আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৫০- নবীজীর সাঃ যুদ্ধাভিযানসমূহ
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৪৪৬২
২২৪৭. নবী কারীম (ﷺ)- এর রোগ ও তাঁর ওফাত।
৪১১১। সুলাইমান ইবনে হারব (রাহঃ) .... আনাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন নবী কারীম (ﷺ)- এর রোগ প্রকটরূপ ধারণ করে তখন তিনি বেহুশ হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় ফাতিমা (রাযিঃ) বললেন, উহ! আমার পিতার উপর কত কষ্ট! তখন নবী কারীম (ﷺ) তাঁকে বললেন, আজকের পরে তোমার পিতার উপর আর কোন কষ্ট নেই। যখন তিনি ইন্তিকাল করলেন তখন ফাতিমা (রাযিঃ) বললেন, হায়! আমার পিতা! রবের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। হায় আমার পিতা! জান্নাতুল ফিরদাউসে তাঁর বাসস্থান। হায় পিতা! জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম)- কে তাঁর ইন্তিকালের খবর পরিবেশন করছি। যখন নবী কারীম (ﷺ)- কে সমাহিত করা হল, তখন ফাতিমা (রাযিঃ) বললেন, হে আনাস! রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- কে মাটি চাপা দিতে কি করে তোমাদের প্রাণ সায় দিল।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছেও সবর সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আছে। এতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুযন্ত্রণা এবং তাতে হযরত ফাতিমা রাযি.-এর শোকার্ত হয়ে পড়ার বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। দু'টি বিষয়ই আমাদের ভালোভাবে বুঝে নেওয়া দরকার।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুযন্ত্রণা
কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন আল্লাহর হাবীব। তাঁর সর্বাপেক্ষা প্রিয় সৃষ্টি। তাঁর কেন মৃত্যুযন্ত্রণা হবে?
উত্তর : দুনিয়ায় সুখ-শান্তি পাওয়া আল্লাহ তা'আলার প্রিয় হওয়ার এবং দুঃখ-কষ্টে পড়া তার অপ্রিয় হওয়ার প্রমাণ বহন করে না। উভয়টিই আল্লাহর পরীক্ষা। এতে পাশ করতে পারলে উভয়টি আল্লাহ তা'আলার অতি বড় নি'আমত হয়ে যায়। বরং নি'আমত হিসেবে দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-আপদেরই মর্যাদা বেশি, যদিও তা চেয়ে নেওয়া ঠিক নয়। এক হাদীছে ইরশাদ-
من يرد الله به خيرا يصب منه
‘আল্লাহ তা'আলা যার কল্যাণ চান তাকে বিপদ-আপদ দেন। আল্লাহপ্রদত্ত সেই বিপদ-আপদে বান্দা ধৈর্যধারণ করে। ফলে আল্লাহ তা'আলার কাছে সে প্রভূত ছওয়াবের অধিকারী হয় এবং তাঁর অকল্পনীয় নৈকট্য লাভ করে। এভাবে বিপদ-আপদ তার পক্ষে আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য লাভের উপায় হয়ে যায়। যেমন এক হাদীছে আছে, যখন আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে বান্দার জন্যে বিশেষ কোনও মর্যাদা স্থিরীকৃত থাকে আর বান্দা নিজ আমল দ্বারা সেখানে পৌঁছতে না পারে, তখন আল্লাহ তা'আলা তার শরীরে বা সম্পদে বা সন্তান-সন্ততিতে কোনও বিপদ দান করেন এবং তাতে তাকে ধৈর্যধারণের তাওফীক দেন। আর এভাবে তিনি তাকে পূর্বস্থিরীকৃত সেই মর্যাদায় পৌঁছে দেন। অপর এক হাদীছে আছে-
أشد الناس بلاء الأنبياء ثم الأمثل فالأمثل
‘মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা কঠিন পরীক্ষা বা কঠিন বিপদ-আপদ হয় নবীগণের। তারপর যারা তাদের সর্বাপেক্ষা বেশি অনুসারী তাদের এবং তারপর পর্যায়ক্রমে পরবর্তীদের।
সন্দেহ নেই নবী-রাসূল ও তাঁদের প্রকৃত অনুসারীদের এ পরীক্ষা ও বিপদ-আপদ তাদের মর্যাদাবৃদ্ধির জন্যই হত। মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা যেহেতু সকলের ঊর্ধ্বে এবং নাজানি আল্লাহ তা'আলার নৈকট্যের কোন উচ্চতায় তাঁর আসন নির্ধারিত, সেহেতু বিপদ-আপদ দ্বারা তাঁর পরীক্ষাও নেওয়া হয়েছে সর্বাপেক্ষা কঠিন। উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, কেবলই নৈকট্যের সেই উচ্চতায় তাঁকে পৌঁছানো এবং অকল্পনীয় মর্যাদার আসনে তাঁকে অধিষ্ঠিত করা।
প্রশ্ন হতে পারে, কোনও কোনও আল্লাহওয়ালা বুযুর্গকে তো আরামের মৃত্যুবরণ করতে দেখা যায়। মৃত্যুকালে তার কোনও কষ্ট চোখে পড়ে না। আবার অনেক সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও দেখা যায় কোনও রকম মৃত্যুযন্ত্রণা তারা ভোগ করে না। তাদের ক্ষেত্রে এই ব্যতিক্রম কেন?
