মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা রহঃ

১৭. ক্রয়-বিক্রয়ের বিধান

হাদীস নং: ৩৩০
ছয় বস্তুর মধ্যে অতিরিক্ত গ্রহণ করা সুদ
হাদীস নং- ৩৩০

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন : স্বর্ণ স্বর্ণের পরিবর্তে সমান সমান হলে জায়েয়, অতিরিক্ত হলো সুদ। রূপা রূপার পরিবর্তে ওজনে সমান সমান হলে জায়েয হবে, অতিরিক্ত হলে সুদ। খেজুর খেজুরের সমান সমান হলে জায়েয,অতিরিক্ত হলে সুদ হবে। যব বা বার্লি যবের সমান হলে জায়েয , অতিরিক্ত হলে সুদ হবে।
অন্য এক রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে, স্বর্ণ-স্বর্ণের সমান ওজনে ও হাতে হাতে, এর অতিরিক্ত হলো সুদ, গম গমের সমান ওজনে ও হাতে হাতে এবং অতিরিক্ত হলো সুদ, খেজুর খেজুরের সমান ও লবণ লবণের সমান ওজনে, এর অতিরিক্ত হলো সুদ।
عَنْ عَطِيَّةَ، عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: «الذَّهَبُ بِالذَّهَبِ مِثْلًا بِمِثْلٍ، وَالْفَضْلُ رِبًا، وَالْفِضَّةُ بِالْفِضَّةِ وَزْنًا بِوَزْنٍ، وَالْفَضْلُ رِبًا، وَالتَّمْرُ بِالتَّمْرِ مِثْلًا بِمِثْلٍ، وَالْفَضْلُ رِبًا، وَالشَّعِيرُ بِالشَّعِيرِ مِثْلًا بِمِثْلٍ، وَالْفَضْلُ رِبًا، وَالْمِلْحُ بِالْمِلْحِ مِثْلًا بِمِثْلٍ، وَالْفَضْلُ رِبًا» ، وَفِي رِوَايَةٍ: «الذَّهَبُ بِالذَّهَبِ وَزْنًا بِوَزْنٍ يَدًا بِيَدٍ، وَالْفَضْلُ رِبًا، وَالْحِنْطَةُ بِالْحِنْطَةِ كَيْلًا بِكَيْلٍ يَدًا بِيَدٍ، وَالْفَضْلُ رِبًا، وَالتَّمْرُ بِالتَّمْرِ، وَالْمِلْحُ بِالْمِلْحِ كَيْلًا بِكَيْلٍ، وَالْفَضْلُ رِبًا»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

প্রচলিত অর্থে রিবাকে (ربوا) সুদ বলা হয়। রিবা’র আভিধানিক অর্থ অতিরিক্ত। কিন্তু শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশেষ ঐ অতিরিক্ত অংশ বা আধিক্যের নাম, যা দুটি মালের পরিবর্তে কোন বদল ব্যতীত দেয়া নেয়া হয়।
রিবা' মূলত দু'প্রকারঃ
এক. রিবা নাসিয়া (ربوا نسيه)। নগদ কোন বস্তুকে ধার বা কর্জ হিসেবে বদল করা এবং
দ্বিতীয়, রিবা ফদল (ربوا فضل)। মূলের থেকে অতিরিক্ত দিয়ে হাতে হাতে নগদ দেয়া নেয়া। সুদ (রিবা) হারাম হওয়া সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছেঃ وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا (আল্লাহ তা'আলা ক্রয়-বিক্রয় হালাল এবং সুদকে হারাম করেছেন)। এ আয়াতে রিবার (সুদ) আভিধানিক অর্থ সাধারণ অতিরিক্ত সর্ব সম্মতিক্রমে উদ্দেশ্য নয়,তা হলে কুরআনের আয়াতের বিষয়বস্তু সংক্ষিপ্ত হয়েছে যা ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে এবং হাদীসসমূহে এর ব্যাখ্যা রয়েছে। মূল হাদীসে আঁ হযরত (সা) স্বর্ণ, রৌপ্য, গম, যব, খেজুর ও লবণ এ ছয়টি বস্তুকে গণনা করেছেন। এ হাদীস হযরত উবাদা ইব্ন সামিত (রা) থেকে বর্ণিত আছে।

