আল-আদাবুল মুফরাদ- ইমাম বুখারী রহঃ

আল-আদাবুল মুফরাদের পরিচ্ছেদসমূহ

হাদীস নং: ৫৫৩
২৫১. অহংকার
৫৫৩। হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিয়াছেনঃ আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ ইজ্জত আমার পরিধেয়, কিবরিয়া (অহংকার) আমার চাদর, যে কেহ এগুলির ব্যাপারে আমার সহিত দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হইবে (অর্থাৎ নিজেকেও এগুলির হক্‌দার মনে করিবে) আমি তাহাকে শাস্তি প্রদান করিব।
حَدَّثَنَا عُمَرُ، قَالَ‏:‏ حَدَّثَنَا أَبِي، قَالَ‏:‏ حَدَّثَنَا الأَعْمَشُ، قَالَ‏:‏ حَدَّثَنَا أَبُو إِسْحَاقَ، عَنْ أَبِي مُسْلِمٍ الأَغَرِّ حَدَّثَهُ، عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ، وَأَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ‏:‏ الْعِزُّ إِزَارِي، وَالْكِبْرِيَاءُ رِدَائِي، فَمَنْ نَازَعَنِي بِشَيْءٍ مِنْهُمَا عَذَّبْتُهُ‏.‏

হাদীসের ব্যাখ্যা:

الْعِزّ إِزَارَي (মহিমা আমার লুঙ্গি)। الْعِزّ অর্থ প্রতাপ, মহিমা, পরাক্রম, ক্ষমতা ও সর্বোচ্চ মর্যাদা। ইমাম রাগিব রহ. বলেন-الْعِزَّةُ: حَالَةٌ مَانِعَةٌ لِلْإِنْسَانِ مِنْ أَنْ يُغْلَبَ مِنْ قَوْلِهِمْ: أَرْضٌ عَزَاز، أَيْ: صَلْبَةٌ قَالَ تَعَالَى : ﴿أَيَبْتَغُونَ عِنْدَهُمُ الْعِزَّةَ فَإِنَّ الْعِزَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا ﴾ [النساء/ ١٣٩] ‘ইযয মানুষের এমন এক অবস্থাকে বলে, যা তাকে পরাস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে। যেমন বলা হয়- أَرْض عَزَاز (শক্ত ভূমি)। আল্লাহ তা'আলা বলেন- أَيَبْتَغُونَ عِنْدَهُمُ الْعِزَّةَ فَإِنَّ الْعِزَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا (তারা কি তাদের কাছে শক্তি খোঁজে? সমস্ত শক্তি তো আল্লাহরই কাছে (সূরা নিসা: ১৩৯)।(রাগিব আসবাহানী, আল-মুফরাদাত লিগারীবিল কুরআন- দেখুন: عز শব্দের বিশ্লেষণ।)

প্রকৃত অর্থে এ গুণটি কেবল আল্লাহ তা'আলার জন্যই প্রযোজ্য। এরই থেকে আল্লাহ তা'আলার এক নাম الْعَزِيزِ (আল-আযীয)। যেহেতু এ গুণটি আল্লাহ তা'আলার জন্য নির্ধারিত, তাই প্রকৃত অর্থে অন্য কেউ এর দাবিদার হতে পারে না। কেউ নিজের জন্য এ দাবি করতে পারে না যে, তাকে পরাভূত করার মতো কেউ নেই কিংবা সে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। এমন কোনও ভাবও কারও জন্য দেখানোর সুযোগ নেই, যা দ্বারা ধারণা জন্মায় যে, সে নিজের জন্য এরূপ দাবি করে বা নিজেকে এ স্তরের মনে করে। হাঁ, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখে ও তাঁর উপর পরিপূর্ণ আস্থা রেখে তাঁর আদেশ-নিষেধ পালনে যত্নবান থাকে, আল্লাহ তা'আলা তাকে এরূপ ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী করেন। সে আল্লাহপ্রদত্ত ক্ষমতায় ক্ষমতাবান ও আল্লাহপ্রদত্ত মর্যাদায় মর্যাদাবান। এ অর্থে আল্লাহ তা'আলা মুমিনদের জন্যও শব্দটি ব্যবহার করেছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
وَلِلَّهِ الْعِزَّةُ وَلِرَسُولِهِ وَلِلْمُؤْمِنِينَ
অথচ মর্যাদা ও ক্ষমতা তো কেবল আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের এবং মুমিনদেরই আছে।(সূরা মুনাফিকূন (৬৩), আয়াত ৮)
অর্থাৎ প্রকৃত মর্যাদা ও ক্ষমতা আল্লাহ তা'আলারই আছে এবং তাঁর দান ও অনুগ্রহে তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুমিনগণও তার অধিকারী। কাজেই কেউ যদি মর্যাদা ও ক্ষমতার অধিকারী হতে চায়, তবে তার কর্তব্য আল্লাহর প্রতি আনুগত্য স্বীকার করা ও তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা। তখন সে আল্লাহপ্রদত্ত ইজ্জত-সম্মান ও ক্ষমতার অধিকারী হতে পারবে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْعِزَّةَ فَلِلَّهِ الْعِزَّةُ جَمِيعًا
‘যে ব্যক্তি মর্যাদা লাভ করতে চায় (সে জেনে রাখুক) সমস্ত মর্যাদা আল্লাহরই হাতে (কাজেই তাঁর কাছ থেকেই তাকে তা অর্জন করতে হবে)।(সূরা ফাতির (৩৫), আয়াত ১০)