উত্তর : সাধারণ লোকের ব্যাপারে তো উত্তর স্পষ্ট। হয়তো তাদের জন্য বিশেষ কোনও মর্যাদা নির্দিষ্ট নেই যে, বিপদ-আপদ দিয়ে তাদেরকে সেখানে পৌঁছানো হবে। আর বুযুর্গানে দীনের ক্ষেত্রে সকলের জন্যে আল্লাহ তা'আলার নীতি এক রকম নয়। আল্লাহওয়ালাদের অবস্থাভেদে আচরণ বিভিন্ন হয়ে থাকে। সবর করার শক্তি সকলের সমান থাকে না। যাদের সেই শক্তি দুর্বল, আল্লাহ তা'আলা দয়াপরবশ হয়ে তাদেরকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেন না। তাদের মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে হয়তো অন্য কোনও ব্যবস্থা গৃহীত হয়। নবীগণের সংগে অন্য কোনও ব্যক্তির তুলনা করা যায় না, তা তিনি যত বড় বুযুর্গই হন। সবর ও ধৈর্যশক্তি দাওয়াতী কার্যক্রমের এক অপরিহার্য শর্ত। নবী যেহেতু আসল দাওয়াতদাতা, তাই এ শক্তি তাঁদের মধ্যে থাকত সর্বাপেক্ষা বেশি। ফলে কঠিন কঠিন পরীক্ষায় তাদের উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব ছিল। সাধারণ লোকদের যেহেতু তাঁদের মত শক্তি নেই আর যতটুকুও থাকে তাতে সকলে সমস্তরের নয়, তাই তাদের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা'আলার আচরণ নবীগণের মত হয় না। তাদের একেকজনের বেলায় একেক রকম আচরণ হয়। এ কারণেই তাদের মৃত্যুকালীন অবস্থাও হয় বিভিন্নরকম। এর দ্বারা তাদের মর্যাদাগত পার্থক্য নির্ণয় করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ মৃত্যুযন্ত্রণা কম-বেশি হওয়ার দ্বারা কারও বুযুর্গ হওয়া না হওয়া নির্ণয় করা যায় না। তাই মৃত্যুযন্ত্রণার ভিত্তিতে কারও সম্পর্কে মন্তব্য করা ঠিক নয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুত্র-কন্যাদের মধ্যে একমাত্র হযরত ফাতিমা রাযি.-ই তাঁর ওফাতকালে জীবিত ছিলেন। তিনি ছাড়া আর সকলের ইন্তিকাল বহু আগেই হয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্নেহ-মমতা সর্বাপেক্ষা বেশি তিনিই পেয়েছিলেন। একদিকে তিনি ছিলেন একজন বিদুষী, পুণ্যবতী ও অত্যন্ত গুণবতী নারী। তিনি জান্নাতী নারীদের শ্রেষ্ঠতম। অপরদিকে পিতা হচ্ছেন সায়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন। এমন পিতা-কন্যার পারস্পরিক ভালোবাসা কী গভীর হবে সহজেই অনুমেয়। এমনিতেও নারীর মন বড় নরম। মা- বাবার ওফাতে পুত্র অপেক্ষা কন্যাকেই বেশি অস্থির হতে দেখা যায়। সেই ওফাত যদি হয় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের মত পিতার, আর তা হয় হযরত ফাতিমা রাযি.-এর মত মহিয়সী কন্যার চোখের সামনে, তখন তার বিরহবেদনা কতটা হৃদয়বিদারক হতে পারে তা কি ভাবা যায়? জনৈক কবি তার এ মনোবেদনার কথা। এভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন— صُبت عليَّ مصائب لو أنها ... صُبتْ على الأيام صِرْنَ لَيَالِيَا
'পিতৃবিয়োগের যে মসিবত আমার উপর পড়েছে, তা যদি পড়ত দিনগুলির উপর, তবে সব দিন অন্ধকার রাত হয়ে যেত।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রিয় কন্যাকে আগেই বলে দিয়েছিলেন যে, তিনি আর বেশি দিন দুনিয়ায় থাকবেন না। খুব শীঘ্রই বিদায় নিয়ে চলে যাবেন। সেই চলে যাওয়ার পূর্বাভাস মাতৃমতি কন্যা নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছেন। তিনি দেখছেন পিতার কত কষ্ট। দেখছেন তাঁর যন্ত্রণা, যে যন্ত্রণা লাঘব করার কোনও উপায় তাঁর হাতে নেই। অসহায় চোখে দেখে যাওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই। কেবল রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা, কখন যেন শেষ নিঃশ্বাসের ক্ষণ এসে যায়! পরম পিতার জীবন-মৃত্যুর এই শেষ সন্ধিক্ষণে নাজানি কি তোলপাড়ই চলছিল হযরত ফাতিমা রাযি.-এর হৃদয়মনে! তারই কিঞ্চিত প্রকাশ ছিল তাঁর এই কথার ভেতর যে, আহা! আমার আব্বার কত কষ্ট!