«الذَّهَبُ بِالذَّهَبِ، وَالْفِضَّةُ بِالْفِضَّةِ، وَالْبُرُّ بِالْبُرِّ، وَالشَّعِيرُ بِالشَّعِيرِ، وَالتَّمْرُ بِالتَّمْرِ، وَالْمِلْحُ بِالْمِلْحِ، مِثْلًا بِمِثْلٍ، سَوَاءً بِسَوَاءٍ، يَدًا بِيَدٍ، فَإِذَا اخْتَلَفَتْ هَذِهِ الْأَصْنَافُ، فَبِيعُوا كَيْفَ شِئْتُمْ، إِذَا كَانَ يَدًا بِيَدٍ»

“আঁ হযরত (সা) বলেছেন : স্বর্ণ স্বর্ণের পরিবর্তে, রূপা রূপার পরিবর্তে, গম গমের পরিবর্তে, যব যবের পরিবর্তে, খেজুর খেজুরের পরিবর্তে, লবণ লবণের পরিবর্তে সমান সমান এবং হাতে হাতে অর্থাৎ নগদ মূল্যে জায়েয। যদি এ সমস্ত বস্তুর পরস্পর রূপের পরিবর্তন হয়, তা হলে যেভাবে ইচ্ছা, ক্রয়-বিক্রয় করতে পার যখন তা হবে নগদ মূল্যে। বুখারী ব্যতীত সিহাহ সিত্তার অন্যান্য গ্রন্থে এ হাদীস বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বর্ণিত এ হাদীস একই বিষয়ে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত হয়েছে। মোট কথা, এ হাদীস ষোলজন সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে। আসহাবে যাহির (اصحاب ظاهر) যেহেতু ক্বিয়াস অস্বীকার করে থাকেন, তাঁরা এ হাদীসের বিধানকে বর্ণিত দু'টি বস্তুর উপর সীমাবদ্ধ রাখেন। কিন্তু ইমামগণ ক্বিয়াসের বিষয়টিও গ্রহণ করে। এতে বিধানের কারণ সন্ধান করেন এবং ত্রুটির সাথে হারামের বিধানকে অন্যদিকে নিয়ে যান।
এ বিধানের কারণ সন্ধানের ব্যাপারে ইমামগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। মোট কথা ইমামগণের মধ্যে মতপার্থক্যের কেন্দ্রবিন্দু হলো এ হাদীস। হারাম হওয়ার বিধানের কারণসমূহ নিয়ে আলোচনা ও জিজ্ঞাসার ফলে বিভিন্ন মাসয়ালার সূত্রপাত হয়েছে এবং এগুলোর উপর বিভিন্ন মাসয়ালার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন ইমাম আবূ হানীফা (র) সমস্ত হাদীসের দৃষ্টিকোণ থেকে কারণ (علت) হিসেবে দু'টি বস্তু নির্ধারণ করেছেন। এক হলো বস্তু বা জাতি (جنس), দ্বিতীয় হলো পরিমাণ (قدر)।قدر এর অর্থ হলো ওজন করা বস্তুর ওজন এবং দ্বিতীয় হলো পরিমাপ করা যায় এমন বস্তুর পরিমাপ। কেননা হাদীসে বর্ণিত مِثْلًا بِمِثْلٍ এর দ্বারা সাদৃশ্য বা একই রকম হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এ অতিরিক (زيادتى) ঐ সময় হারাম হবে যখন এ সমস্ত বস্তুর মধ্যে সাদৃশ্য (مما ثلت) হবে। মোট কথা হারাম হওয়ার ভিত্তি হলো সাদৃশ্য এবং একই