ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার

৩. নামাযের অধ্যায়

হাদীস নং: ১১৭২
কবর যিয়ারত করা ও যিয়ারতের দুআ
(১১৭২) আয়িশা রা. বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি কবর যিয়ারত করলে কবরবাসীদের জন্য কী বলব? তিনি বলেন, তুমি বলবে, 'মুমিন ও মুসলিম গৃহবাসীদের উপর সালাম, এবং আল্লাহ ক্ষমা করুন আমাদের মধ্যে যারা অগ্রগামী এবং আমাদের মধ্যে যারা পশ্চাতগামী, আর নিশ্চয় আমরা আল্লাহ চাইলে আপনাদের সাথে মিলিত হব'।
عن عائشة رضي الله عنها قالت: كيف أقول لهم يا رسول الله؟ قال قولي: السلام على أهل الديار من المؤمنين والمسلمين ويرحم الله المستقدمين منا والمستأخرين وإنا إن شاء الله بكم للاحقون.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

কবরস্থানে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরবাসীদের মাগফিরাতের জন্য আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করতেন। তিনি তখন যা পড়তেন, তা বিভিন্ন বর্ণনায় বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে।

কোন বর্ণনায় আছে, তিনি কবরবাসীদের লক্ষ্য করে বলতেন- السَّلَامُ عَلَيْكُمْ دَارَ قَوْمٍ مُؤْمِنِیْنَ – এর মূল অর্থ- ‘তোমাদের প্রতি সালাম, হে মুমিন সম্প্রদায়ের নিবাস'। ‘নিবাস’ বলে নিবাসী বা বাসিন্দাগণকে বোঝানো উদ্দেশ্য। কোন বর্ণনায় আছে- السَّلَامُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ (হে মুমিন ও মুসলিম বাসিন্দাগণ! তোমাদের প্রতি সালাম)। নিবাস বা বাসস্থান বলে কবর বোঝানো উদ্দেশ্য। কোন বর্ণনায় আছে- السَّلَامُ عَلَيْكُمْ يَا أَهْلَ الْقُبُوْرِ (হে কবরবাসীগন! তোমাদের প্রতি সালাম)। কবর যেহেতু একটা দীর্ঘ সময়ের জন্য মৃতব্যক্তির থাকার জায়গা, তাই একে নিবাস বা ঘর শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরবাসীদের সম্বোধন করে বলেছেন- اَلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ (তোমাদের প্রতি সালাম)। এর দ্বারা বোঝা গেল, মায়্যিতের রূহ তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও এক রকম সম্পর্ক তারপরও অবশিষ্ট থাকে। ফলে সে জীবিত ব্যক্তির সম্বোধন বুঝতে পারে এবং তার সালাম শুনতে পায়। এমনকি যে ব্যক্তি তাকে সালাম দেয় তাকে চিনতেও পারে। সুতরাং এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَا مِنْ رَجُلٍ يَمُرُّ بِقَبْرِ رَجُلٍ كَانَ يَعْرِفُهُ فِي الدُّنْيَا، فَيُسَلِّمُ عَلَيْهِ إِلَّا عَرَفَهُ وَرَدَّ عَلَيْهِ
যে ব্যক্তি এমন কোনও কবরবাসীর পাশ দিয়ে যায়, যে দুনিয়ায় থাকাকালে তাকে চিনত, আর তাকে সালাম দেয়, সে কবরবাসী তাকে চিনতে পারে এবং তার সালামের উত্তর দেয়।(আল ইস্তিযকার ফাওয়াইদু তাম্মাম: ১৩৯; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৮৮৫৭
صححه الإمام ابن عبد البر كما قال الإمام الكشميري في فيض الباري. والإمام عبد الحق الإمام ابن الإشبيلي كما في فيض القدير. (المحرر)

