রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৬৫২
শাসকবর্গকে জনগণের প্রতি নম্রতা দেখানো, তাদের প্রতি কল্যাণকামিতা ও মমত্ব প্রদর্শনের হুকুম এবং তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, কঠোরতা আরোপ, তাদের কল্যাণকর বিষয়সমূহ উপেক্ষা করা, তাদের প্রতি অমনোযোগিতা ও তাদের প্রয়োজন পূরণে অবহেলা প্রদর্শনের উপর নিষেধাজ্ঞা
ইসলামী শাসনের মূল উদ্দেশ্য জনগণের দীনী ও দুনিয়াবী তত্ত্বাবধান ও কল্যাণসাধন। কাজেই শাসকশ্রেণির কর্তব্য ইসলামের রক্ষণাবেক্ষণ করা, মানুষের মধ্যে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং তাদের মধ্যে ইসলামের বিধানাবলি প্রতিষ্ঠা করা। এটা তাদের কর্তব্যের দীনী দিক। এর দুনিয়াবী দিক হল রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। মানুষের মধ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করা। সামাজিক অন্যায়-অবিচার দূর করে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা। জনজীবনের প্রতিটি দিক সুচারুরূপে পরিচালনার উদ্দেশ্যে সুযোগ্য লোকদের নিয়োগদান করা ও তাদের তত্ত্বাবধান করা। মানুষের মৌলিক চাহিদাসমূহ পূরণের ব্যবস্থা করা। ইসলামী নীতি অনুযায়ী অর্থ-সম্পদের উন্নয়ন ও সুষম বণ্টন করা ইত্যাদি। বলাবাহুল্য, দুনিয়াবী এ দিকসমূহও মৌলিকভাবে দীনেরই অন্তর্ভুক্ত। কেননা ইসলাম এক পরিপূর্ণ দীন এবং এসব দিক সম্পর্কে ইসলামের রয়েছে সুস্পষ্ট বিধান ও পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা। কাজেই এসব দায়িত্বও যথাযথভাবে পালন করার জন্য শাসকশ্রেণির দীনী চেতনা ও বিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাস লালন করা জরুরি। যে শাসকের অন্তরে আখিরাতের জবাবদিহিতার ভয় থাকে, তার পক্ষেই এসব দায়িত্ব ও কর্তব্য সুচারুরূপে পালন করা সম্ভব হয়। তখন তার দ্বারা রাষ্ট্রীয় কাজে কোনওরকম অবহেলা হয় না। সে জনগণের শোষক না হয়ে একজন সত্যিকারের কল্যাণকামী হয়। তাদের জন্য যা-কিছু কল্যাণকর তা আঞ্জাম দেওয়ার জন্য সে সর্বদা সজাগ ও তৎপর থাকে। সে হয় তাদের প্রতি সহমর্মী ও দরদী বন্ধু। তার যাবতীয় কাজ হয় মমত্বপূর্ণ। কখনও অহেতুক কঠোরতা প্রদর্শন করে না। তা করা কখনও সমীচীনও নয়। কেননা তাতে রাষ্ট্রীয় শাসন ও নেতৃত্বের মুখ্য উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। এ কারণেই কুরআন ও হাদীছ শাসকশ্রেণিকে জনগণের প্রতি মমতাবান ও কল্যাণকামী থাকার প্রতি বিশেষ উৎসাহদান করেছে। সতর্ক করেছে যেন কোনওভাবেই তাদের প্রতি কঠোর আচরণ করা না হয়, তাদের প্রতি দায়িত্বপালনে অবহেলা প্রদর্শন এবং তাদের প্রতি জুলুম-অবিচারকে কিছুতেই প্রশ্রয় দেওয়া না হয়। আলোচ্য অধ্যায়ের আয়াত ও হাদীছসমূহ সে সম্পর্কেই।
‘শাসকবর্গকে জনগণের প্রতি নম্রতা দেখানো…’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ
অর্থ: আর যে মুমিনগণ তোমার অনুসরণ করে, তাদের সঙ্গে বিনয়-নম্র আচরণ করো।(সূরা শু'আরা (২৬), আয়াত ২১৫)
ব্যাখ্যা
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ এর মূল অর্থ- তোমার ডানা নামিয়ে দাও। 'ডানা নামানো' দ্বারা মমত্বপূর্ণ আচরণ বোঝানো হয়। পাখি যখন তার ছানাদেরকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নেয়, তখন প্রথমে ডানা বিস্তার করে দেয়, তারপর ছানারা যখন তার শরীরের সঙ্গে এসে মিশে যায়, তখন তাদের উপর তা নামিয়ে দেয়। এটা ছানাদের প্রতি তার মমত্বের আচরণ। নিজ অনুসারী ও অধীন ব্যক্তিবর্গকে অনুরূপ কাছে নিয়ে আসা ও তাদের প্রতি মমত্বের আচরণ করাকে পাখির এ আচরণের সঙ্গে উপমিত করা হয়েছে এবং সে হিসেবেই পাখির জন্য ব্যবহৃত শব্দমালাকে এস্থলে ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং 'মুমিনদের প্রতি ডানা নামিয়ে দাও'-এর অর্থ হবে- যারা তোমার প্রতি ঈমান এনেছে, তুমি তাদের প্রতি মমত্বের আচরণ করো, যাতে তারা তোমার কাছে কাছে থাকে, দূরে সরে না যায়।
সরাসরি এ আদেশটি করা হয়েছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে, যাতে তিনি মুমিন-মুসলিমদের প্রতি নম্রকোমল আচরণ বজায় রাখেন। তিনি যেমন নবী ছিলেন, তেমনি ছিলেন ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধানও। সুতরাং নবী হিসেবে উম্মতের প্রতি মমত্বপূর্ণ আচরণ করা যেমন এ আয়াতের আদেশের অন্তর্ভুক্ত, তেমনি শাসক হিসেবে জনগণের প্রতি মমত্বের আচরণ করাও এর অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতপক্ষে তিনি এই চরিত্রেরই ছিলেন। তারপরও তাঁকে এ আদেশদান দ্বারা মূলত প্রত্যেক অভিভাবক বিশেষত পরবর্তীকালের শাসকশ্রেণিকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, তারা যেন জনগণের প্রতি মমত্বপূর্ণ আচরণ করে।
উল্লেখ্য, এ আয়াতটি ৭ম খণ্ডের ৭১ নং অধ্যায়ের ১নং আয়াতরূপে গত হয়েছে। সেখানে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. প্রত্যেক অভিভাবক ও শাসকের কর্তব্য অধীন ও জনগণের সঙ্গে বিনয়-নম্র। মমত্বপূর্ণ আচরণ করা।
খ. আয়াতটির শব্দসমূহের প্রতি লক্ষ করলে জানা যায় যে, কুরআন মাজীদের কোনও কোনও শব্দ তার প্রকৃত অর্থে নয়; বরং রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সেদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি।
দুই নং আয়াত
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ
অর্থ: নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফ, দয়া এবং আত্মীয়-স্বজনকে (তাদের হক) প্রদানের হুকুম দেন আর অশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও জুলুম করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।( সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৯০)
ব্যাখ্যা
এটি কুরআন মাজীদের অত্যন্ত সারগর্ভ ও পূর্ণাঙ্গ আয়াত। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ তা'আলা যাবতীয় ভালো ও মন্দ বিষয়সমূহ সম্পর্কে এক পরিপূর্ণ নির্দেশনা এ আয়াতের ভেতর দান করেছেন। আকীদা, আখলাক, নিয়ত, আমল, লেনদেন ইত্যাদি এমন কোনও বিষয় নেই, যা এ আয়াতটির অধীনে আসেনি। এর মধ্যে যা ভালো তা করতে হুকুম করা হয়েছে আর যা মন্দ তা করতে নিষেধ করা হয়েছে। সম্ভবত এ পরিপূর্ণতার কারণেই হযরত উমর ইবন আব্দুল আযীয রহ. জুমু'আর খুতবায় আয়াতটি যুক্ত করে দিয়েছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আয়াতটি কুরায়শ নেতা ওয়ালীদের সামনে পাঠ করলে সে বলেছিল, ভাতিজা! আবার পড়ো। তিনি ফের পড়লেন। তখন সে বলল, আল্লাহর কসম! এ যে বড় সুমিষ্ট ও সমুজ্জ্বল। এর উপরের অংশ ফলবান, নিচের অংশ সজীব। এটা কিছুতেই মানুষের কথা নয়।