জাতি থেকে গোপনীয়। সুতরাং এ বস্তুও পরিমাণের কারণের সাথে অতিরিক্ত (فضل) হারাম হওয়ার বিধান দূরীভূত হবে। যেখানে দু'টি অংশের কারণ বিদ্যমান থাকবে, সেখানে নগদের মধ্যে অতিরিক্ত হওয়াও অবৈধ হবে এবং ধারও অবৈধ হবে। যেমন- হাদীসে বর্ণিত বস্তুসমূহের মধ্যে স্বর্ণ স্বর্ণের পরিবর্তে, রৌপ্য-রৌপ্যের পরিবর্তে সমান-সমান এবং নগদ নগদ ইত্যাদি। যদি কারণের (علت) দুটি অংশ না পাওয়া যায় যে, বস্তুও এক নয় পরিমাণও এক নয়, তাহলে নগদের মধ্যে অতিরিক্ত জায়েয হবে, ধার ও নাসিয়াও জায়েয হবে। যেমন গম রৌপ্যের পরিবর্তে বিক্রি করা হলে তাতে উভয় পদ্ধতিতে জায়েয হবে। কেননা এখানে শুধু বস্তুই নয়, পরিমাণের ঐক্যও নেই, যেমন গম পরিমাপের এবং রৌপ্য ওজনের। যদি কারণ এক অংশে একইরূপ হয় এবং দ্বিতীয় অংশে মতপার্থক্য, তাহলে অতিরিক্ত জায়েয হবে। অর্থাৎ নগদই অতিরিক্ত নিয়ে বিক্রি করা যাবে। কিন্তু এখানে ধার জায়েয হবে না। যেমন গম ছোলার পরিবর্তে বিক্রি করা হলে অতিরিক্ত হালাল হবে এবং নাসিয়া হারাম অর্থাৎ নগদ নগদ অতিরিক্ত নেয়া দেয়া যাবে। ধারের উপর সওদা করা যাবে না। কেননা এখানে বস্তুর প্রকার ভিন্ন এবং পরিমাপ এক। কেননা গম এবং ছোলা উভয়ই পরিমাপের, অথবা যেমন ঘোড়া ঘোড়ার পরিবর্তে বিক্রি করতে গেলেও অতিরিক্ত জায়েয হবে। অর্থাৎ এক ঘোড়ার পরিবর্তে দুটি দেয়া অথবা নেয়া যাবে। কিন্তু নাসিয়া হারাম, কেননা এতে যদিও বস্তু এক কিন্তু পরিমাণ নেই। কেননা ঘোড়া পরিমাপেরও নয়, ওযনেরও নয়।
ইমাম আহমদ এক রিওয়ায়েতে ইমাম আবু হানীফার সাথে একমত পোষণ করেন। ইমাম শাফিঈ (র) হাদীসে বর্ণিত বস্তুসমূহের মধ্যে চারটি যথা : গম, যব, খেজুর, লবণ খাদ্যের উপাদান মনে করেন। কেননা এগুলো পানাহারের কাজে লাগে এবং স্বর্ণ-রৌপ্যে মূল্য আরোপিত হয়। এক রিওয়ায়েতে ইমাম আহমদ (র) তাঁদের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেন। ইমাম শাফিঈ (র) অতিরিক্ত দলীল হিসেবে অপর এক হাদীস পেশ করেছেন। তিনি মুসলিম শরীফে বর্ণিত মুআম্মার ইব্ন আবদুল্লাহ বর্ণিত হাদীস পেশ করেছেনঃ
كنت أسمع النبي صلى الله عليه وسلم يقول الطعام بالطعام مثلاً بمثل وكان طعامنا يومئذ الشعير
"আমি নবী করীম (সা)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন : খাদ্য খাদ্যের পরিবর্তে সমান সমান এবং ঐ সময় আমাদের খাদ্য ছিল যব বা বার্লি।”
এখানে খাদ্য কারণ (علت) হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। তাঁদের মতে তরকারি, ফলমূল এবং ঔষধের মধ্যে অতিরিক্ত সুদ হবে। কেননা এতে খাদ্য ও রিযিক রয়েছে কিন্তু লোহা, তামা, পিতল, চুন ইত্যাদির মধ্যে সুদ হবে না। এগুলোর মধ্যে একই বস্তু অতিরিক্ত হলেও বিক্রি জায়েয হবে।