হযরত ফাতিমা রাযি. ছিলেন রাসূলপিতার শিক্ষার প্রতিচ্ছবি। দীনের যাবতীয় বিষয়েই তিনি শিক্ষা পেয়েছিলেন। কোনও অবস্থায়ই তাঁর দ্বারা সেই শিক্ষার ব্যতিক্রম হত না। পিতৃবিয়োগের মত জীবনের সর্বাপেক্ষা হৃদয়বিদারক এই মুহূর্তেও তার ব্যতিক্রম করেননি। এ সময়ের প্রধান কাজ সবর করা। তিনি যথার্থ সবরই করেছিলেন। যে ক'টি বাক্য এ সময়ে তাঁর মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে, তার কোনওটিই সবরের সীমা অতিক্রম করেনি। শোকে-দুঃখে মনে বেদনাবোধ হওয়া, চোখ থেকে পানি পড়া এবং মুখে বেদনাব্যঞ্জক কথা উচ্চারণ করা সবরের পরিপন্থী নয়। এটা স্বভাবগত ব্যাপার। স্বভাবগত ব্যাপারে দোষ নেই, যতক্ষণ তা শরী'আতের সীমার মধ্যে থাকে। হযরত ফাতিমা রাযি. সেই সীমা অতিক্রম করেননি। উচ্চস্বরে চিৎকার করেননি, আল্লাহর ফয়সালায় আপত্তি জানাননি এবং আপত্তিকর কোনও কাজই করেননি। তিনি নিজ আচরণ দ্বারা আমাদের জন্য এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন যে, পিতামাতার ইন্তিকালে শোকার্ত সন্তানদের কিভাবে ধৈর্য রক্ষা করতে হবে।
শোকার্ত কন্যাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বলে সান্ত্বনা দান করেন যে, আজকের পর তোমার পিতার আর কোনও কষ্ট নেই। কেননা তিনি যেহেতু কষ্ট-ক্লেশের এই জগত ছেড়ে আখিরাতের পথে পা বাড়াচ্ছেন, সেহেতু এই কষ্টই তাঁর শেষ কষ্ট। মু'মিনদের জন্যে আখিরাত তো শান্তির নিবাস। দুনিয়া তার কারাগার। এখানে যতদিন থাকবে, কষ্ট-ক্লেশের সংগেই থাকতে হবে। এক বর্ণনায় আছে-
لا رَاحَةَ لِلْمُؤْمِن دُونَ لِقَاءِ رَبِّهِ
'মু'মিনের পক্ষে তার প্রতিপালকের সাক্ষাতলাভের আগে কোনও শান্তি নেই।” মুমিনের জন্য শান্তির জায়গা হচ্ছে আখিরাত। সেখানে কোনওরকম কষ্ট-ক্লেশ মু'মিনদের স্পর্শ করবে না। প্রিয়নবী তো সায়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল-মুরসালীন। তিনি যাচ্ছেন পরমপ্রিয়ের সাক্ষাতে আল্লাহ রাব্বুল 'আলামীনের কাছে। তিনি বার বার বলছিলেন-
اللهم الرفيق الأعلى، اللهم الرفيق الأعلى
“হে আল্লাহ! হে মহান বন্ধু!' তিনি তখন মহান বন্ধু আল্লাহ তা'আলার সাক্ষাত লাভের জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। কাজেই তাঁর এ যাত্রা তো আনন্দের যাত্রা। এ যাত্রায় কবর থেকে জান্নাতুল ফিরদাওস পর্যন্ত কোথাও তাঁর কোনওরকম কষ্টের সম্মুখীন হওয়ার প্রশ্নই আসে না । প্রতিটি ঘাঁটিই হবে তাঁর পক্ষে পরম শান্তিময় ও চূড়ান্ত রকমের স্বস্তিকর। সুতরাং ওহে প্রিয় কন্যা! তুমি আক্ষেপ করো না। তোমার পিতার জীবনে কষ্টের পালা শেষ। এরপর শুধু সুখই সুখ।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত হয়ে গেল। তাঁর ওফাত তাঁর প্রিয় সাহাবীগণের পক্ষে কতটা মর্মান্তিক ছিল তা সকলেরই জানা। হযরত ফাতিমা রাখি, সাহারীমাত্র নন। আদরের কন্যা। তাঁর পক্ষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত কতটা হৃদয়বিদারী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু দুর্বিষহ মর্মযাতনা সত্ত্বেও তিনি সবরের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন। তিনি বলছিলেন, আহা! আমার আব্বা তাঁর রব্বের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন। অর্থাৎ এই বলে তিনি প্রকারান্তরে আল্লাহর ফয়সালায় নিজ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তিনি বোঝাচ্ছেন, তাঁর এ যাওয়া আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়া মাত্র। এটা আল্লাহর ফয়সালা। তাঁর ফয়সালা শিরোধার্য করাই সকলের কর্তব্য।