আকছাম ইবন সায়ফী রাযি, এ আয়াতটি শুনে এমনই অভিভূত হয়েছিলেন যে, তিনি নিজ সম্প্রদায়ের কাছে গিয়ে বলেছিলেন, আমি তো দেখছি এ নবী সকল উত্তম চরিত্র ও সাধু আচরণের আদেশ করেন। তিনি হীন ও নীচ কাজকর্ম করতে নিষেধ করেন। সুতরাং তোমরা দেরি করো না; শীঘ্র তাঁর অনুসারী হয়ে যাও। এ ক্ষেত্রে তোমরা মাথা হও, লেজ হয়ো না। অর্থাৎ অগ্রাগামী হও, পেছনে থেকো না।
এ আয়াতে মৌলিকভাবে তিনটি বিষয়ের আদেশ করা হয়েছে এবং তিনটি বিষয়ে নিষেধ করা হয়েছে। যেসব বিষয়ের আদেশ করা হয়েছে তা হল 'আদল, ইহসান ও আত্মীয়-স্বজনকে দান করা। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ (নিশ্চয়ই আল্লাহ হুকুম দেন ইনসাফ ও দয়া করার)। ‘আদল’-এর অর্থ ইনসাফ করা। অর্থাৎ মানুষের আকীদা-বিশ্বাস, কাজকর্ম, স্বভাব-চরিত্র ও লেনদেনসহ যাবতীয় বিষয় ইনসাফের মানদণ্ডে সম্পন্ন করতে হবে। কোনওরকম বাড়াবাড়ি বা শিথিলতা করা যাবে না। যত ঘোর শত্রুই হোক না কেন, তার প্রতি আচরণেও ইনসাফ রক্ষা করতে হবে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
‘হে মুমিনগণ! তোমরা হয়ে যাও আল্লাহর (বিধানাবলি পালনের) জন্য সদাপ্রস্তুত (এবং) ইনসাফের সাথে সাক্ষ্যদানকারী এবং কোনও সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে ইনসাফ পরিত্যাগে প্ররোচিত না করে। ইনসাফ অবলম্বন করো। এ পন্থাই তাকওয়ার বেশি নিকটবর্তী। এবং আল্লাহকে ভয় করে চলো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবগত।(সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৮)
‘ইহসান’-এর অর্থ যাবতীয় কাজ তার সাধারণ নিয়ম ও আইনের ঊর্ধ্বে উঠে আরও উত্তমরূপে সম্পন্ন করা। ন্যায় ও ইনসাফের স্তর অতিক্রম করে দয়া ও ক্ষমা এবং সহানুভূতি ও সমবেদনার পন্থা অবলম্বন করা। ফরয আদায় করার পর নফলের প্রতিও মনোযোগী হওয়া। এমনিভাবে যাবতীয় আদেশ-নিষেধ পালনে পুরোপুরি নিয়ম-নীতি রক্ষার সঙ্গে অন্তরে এই ধারণাও জাগ্রত রাখা যে, আমি যা করছি তা এ অবস্থায় করছি, যেন আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছি। আর আমি না দেখলেও সর্বাবস্থায় আল্লাহ তো আমাকে দেখছেনই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ما الْإِحْسَانُ؟ قَالَ: «أَنْ تَعْبُدَ اللَّهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ
‘ইহসান কী? তিনি বললেন, তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে এমনভাবে, যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। আর তুমি তাঁকে না দেখলেও তিনি তো তোমাকে অবশ্যয় দেখছেন।(সহীহ বুখারী: ৫০; সহীহ মুসলিম: ৮; জামে' তিরমিযী: ২৬১০; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৬৯৫; সুনানে নাসাঈ: ৪৯৯০; সুনানে ইবন মাজাহ ৬৪; মুসনাদে আহমাদ: ৩৬৬; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা : ৩০৩০৯; সহীহ ইবনে হিব্বান: ১৫৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২০৮৭১)
وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى ‘এবং আত্মীয়-স্বজনকে (তাদের হক) প্রদানের হুকুম দেন'।
এমনিতে ইনসাফ ও ইহসান করার যে আদেশ প্রদান করা হয়েছে, আত্মীয়-স্বজনের হক আদায়ের বিষয়টিও তার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তারপরও আলাদাভাবে তাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এ কারণে যে, অন্যদের তুলনায় আত্মীয়-স্বজনের হক অনেক বেশি। তাই যদিও ইনসাফ ও ইহসানের আচরণ সকলের সঙ্গেই করতে হবে, তবুও আত্মীয়-স্বজনের বেলায় এ বিষয়ে আরও বেশি সচেতন থাকতে হবে। বরং তাদের ক্ষেত্রে সর্বদা ইনসাফের ঊর্ধ্বে উঠে ইহসানকেই আঁকড়ে ধরা চাই।
তিনটি বিষয়ের আদেশ করার পর আল্লাহ তা'আলা তিনটি বিষয়ে নিষেধ করেছেন। বলা হয়েছে- وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ (আর অশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও জুলুম করতে নিষেধ করেন)। الْفَحْشَاء হল যাবতীয় নির্লজ্জতামূলক অশ্লীল ও অশালীন কথা ও কাজ। যেমন ব্যভিচার, নগ্নতা, গালাগালি, নাচ-গান ইত্যাদি। অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَنْ تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ
'স্মরণ রেখো, যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার হোক এটা কামনা করে, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে আছে যন্ত্রণাময় শাস্তি।(সূরা নূর (২৪), আয়াত ১৯)
الْمُنْكَر অর্থ আপত্তিকর কাজ। শরী'আত যা-কিছু করতে নিষেধ করেছে সবই এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন কুফর, শিরক, হিংসা-বিদ্বেষ এবং প্রকাশ্য ও গুপ্ত যাবতীয় পাপকর্ম।
الْبَغْيِ অর্থ সীমালঙ্ঘন। জুলুম অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ কারও জান, মাল ও ইজ্জতের উপর আঘাত করা, কাউকে তার জান, মাল ও ইজ্জতের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। কিংবা বলা যায়, কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা বা মারধর করা, অন্যায়ভাবে কারও অর্থ-সম্পদ গ্রাস করা এবং কারও অসম্মান ও অমর্যাদা করা। জুলুম যদিও الْمُنْكَر এর অন্তর্ভুক্ত, তথাপি বিশেষ গুরুত্বের কারণে আলাদাভাবেও এটি উল্লেখ করা হয়েছে।কেননা এর দ্বারা মানুষের অধিকার খর্ব করা হয়। অন্যের অধিকার খর্ব করলে তা যতক্ষণ সে ব্যক্তি ক্ষমা না করবে, ততোক্ষণ আল্লাহ তা'আলাও ক্ষমা করেন না। এটা এমন এক পাপ, যার শাস্তি আখিরাতে তো বটেই, দুনিয়াতেও দিয়ে দেওয়া হয়। মজলুমের বদদু'আ অতিদ্রুত কবুল হয়। ফলে আল্লাহ তা'আলা তাকে সাহায্য করেন এবং জালেমের থেকে প্রতিশোধ নিয়ে নেন। তাই জুলুম করা হতে বেঁচে থাকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটি হাদীছে কুদসীতে ইরশাদ হয়েছে-
يَا عِبَادِي! إِنِّي حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِي وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا فَلَا تَظَالَمُوا
‘হে আমার বান্দাগণ! আমি নিজের প্রতি জুলুম হারাম করে রেখেছি এবং একে তোমাদের জন্য হারাম করেছি। কাজেই তোমরা পরস্পর জুলুম করো না।(সহীহ মুসলিম: ২৫৭৭; জামে' তিরমিযী: ২৪৯৫; সুনানে ইবনে মাজাহ: ৪২৫৭)
يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ (তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা তোমাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ের আদেশ করেন ও বিভিন্ন কাজ করতে নিষেধ করেন এবং ভালো-মন্দে পার্থক্য করে চলতে বলেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আপন-পর সকলের সঙ্গে সকল বিষয়ে ন্যায় ও ইনসাফ রক্ষা করতে হবে।
খ. মুমিন ব্যক্তি কেবল আইনের উপর চলবে না; বরং ইহসান তথা উত্তম আদর্শের উপর চলবে।
গ. আত্মীয়-স্বজনের অধিকার অন্যদের তুলনায় বেশি। তাই আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সর্বদা ইহসান ও উন্নত আদর্শের অবস্থান থেকে আচরণ করা চাই।