ইমান মালিক (র) হাদীসে বর্ণিত এ চার বস্তুর মধ্যে সুদ হওয়ার কারণ রিযিক ও সঞ্চয় বা জমা করা যায় বলে মনে করেন। অর্থাৎ যে সমস্ত বস্তু সঞ্চয় ও জমা করা যায়, এরূপ চার বস্তুর মধ্যে সুদ হারাম এবং যেগুলো জমা করা যায় না, এগুলোর মধ্যে সুদ হবে না। কেননা তাঁরা বলেন যে, আঁ হযরত (সা) ঐ সমস্ত বস্তুর মধ্যে অতিরিক্ত হারাম হওয়া সম্পর্কে বলেছেন, যেগুলো খাদ্য ও রিযিক হতে পারে এবং সঞ্চয় করার উপযুক্ত। সুতরাং এটাই কারণ (علت) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি। এর উপর ভিত্তি করে তরকারি, ফলমূল এবং পানাহারের ঐ সমস্ত দ্রব্য যা রাখা যায় না, তাঁদের মতে এগুলোর মধ্যে সুদ হবে না। এগুলোর মধ্যে একটি দুটির পরিবর্তে নেয়া দেয়া যায়। স্বর্ণ ও রৌপ্যের মধ্যে তাঁদের মতে মূল্য রয়েছে। এ বিষয়ে তাঁরা ইমাম শাফিঈ (র)-এর সাথে একমত পোষণ করেছেন। ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মত অনুযায়ী প্রথম কারণ (علت اول) বর্ণিত হাদীস অথবা উবাদা ইব্ন সামিত (রা) বর্ণিত হাদীসের বাক্য -এর দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ হয়েছে। এছাড়া ইমাম আবু হানীফা (রা)-এর এটা শুধু ক্বিয়াসই নয়, বরং তাঁর ক্বিয়াস স্পষ্ট আয়াতের সাথেও মিলে যায়, যাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। সুতরাং দারে কুতনী এবং বাযযার হযরত উবাদা ও হযরত আনাস (রা) থেকে মরফু হাদীস বর্ণনা করেছেন যা এ রিবার হাদীসের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা এবং ইমাম আবু হানীফা (র)-এর ক্বিয়াসের সুস্পষ্ট দলীল। হাদীসের বাক্য হলোঃ
انه صلى الله عليه وسلم قال كل مايوزن مثل بمثل إذا كان من نوع واحد ومايكال مثله واذا اختلفا النوعان فلا بأس به
“নবী করীম (সা) বলেছেন: ওযন করা যায় এমন প্রত্যেকটি বস্তু যখন সমান সমান হবে,তখন তা একই প্রকার বস্তু হয়। এমনিভাবে যে সমস্ত দ্রব্য মাপা যায়, তাও এ বিধানের অন্তর্ভুক্ত। যখন বস্তু বিভিন্ন প্রকারের হওয়ার কারণে পার্থক্য হয়, তা হলে কোন সমস্যা নেই।
এবার ইমাম শাফিঈ (র)-এর দলীল মুআম্মার (রা) বর্ণিত হাদীসে মুকাবিলায় হানাফীদের নিকট নবী করীম (সা)-এর এ সাধারণ নির্দেশ :
لا تبيعوا الدرهم بالدرهمين ولا الصاع بالصاعين
“এক দিরহামের পরিবর্তে দু'দিরহাম এবং এক সা' এর পরিবর্তে দু’ সা বিক্রি করো না, যা খাদ্য ও অখাদ্য সবকিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে। সুতরাং ইমাম আবূ হানীফার কিয়াস যথার্থ।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান