আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৫০- নবীজীর সাঃ যুদ্ধাভিযানসমূহ

হাদীস নং: ৩৭৪০
আন্তর্জতিক নং: ৪০৩৩

পরিচ্ছেদঃ ২১৭৬. দুই ব্যক্তির দিয়াতের (রক্তপন) ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর বনু নাযীর গোত্রের নিকট যাওয়া এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর সঙ্গে তাদের গাদ্দারী সংক্রান্ত ঘটনা। যুহরী (রাহঃ) উরওয়া (রাহঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, বনু নাযীর যুদ্ধ ওহোদ যুদ্ধের পূর্বে এবং বদর যুদ্ধের পর ষষ্ঠ মাসের শুরুতে সংঘঠিত হয়েছিল। মহান আল্লাহর বাণীঃ তিনিই কিতাবীদের মধ্যে যারা কাফির তাদেরকে প্রথম সমবেতভাবে তাদের আবাস ভূমি হতে বিতাড়িত করেছিলেন (হাশরঃ ৫৯ :২) বনু নাযীর যুদ্ধের এ ঘটনাকে ইবনে ইসহাক (রাহঃ) বিরে মাউনার ঘটনা ও উহুদ যুদ্ধের পরবর্তীকালের ঘটনা বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

৩৭৪০। আবুল ইয়ামান (রাহঃ) .... মালিক ইবনে আওস ইবনে হাদসান নাসিরী (রাহঃ) বর্ণনা করেন যে, (একদা) উমর ইবনে খাত্তাব (রাযিঃ) তাকে ডাকলেন। এসময় তার দ্বাররক্ষী ইয়ারফা এসে বলল, উসমান, আব্দুর রহমান, যুবাইর এবং সা‘দ (রাযিঃ) আপনার নিকট আসার অনুমতি চাচ্ছেন। তিনি বললেন, হ্যাঁ তাঁদেরকে আসতে বল। কিছুক্ষণ পরে এসে বলল, আব্বাস এবং আলী (রাযিঃ) আপনার নিকট অনুমতি চাচ্ছেন। তিনি বললেন, হ্যাঁ। তাঁরা উভয়েই ভিতরে প্রবেশ করলেন। আব্বাস (রাযিঃ) বললেন, হে, আমীরুল মু’মিনীন! আমার এবং তাঁর মাঝে (চলমান বিবাদের) মীমাংসা করে দিন। বনু নাযীরের সম্পদ থেকে আল্লাহ তাঁর রাসূল (ﷺ)- কে ফাই (বিনা যুদ্ধে লব্ধ সম্পদ) হিসাবে যা দিয়েছিলেন তা নিয়ে তাদের উভয়ের মাঝে বিবাদ চলছিল। এ নিয়ে তাঁরা তর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন, (এ দেখে আগত) দলের সকলেই বললেন, হে আমীরুল মু’মিনীন! তাদের মাঝে একটি ফয়সালা করে তাদের পারস্পরিক এ বিবাদ থেকে অব্যাহতি দিন।
তখন উমর (রাযিঃ) বললেন, তাড়াহুড়া করবেন না। আমি আপনাদেরকে আল্লাহর নামে শপথ দিয়ে বলছি, যাঁর আদেশে আসমান ও যমীন স্থির আছে। আপনারা কি জানেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজের সম্বন্ধে বলেছেন, আমরা (নবীগণ) কাউকে উত্তরাধিকারী রেখে যাই না। যা রেখে যাই তা সাদ্‌কা হিসাবেই গণ্য হয়। এর দ্বারা তিনি নিজের কথাই বললেন, উপস্থিত সকলেই বললেন, হ্যাঁ তিনি একথা বলেছেন। উমর (রাযিঃ) আলী এবং আব্বাসের দিকে লক্ষ্য করে বললেন, আমি আপনাদের উভয়কে আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে একথা বলেছেন, আপনারা তা জানেন কি? তাঁরা উভয়েই বললেন, হ্যাঁ, এরপর তিনি (উমর) বললেন, এখন আমি আপনাদেরকে (উত্থাপিত) বিষয়টির প্রকৃত অবস্থা খুলে বলছি।
ফায় (বিনা যুদ্ধ লব্ধ সম্পদ)- এর কিছু অংশ আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূল (ﷺ)- এর জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, যা তিনি আর অন্য কাউকে দেননি। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ আল্লাহ ইয়াহুদীদের নিকট হতে তাঁর রাসূলকে যে ফায় দিয়েছেন, তাঁর জন্য তোমরা অশ্বে কিংবা উটে আরোহণ করে যুদ্ধ করনি; আল্লাহ তো তাঁর রাসূলকে যার উপর ইচ্ছা তার উপর কর্তৃত্ব দান করেন। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। (৬ঃ ৫৯) অতএব এ ফায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর জন্যই খাস ছিল। আল্লাহর কসম! এরপর তিনি তোমাদেরকে বাদ দিয়ে নিজের জন্য এ সম্পদকে সংরক্ষিতও রাখেন নি এবং নিজের জন্য নির্ধারিতও করে যান নি। বরং এ অর্থকে তিনি তোমাদের মাঝে বন্টন করে দিয়েছেন। অবশেষে এ মাল উদ্বৃত্ত আছে। এ মাল থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর পরিবার পরিজনের এক বছরের খোরপোশ দিতেন। এ থেকে যা অবশিষ্ট থাকত তা তিনি আল্লাহর পথে খরচ করে দিতেন।