কিতাবুস সুনান - ইমাম আবু দাউদ রহঃ
২. নামাযের অধ্যায়
হাদীস নং: ৭৯১
আন্তর্জাতিক নং: ৭৯০
১৩৪. নামায সংক্ষিপ্ত করা সম্পর্কে।
৭৯১. আহমদ ইবনে হাম্বল .... জাবের (রাযিঃ) বলেন, মুআয (রাযিঃ) মসজিদে নববীতে নবী (ﷺ)-এর সাথে নামায আদায়ের পর স্বীয় সম্প্রদায়ে প্রত্যাবর্তন করে আমাদের নামাযে ইমামতি করতেন। রাবী পুনরায় বলেন, নবী (ﷺ) এর সাথে নামায আদায়ের পর তিনি স্বীয় কওমের নিকট ফিরে এসে তাদের নামাযে ইমামতি করতেন। একদা রাতে-এশার নামায পড়তে নবী (ﷺ) বিলম্ব করেন। সেদিনও মুআয (রাযিঃ) নবী (ﷺ)-এর সাথে এশার নাময পড়ে ফিরে গিয়ে স্বীয় কওমের ইমামতি করেন এবং এই নামাযে তিনি সূরা আল-বাক্কারা তিলাওয়াত শুরু করেন। ঐ সময় এক ব্যক্তি জামাআত হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী নামায পড়ে। তাকে বলা হল, হে অমুক তুমি কি মুনাফিক হয়ে গেছ? জবাবে সে বলল, আমি মুনাফিক নই।
অতঃপর সেই ব্যক্তি নবী (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে বলে, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! মুআয (রাযিঃ) আপনার সাথে নামায পড়ার পর প্রত্যাবর্তন করে আমাদের নামাযের ইমামতি করেন। আমরা মেহনতী কৃষিজীবি লোক এবং নিজেরাই ক্ষেতের কাজকর্ম করে থাকি। অপরপক্ষে মুআয (রাযিঃ) আমাদের নামাযে ইমামতি করার সময় সূরা বাক্কারার ন্যায় দীর্ঘ সূরা পাঠ করে থাকেন। তখন নবী (ﷺ) মুআয (রাযিঃ)-কে সম্বোধন করে বলেনঃ হে মুআয! তুমি কি লোকদেরকে ফিতনার মধ্যে নিক্ষেপ করতে চাও (দুইবার)? তিনি আরো বলেনঃ তুমি নামাযে অমুক অমুক সূরা পাঠ কর। আবুয-যুবারের বলেন, সূরা আল-আ'লার ন্যায় ছোট ছোট সূরা পাঠ করবে।
অতঃপর সেই ব্যক্তি নবী (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে বলে, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! মুআয (রাযিঃ) আপনার সাথে নামায পড়ার পর প্রত্যাবর্তন করে আমাদের নামাযের ইমামতি করেন। আমরা মেহনতী কৃষিজীবি লোক এবং নিজেরাই ক্ষেতের কাজকর্ম করে থাকি। অপরপক্ষে মুআয (রাযিঃ) আমাদের নামাযে ইমামতি করার সময় সূরা বাক্কারার ন্যায় দীর্ঘ সূরা পাঠ করে থাকেন। তখন নবী (ﷺ) মুআয (রাযিঃ)-কে সম্বোধন করে বলেনঃ হে মুআয! তুমি কি লোকদেরকে ফিতনার মধ্যে নিক্ষেপ করতে চাও (দুইবার)? তিনি আরো বলেনঃ তুমি নামাযে অমুক অমুক সূরা পাঠ কর। আবুয-যুবারের বলেন, সূরা আল-আ'লার ন্যায় ছোট ছোট সূরা পাঠ করবে।
باب فِي تَخْفِيفِ الصَّلاَةِ
حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ حَنْبَلٍ، حَدَّثَنَا سُفْيَانُ، عَنْ عَمْرٍو، سَمِعَهُ مِنْ، جَابِرٍ قَالَ كَانَ مُعَاذٌ يُصَلِّي مَعَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم ثُمَّ يَرْجِعُ فَيَؤُمُّنَا - قَالَ مَرَّةً ثُمَّ يَرْجِعُ فَيُصَلِّي بِقَوْمِهِ - فَأَخَّرَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم لَيْلَةً الصَّلاَةَ - وَقَالَ مَرَّةً الْعِشَاءَ - فَصَلَّى مُعَاذٌ مَعَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم ثُمَّ جَاءَ يَؤُمُّ قَوْمَهُ فَقَرَأَ الْبَقَرَةَ فَاعْتَزَلَ رَجُلٌ مِنَ الْقَوْمِ فَصَلَّى فَقِيلَ نَافَقْتَ يَا فُلاَنُ . فَقَالَ مَا نَافَقْتُ . فَأَتَى رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ إِنَّ مُعَاذًا يُصَلِّي مَعَكَ ثُمَّ يَرْجِعُ فَيَؤُمُّنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَإِنَّمَا نَحْنُ أَصْحَابُ نَوَاضِحَ وَنَعْمَلُ بِأَيْدِينَا وَإِنَّهُ جَاءَ يَؤُمُّنَا فَقَرَأَ بِسُورَةِ الْبَقَرَةِ . فَقَالَ " يَا مُعَاذُ أَفَتَّانٌ أَنْتَ أَفَتَّانٌ أَنْتَ اقْرَأْ بِكَذَا اقْرَأْ بِكَذَا " . قَالَ أَبُو الزُّبَيْرِ بِـ ( سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الأَعْلَى ) ( وَاللَّيْلِ إِذَا يَغْشَى ) فَذَكَرْنَا لِعَمْرٍو فَقَالَ أُرَاهُ قَدْ ذَكَرَهُ .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
লক্ষণীয় হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসল্লীর অভিযোগের কারণে কিন্তু হযরত মুআয রাযি.-কে মুস্তাহাব কিরাআত পরিত্যাগ করতে বলেননি; বরং তাঁকে মুস্তাহাব কিরাআতের মধ্যেই থাকার হুকুম করেছিলেন। তিনি তাঁকে যে তিরস্কার করেছিলেন তা নিজ কিরাআত মুস্তাহাবের সীমা ছাড়িয়ে আরও বেশি লম্বা করার কারণে। সুতরাং মুসল্লীদের অভিযোগের কারণে কিছুতেই সুন্নত-মুস্তাহাব ছেড়ে দেওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে কেউ অভিযোগ করলে তার কারণ কেবলই তার গাফলাতী এবং সুন্নত-মুস্তাহাবের উপর আমলে অনাগ্রহ।
তারাবীর নামাযে এ গাফলাতী ও অনাগ্রহ অনেক বেশি লক্ষ করা যায়। অনেক জায়গায় এ গাফলাতীর কারণে তারাবীতে কুরআন মাজীদ খতম করা হয় না। আবার বহু জায়গায় খতম করা হয় বটে, কিন্তু খুবই তাড়াহুড়া করে পড়া হয়। হাফেজ সাহেব কী যে পড়েন তা বোঝার কোনও উপায় থাকে না। এ গাফলাতী অবশ্যই পরিত্যাগ করা উচিত। রমযান মাস কুরআনের মাস। পবিত্র এ মাসে তারাবীতে কুরআন খতমের ফযীলত ও বরকতলাভ থেকে কিছুতেই বঞ্চিত থাকা উচিত নয়। কুরআনের তিলাওয়াত ও শ্রবণ উভয়টাই আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় নি'আমত। এ নি'আমত অত্যন্ত মহব্বতের সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত। তাই তিলাওয়াতে তাড়াহুড়া বাঞ্ছনীয় নয় এবং শ্রবণেও ব্যস্ততা কাঙ্ক্ষিত নয়।
নফল নামায দীর্ঘ করা
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছের শেষে ইরশাদ করেছেনঃ- وإذا صلى أحدكم لنفسه فليطول ما شاء (আর তোমাদের মধ্যে কেউ যখন একা নামায় পড়ে, সে যতটা ইচ্ছা দীর্ঘ করুক)।একা নামায পড়ার অর্থ ফরয নামায জামাত ছেড়ে একাকী পড়া নয়। ফরয নামায জামাতেই পড়া চাই। এটাই মুমিন-মুত্তাকীর নামায। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জমানায় জামাত ছাড়ত কেবল প্রকাশ্য মুনাফিকরা। তাদের মত কাজ করা আমাদের কিছুতেই উচিত নয়। আল্লাহ তা'আলা আমাদের হেফাজত করুন।