ঘ. সর্বাবস্থায় অশ্লীল ও নির্লজ্জ কথা ও কাজ পরিহার করে চলতে হবে।
৬. যাবতীয় আপত্তিকর কাজ তথা শরী'আতবিরোধী কাজ পরিহার করে চলাই প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য।
চ. আপন-পর কারও প্রতি কোনও অবস্থায় জুলুম করা যাবে না।
ইসলামী শাসনের মূল উদ্দেশ্য জনগণের দীনী ও দুনিয়াবী তত্ত্বাবধান ও কল্যাণসাধন। কাজেই শাসকশ্রেণির কর্তব্য ইসলামের রক্ষণাবেক্ষণ করা, মানুষের মধ্যে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং তাদের মধ্যে ইসলামের বিধানাবলি প্রতিষ্ঠা করা। এটা তাদের কর্তব্যের দীনী দিক। এর দুনিয়াবী দিক হল রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। মানুষের মধ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করা। সামাজিক অন্যায়-অবিচার দূর করে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা। জনজীবনের প্রতিটি দিক সুচারুরূপে পরিচালনার উদ্দেশ্যে সুযোগ্য লোকদের নিয়োগদান করা ও তাদের তত্ত্বাবধান করা। মানুষের মৌলিক চাহিদাসমূহ পূরণের ব্যবস্থা করা। ইসলামী নীতি অনুযায়ী অর্থ-সম্পদের উন্নয়ন ও সুষম বণ্টন করা ইত্যাদি। বলাবাহুল্য, দুনিয়াবী এ দিকসমূহও মৌলিকভাবে দীনেরই অন্তর্ভুক্ত। কেননা ইসলাম এক পরিপূর্ণ দীন এবং এসব দিক সম্পর্কে ইসলামের রয়েছে সুস্পষ্ট বিধান ও পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা। কাজেই এসব দায়িত্বও যথাযথভাবে পালন করার জন্য শাসকশ্রেণির দীনী চেতনা ও বিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাস লালন করা জরুরি। যে শাসকের অন্তরে আখিরাতের জবাবদিহিতার ভয় থাকে, তার পক্ষেই এসব দায়িত্ব ও কর্তব্য সুচারুরূপে পালন করা সম্ভব হয়। তখন তার দ্বারা রাষ্ট্রীয় কাজে কোনওরকম অবহেলা হয় না। সে জনগণের শোষক না হয়ে একজন সত্যিকারের কল্যাণকামী হয়। তাদের জন্য যা-কিছু কল্যাণকর তা আঞ্জাম দেওয়ার জন্য সে সর্বদা সজাগ ও তৎপর থাকে। সে হয় তাদের প্রতি সহমর্মী ও দরদী বন্ধু। তার যাবতীয় কাজ হয় মমত্বপূর্ণ। কখনও অহেতুক কঠোরতা প্রদর্শন করে না। তা করা কখনও সমীচীনও নয়। কেননা তাতে রাষ্ট্রীয় শাসন ও নেতৃত্বের মুখ্য উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। এ কারণেই কুরআন ও হাদীছ শাসকশ্রেণিকে জনগণের প্রতি মমতাবান ও কল্যাণকামী থাকার প্রতি বিশেষ উৎসাহদান করেছে। সতর্ক করেছে যেন কোনওভাবেই তাদের প্রতি কঠোর আচরণ করা না হয়, তাদের প্রতি দায়িত্বপালনে অবহেলা প্রদর্শন এবং তাদের প্রতি জুলুম-অবিচারকে কিছুতেই প্রশ্রয় দেওয়া না হয়। আলোচ্য অধ্যায়ের আয়াত ও হাদীছসমূহ সে সম্পর্কেই।
‘শাসকবর্গকে জনগণের প্রতি নম্রতা দেখানো…’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ
অর্থ: আর যে মুমিনগণ তোমার অনুসরণ করে, তাদের সঙ্গে বিনয়-নম্র আচরণ করো।(সূরা শু'আরা (২৬), আয়াত ২১৫)
ব্যাখ্যা
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ এর মূল অর্থ- তোমার ডানা নামিয়ে দাও। 'ডানা নামানো' দ্বারা মমত্বপূর্ণ আচরণ বোঝানো হয়। পাখি যখন তার ছানাদেরকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নেয়, তখন প্রথমে ডানা বিস্তার করে দেয়, তারপর ছানারা যখন তার শরীরের সঙ্গে এসে মিশে যায়, তখন তাদের উপর তা নামিয়ে দেয়। এটা ছানাদের প্রতি তার মমত্বের আচরণ। নিজ অনুসারী ও অধীন ব্যক্তিবর্গকে অনুরূপ কাছে নিয়ে আসা ও তাদের প্রতি মমত্বের আচরণ করাকে পাখির এ আচরণের সঙ্গে উপমিত করা হয়েছে এবং সে হিসেবেই পাখির জন্য ব্যবহৃত শব্দমালাকে এস্থলে ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং 'মুমিনদের প্রতি ডানা নামিয়ে দাও'-এর অর্থ হবে- যারা তোমার প্রতি ঈমান এনেছে, তুমি তাদের প্রতি মমত্বের আচরণ করো, যাতে তারা তোমার কাছে কাছে থাকে, দূরে সরে না যায়।
সরাসরি এ আদেশটি করা হয়েছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে, যাতে তিনি মুমিন-মুসলিমদের প্রতি নম্রকোমল আচরণ বজায় রাখেন। তিনি যেমন নবী ছিলেন, তেমনি ছিলেন ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধানও। সুতরাং নবী হিসেবে উম্মতের প্রতি মমত্বপূর্ণ আচরণ করা যেমন এ আয়াতের আদেশের অন্তর্ভুক্ত, তেমনি শাসক হিসেবে জনগণের প্রতি মমত্বের আচরণ করাও এর অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতপক্ষে তিনি এই চরিত্রেরই ছিলেন। তারপরও তাঁকে এ আদেশদান দ্বারা মূলত প্রত্যেক অভিভাবক বিশেষত পরবর্তীকালের শাসকশ্রেণিকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, তারা যেন জনগণের প্রতি মমত্বপূর্ণ আচরণ করে।
উল্লেখ্য, এ আয়াতটি ৭ম খণ্ডের ৭১ নং অধ্যায়ের ১নং আয়াতরূপে গত হয়েছে। সেখানে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. প্রত্যেক অভিভাবক ও শাসকের কর্তব্য অধীন ও জনগণের সঙ্গে বিনয়-নম্র। মমত্বপূর্ণ আচরণ করা।
খ. আয়াতটির শব্দসমূহের প্রতি লক্ষ করলে জানা যায় যে, কুরআন মাজীদের কোনও কোনও শব্দ তার প্রকৃত অর্থে নয়; বরং রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সেদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি।
দুই নং আয়াত
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ
অর্থ: নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফ, দয়া এবং আত্মীয়-স্বজনকে (তাদের হক) প্রদানের হুকুম দেন আর অশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও জুলুম করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।( সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৯০)
ব্যাখ্যা
এটি কুরআন মাজীদের অত্যন্ত সারগর্ভ ও পূর্ণাঙ্গ আয়াত। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ তা'আলা যাবতীয় ভালো ও মন্দ বিষয়সমূহ সম্পর্কে এক পরিপূর্ণ নির্দেশনা এ আয়াতের ভেতর দান করেছেন। আকীদা, আখলাক, নিয়ত, আমল, লেনদেন ইত্যাদি এমন কোনও বিষয় নেই, যা এ আয়াতটির অধীনে আসেনি। এর মধ্যে যা ভালো তা করতে হুকুম করা হয়েছে আর যা মন্দ তা করতে নিষেধ করা হয়েছে। সম্ভবত এ পরিপূর্ণতার কারণেই হযরত উমর ইবন আব্দুল আযীয রহ. জুমু'আর খুতবায় আয়াতটি যুক্ত করে দিয়েছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আয়াতটি কুরায়শ নেতা ওয়ালীদের সামনে পাঠ করলে সে বলেছিল, ভাতিজা! আবার পড়ো। তিনি ফের পড়লেন। তখন সে বলল, আল্লাহর কসম! এ যে বড় সুমিষ্ট ও সমুজ্জ্বল। এর উপরের অংশ ফলবান, নিচের অংশ সজীব। এটা কিছুতেই মানুষের কথা নয়।
আকছাম ইবন সায়ফী রাযি, এ আয়াতটি শুনে এমনই অভিভূত হয়েছিলেন যে, তিনি নিজ সম্প্রদায়ের কাছে গিয়ে বলেছিলেন, আমি তো দেখছি এ নবী সকল উত্তম চরিত্র ও সাধু আচরণের আদেশ করেন। তিনি হীন ও নীচ কাজকর্ম করতে নিষেধ করেন। সুতরাং তোমরা দেরি করো না; শীঘ্র তাঁর অনুসারী হয়ে যাও। এ ক্ষেত্রে তোমরা মাথা হও, লেজ হয়ো না। অর্থাৎ অগ্রাগামী হও, পেছনে থেকো না।