তারপর বলছেন, জান্নাতুল ফিরদাওস তাঁর ঠিকানা। 'জান্নাতুল ফিরদাওস' জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তরের নাম। আল্লাহ তা'আলার আরশ তার ছাদ। সর্বোচ্চ স্তরের মু'মিনগণ তা লাভ করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
فإذا سألتم الله فسلوه الفردوس، فإنه أوسط الجنة، وأعلى الجنة
“তোমরা যখন আল্লাহর কাছে চাবে তখন ফিরদাওস চেয়ো, কেননা এটা জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তর।” বলাবাহুল্য, ফিরদাওসের মধ্যেও বিভিন্ন স্তর থাকবে। তার শ্রেষ্ঠতম স্থানে থাকবেন নবী-রাসূলগণ নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থান হবে সর্বোচ্চ। তিনি আরও বলছিলেন, আমরা জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে তাঁর মৃত্যু সংবাদ শোনাব। এর দ্বারা পরোক্ষভাবে হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামের আগমন ও ওহী নাযিলের ধারা বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্যে আক্ষেপ প্রকাশ করা হচ্ছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম যতদিন জীবিত ছিলেন, হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম সকাল-সন্ধ্যা তাঁর কাছে ওহী নিয়ে আসতেন। ওহী আল্লাহর রহমত। তাঁর সে আসা হত রহমত নিয়ে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম চলে যাওয়ায় তাঁর সেই আসার আর কোনও অবকাশ থাকল না। তার মানে ওহীরূপের রহমত নাযিলের ধারা আর বর্ষিত হবে না। এটা আক্ষেপের বিষয়ই বটে। তবে এটা ভিন্ন কথা যে, তাঁর না আসায় মানুষের হিদায়াত লাভের পক্ষে কোনও অসুবিধা দেখা দেবে না। কারণ কুরআন নাযিলের মাধ্যমে মানুষকে পরিপূর্ণ হিদায়াত দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাফন-কাফন সমাপ্ত হয়ে যাওয়ার পর তিনি হযরত আনাস রাযি.-কে লক্ষ্য করে বললেন, ওহে আনাস! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর মাটি নিক্ষেপ করতে তোমাদের মন সায় দিল? এটা ছিল তাঁর মনের প্রচণ্ড শোক ও বেদনার বহিঃপ্রকাশ। এটা সত্যিকারের কোনও আপত্তি ছিল না। কিভাবেই বা আপত্তি করবেন, যখন তাঁর জানা যে, এটাই আল্লাহর বিধান এবং এটাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা? এবং যখন তাঁর জানা আছে সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কতটা ভালোবাসেন? তারা তো পারলে তাকে মাটির কবরে সমাহিত করবেন কি. বরং তাকে রক্ষার জন্যে নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করে দিতেন। কিন্তু এটা যে আল্লাহর ফয়সালা, যা বুকে পাষাণের ভার চাপিয়ে তাঁরা মানতে বাধ্য ছিলেন। হযরত আনাস রাযি.-ও ঢের বুঝেছিলেন যে, তাঁর এ কথা আপত্তির জন্য নয়, কেবল শোকের বহিঃপ্রকাশ। তাই তিনি এর কোনও জবাব না দিয়ে নীরব থেকেছিলেন। নীরবতা অবলম্বন ছাড়া এ প্রশ্নের কি কোনও উত্তর হয়?