একা নামায পড়া বলতে মূলত সুন্নত ও নফল নামায বোঝানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আগ্রহ-উদ্দীপনার সঙ্গে নামায যতটা দীর্ঘ করা যায় ততই ভালো। নফল নামায সম্পর্কে একটি হাদীছে কুদসীতে ইরশাদ হয়েছেঃ- وما يزال عبدي يتقرب إلي بالنوافل حتى أحبه، فإذا أحببته كنت سمعه الذي يسمع به وبصره الذي يبصر به ويده التي يبطش بها ورجله التي يمشي بها ‘আমার বান্দা নফলসমূহের দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে। একপর্যায়ে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি। আর আমি যখন তাকে ভালোবেসে ফেলি তখন হয়ে যাই তার কান, যা দ্বারা সে শোনে; তার চোখ, যা দ্বারা সে দেখে; তার হাত, যা দ্বারা সে ধরে এবং তার পা, যা দ্বারা সে চলে।
তো বান্দার যে নামায আল্লাহর এত প্রিয় এবং যে নামাযের কারণে বান্দা আল্লাহর মাহবুব ও প্রিয় হয়ে যায়, সে নামায কতইনা ইশক ও মহব্বতের সঙ্গে পড়া উচিত। নামাযে ইশক ও মহব্বত এবং যত্ন ও উৎসাহ থাকলে নামায আপনিই দীর্ঘ হয়ে যায়। এরকম নামায আশেক বান্দার জন্য হয় নয়নপ্রীতিকর। সে তা যত দীর্ঘ করে ততই প্রাণ জুড়ায়। সে সহজে তা শেষ করতে চায় না। নামাযের বিপরীতে তার কাছে শারীরিক কষ্ট তুচ্ছ হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত আনসারী সাহাবী হযরত আব্বাদ ইব্ন বিশর রাযি.-এর ঘটনা উল্লেখ করার মত।
হযরত আব্বাদ ইবনে বিশর্ রাযি.-এর ঘটনা
হি. ৪র্থ বছর যাতুর রিকা'র যুদ্ধাভিযান থেকে ফেরার সময় তাঁর ঘটনাটি ঘটেছিল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক গিরিপথে হযরত আম্মার ইব্ন ইয়াসির রাযি. ও আব্বাদ ইব্ন বিশর রাযি.-কে পাহারায় নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁরা দু'জন সিদ্ধান্ত নেন যে, রাতের প্রথম অংশে হযরত আব্বাদ ইবন বিশর রাযি জেগে থাকবেন এবং শেষ অংশে আম্মার ইব্ন ইয়াসির রাযি.। সেমতে হযরত আব্বাদ ইবন বিশর রাযি. রাতের প্রথম অংশে জাগ্রত থাকেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, শুধু শুধু জেগে সময় পার করবেন? তারচে' সময়টা নামাযে কাটুক। তাতে নামাযও হবে, আবার পাহারার কাজও হয়ে যাবে। সুতরাং তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি নামাযে কুরআন তিলাওয়াতে রত হয়ে গেলেন। লম্বা কিরাআত পড়তে থাকলেন। এ অবস্থায় তাঁর প্রতি এক কাফেরের দৃষ্টি পড়ল। সে তাঁকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ল, যা তাঁর গায়ে বিদ্ধ হয়ে গেল। তিনি নামায ছাড়লেন না। নামায অবস্থায়ই সেটি টেনে বের করে ফেললেন। শত্রু আবারও তাঁকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ল। এভাবে তিনবার। শেষটায় তিনি তাড়াতাড়ি সালাম ফেরালেন এবং সঙ্গীকে জাগালেন। সঙ্গী প্রথমে বিষয়টা বুঝে উঠতে পারেননি। পরে তাঁকে রক্তাক্ত দেখে বিচলিত হয়ে উঠলেন এবং বললেন, সুবহানাল্লাহ, ভাই তুমি আগে আমাকে কেন জাগালে না? তিনি বললেন, আমি একটি সূরা পড়ছিলাম, সেটি শেষ না করে ক্ষান্ত হতে আমার মন মানছিল না। কিন্তু সে যখন একের পর এক তীর মেরে যাচ্ছিল, তখন আমি রুকূতে চলে গেলাম, তারপর তোমাকে জাগালাম। আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে পাহারাদারীর দায়িত্বে আমাকে নিযুক্ত করেছেন তা ভণ্ডুল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা যদি না থাকত, তবে সে আমাকে হত্যা করে ফেললেও আমি নামায সংক্ষেপ করতাম না।