কবরবাসী যে শুনতে পায়, তা আরও বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদরের যে গর্তে মুশরিকদের নিহত সর্দারদের মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল সেখানে উপস্থিত হয়ে ওই সর্দারদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা সত্য পেয়েছ কি? তখন হযরত উমর রাযি. বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যে দেহগুলোতে কোনও রূহ নেই, তাদের লক্ষ্য করে আপনি কীভাবে কথা বলছেন? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন-
مَا أَنْتُمْ بِأَسْمَعَ مِنْهُمْ
‘তোমরা তাদেরচে' বেশি শুনতে পাও না।’(সহীহ বুখারী: ৩৯৭৬; সহীহ মুসলিম: ২৮৭৩; সুনানে নাসাঈ ২০৭৪; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ১৪০; সহীহ ইবন হিব্বান: ৪৭৭৮; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৪৭০১)

কোন বর্ণনায় দু'আর একটি অংশ হল- وَأَتاكُمْ مَا تُوْعَدُونَ غَدًا مُؤَجَّلُوْنَ (তোমাদেরকে আগামী দিনের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছিল তা তোমাদের কাছে এসে গেছে এ অবস্থায় যে, তোমাদেরকে অবকাশ দেওয়া হয়েছিল)। অর্থাৎ তোমরা যখন দুনিয়ায় ছিলে, তখন তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল- আগামীতে একদিন তোমাদের মৃত্যু আসবে, তারপর তোমাদেরকে কবরবাসী হতে হবে। সে প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হয়েছে। তার আগে তোমাদেরকে কিছুদিনের অবকাশ দেওয়া হয়েছিল। সে অবকাশ শেষ হলে তোমাদের মৃত্যু ঘটানো হয়। এখন তোমরা কবরের বাসিন্দা হয়ে গিয়েছ।

এর আরেক অর্থ হতে পারে- তোমাদের কাছে প্রতিশ্রুত মৃত্যু এসে গেছে। এখন তোমাদের সামনে রয়েছে কর্মফললাভের বিষয়টি। সেজন্য তোমাদের একটা কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সে কাল পূরণ হওয়ার পর অর্থাৎ কবরের জীবন শেষ হওয়ার পর তোমাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে। তারপর তোমাদেরকে তোমাদের কর্মের পরিপূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হবে।

হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম দেওয়ার সময় কবরবাসীদের দিকে ফিরে দাঁড়িয়েছিলেন। এর দ্বারা বোঝা যায় তাদের দিকে ফিরেই সালাম দেওয়া উচিত। এটা সালাম দেওয়ার আদব। জীবিত-মৃত সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আরও বোঝা গেল, মৃতব্যক্তিদেরও আদব রক্ষা করা চাই। কবরের পাশে এমন কোনও আচরণ করা উচিত নয়, যা জীবিত ব্যক্তির সামনে করলে বেয়াদবী বলে গণ্য হয়।

হাদীছে কবরবাসীর জন্য যে নিরাপত্তা ও মাগফিরাতের দু'আ করা হয়েছে, সেই দু'আ নিজের জন্যও করা হয়েছে। এটা দু'আ করার নিয়ম। অন্যের জন্য মাগফিরাত ও নাজাতের দু'আ করলে সেই দু'আয় নিজেকেও শামিল রাখা চাই এবং তাতেও নিয়ম হল নিজের কথা আগে উল্লেখ করা।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কবর যিয়ারত করা সুন্নত। মাঝেমধ্যে এর উপর আমল করা চাই।

খ. কবর যিয়ারতকালে হাদীছে বর্ণিত দু'আ পাঠ করা উত্তম।

গ. কবরও একটি ঠিকানা। একটা কাল পর্যন্ত প্রত্যেককে এ ঠিকানায় থাকতে হবে।

ঘ. কবরবাসী যিয়ারতকারীর সালাম শুনতে পায় এবং পরিচিত হলে সালামদাতাকে চিনতেও পারে।

ঙ. কবরবাসীকে সালাম দেওয়ার সময় কবরের দিকে মুখ করে দাঁড়ানো উত্তম।

চ. কবরবাসীর আদব ও সম্মান রক্ষা করা চাই, যেমন জীবিত অবস্থায় তার আদব ও সম্মান রক্ষা করা হতো।

ছ. অন্যের জন্য মাগফিরাতের দু'আ করা হলে সে দু'আয় নিজেকেও শামিল রাখা চাই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
ফিকহুস সুনান - হাদীস নং ১১৭২ | মুসলিম বাংলা