এ আয়াতে মৌলিকভাবে তিনটি বিষয়ের আদেশ করা হয়েছে এবং তিনটি বিষয়ে নিষেধ করা হয়েছে। যেসব বিষয়ের আদেশ করা হয়েছে তা হল 'আদল, ইহসান ও আত্মীয়-স্বজনকে দান করা। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ (নিশ্চয়ই আল্লাহ হুকুম দেন ইনসাফ ও দয়া করার)। ‘আদল’-এর অর্থ ইনসাফ করা। অর্থাৎ মানুষের আকীদা-বিশ্বাস, কাজকর্ম, স্বভাব-চরিত্র ও লেনদেনসহ যাবতীয় বিষয় ইনসাফের মানদণ্ডে সম্পন্ন করতে হবে। কোনওরকম বাড়াবাড়ি বা শিথিলতা করা যাবে না। যত ঘোর শত্রুই হোক না কেন, তার প্রতি আচরণেও ইনসাফ রক্ষা করতে হবে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
‘হে মুমিনগণ! তোমরা হয়ে যাও আল্লাহর (বিধানাবলি পালনের) জন্য সদাপ্রস্তুত (এবং) ইনসাফের সাথে সাক্ষ্যদানকারী এবং কোনও সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে ইনসাফ পরিত্যাগে প্ররোচিত না করে। ইনসাফ অবলম্বন করো। এ পন্থাই তাকওয়ার বেশি নিকটবর্তী। এবং আল্লাহকে ভয় করে চলো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবগত।(সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৮)
‘ইহসান’-এর অর্থ যাবতীয় কাজ তার সাধারণ নিয়ম ও আইনের ঊর্ধ্বে উঠে আরও উত্তমরূপে সম্পন্ন করা। ন্যায় ও ইনসাফের স্তর অতিক্রম করে দয়া ও ক্ষমা এবং সহানুভূতি ও সমবেদনার পন্থা অবলম্বন করা। ফরয আদায় করার পর নফলের প্রতিও মনোযোগী হওয়া। এমনিভাবে যাবতীয় আদেশ-নিষেধ পালনে পুরোপুরি নিয়ম-নীতি রক্ষার সঙ্গে অন্তরে এই ধারণাও জাগ্রত রাখা যে, আমি যা করছি তা এ অবস্থায় করছি, যেন আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছি। আর আমি না দেখলেও সর্বাবস্থায় আল্লাহ তো আমাকে দেখছেনই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ما الْإِحْسَانُ؟ قَالَ: «أَنْ تَعْبُدَ اللَّهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ
‘ইহসান কী? তিনি বললেন, তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে এমনভাবে, যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। আর তুমি তাঁকে না দেখলেও তিনি তো তোমাকে অবশ্যয় দেখছেন।(সহীহ বুখারী: ৫০; সহীহ মুসলিম: ৮; জামে' তিরমিযী: ২৬১০; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৬৯৫; সুনানে নাসাঈ: ৪৯৯০; সুনানে ইবন মাজাহ ৬৪; মুসনাদে আহমাদ: ৩৬৬; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা : ৩০৩০৯; সহীহ ইবনে হিব্বান: ১৫৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২০৮৭১)
وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى ‘এবং আত্মীয়-স্বজনকে (তাদের হক) প্রদানের হুকুম দেন'।
এমনিতে ইনসাফ ও ইহসান করার যে আদেশ প্রদান করা হয়েছে, আত্মীয়-স্বজনের হক আদায়ের বিষয়টিও তার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তারপরও আলাদাভাবে তাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এ কারণে যে, অন্যদের তুলনায় আত্মীয়-স্বজনের হক অনেক বেশি। তাই যদিও ইনসাফ ও ইহসানের আচরণ সকলের সঙ্গেই করতে হবে, তবুও আত্মীয়-স্বজনের বেলায় এ বিষয়ে আরও বেশি সচেতন থাকতে হবে। বরং তাদের ক্ষেত্রে সর্বদা ইনসাফের ঊর্ধ্বে উঠে ইহসানকেই আঁকড়ে ধরা চাই।
তিনটি বিষয়ের আদেশ করার পর আল্লাহ তা'আলা তিনটি বিষয়ে নিষেধ করেছেন। বলা হয়েছে- وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ (আর অশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও জুলুম করতে নিষেধ করেন)। الْفَحْشَاء হল যাবতীয় নির্লজ্জতামূলক অশ্লীল ও অশালীন কথা ও কাজ। যেমন ব্যভিচার, নগ্নতা, গালাগালি, নাচ-গান ইত্যাদি। অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَنْ تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ
'স্মরণ রেখো, যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার হোক এটা কামনা করে, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে আছে যন্ত্রণাময় শাস্তি।(সূরা নূর (২৪), আয়াত ১৯)
الْمُنْكَر অর্থ আপত্তিকর কাজ। শরী'আত যা-কিছু করতে নিষেধ করেছে সবই এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন কুফর, শিরক, হিংসা-বিদ্বেষ এবং প্রকাশ্য ও গুপ্ত যাবতীয় পাপকর্ম।
الْبَغْيِ অর্থ সীমালঙ্ঘন। জুলুম অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ কারও জান, মাল ও ইজ্জতের উপর আঘাত করা, কাউকে তার জান, মাল ও ইজ্জতের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। কিংবা বলা যায়, কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা বা মারধর করা, অন্যায়ভাবে কারও অর্থ-সম্পদ গ্রাস করা এবং কারও অসম্মান ও অমর্যাদা করা। জুলুম যদিও الْمُنْكَر এর অন্তর্ভুক্ত, তথাপি বিশেষ গুরুত্বের কারণে আলাদাভাবেও এটি উল্লেখ করা হয়েছে।কেননা এর দ্বারা মানুষের অধিকার খর্ব করা হয়। অন্যের অধিকার খর্ব করলে তা যতক্ষণ সে ব্যক্তি ক্ষমা না করবে, ততোক্ষণ আল্লাহ তা'আলাও ক্ষমা করেন না। এটা এমন এক পাপ, যার শাস্তি আখিরাতে তো বটেই, দুনিয়াতেও দিয়ে দেওয়া হয়। মজলুমের বদদু'আ অতিদ্রুত কবুল হয়। ফলে আল্লাহ তা'আলা তাকে সাহায্য করেন এবং জালেমের থেকে প্রতিশোধ নিয়ে নেন। তাই জুলুম করা হতে বেঁচে থাকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটি হাদীছে কুদসীতে ইরশাদ হয়েছে-
يَا عِبَادِي! إِنِّي حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِي وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا فَلَا تَظَالَمُوا
‘হে আমার বান্দাগণ! আমি নিজের প্রতি জুলুম হারাম করে রেখেছি এবং একে তোমাদের জন্য হারাম করেছি। কাজেই তোমরা পরস্পর জুলুম করো না।(সহীহ মুসলিম: ২৫৭৭; জামে' তিরমিযী: ২৪৯৫; সুনানে ইবনে মাজাহ: ৪২৫৭)
يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ (তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা তোমাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ের আদেশ করেন ও বিভিন্ন কাজ করতে নিষেধ করেন এবং ভালো-মন্দে পার্থক্য করে চলতে বলেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আপন-পর সকলের সঙ্গে সকল বিষয়ে ন্যায় ও ইনসাফ রক্ষা করতে হবে।
খ. মুমিন ব্যক্তি কেবল আইনের উপর চলবে না; বরং ইহসান তথা উত্তম আদর্শের উপর চলবে।
গ. আত্মীয়-স্বজনের অধিকার অন্যদের তুলনায় বেশি। তাই আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সর্বদা ইহসান ও উন্নত আদর্শের অবস্থান থেকে আচরণ করা চাই।
ঘ. সর্বাবস্থায় অশ্লীল ও নির্লজ্জ কথা ও কাজ পরিহার করে চলতে হবে।