প্রশ্ন হতে পারে, সবরের সংগে এ হাদীছের কী সম্পর্ক? এর উত্তর স্পষ্ট। কেননা প্রচণ্ড মৃত্যুযাতনা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। এমনকি প্রিয় কন্যা শোকার্ত হয়ে পড়লে তিনি তাঁকে সান্ত্বনা যুগিয়েছেন। হযরত ফাতিমা রাযি. নিজেও শোকসন্তপ্ত হওয়া সত্ত্বেও ধৈর্যের পরিপন্থী কোনও কাজ করেননি।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. মানুষ মাত্রই মরণশীল, নবী-রাসূলগণও যার আওতাধীন।
খ. মৃত্যুযন্ত্রণার বিষয়টা সকলেরই আছে। এটা মাথায় রেখেই সকলের কাজ করা উচিত।
গ. মৃত্যুকালীন অবস্থা দেখে কারও ভালো-মন্দ হওয়ার বিচার করা যায় না।
ঘ. প্রত্যেকের মৃত্যু যথাসময়েই হয় এবং আল্লাহ তা'আলার ফয়সালা অনুযায়ীই হয় । তা মেনে নেওয়াই সকলের কর্তব্য।
ঙ. প্রিয়জনের মৃত্যুতে ব্যথিত হওয়া ও কান্নাকাটি করা কিংবা শোক ও বেদনামূলক কথা বলা দোষের নয়। তবে সর্বাবস্থায় শরী'আতের সীমা রক্ষা করা কর্তব্য।
চ. মৃত ব্যক্তি যেই হোক না কেন, তাকে মাটিতে দাফন করাই শরী'আতের বিধান।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুযন্ত্রণা
কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন আল্লাহর হাবীব। তাঁর সর্বাপেক্ষা প্রিয় সৃষ্টি। তাঁর কেন মৃত্যুযন্ত্রণা হবে?
উত্তর : দুনিয়ায় সুখ-শান্তি পাওয়া আল্লাহ তা'আলার প্রিয় হওয়ার এবং দুঃখ-কষ্টে পড়া তার অপ্রিয় হওয়ার প্রমাণ বহন করে না। উভয়টিই আল্লাহর পরীক্ষা। এতে পাশ করতে পারলে উভয়টি আল্লাহ তা'আলার অতি বড় নি'আমত হয়ে যায়। বরং নি'আমত হিসেবে দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-আপদেরই মর্যাদা বেশি, যদিও তা চেয়ে নেওয়া ঠিক নয়। এক হাদীছে ইরশাদ-
من يرد الله به خيرا يصب منه
‘আল্লাহ তা'আলা যার কল্যাণ চান তাকে বিপদ-আপদ দেন। আল্লাহপ্রদত্ত সেই বিপদ-আপদে বান্দা ধৈর্যধারণ করে। ফলে আল্লাহ তা'আলার কাছে সে প্রভূত ছওয়াবের অধিকারী হয় এবং তাঁর অকল্পনীয় নৈকট্য লাভ করে। এভাবে বিপদ-আপদ তার পক্ষে আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য লাভের উপায় হয়ে যায়। যেমন এক হাদীছে আছে, যখন আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে বান্দার জন্যে বিশেষ কোনও মর্যাদা স্থিরীকৃত থাকে আর বান্দা নিজ আমল দ্বারা সেখানে পৌঁছতে না পারে, তখন আল্লাহ তা'আলা তার শরীরে বা সম্পদে বা সন্তান-সন্ততিতে কোনও বিপদ দান করেন এবং তাতে তাকে ধৈর্যধারণের তাওফীক দেন। আর এভাবে তিনি তাকে পূর্বস্থিরীকৃত সেই মর্যাদায় পৌঁছে দেন। অপর এক হাদীছে আছে-
أشد الناس بلاء الأنبياء ثم الأمثل فالأمثل
‘মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা কঠিন পরীক্ষা বা কঠিন বিপদ-আপদ হয় নবীগণের। তারপর যারা তাদের সর্বাপেক্ষা বেশি অনুসারী তাদের এবং তারপর পর্যায়ক্রমে পরবর্তীদের।
সন্দেহ নেই নবী-রাসূল ও তাঁদের প্রকৃত অনুসারীদের এ পরীক্ষা ও বিপদ-আপদ তাদের মর্যাদাবৃদ্ধির জন্যই হত। মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা যেহেতু সকলের ঊর্ধ্বে এবং নাজানি আল্লাহ তা'আলার নৈকট্যের কোন উচ্চতায় তাঁর আসন নির্ধারিত, সেহেতু বিপদ-আপদ দ্বারা তাঁর পরীক্ষাও নেওয়া হয়েছে সর্বাপেক্ষা কঠিন। উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, কেবলই নৈকট্যের সেই উচ্চতায় তাঁকে পৌঁছানো এবং অকল্পনীয় মর্যাদার আসনে তাঁকে অধিষ্ঠিত করা।
প্রশ্ন হতে পারে, কোনও কোনও আল্লাহওয়ালা বুযুর্গকে তো আরামের মৃত্যুবরণ করতে দেখা যায়। মৃত্যুকালে তার কোনও কষ্ট চোখে পড়ে না। আবার অনেক সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও দেখা যায় কোনও রকম মৃত্যুযন্ত্রণা তারা ভোগ করে না। তাদের ক্ষেত্রে এই ব্যতিক্রম কেন?