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর জীবদ্দশায় এ রূপই করেছেন। নবী কারীম (ﷺ)- এর ওফাতের পর আবু বকর (রাযিঃ) বললেন, এখন থেকে আমিই হলাম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর ওলী। এরপর আবু বকর (রাযিঃ) তা স্বীয় তত্ত্বাবধানে নিয়ে এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে নীতি অনুসরণ করেছিলেন তিনিও সে নীতিই অনুসরণ করে চললেন। তিনি আলী ও আব্বাসের প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, আজ আপনারা যা বলেছেন এ বিষয়ে আপনারা আবু বকরের সাথেও এ ধরনেরই আলোচনা করেছিলেন। আল্লাহর কসম! তিনি জানেন, এ বিষয়ে আবু বকর (রাযিঃ) ছিলেন সত্যবাদী, ন্যায়পরায়ণ এবং হকের অনুসারী এক মহান ব্যক্তিত্ব। এরপর আবু বকরের ইন্‌তিকাল হলে আমি বললাম, (আজ থেকে) আমিই হলাম, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং আবু বকরের ওলী। এরপর এ সম্পদকে আমি আমার খিলাফতের দুই বছরকাল আমার তত্ত্বাবধানে রাখি এবং এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও আবু বকরের অনুসৃত নীতিই আনুসরণ করে চলছি। আল্লাহ তাআলাই ভাল জানেন, এ বিষয়ে নিশ্চয়ই আমি সত্যবাদী, ন্যায়পরায়ণ ও হকের একনিষ্ঠ অনুসারী।
তা সত্ত্বেও পুনরায় আপনারা দু’জনই আমার নিকট এসেছেন। আপনাদের কথাও এবং আপনাদের ব্যাপারটিও এক। আর আব্বাস আপনিও এখন এসেছেন। আমি আপনাদের উভয়কেই বলেছিলাম, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, আমরা (নবীগণ) কাউকে উত্তরাধিকারী করি না, আমরা যা রেখে যাই তা সাদ্‌কা হিসাবেই গণ্য হয়। এরপর এ সম্পদটি আপনাদের উভয়ের তত্ত্বাবধানে দেওয়ার বিষয়টি যখন আমার নিকট স্পষ্ট হল তখন আমি বলেছিলাম, যদি আপনারা চান তাহলে একটি শর্তে তা আমি আপনাদের নিকট অর্পণ করব। শর্তটি হচ্ছে, আপনারা আল্লাহর নির্দেশ ও তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এমনভাবে কাজ করবেন যেভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং আবু বকর করেছেন। আমার তত্ত্বাবধানে আসার পর আমি করেছি। অন্যথায় এ বিষয়ে আমার সাথে আর কোন আলোচনা করবেন না। তখন আপনারা বলেছিলেন, এ শর্তেই আপনি তা আমাদের নিকট অর্পণ করুন। আমি তা আপনাদের হাতে অর্পণ করেছি। এখন আপনারা আমার নিকট অন্য কোন ফয়সালা কামনা করেন কি? আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, যাঁর আদেশে আসমান যমীন স্থির আছে কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত আমি এর বাইরে অন্য কোন ফয়সালা দিতে পারব না। আপনারা যদি এ দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে থাকেন তাহলে আমার নিকট ফিরিয়ে দিন। আপনাদের এ দায়িত্ব পালনে আমিই যথেষ্ট।
বর্ণনাকারী (যুহরী) বলেন, আমি হাদীসটি উরওয়া ইবনে যুবাইরের নিকট বর্ণনা করার পর তিনি (আমাকে) বললেন, মালিক ইবনে আওস (রাযিঃ) ঠিকই বর্ণনা করেছেন। আমি নবী কারীম (ﷺ)- এর সহধর্মিণী আয়েশা (রাযিঃ)- কে বলতে শুনেছি, (বনু নাযীর গোত্রের সম্পদ থেকে) ফায় হিসাবে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে যে সম্পদ দিয়েছেন তার অষ্টমাংশ আনার জন্য নবী কারীম (ﷺ)- এর সহধর্মিণীগণ উসমানকে আবু বকরের নিকট পাঠালে (পাঠাতে ইচ্ছা করলে) এই বলে আমি তাদেরকে রাবণ করছিলাম যে, আপনারা কি আল্লাহকে ভয় করেন না? আপনারা কি জানেন না যে, নবী কারীম (ﷺ) বলতেন আমরা (নবীগণ) কাউকে উত্তরাধিকারী রেখে যাই না, আমরা যা রেখে যাই তা সাদ্‌কা হিসাবেই থেকে যায়। এ দ্বারা তিনি নিজেকে উদ্দেশ্য করেছেন। এ সম্পদ থেকে মুহাম্মাদ (ﷺ)- এর বংশধরগণ খেতে পারবেন। (তারা এ সম্পদের মালিক হতে পারবেন না।)
আমার এ কথা শুনে নবী কারীম (ﷺ)- এর সহধর্মিণীগণ বিরত হলেন। বর্ণনাকারী (উরওয়া ইবনে যুবাইর (রাহঃ)) বলেন, অবশেষে সাদ্‌কার এ মাল আলীর তত্ত্বাবধানে ছিল। তিনি আব্বাসকে তা দিতে অস্বীকার করেন এবং পরিশেষে (এ যমীনের ব্যাপারে) তিনি আব্বাসের উপর জয়ী হন। এরপর তা যথাক্রমে হাসান ইবনে আলী এবং হুসাইন ইবনে আলীর হাতে ছিল। পুনরায় তা আলী ইবনে হুসাইন এবং হাসান ইবনে হাসানের হস্তগত হয়। তাঁরা উভয়ই পর্যায়ক্রমে তার দেখা শোনা করতেন। এরপর তা যায়দ ইবনে হাসানের তত্ত্বাবধানে যায়। ইহা অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর সদকা।


tahqiq

তাহকীক:

তাহকীক নিষ্প্রয়োজন