারও বেশি তবে সেটা সর্দির আলামত। সেক্ষেত্রে বারবার উত্তর দেওয়ার জরুরত নেই।
উপস্থিত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে যখন ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা হবে তখন আবার হাঁচিদাতার কাজ তাদের জন্য দুআ করা। তারা তার জন্য দুআ করে তার প্রতি যেই ইহসান করেছে তার বদলা দেওয়া তার কর্তব্য। উপকারীর উপকার করাও ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। কেউ কারও উপকার করলে সে উপকারের বদলা দেওয়া কর্তব্য। বৈষয়িক উপকারও উপকার বটে। তবে কারও জন্য দু'আ করা বা কারও দীনী কল্যাণ সাধন করা আরও বড় উপকার। কাজেই উপস্থিত ব্যক্তিগণ দু'আ দ্বারা হাঁচিদাতার যে বিরাট উপকার করল তার বিনিময়ে কিছু করা তো চাই। সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা হল সেও তাদের জন্য এই বলে দু'আ করবে- (আল্লাহ তোমাদের হেদায়েত দান করুন এবং তোমাদের অবস্থা দুরস্ত করে দিন)।
“এই যে হকসমূহের কথা উল্লেখ করা হল, এর সবগুলোই সকল মুসলিমের প্রাপ্য। এ ব্যাপারে কোনওরকম ভেদাভেদ ও বৈষম্য করার সুযোগ নেই। ইবনুল আরাবী রহ. বলেন, ইসলাম সকল মুসলিমকে সমান মর্যাদা দিয়েছে। সুতরাং এসব হকেও সকল মুসলিমের প্রতি সমান আচরণ জরুরি। তুমি কখনও এরকম ভাববে না যে, ইনি একজন শাসক, একজন প্রভাবশালী ও একজন বিত্তবান, আর সে একজন গরীব ও তুচ্ছলোক। তুমি কাউকেই তুচ্ছ গণ্য করবে না। তুমি মনে করবে ইসলাম যেন এক ব্যক্তি আর সমস্ত মুসলিম তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। কেননা মুসলিমসাধারণ ছাড়া ইসলামের অস্তিত্ব কোথায় পাবে? যেমন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও প্রকাশ্য-গুপ্ত শক্তি-ক্ষমতা ছাড়া কোনও ব্যক্তির অস্তিত্ব পেতে পার না।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা আমরা কর্তব্যবোধের শিক্ষা পাই। কোনও মুসলিম কেবল তার নিজের জন্য নয়; অন্যদের উপরও তার অনেক দায়-দায়িত্ব রয়েছে। প্রকৃত মুসলিম হওয়ার জন্য সেসব দায়িত্ব পালন করা অপরিহার্য।
খ. এক মুসলিমের প্রতি আরেক মুসলিমের একটি কর্তব্য সালাম দেওয়া। এটা তার হক, যা আদায় করা আবশ্যক।
গ. মুসলিম ব্যক্তির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ হক হচ্ছে তার প্রতি কল্যাণকামিতার আচরণ করা।
ঘ. রোগীর ইয়াদাত করা অর্থাৎ তার খোঁজখবর নেওয়াও ইসলামী হকসমূহের একটি এবং এটা অত্যন্ত ফযীলতের কাজ।
ঙ. জানাযায় অংশগ্রহণ করা একটি অবশ্যপালনীয় আমল এবং এটা মৃতব্যক্তি ও তার পরিবারবর্গের হক।
চ. দাওয়াত কবুল করা এবং অন্যের ডাকে সাড়া দেওয়াও একটি হক, যা রক্ষা করা অবশ্যকর্তব্য।
ছ. তাশমীত অর্থাৎ হাঁচিদাতার আলহামদুলিল্লাহ বলার জবাবে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা তার হক ও অবশ্যপ্রাপ্য।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