এ হচ্ছে ইশক ও মহব্বতের নামায। সাহাবায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে দীনের এ জাতীয় নামায আদায়ের বহু ঘটনা আছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও দীর্ঘ সময় লাগিয়ে নফল নামায পড়তেন। হাদীছে বর্ণিত আছেঃ- قام النبي ﷺ حتى تورمت قدماه، فقيل له: غفر الله لك ما تقدم من ذنبك وما تأخر، قال: أفلا أكون عبدا شكورا؟ 'নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযে দাঁড়ালেন দীর্ঘক্ষণ। ফলে তাঁর পা দুটি ফুলে গেল। তাঁকে বলা হল, আপনার আগের পরের সব ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করা হয়েছে (তারপরও কেন এত কষ্ট করা)? তিনি বললেন, আমি কি একজন শোকরগুযার বান্দা হব না?
কিন্তু আমাদের অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। জামাতে নামায আদায়কালে তো বাধ্য হয়েই ইমাম সাহেব যতক্ষণ সালাম না ফেরান ততক্ষণ নামাযে থাকা হয়, কিন্তু যখন একা নামায পড়ি তখন তাড়াহুড়া করে শেষ করে ফেলা হয়। যেন শেষ করার জন্য কেউ তাড়া দিচ্ছে। যে নামায দ্বারা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ হয় এবং তাঁর মাহবূব বান্দায় পরিণত হওয়া যায়, তাতে এতটা তাড়াহুড়া উচিত কি? আল্লাহ তা'আলা আমাদের অন্তরে নামাযের প্রতি আগ্রহ ও মহব্বত সৃষ্টি করে দিন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা উম্মতের প্রতি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গভীর দয়ামায়ার পরিচয় পাওয়া যায়।
খ. এ হাদীছ দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায় যে, নামাযে ইমামের কর্তব্য সুন্নতের সীমার মধ্যেই থাকা, এর বেশি লম্বা না করা।
গ. সুন্নত ও নফল নামায নিজ আগ্রহ-উদ্দীপনা অনুযায়ী দীর্ঘ করা পছন্দনীয়।
ঘ. ইসলামে দুর্বল, বৃদ্ধ ও পীড়িতের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকার কী গুরুত্ব, এ হাদীছ দ্বারা তা অনুমান করা যায়। নামাযের মত সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত আদায়েও তাদের প্রতি লক্ষ রাখার তাগিদ করা হয়েছে। কাজেই অন্যসকল ক্ষেত্রে তাদের প্রতি যে আরও বেশি সময় থাকতে হবে এটাই তো স্বাভাবিক।
তারাবীর নামাযে এ গাফলাতী ও অনাগ্রহ অনেক বেশি লক্ষ করা যায়। অনেক জায়গায় এ গাফলাতীর কারণে তারাবীতে কুরআন মাজীদ খতম করা হয় না। আবার বহু জায়গায় খতম করা হয় বটে, কিন্তু খুবই তাড়াহুড়া করে পড়া হয়। হাফেজ সাহেব কী যে পড়েন তা বোঝার কোনও উপায় থাকে না। এ গাফলাতী অবশ্যই পরিত্যাগ করা উচিত। রমযান মাস কুরআনের মাস। পবিত্র এ মাসে তারাবীতে কুরআন খতমের ফযীলত ও বরকতলাভ থেকে কিছুতেই বঞ্চিত থাকা উচিত নয়। কুরআনের তিলাওয়াত ও শ্রবণ উভয়টাই আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় নি'আমত। এ নি'আমত অত্যন্ত মহব্বতের সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত। তাই তিলাওয়াতে তাড়াহুড়া বাঞ্ছনীয় নয় এবং শ্রবণেও ব্যস্ততা কাঙ্ক্ষিত নয়।