উত্তর : সাধারণ লোকের ব্যাপারে তো উত্তর স্পষ্ট। হয়তো তাদের জন্য বিশেষ কোনও মর্যাদা নির্দিষ্ট নেই যে, বিপদ-আপদ দিয়ে তাদেরকে সেখানে পৌঁছানো হবে। আর বুযুর্গানে দীনের ক্ষেত্রে সকলের জন্যে আল্লাহ তা'আলার নীতি এক রকম নয়। আল্লাহওয়ালাদের অবস্থাভেদে আচরণ বিভিন্ন হয়ে থাকে। সবর করার শক্তি সকলের সমান থাকে না। যাদের সেই শক্তি দুর্বল, আল্লাহ তা'আলা দয়াপরবশ হয়ে তাদেরকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেন না। তাদের মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে হয়তো অন্য কোনও ব্যবস্থা গৃহীত হয়। নবীগণের সংগে অন্য কোনও ব্যক্তির তুলনা করা যায় না, তা তিনি যত বড় বুযুর্গই হন। সবর ও ধৈর্যশক্তি দাওয়াতী কার্যক্রমের এক অপরিহার্য শর্ত। নবী যেহেতু আসল দাওয়াতদাতা, তাই এ শক্তি তাঁদের মধ্যে থাকত সর্বাপেক্ষা বেশি। ফলে কঠিন কঠিন পরীক্ষায় তাদের উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব ছিল। সাধারণ লোকদের যেহেতু তাঁদের মত শক্তি নেই আর যতটুকুও থাকে তাতে সকলে সমস্তরের নয়, তাই তাদের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা'আলার আচরণ নবীগণের মত হয় না। তাদের একেকজনের বেলায় একেক রকম আচরণ হয়। এ কারণেই তাদের মৃত্যুকালীন অবস্থাও হয় বিভিন্নরকম। এর দ্বারা তাদের মর্যাদাগত পার্থক্য নির্ণয় করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ মৃত্যুযন্ত্রণা কম-বেশি হওয়ার দ্বারা কারও বুযুর্গ হওয়া না হওয়া নির্ণয় করা যায় না। তাই মৃত্যুযন্ত্রণার ভিত্তিতে কারও সম্পর্কে মন্তব্য করা ঠিক নয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুত্র-কন্যাদের মধ্যে একমাত্র হযরত ফাতিমা রাযি.-ই তাঁর ওফাতকালে জীবিত ছিলেন। তিনি ছাড়া আর সকলের ইন্তিকাল বহু আগেই হয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্নেহ-মমতা সর্বাপেক্ষা বেশি তিনিই পেয়েছিলেন। একদিকে তিনি ছিলেন একজন বিদুষী, পুণ্যবতী ও অত্যন্ত গুণবতী নারী। তিনি জান্নাতী নারীদের শ্রেষ্ঠতম। অপরদিকে পিতা হচ্ছেন সায়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন। এমন পিতা-কন্যার পারস্পরিক ভালোবাসা কী গভীর হবে সহজেই অনুমেয়। এমনিতেও নারীর মন বড় নরম। মা- বাবার ওফাতে পুত্র অপেক্ষা কন্যাকেই বেশি অস্থির হতে দেখা যায়। সেই ওফাত যদি হয় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের মত পিতার, আর তা হয় হযরত ফাতিমা রাযি.-এর মত মহিয়সী কন্যার চোখের সামনে, তখন তার বিরহবেদনা কতটা হৃদয়বিদারক হতে পারে তা কি ভাবা যায়? জনৈক কবি তার এ মনোবেদনার কথা। এভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন— صُبت عليَّ مصائب لو أنها ... صُبتْ على الأيام صِرْنَ لَيَالِيَا
'পিতৃবিয়োগের যে মসিবত আমার উপর পড়েছে, তা যদি পড়ত দিনগুলির উপর, তবে সব দিন অন্ধকার রাত হয়ে যেত।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রিয় কন্যাকে আগেই বলে দিয়েছিলেন যে, তিনি আর বেশি দিন দুনিয়ায় থাকবেন না। খুব শীঘ্রই বিদায় নিয়ে চলে যাবেন। সেই চলে যাওয়ার পূর্বাভাস মাতৃমতি কন্যা নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছেন। তিনি দেখছেন পিতার কত কষ্ট। দেখছেন তাঁর যন্ত্রণা, যে যন্ত্রণা লাঘব করার কোনও উপায় তাঁর হাতে নেই। অসহায় চোখে দেখে যাওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই। কেবল রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা, কখন যেন শেষ নিঃশ্বাসের ক্ষণ এসে যায়! পরম পিতার জীবন-মৃত্যুর এই শেষ সন্ধিক্ষণে নাজানি কি তোলপাড়ই চলছিল হযরত ফাতিমা রাযি.-এর হৃদয়মনে! তারই কিঞ্চিত প্রকাশ ছিল তাঁর এই কথার ভেতর যে, আহা! আমার আব্বার কত কষ্ট!