৬. যাবতীয় আপত্তিকর কাজ তথা শরী'আতবিরোধী কাজ পরিহার করে চলাই প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য।
চ. আপন-পর কারও প্রতি কোনও অবস্থায় জুলুম করা যাবে না।
জনগণের প্রতি শাসকবর্গের দায়িত্বশীলতা
হাদীছ নং: ৬৫২
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি ইরশাদ করেন, তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। ইমাম একজন দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। পুরুষ তার পরিবারবর্গের উপর দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। নারী তার স্বামীর ঘরে দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। খাদেম তার মনিবের অর্থ-সম্পদের উপর দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। সুতরাং তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।- বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৮৯৩; সহীহ মুসলিম: ১৮২৯; জামে তিরমিযী: ১৭০৫; সুনানে আবূ দাউদ। ২৯২৮; মুসনাদে আহমাদ: ৪৪৯৫; সহীহ ইবনে হিব্বান ৪৪৮৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ১২৬৮৬; শুআবুল ঈমান: ৪৮৮১; তাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর: ৪৫০৬)
হাদীছ নং: ৬৫২
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি ইরশাদ করেন, তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। ইমাম একজন দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। পুরুষ তার পরিবারবর্গের উপর দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। নারী তার স্বামীর ঘরে দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। খাদেম তার মনিবের অর্থ-সম্পদের উপর দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। সুতরাং তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।- বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৮৯৩; সহীহ মুসলিম: ১৮২৯; জামে তিরমিযী: ১৭০৫; সুনানে আবূ দাউদ। ২৯২৮; মুসনাদে আহমাদ: ৪৪৯৫; সহীহ ইবনে হিব্বান ৪৪৮৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ১২৬৮৬; শুআবুল ঈমান: ৪৮৮১; তাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর: ৪৫০৬)
78 - باب أمر وُلاة الأمور بالرفق برعاياهم ونصيحتهم والشفقة عليهم والنهي عن غشهم والتشديد عليهم وإهمال مصالحهم والغفلة عنهم وعن حوائجهم
قَالَ الله تَعَالَى: {وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ} [الشعراء: 215]، وقال تَعَالَى: {إنَّ اللهَ يَأمُرُ بِالْعَدْلِ وَالإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ} [النحل: 90].
قَالَ الله تَعَالَى: {وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ} [الشعراء: 215]، وقال تَعَالَى: {إنَّ اللهَ يَأمُرُ بِالْعَدْلِ وَالإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ} [النحل: 90].
652 - وعن ابن عمر رضي الله عنهما، قَالَ: سَمِعْتُ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «كُلُّكُمْ رَاعٍ، وَكُلُّكُمْ مَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتهِ: الإمَامُ رَاعٍ وَمَسؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ في أهلِهِ وَمَسؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ في بَيْتِ زَوْجِهَا وَمَسْؤُولَةٌ عَنْ رَعِيَّتِهَا، وَالخَادِمُ رَاعٍ في مال سيِّدِهِ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে প্রথমে সাধারণ নীতি জানানো হয়েছে যে- كلُّكم راعٍ وكلُّكم مسؤولٌ عن رعيتِهِ (তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে)। راع শব্দটির উৎপত্তি رعاية থেকে, যার মূল অর্থ রক্ষণাবেক্ষণ করা। রাখালকে راع বলা হয়। কারণ সে তার দায়িত্বভুক্ত গবাদিপশুর রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। এ হাদীছে প্রত্যেককে راع বলা হয়েছে। কেননা প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু দায়িত্ব রয়েছে এবং প্রত্যেকেরই দায়িত্বে কেউ না কেউ থাকে। আর কেউ না থাকুক, অন্ততপক্ষে নিজ সত্তা তো থাকেই। যার অধীনে আর কেউ নেই, তার কর্তব্য নিজের রক্ষণাবেক্ষণ করা। কেননা সে নিজ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপর দায়িত্বশীল। তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, তার শক্তিসমূহ ও তার ইন্দ্রিয়সমূহ তার দায়িত্বাধীন। এগুলো যেন তার প্রজা। তার কর্তব্য এগুলোর যথাযথ ব্যবহার। সে এগুলোকে অন্যায়-অপরাধ থেকে বাঁচাবে ও যাবতীয় ক্ষতিকর কাজ থেকে হেফাজত করবে এবং শরী'আতসম্মতভাবে এগুলোর ব্যবহার করবে, যাতে তার প্রতিটি অঙ্গ তথা নিজ সত্তা জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা পায় এবং জান্নাতের উপযুক্ত হয়ে যায়।
মোটকথা, নিজ আওতা ও ক্ষমতার বিস্তারভেদে জান-মালের যা-কিছুই যার অধীনে আছে, সে তার বা তাদের দায়িত্বশীল। তার কর্তব্য ন্যায়নিষ্ঠতার সঙ্গে তার রক্ষণাবেক্ষণ করা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে তা পরিচালনা করা। কেননা আখিরাতে তাকে তার সে দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। এ হাদীছটিরই এক বর্ণনায় সবশেষে আছে-
فَأَعِدُّوا لِتِلْكَ الْمَسَائِلِ جَوَابًا ، فَقَالَ : يَا رَسُوْلَ اللهِ ، وَمَا جَوَابُهَا؟ قَالَ: أَعْمَالُ الْبِر
(সুতরাং তোমরা সেসব জিজ্ঞাসার উত্তর প্রস্তুত করো। সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তার জবাব কী? তিনি বললেন, সৎকর্ম)। (তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৩৫৭৬; আল মু'জামুস সগীর : ৪৫০)
প্রথমে সাধারণ মূলনীতি বয়ান করার পর এবার পর্যায়ক্রমে বিশেষ বিশেষ দায়িত্বশীলদের দায়িত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে। সর্বপ্রথম আমীর ও শাসক সম্পর্কে বলা হচ্ছে- الإِمَامُ رَاعٍ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ (ইমাম একজন দায়িত্বশীল। তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে)। এ হাদীছে ইমাম বলে রাষ্ট্রপ্রধান ও তার প্রতিনিধিদের বোঝানো হয়েছে। তাদের কর্তব্য ন্যায় ও ইনসাফের সাথে রাষ্ট্র পরিচালনা করা, শরী'আত মোতাবেক জনগণের দেখভাল করা, দেশে ইসলামী বিধান জারি করা, ইসলামী শরী'আত মোতাবেক আইন-আদালত পরিচালনা করা, জামা'আত, জুমু'আ ও ঈদের নামায কায়েম করা, দেশ ও ধর্মের শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনা করা ইত্যাদি। আখিরাতে তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে যে, তারা এসব দায়িত্ব কীভাবে পালন করেছিল? শরী'আত মোতাবেক, না নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো?
সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সরকারি বড় বড় পদ মানুষের কাছে বড়ই লোভনীয়। কিন্তু এ লোভের অন্তরালে যে কী কঠিন পরিণতি নিহিত রয়েছে, তা কেউ চিন্তা করে না। একসময় মানুষের মনে যখন যথেষ্ট পরিমাণে আল্লাহর ভয় ছিল, তখন তারা এসব পদ গ্রহণ করতেও ভয় পেত। বর্তমানে ভয় তো করাই হয় না, উল্টো এসব পাওয়ার জন্য নানা তদবির করা হয়, অবলম্বন করা হয় অন্যায়-অনুচিত পন্থা। যে পদ গ্রহণ করা হয় লোভ-লালসার সাথে এবং যা পাওয়ার জন্য অবলম্বন করা হয় অন্যায়-অনুচিত পন্থা, তা পদাধিকারীর জন্য কখনও কল্যাণ বয়ে আনে না। তার নিজের জন্যও কল্যাণ বয়ে আনে না এবং জনগণের জন্যও তা হয় না কল্যাণপ্রসূ। এরূপ ব্যক্তিদের দ্বারা দেশের জনগণও অন্যায়-অনাচার দ্বারা জর্জরিত হয় আর তারা নিজেরাও দীন ও ঈমানের সর্বনাশ ঘটিয়ে আখিরাতের জীবন ধ্বংস করে। মুমিনগণ যাতে সে ধ্বংসের পথে পা না বাড়ায়, তাই এ হাদীছ সতর্ক করছে যে, রাষ্ট্রীয় পদ অত্যন্ত কঠিন ও গুরুদায়িত্বের পদ। তোমরা সাবধান থেক, আখিরাতে কিন্তু এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
তারপর গৃহকর্তার সম্পর্কে বলা হয়েছে-وَالرَّجُلُ رَاعٍ فِي أَهْلِهِ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ (পুরুষ তার পরিবারবর্গের উপর দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে)। সুতরাং তার কর্তব্য আপন সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের খরচা বহন করা, তাদের পার্থিব কল্যাণের প্রতি লক্ষ রাখা এবং পরকালীন মুক্তির লক্ষ্যে সৎকাজের আদেশ করা, অসৎকাজে নিষেধ করা আর দীনের জরুরি ইলম শিক্ষা দেওয়া। তাদের পার্থিব জরুরত মেটানোর তুলনায় পরকালীন প্রয়োজন মেটানোর গুরুত্ব কোনও অংশেই কম নয়; বরং তার গুরুত্ব অনেক অনেক বেশি। এ ব্যাপারে অবহেলা করার কোনও সুযোগ স্বামী বা গৃহকর্তার নেই। আল্লাহ তা'আলা আদেশ করেন-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا
‘হে মুমিনগণ! নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে রক্ষা করো জাহান্নামের আগুন থেকে।(সূরা তাহরীম (৬৬), আয়াত ৬)
তৃতীয় পর্যায়ে স্ত্রী সম্পর্কে বলা হয়েছে- وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ فِي بَيْتِ زَوْجِهَا وَمَسْؤُولَةٌ عَنْ رَعِيَّتِهَا (নারী তার স্বামীর ঘরে দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে)। তার দায়িত্ব ঘরের মালামাল হেফাজত করা, যাতে তা চুরি না হয়ে যায়, পশুপাখিতে নষ্ট না করে ফেলে কিংবা অবহেলায় পড়ে থাকার কারণে নষ্ট না হয়ে যায়। স্বামীর অনুমতি ছাড়া সে তার অর্থ-সম্পদ দান-সদাকাও করবে না। কেননা তা তার জন্য আমানতস্বরূপ। স্বামীর ইচ্ছার বিপরীতে তা খরচ করলে আমানতের খেয়ানত হয়, যা কঠিন পাপ। হাঁ, যদি স্বামীর পক্ষ থেকে সরাসরি বা পরোক্ষ অনুমতি থাকে, তবে তা করতে পারবে। তাতে তার নিজেরও ছাওয়াব হবে এবং স্বামীরও ছাওয়াব হবে। স্বামীরও উচিত দান-খয়রাতের অনুমতি তাকে দিয়ে দেওয়া।
তারপর খাদেম সম্পর্কে বলা হয়েছে- وَالْخَادِمُ رَاعٍ فِي مَالِ سَيِّدِهِ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ (খাদেম তার মনিবের অর্থ-সম্পদের উপর দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে)। খাদেম তার মনিবের অর্থ-সম্পদের উপর দায়িত্বশীল। তার দায়িত্ব মনিবের মালামাল ও আসবাবপত্রের হেফাজত করা। এ ব্যাপারে অবহেলা করলে তা তার খেয়ানতরূপে গণ্য হবে। যদি মনিবের অগোচরে তার কোনও মাল সরিয়ে ফেলে, তবে তা স্পষ্টই চুরি। সিকিউরিটি গার্ড, অফিস সহকারি, দপ্তরি, কেয়ারটেকার প্রভৃতি পদে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্যও এ কথা প্রযোজ্য। সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতে নিয়োজিত কর্মচারীগণও এর আওতায় পড়ে। কিন্তু এ ব্যাপারে সর্বত্র মারাত্মক গাফলাতি লক্ষ করা যায়। এদের প্রত্যেকেই যেন মালিক ও কর্তৃপক্ষের মালামালকে নিজের মাল মনে করে এবং সে হিসেবে তার যথেচ্ছ ব্যবহার করে। সুযোগমত সরিয়েও ফেলে। কিছুতেই এটা উচিত নয়। কেননা তাদেরকেও আখিরাতে এ ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে।
সবশেষে প্রথম কথার পুনরাবৃত্তি করে বলা হয়েছে- وَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ (সুতরাং তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে)। অর্থাৎ দায়িত্বশীলতার বাইরে কেউ নেই। যে ব্যক্তি সরকারি কোনও পদে নেই এবং বিবাহও করেনি, সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করে, সে নিজ শরীর ও প্রাণের উপর দায়িত্বশীল। তার কর্তব্য শরীর-মনকে জাহান্নাম থেকে হেফাজত করে জান্নাতের উপযুক্ত বানানো। সে লক্ষ্যে বিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাস পোষণ করা, যবানের হেফাজত করা এবং প্রতিটি অঙ্গের শরী'আতসম্মত ব্যবহারের প্রতি যত্নবান থাকা তার কর্তব্য। তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, তার শক্তি-ক্ষমতা ও ইন্দ্রিয়সমূহ তার প্রজা। তার কর্তব্য এসবের দেখভাল করা।
মোটকথা, একক এক ব্যক্তি থেকে শুরু করে কমবেশি সংখ্যক সমষ্টির প্রতিনিধিত্বকারী সকলেই আপন আপন পরিসরে দায়িত্বশীল ও যিম্মাদার। প্রত্যেককেই জিজ্ঞেস করা হবে সে তার করণীয় যথাযথ আঞ্জাম দিয়েছে কি না। এক বর্ণনায় আছে-
لا يَستَرعي اللهُ تَبارك وتَعالى عبدًا رعيَّةً، قَلَّتْ أو كَثُرَتْ، إلَّا سَأَلَه اللهُ تَبارك وتَعالى عنها يَومَ القيامَةِ، أقامَ فيهم أمْرَ اللهِ تَبارك وتَعالى أم أضاعَه؟ حتى يَسأَلَه عن أهْلِ بَيتِه خاصَّةً
আল্লাহ তাঁর যে বান্দাকেই লোকজনের দায়িত্বে নিযুক্ত করেন, তাদের সংখ্যা কম হোক বা বেশি, তাকে অবশ্যই কিয়ামতের দিন তার দায়িত্বভুক্ত লোকজন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন, সে তাদের মধ্যে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠা করেছিল না তা নষ্ট করেছিল? এমনকি তাকে বিশেষভাবে তার ঘরের লোকজন সম্পর্কেও জিজ্ঞেস করবেন। (মুসনাদে আহমাদ: ৪৬৩৭; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর: ৮৮৫৫)
এভাবে হাদীছটির শুরু-শেষে একই মূলনীতির পুনরাবৃত্তি করে দায়িত্ব ও দায়িত্বের জবাবদিহিতার তাকিদ করা হয়েছে যে, প্রত্যেকের দায়িত্ব কিন্তু অত্যন্ত কঠিন। তা যথাযথভাবে আঞ্জাম দিতে সচেষ্ট থেকো। একদিন এ সম্পর্কে অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আমরা কেউ দায়িত্বমুক্ত নই। আপন আপন ক্ষেত্রে প্রত্যেকের উপরই কোনও না কোনও দায়িত্ব ন্যস্ত আছে। সে দায়িত্ব পালনে প্রত্যেকেরই সচেষ্ট থাকা চাই।
খ. শাসকশ্রেণির কর্তব্য দেশবাসীকে শরী'আতের নির্দেশনা মোতাবেক পরিচালনা করা।
গ. গৃহকর্তার কর্তব্য আপন সামর্থ্য অনুযায়ী পরিবারবর্গের দুনিয়াবী প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি তাদের দীনদারীরও তত্ত্বাবধান করা।
ঘ. স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর আনুগত্য করা এবং সন্তান-সন্ততি ও ঘর-সংসারের প্রতি কল্যাণকামিতাপূর্ণ আচার-আচরণ করা।
ঙ. গৃহকর্মী থেকে শুরু করে অফিস-আদালতের কর্মচারী-কর্মকর্তা পর্যন্ত সকলেরই আপন দায়িত্ব সম্পর্কে আখিরাতে জবাবদিহি করতে হবে। তাই এদের প্রত্যেকেরও সবরকম খেয়ানত ও দুর্নীতি পরিহার করে যথাযথভাবে দায়িত্বপালনে রত থাকা উচিত।
চ. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল আখিরাত সত্য, আখিরাতে প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হবে এবং আপন আপন দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।
মোটকথা, নিজ আওতা ও ক্ষমতার বিস্তারভেদে জান-মালের যা-কিছুই যার অধীনে আছে, সে তার বা তাদের দায়িত্বশীল। তার কর্তব্য ন্যায়নিষ্ঠতার সঙ্গে তার রক্ষণাবেক্ষণ করা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে তা পরিচালনা করা। কেননা আখিরাতে তাকে তার সে দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। এ হাদীছটিরই এক বর্ণনায় সবশেষে আছে-
فَأَعِدُّوا لِتِلْكَ الْمَسَائِلِ جَوَابًا ، فَقَالَ : يَا رَسُوْلَ اللهِ ، وَمَا جَوَابُهَا؟ قَالَ: أَعْمَالُ الْبِر
(সুতরাং তোমরা সেসব জিজ্ঞাসার উত্তর প্রস্তুত করো। সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তার জবাব কী? তিনি বললেন, সৎকর্ম)। (তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৩৫৭৬; আল মু'জামুস সগীর : ৪৫০)
প্রথমে সাধারণ মূলনীতি বয়ান করার পর এবার পর্যায়ক্রমে বিশেষ বিশেষ দায়িত্বশীলদের দায়িত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে। সর্বপ্রথম আমীর ও শাসক সম্পর্কে বলা হচ্ছে- الإِمَامُ رَاعٍ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ (ইমাম একজন দায়িত্বশীল। তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে)। এ হাদীছে ইমাম বলে রাষ্ট্রপ্রধান ও তার প্রতিনিধিদের বোঝানো হয়েছে। তাদের কর্তব্য ন্যায় ও ইনসাফের সাথে রাষ্ট্র পরিচালনা করা, শরী'আত মোতাবেক জনগণের দেখভাল করা, দেশে ইসলামী বিধান জারি করা, ইসলামী শরী'আত মোতাবেক আইন-আদালত পরিচালনা করা, জামা'আত, জুমু'আ ও ঈদের নামায কায়েম করা, দেশ ও ধর্মের শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনা করা ইত্যাদি। আখিরাতে তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে যে, তারা এসব দায়িত্ব কীভাবে পালন করেছিল? শরী'আত মোতাবেক, না নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো?
সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সরকারি বড় বড় পদ মানুষের কাছে বড়ই লোভনীয়। কিন্তু এ লোভের অন্তরালে যে কী কঠিন পরিণতি নিহিত রয়েছে, তা কেউ চিন্তা করে না। একসময় মানুষের মনে যখন যথেষ্ট পরিমাণে আল্লাহর ভয় ছিল, তখন তারা এসব পদ গ্রহণ করতেও ভয় পেত। বর্তমানে ভয় তো করাই হয় না, উল্টো এসব পাওয়ার জন্য নানা তদবির করা হয়, অবলম্বন করা হয় অন্যায়-অনুচিত পন্থা। যে পদ গ্রহণ করা হয় লোভ-লালসার সাথে এবং যা পাওয়ার জন্য অবলম্বন করা হয় অন্যায়-অনুচিত পন্থা, তা পদাধিকারীর জন্য কখনও কল্যাণ বয়ে আনে না। তার নিজের জন্যও কল্যাণ বয়ে আনে না এবং জনগণের জন্যও তা হয় না কল্যাণপ্রসূ। এরূপ ব্যক্তিদের দ্বারা দেশের জনগণও অন্যায়-অনাচার দ্বারা জর্জরিত হয় আর তারা নিজেরাও দীন ও ঈমানের সর্বনাশ ঘটিয়ে আখিরাতের জীবন ধ্বংস করে। মুমিনগণ যাতে সে ধ্বংসের পথে পা না বাড়ায়, তাই এ হাদীছ সতর্ক করছে যে, রাষ্ট্রীয় পদ অত্যন্ত কঠিন ও গুরুদায়িত্বের পদ। তোমরা সাবধান থেক, আখিরাতে কিন্তু এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
তারপর গৃহকর্তার সম্পর্কে বলা হয়েছে-وَالرَّجُلُ رَاعٍ فِي أَهْلِهِ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ (পুরুষ তার পরিবারবর্গের উপর দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে)। সুতরাং তার কর্তব্য আপন সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের খরচা বহন করা, তাদের পার্থিব কল্যাণের প্রতি লক্ষ রাখা এবং পরকালীন মুক্তির লক্ষ্যে সৎকাজের আদেশ করা, অসৎকাজে নিষেধ করা আর দীনের জরুরি ইলম শিক্ষা দেওয়া। তাদের পার্থিব জরুরত মেটানোর তুলনায় পরকালীন প্রয়োজন মেটানোর গুরুত্ব কোনও অংশেই কম নয়; বরং তার গুরুত্ব অনেক অনেক বেশি। এ ব্যাপারে অবহেলা করার কোনও সুযোগ স্বামী বা গৃহকর্তার নেই। আল্লাহ তা'আলা আদেশ করেন-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا
‘হে মুমিনগণ! নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে রক্ষা করো জাহান্নামের আগুন থেকে।(সূরা তাহরীম (৬৬), আয়াত ৬)
তৃতীয় পর্যায়ে স্ত্রী সম্পর্কে বলা হয়েছে- وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ فِي بَيْتِ زَوْجِهَا وَمَسْؤُولَةٌ عَنْ رَعِيَّتِهَا (নারী তার স্বামীর ঘরে দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে)। তার দায়িত্ব ঘরের মালামাল হেফাজত করা, যাতে তা চুরি না হয়ে যায়, পশুপাখিতে নষ্ট না করে ফেলে কিংবা অবহেলায় পড়ে থাকার কারণে নষ্ট না হয়ে যায়। স্বামীর অনুমতি ছাড়া সে তার অর্থ-সম্পদ দান-সদাকাও করবে না। কেননা তা তার জন্য আমানতস্বরূপ। স্বামীর ইচ্ছার বিপরীতে তা খরচ করলে আমানতের খেয়ানত হয়, যা কঠিন পাপ। হাঁ, যদি স্বামীর পক্ষ থেকে সরাসরি বা পরোক্ষ অনুমতি থাকে, তবে তা করতে পারবে। তাতে তার নিজেরও ছাওয়াব হবে এবং স্বামীরও ছাওয়াব হবে। স্বামীরও উচিত দান-খয়রাতের অনুমতি তাকে দিয়ে দেওয়া।
তারপর খাদেম সম্পর্কে বলা হয়েছে- وَالْخَادِمُ رَاعٍ فِي مَالِ سَيِّدِهِ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ (খাদেম তার মনিবের অর্থ-সম্পদের উপর দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে)। খাদেম তার মনিবের অর্থ-সম্পদের উপর দায়িত্বশীল। তার দায়িত্ব মনিবের মালামাল ও আসবাবপত্রের হেফাজত করা। এ ব্যাপারে অবহেলা করলে তা তার খেয়ানতরূপে গণ্য হবে। যদি মনিবের অগোচরে তার কোনও মাল সরিয়ে ফেলে, তবে তা স্পষ্টই চুরি। সিকিউরিটি গার্ড, অফিস সহকারি, দপ্তরি, কেয়ারটেকার প্রভৃতি পদে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্যও এ কথা প্রযোজ্য। সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতে নিয়োজিত কর্মচারীগণও এর আওতায় পড়ে। কিন্তু এ ব্যাপারে সর্বত্র মারাত্মক গাফলাতি লক্ষ করা যায়। এদের প্রত্যেকেই যেন মালিক ও কর্তৃপক্ষের মালামালকে নিজের মাল মনে করে এবং সে হিসেবে তার যথেচ্ছ ব্যবহার করে। সুযোগমত সরিয়েও ফেলে। কিছুতেই এটা উচিত নয়। কেননা তাদেরকেও আখিরাতে এ ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে।
সবশেষে প্রথম কথার পুনরাবৃত্তি করে বলা হয়েছে- وَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ (সুতরাং তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে)। অর্থাৎ দায়িত্বশীলতার বাইরে কেউ নেই। যে ব্যক্তি সরকারি কোনও পদে নেই এবং বিবাহও করেনি, সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করে, সে নিজ শরীর ও প্রাণের উপর দায়িত্বশীল। তার কর্তব্য শরীর-মনকে জাহান্নাম থেকে হেফাজত করে জান্নাতের উপযুক্ত বানানো। সে লক্ষ্যে বিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাস পোষণ করা, যবানের হেফাজত করা এবং প্রতিটি অঙ্গের শরী'আতসম্মত ব্যবহারের প্রতি যত্নবান থাকা তার কর্তব্য। তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, তার শক্তি-ক্ষমতা ও ইন্দ্রিয়সমূহ তার প্রজা। তার কর্তব্য এসবের দেখভাল করা।
মোটকথা, একক এক ব্যক্তি থেকে শুরু করে কমবেশি সংখ্যক সমষ্টির প্রতিনিধিত্বকারী সকলেই আপন আপন পরিসরে দায়িত্বশীল ও যিম্মাদার। প্রত্যেককেই জিজ্ঞেস করা হবে সে তার করণীয় যথাযথ আঞ্জাম দিয়েছে কি না। এক বর্ণনায় আছে-
لا يَستَرعي اللهُ تَبارك وتَعالى عبدًا رعيَّةً، قَلَّتْ أو كَثُرَتْ، إلَّا سَأَلَه اللهُ تَبارك وتَعالى عنها يَومَ القيامَةِ، أقامَ فيهم أمْرَ اللهِ تَبارك وتَعالى أم أضاعَه؟ حتى يَسأَلَه عن أهْلِ بَيتِه خاصَّةً
আল্লাহ তাঁর যে বান্দাকেই লোকজনের দায়িত্বে নিযুক্ত করেন, তাদের সংখ্যা কম হোক বা বেশি, তাকে অবশ্যই কিয়ামতের দিন তার দায়িত্বভুক্ত লোকজন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন, সে তাদের মধ্যে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠা করেছিল না তা নষ্ট করেছিল? এমনকি তাকে বিশেষভাবে তার ঘরের লোকজন সম্পর্কেও জিজ্ঞেস করবেন। (মুসনাদে আহমাদ: ৪৬৩৭; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর: ৮৮৫৫)
এভাবে হাদীছটির শুরু-শেষে একই মূলনীতির পুনরাবৃত্তি করে দায়িত্ব ও দায়িত্বের জবাবদিহিতার তাকিদ করা হয়েছে যে, প্রত্যেকের দায়িত্ব কিন্তু অত্যন্ত কঠিন। তা যথাযথভাবে আঞ্জাম দিতে সচেষ্ট থেকো। একদিন এ সম্পর্কে অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আমরা কেউ দায়িত্বমুক্ত নই। আপন আপন ক্ষেত্রে প্রত্যেকের উপরই কোনও না কোনও দায়িত্ব ন্যস্ত আছে। সে দায়িত্ব পালনে প্রত্যেকেরই সচেষ্ট থাকা চাই।
খ. শাসকশ্রেণির কর্তব্য দেশবাসীকে শরী'আতের নির্দেশনা মোতাবেক পরিচালনা করা।
গ. গৃহকর্তার কর্তব্য আপন সামর্থ্য অনুযায়ী পরিবারবর্গের দুনিয়াবী প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি তাদের দীনদারীরও তত্ত্বাবধান করা।
ঘ. স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর আনুগত্য করা এবং সন্তান-সন্ততি ও ঘর-সংসারের প্রতি কল্যাণকামিতাপূর্ণ আচার-আচরণ করা।
ঙ. গৃহকর্মী থেকে শুরু করে অফিস-আদালতের কর্মচারী-কর্মকর্তা পর্যন্ত সকলেরই আপন দায়িত্ব সম্পর্কে আখিরাতে জবাবদিহি করতে হবে। তাই এদের প্রত্যেকেরও সবরকম খেয়ানত ও দুর্নীতি পরিহার করে যথাযথভাবে দায়িত্বপালনে রত থাকা উচিত।
চ. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল আখিরাত সত্য, আখিরাতে প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হবে এবং আপন আপন দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।