নফল নামায দীর্ঘ করা
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছের শেষে ইরশাদ করেছেনঃ- وإذا صلى أحدكم لنفسه فليطول ما شاء (আর তোমাদের মধ্যে কেউ যখন একা নামায় পড়ে, সে যতটা ইচ্ছা দীর্ঘ করুক)।একা নামায পড়ার অর্থ ফরয নামায জামাত ছেড়ে একাকী পড়া নয়। ফরয নামায জামাতেই পড়া চাই। এটাই মুমিন-মুত্তাকীর নামায। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জমানায় জামাত ছাড়ত কেবল প্রকাশ্য মুনাফিকরা। তাদের মত কাজ করা আমাদের কিছুতেই উচিত নয়। আল্লাহ তা'আলা আমাদের হেফাজত করুন।
একা নামায পড়া বলতে মূলত সুন্নত ও নফল নামায বোঝানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আগ্রহ-উদ্দীপনার সঙ্গে নামায যতটা দীর্ঘ করা যায় ততই ভালো। নফল নামায সম্পর্কে একটি হাদীছে কুদসীতে ইরশাদ হয়েছেঃ- وما يزال عبدي يتقرب إلي بالنوافل حتى أحبه، فإذا أحببته كنت سمعه الذي يسمع به وبصره الذي يبصر به ويده التي يبطش بها ورجله التي يمشي بها ‘আমার বান্দা নফলসমূহের দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে। একপর্যায়ে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি। আর আমি যখন তাকে ভালোবেসে ফেলি তখন হয়ে যাই তার কান, যা দ্বারা সে শোনে; তার চোখ, যা দ্বারা সে দেখে; তার হাত, যা দ্বারা সে ধরে এবং তার পা, যা দ্বারা সে চলে।
তো বান্দার যে নামায আল্লাহর এত প্রিয় এবং যে নামাযের কারণে বান্দা আল্লাহর মাহবুব ও প্রিয় হয়ে যায়, সে নামায কতইনা ইশক ও মহব্বতের সঙ্গে পড়া উচিত। নামাযে ইশক ও মহব্বত এবং যত্ন ও উৎসাহ থাকলে নামায আপনিই দীর্ঘ হয়ে যায়। এরকম নামায আশেক বান্দার জন্য হয় নয়নপ্রীতিকর। সে তা যত দীর্ঘ করে ততই প্রাণ জুড়ায়। সে সহজে তা শেষ করতে চায় না। নামাযের বিপরীতে তার কাছে শারীরিক কষ্ট তুচ্ছ হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত আনসারী সাহাবী হযরত আব্বাদ ইব্ন বিশর রাযি.-এর ঘটনা উল্লেখ করার মত।
হযরত আব্বাদ ইবনে বিশর্ রাযি.-এর ঘটনা
হি. ৪র্থ বছর যাতুর রিকা'র যুদ্ধাভিযান থেকে ফেরার সময় তাঁর ঘটনাটি ঘটেছিল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক গিরিপথে হযরত আম্মার ইব্ন ইয়াসির রাযি. ও আব্বাদ ইব্ন বিশর রাযি.-কে পাহারায় নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁরা দু'জন সিদ্ধান্ত নেন যে, রাতের প্রথম অংশে হযরত আব্বাদ ইবন বিশর রাযি জেগে থাকবেন এবং শেষ অংশে আম্মার ইব্ন ইয়াসির রাযি.। সেমতে হযরত আব্বাদ ইবন বিশর রাযি. রাতের প্রথম অংশে জাগ্রত থাকেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, শুধু শুধু জেগে সময় পার করবেন? তারচে' সময়টা নামাযে কাটুক। তাতে নামাযও হবে, আবার পাহারার কাজও হয়ে যাবে। সুতরাং তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি নামাযে কুরআন তিলাওয়াতে রত হয়ে গেলেন। লম্বা কিরাআত পড়তে থাকলেন। এ অবস্থায় তাঁর প্রতি এক কাফেরের দৃষ্টি পড়ল। সে তাঁকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ল, যা তাঁর গায়ে বিদ্ধ হয়ে গেল। তিনি নামায ছাড়লেন না। নামায অবস্থায়ই সেটি টেনে বের করে ফেললেন। শত্রু আবারও তাঁকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ল। এভাবে তিনবার। শেষটায় তিনি তাড়াতাড়ি সালাম ফেরালেন এবং সঙ্গীকে জাগালেন। সঙ্গী প্রথমে বিষয়টা বুঝে উঠতে পারেননি। পরে তাঁকে রক্তাক্ত দেখে বিচলিত হয়ে উঠলেন এবং বললেন, সুবহানাল্লাহ, ভাই তুমি আগে আমাকে কেন জাগালে না? তিনি বললেন, আমি একটি সূরা পড়ছিলাম, সেটি শেষ না করে ক্ষান্ত হতে আমার মন মানছিল না। কিন্তু সে যখন একের পর এক তীর মেরে যাচ্ছিল, তখন আমি রুকূতে চলে গেলাম, তারপর তোমাকে জাগালাম। আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে পাহারাদারীর দায়িত্বে আমাকে নিযুক্ত করেছেন তা ভণ্ডুল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা যদি না থাকত, তবে সে আমাকে হত্যা করে ফেললেও আমি নামায সংক্ষেপ করতাম না।
এ হচ্ছে ইশক ও মহব্বতের নামায। সাহাবায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে দীনের এ জাতীয় নামায আদায়ের বহু ঘটনা আছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও দীর্ঘ সময় লাগিয়ে নফল নামায পড়তেন। হাদীছে বর্ণিত আছেঃ- قام النبي ﷺ حتى تورمت قدماه، فقيل له: غفر الله لك ما تقدم من ذنبك وما تأخر، قال: أفلا أكون عبدا شكورا؟ 'নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযে দাঁড়ালেন দীর্ঘক্ষণ। ফলে তাঁর পা দুটি ফুলে গেল। তাঁকে বলা হল, আপনার আগের পরের সব ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করা হয়েছে (তারপরও কেন এত কষ্ট করা)? তিনি বললেন, আমি কি একজন শোকরগুযার বান্দা হব না?
কিন্তু আমাদের অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। জামাতে নামায আদায়কালে তো বাধ্য হয়েই ইমাম সাহেব যতক্ষণ সালাম না ফেরান ততক্ষণ নামাযে থাকা হয়, কিন্তু যখন একা নামায পড়ি তখন তাড়াহুড়া করে শেষ করে ফেলা হয়। যেন শেষ করার জন্য কেউ তাড়া দিচ্ছে। যে নামায দ্বারা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ হয় এবং তাঁর মাহবূব বান্দায় পরিণত হওয়া যায়, তাতে এতটা তাড়াহুড়া উচিত কি? আল্লাহ তা'আলা আমাদের অন্তরে নামাযের প্রতি আগ্রহ ও মহব্বত সৃষ্টি করে দিন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা উম্মতের প্রতি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গভীর দয়ামায়ার পরিচয় পাওয়া যায়।
খ. এ হাদীছ দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায় যে, নামাযে ইমামের কর্তব্য সুন্নতের সীমার মধ্যেই থাকা, এর বেশি লম্বা না করা।
গ. সুন্নত ও নফল নামায নিজ আগ্রহ-উদ্দীপনা অনুযায়ী দীর্ঘ করা পছন্দনীয়।
ঘ. ইসলামে দুর্বল, বৃদ্ধ ও পীড়িতের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকার কী গুরুত্ব, এ হাদীছ দ্বারা তা অনুমান করা যায়। নামাযের মত সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত আদায়েও তাদের প্রতি লক্ষ রাখার তাগিদ করা হয়েছে। কাজেই অন্যসকল ক্ষেত্রে তাদের প্রতি যে আরও বেশি সময় থাকতে হবে এটাই তো স্বাভাবিক।