হযরত ফাতিমা রাযি. ছিলেন রাসূলপিতার শিক্ষার প্রতিচ্ছবি। দীনের যাবতীয় বিষয়েই তিনি শিক্ষা পেয়েছিলেন। কোনও অবস্থায়ই তাঁর দ্বারা সেই শিক্ষার ব্যতিক্রম হত না। পিতৃবিয়োগের মত জীবনের সর্বাপেক্ষা হৃদয়বিদারক এই মুহূর্তেও তার ব্যতিক্রম করেননি। এ সময়ের প্রধান কাজ সবর করা। তিনি যথার্থ সবরই করেছিলেন। যে ক'টি বাক্য এ সময়ে তাঁর মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে, তার কোনওটিই সবরের সীমা অতিক্রম করেনি। শোকে-দুঃখে মনে বেদনাবোধ হওয়া, চোখ থেকে পানি পড়া এবং মুখে বেদনাব্যঞ্জক কথা উচ্চারণ করা সবরের পরিপন্থী নয়। এটা স্বভাবগত ব্যাপার। স্বভাবগত ব্যাপারে দোষ নেই, যতক্ষণ তা শরী'আতের সীমার মধ্যে থাকে। হযরত ফাতিমা রাযি. সেই সীমা অতিক্রম করেননি। উচ্চস্বরে চিৎকার করেননি, আল্লাহর ফয়সালায় আপত্তি জানাননি এবং আপত্তিকর কোনও কাজই করেননি। তিনি নিজ আচরণ দ্বারা আমাদের জন্য এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন যে, পিতামাতার ইন্তিকালে শোকার্ত সন্তানদের কিভাবে ধৈর্য রক্ষা করতে হবে।
শোকার্ত কন্যাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বলে সান্ত্বনা দান করেন যে, আজকের পর তোমার পিতার আর কোনও কষ্ট নেই। কেননা তিনি যেহেতু কষ্ট-ক্লেশের এই জগত ছেড়ে আখিরাতের পথে পা বাড়াচ্ছেন, সেহেতু এই কষ্টই তাঁর শেষ কষ্ট। মু'মিনদের জন্যে আখিরাত তো শান্তির নিবাস। দুনিয়া তার কারাগার। এখানে যতদিন থাকবে, কষ্ট-ক্লেশের সংগেই থাকতে হবে। এক বর্ণনায় আছে-
لا رَاحَةَ لِلْمُؤْمِن دُونَ لِقَاءِ رَبِّهِ
'মু'মিনের পক্ষে তার প্রতিপালকের সাক্ষাতলাভের আগে কোনও শান্তি নেই।” মুমিনের জন্য শান্তির জায়গা হচ্ছে আখিরাত। সেখানে কোনওরকম কষ্ট-ক্লেশ মু'মিনদের স্পর্শ করবে না। প্রিয়নবী তো সায়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল-মুরসালীন। তিনি যাচ্ছেন পরমপ্রিয়ের সাক্ষাতে আল্লাহ রাব্বুল 'আলামীনের কাছে। তিনি বার বার বলছিলেন-
اللهم الرفيق الأعلى، اللهم الرفيق الأعلى
“হে আল্লাহ! হে মহান বন্ধু!' তিনি তখন মহান বন্ধু আল্লাহ তা'আলার সাক্ষাত লাভের জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। কাজেই তাঁর এ যাত্রা তো আনন্দের যাত্রা। এ যাত্রায় কবর থেকে জান্নাতুল ফিরদাওস পর্যন্ত কোথাও তাঁর কোনওরকম কষ্টের সম্মুখীন হওয়ার প্রশ্নই আসে না । প্রতিটি ঘাঁটিই হবে তাঁর পক্ষে পরম শান্তিময় ও চূড়ান্ত রকমের স্বস্তিকর। সুতরাং ওহে প্রিয় কন্যা! তুমি আক্ষেপ করো না। তোমার পিতার জীবনে কষ্টের পালা শেষ। এরপর শুধু সুখই সুখ।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত হয়ে গেল। তাঁর ওফাত তাঁর প্রিয় সাহাবীগণের পক্ষে কতটা মর্মান্তিক ছিল তা সকলেরই জানা। হযরত ফাতিমা রাখি, সাহারীমাত্র নন। আদরের কন্যা। তাঁর পক্ষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত কতটা হৃদয়বিদারী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু দুর্বিষহ মর্মযাতনা সত্ত্বেও তিনি সবরের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন। তিনি বলছিলেন, আহা! আমার আব্বা তাঁর রব্বের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন। অর্থাৎ এই বলে তিনি প্রকারান্তরে আল্লাহর ফয়সালায় নিজ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তিনি বোঝাচ্ছেন, তাঁর এ যাওয়া আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়া মাত্র। এটা আল্লাহর ফয়সালা। তাঁর ফয়সালা শিরোধার্য করাই সকলের কর্তব্য।
তারপর বলছেন, জান্নাতুল ফিরদাওস তাঁর ঠিকানা। 'জান্নাতুল ফিরদাওস' জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তরের নাম। আল্লাহ তা'আলার আরশ তার ছাদ। সর্বোচ্চ স্তরের মু'মিনগণ তা লাভ করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
