কিতাবুস সুনান- ইমাম ইবনে মাজা রহঃ

৬. জানাযা-কাফন-দাফনের অধ্যায়

হাদীস নং: ১৪৬৫
আন্তর্জাতিক নং: ১৪৬৫
স্বামী স্ত্রীকে এবং স্ত্রী স্বামীকে গোসল দেওয়া প্রসঙ্গে
১৪৬৫। মুহাম্মাদ ইবন ইয়াহ্ইয়া (রাহঃ)... 'আয়েশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জান্নাতুল বাকী' থেকে ফিরে এসে আমাকে মাথা যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় পান। আর আমি বলছিলামঃ হে আমার মাথা! তিনি বললেনঃ হে 'আয়েশা! আমিও মাথা ব্যথায় ভুগছি, হে আমার মাথা! তারপর তিনি বললেনঃ তুমি যদি আমার পূর্বে ইন্তিকাল করতে, তাহলে তোমার কোন ক্ষতি হত না। কেননা, আমি তোমাকে গোসল করাতাম, কাফন পরাতাম, তোমার জানাযার সালাত আদায় করতাম এবং তোমাকে দাফন করতাম।
بَاب مَا جَاءَ فِي غَسْلِ الرَّجُلِ امْرَأَتَهُ وَغَسْلِ الْمَرْأَةِ زَوْجَهَا
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ يَحْيَى حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ حَنْبَلٍ حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ سَلَمَةَ عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ إِسْحَقَ عَنْ يَعْقُوبَ بْنِ عُتْبَةَ عَنْ الزُّهْرِيِّ عَنْ عُبَيْدِ اللهِ بْنِ عَبْدِ اللهِ عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ رَجَعَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم صلى الله عليه وسلم مِنْ الْبَقِيعِ فَوَجَدَنِي وَأَنَا أَجِدُ صُدَاعًا فِي رَأْسِي وَأَنَا أَقُولُ وَا رَأْسَاهُ فَقَالَ بَلْ أَنَا يَا عَائِشَةُ وَا رَأْسَاهُ ثُمَّ قَالَ مَا ضَرَّكِ لَوْ مِتِّ قَبْلِي فَقُمْتُ عَلَيْكِ فَغَسَّلْتُكِ وَكَفَّنْتُكِ وَصَلَّيْتُ عَلَيْكِ وَدَفَنْتُكِ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

কাসিম ইবন মুহাম্মাদ রহ. এ হাদীছটি তাঁর ফুফু উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. থেকে বর্ণনা করেছেন। কাসিম হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-এর নাতি। তাঁর পিতার নাম মুহাম্মাদ ইবন আবূ বকর। মুহাম্মাদ হিজরী ১০ম সনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হযরত আলী রাযি.-এর পক্ষ থেকে মিশরের গভর্নর ছিলেন। হিজরী ৩৮ সনে মিশরেই নিহত হন। তখন তাঁর পুত্র কাসিম একজন শিশু। ফুফু আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. তাঁকে লালন-পালন করেন। তিনি ফুফুর নিকট থেকে কুরআন-সুন্নাহর বিপুল জ্ঞান অর্জন করেন। আরও বহু সাহাবী থেকে তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন যুগের শ্রেষ্ঠ ফকীহ।

আলোচ্য হাদীছটি এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে। বিস্তারিত বর্ণনাটি এরূপ-
'হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বলেন, হায়রে আমার মাথা (অর্থাৎ মাথা ব্যথায় আমি মরে গেলাম)! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা শুনে বললেন, আমার জীবিত অবস্থায় যদি তা হয়, তবে তো আমি তোমার জন্য ইস্তিগফার ও দু’আ করব। আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. (রসিকতা করে) বললেন, আ মরণ! আল্লাহর কসম! আমার তো মনে হয় আমার মৃত্যুই আপনার পসন্দ! যদি তাই হয়, তবে দিনশেষে আপনি অন্য কোনও স্ত্রীর সঙ্গে রাত কাটাবেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বরং আমারই মাথাটা গেল। আমার তো ইচ্ছা হয়েছিল যে, আবূ বকর ও তার পুত্রকে ডেকে পাঠাব এবং (খেলাফতের) অসিয়ত করব, পাছে লোকে (কারও পক্ষে খেলাফতের) কথা বলে অথবা আকাঙ্ক্ষাকারীরা (খেলাফতের) আকাঙ্ক্ষা করে। তবে (এর প্রয়োজন নেই। কারণ) আল্লাহ তা প্রত্যাখ্যান করবেন এবং মুমিনগণ তা প্রতিরোধ করবে।'

কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তির জানাযা ও দাফন-কাফন শেষ করার পর আল-বাকী' কবরস্থান থেকে ঘরে ফিরে আসেন। তখন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-এর প্রচণ্ড মাথাব্যথা করছিল। তিনি وَا رَأْسَاه (মাথাটা গেল) বলে যন্ত্রণার কথা প্রকাশ করছিলেন। তিনি এভাবে কেন মাথাব্যথার কথা প্রকাশ করছেন, সেজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে নিষেধ বা তিরস্কার করেননি; উল্টো রসিকতা করেছেন যে, আমার আগে তুমি মারা গেলে তো ভালোই। কারণ তখন আমি তোমার জন্য আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার করব ও দু'আ করব। এমনকি তিনি নিজ মাথাব্যথার কথাও প্রকাশ করেছেন। এর দ্বারা বোঝা যায়, অসুখ-বিসুখের কষ্টে উহ্-আহ্ করা বা অন্য কোনও ভাষায় সে কষ্টের কথা ব্যক্ত করা দূষণীয় নয়। এটা মানুষের স্বভাব যে, মাথা ব্যথা হলে বলে- উহ্, মাথাটা গেল বা মাথাব্যথায় মরে গেলাম। এমনিভাবে যে-কোনও অঙ্গে কঠিন ব্যথা-বেদনা হলে স্বভাবগতভাবেই মুখ দিয়ে তা প্রকাশ হয়ে যায়। এটা শরী'আতবিরোধী নয়। শরী'আতবিরোধী হয় তখনই, যখন সে কষ্টের কারণে আল্লাহ সম্পর্কে বা তাকদীরের ফয়সালা সম্পর্কে অনুচিত কোনও কথা বলা হয়। এমনিভাবে ব্যথা-বেদনায় অস্থিরতার প্রকাশে যদি সীমালঙ্ঘন হয় বা নিজ অস্থিরতা দ্বারা অন্যকেও অস্থির করে ফেলা হয়, তবে তাও সমীচীন নয়।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্ভবত ওহী দ্বারা জানতে পেরেছিলেন যে, হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-এর এ মাথাব্যথা সাময়িক। এটা ভালো হয়ে যাবে। বরং তিনি নিজেই আগে ইন্তিকাল করবেন। তাই তিনি হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. -এর রসিকতায় হেসে দেন এবং বলে ওঠেন-
!بل أنا، وا رَأْساه (বরং আমি বলছি, হায়রে আমার মাথাব্যথা)! অর্থাৎ তুমি নিজ মাথাব্যথার কথা ছেড়ে দাও। তুমি আমার দিকে লক্ষ করো। আমারও প্রচণ্ড মাথাব্যথা। আর আমার এ মাথাব্যথা ভালো হওয়ার নয়। এটা আমার অন্তিম রোগের সূচনা। উল্লেখ্য, এর পরেই তাঁর জ্বর শুরু হয়ে যায়। তাঁর অসুস্থতা বাড়তেই থাকে। পরিশেষে এ অসুস্থতার ভেতরই তাঁর ইন্তিকাল হয়ে যায়।

হাদীছটির বিস্তারিত বর্ণনায় হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর খেলাফতের প্রতিও ইঙ্গিত আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সরাসরিভাবে তাঁকে খলীফা বানিয়ে যাননি বটে, কিন্তু এটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, আল্লাহ তা'আলার ফয়সালা সেটাই এবং মুমিনগণও আবু বকর সিদ্দীক রাযি. ছাড়া আর কাউকে খলীফা মানবে না। বাস্তবে তাই হয়েছিল।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

রোগ-ব্যাধিতে উহ-আহ্ করা ও কষ্টের কথা প্রকাশ করা দোষের নয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
সুনানে ইবনে মাজা - হাদীস নং ১৪৬৫ | মুসলিম বাংলা