فإذا سألتم الله فسلوه الفردوس، فإنه أوسط الجنة، وأعلى الجنة
“তোমরা যখন আল্লাহর কাছে চাবে তখন ফিরদাওস চেয়ো, কেননা এটা জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তর।” বলাবাহুল্য, ফিরদাওসের মধ্যেও বিভিন্ন স্তর থাকবে। তার শ্রেষ্ঠতম স্থানে থাকবেন নবী-রাসূলগণ নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থান হবে সর্বোচ্চ। তিনি আরও বলছিলেন, আমরা জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে তাঁর মৃত্যু সংবাদ শোনাব। এর দ্বারা পরোক্ষভাবে হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামের আগমন ও ওহী নাযিলের ধারা বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্যে আক্ষেপ প্রকাশ করা হচ্ছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম যতদিন জীবিত ছিলেন, হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম সকাল-সন্ধ্যা তাঁর কাছে ওহী নিয়ে আসতেন। ওহী আল্লাহর রহমত। তাঁর সে আসা হত রহমত নিয়ে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম চলে যাওয়ায় তাঁর সেই আসার আর কোনও অবকাশ থাকল না। তার মানে ওহীরূপের রহমত নাযিলের ধারা আর বর্ষিত হবে না। এটা আক্ষেপের বিষয়ই বটে। তবে এটা ভিন্ন কথা যে, তাঁর না আসায় মানুষের হিদায়াত লাভের পক্ষে কোনও অসুবিধা দেখা দেবে না। কারণ কুরআন নাযিলের মাধ্যমে মানুষকে পরিপূর্ণ হিদায়াত দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাফন-কাফন সমাপ্ত হয়ে যাওয়ার পর তিনি হযরত আনাস রাযি.-কে লক্ষ্য করে বললেন, ওহে আনাস! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর মাটি নিক্ষেপ করতে তোমাদের মন সায় দিল? এটা ছিল তাঁর মনের প্রচণ্ড শোক ও বেদনার বহিঃপ্রকাশ। এটা সত্যিকারের কোনও আপত্তি ছিল না। কিভাবেই বা আপত্তি করবেন, যখন তাঁর জানা যে, এটাই আল্লাহর বিধান এবং এটাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা? এবং যখন তাঁর জানা আছে সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কতটা ভালোবাসেন? তারা তো পারলে তাকে মাটির কবরে সমাহিত করবেন কি. বরং তাকে রক্ষার জন্যে নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করে দিতেন। কিন্তু এটা যে আল্লাহর ফয়সালা, যা বুকে পাষাণের ভার চাপিয়ে তাঁরা মানতে বাধ্য ছিলেন। হযরত আনাস রাযি.-ও ঢের বুঝেছিলেন যে, তাঁর এ কথা আপত্তির জন্য নয়, কেবল শোকের বহিঃপ্রকাশ। তাই তিনি এর কোনও জবাব না দিয়ে নীরব থেকেছিলেন। নীরবতা অবলম্বন ছাড়া এ প্রশ্নের কি কোনও উত্তর হয়?
প্রশ্ন হতে পারে, সবরের সংগে এ হাদীছের কী সম্পর্ক? এর উত্তর স্পষ্ট। কেননা প্রচণ্ড মৃত্যুযাতনা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। এমনকি প্রিয় কন্যা শোকার্ত হয়ে পড়লে তিনি তাঁকে সান্ত্বনা যুগিয়েছেন। হযরত ফাতিমা রাযি. নিজেও শোকসন্তপ্ত হওয়া সত্ত্বেও ধৈর্যের পরিপন্থী কোনও কাজ করেননি।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. মানুষ মাত্রই মরণশীল, নবী-রাসূলগণও যার আওতাধীন।
খ. মৃত্যুযন্ত্রণার বিষয়টা সকলেরই আছে। এটা মাথায় রেখেই সকলের কাজ করা উচিত।
গ. মৃত্যুকালীন অবস্থা দেখে কারও ভালো-মন্দ হওয়ার বিচার করা যায় না।
ঘ. প্রত্যেকের মৃত্যু যথাসময়েই হয় এবং আল্লাহ তা'আলার ফয়সালা অনুযায়ীই হয় । তা মেনে নেওয়াই সকলের কর্তব্য।
ঙ. প্রিয়জনের মৃত্যুতে ব্যথিত হওয়া ও কান্নাকাটি করা কিংবা শোক ও বেদনামূলক কথা বলা দোষের নয়। তবে সর্বাবস্থায় শরী'আতের সীমা রক্ষা করা কর্তব্য।
চ. মৃত ব্যক্তি যেই হোক না কেন, তাকে মাটিতে দাফন করাই শরী'আতের বিধান।