وَالْكِبْرِيَاءُ رِدَائِي (এবং অহংকার আমার চাদর)। الْكِبْرِيَاءُ শব্দটির উৎপত্তি كبر থেকে। এর অর্থ বড়ত্ব, গৌরব। الْكِبْرِيَاءُ এর অর্থ বড়ত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়। ইমাম রাগিব রহ. বলেন-
وَالْكِبْرِيَاءُ : التَّرَفعُ عَنِ الْأنْقِيَادِ، وَذَلِكَ لَا يَسْتَحِقَّهُ غَيْرُ اللَّهِ، فَقَالَ: ﴿ وَلَهُ الْكِبْرِيَاءُ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ﴾ [الجاثية / ٣٧]
‘কিবরিয়া অর্থ কারও আনুগত্য ও বশ্যতাস্বীকারের ঊর্ধ্বে অবস্থান করা। আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ এ গুণের অধিকারী হতে পারে না। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَلَهُ الْكِبْرِيَاءُ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ (এবং সমস্ত গৌরব তারই, আকাশমণ্ডলীতেও এবং পৃথিবীতেও। এবং তিনিই পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় - সূরা জাছিয়া:৩৭)(রাগিব আসবাহানী, আল-মুফরাদাত লিগারীবিল কুরআন- দেখুন: كِبْر শব্দের বিশ্লেষণ।)
অর্থাৎ কোনওভাবেই তিনি কোনওকিছুর মুখাপেক্ষী নন। ফলে কারও কাছে তাঁর নতিস্বীকারের প্রশ্নই আসে না। তাই গৌরব করা কেবল তাঁরই সাজে। তিনি ছাড়া আর কেউ এমন নেই, যার কারও কাছে কোনও মুখাপেক্ষিতা নেই। আর সারা জাহানের সবকিছু তো তাঁর মুখাপেক্ষী রয়েছেই। সুতরাং আল্লাহ ছাড়া কারও গৌরব করারও অবকাশ নেই।

হাদীছটিতে বলা হয়েছে, মর্যাদা ও মহিমা আল্লাহ তা'আলার লুঙ্গি এবং গৌরব তাঁর চাদর। আল্লাহ তা'আলার জন্য এ শব্দদু'টি ব্যবহার করা হয়েছে রূপকার্থে, প্রকৃত অর্থে নয়। কেননা প্রকৃত অর্থে পোশাকের প্রয়োজন হয় শরীরী সত্তার। আল্লাহ তা'আলা শরীরধারী নন। তাই তাঁর পোশাকেরও প্রয়োজন হয় না। পোশাকের প্রয়োজন হয় মানুষের। মানুষ লুঙ্গি পরে কোমর থেকে শরীরের নিম্নাংশের জন্য, আর চাদর পরে কোমরের উপর অংশে। লুঙ্গি ও চাদর মানুষের শরীরের সঙ্গে মিশে থাকে। এর দ্বারা তার শরীর ঢাকে ও সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটে। আল্লাহ তা'আলা তাঁর সমুচ্চ মর্যাদা ও গৌরবকে এ দু'টি কাপড়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এর দ্বারা বোঝানো হয়েছে, এ কাপড়দু'টি যেমন মানুষের জন্য অবিচ্ছেদ্য, তেমনি এ গুণদু'টিও আল্লাহ তা'আলার জন্য অবিচ্ছেদ্য। এমনিভাবে মানুষ যেমন এ দু'টি কাপড়ে অন্যকে অংশীদার করে না, অর্থাৎ একটা লুঙ্গি একা একজনই পরে, তাতে অন্যকে শরীক করে না, গায়ে জড়ানোর চাদরও এরকমই, তদ্রূপ এ গুণদু'টিও আল্লাহ তা'আলার জন্য নির্ধারিত। এতে তাঁর কোনও অংশীদার নেই। কেউ যদি অংশীদারিত্বের দাবি করে বা ভাব দেখায়, তবে আল্লাহ তা পসন্দ করেন না। সুতরাং হাদীছটিতে বলা হয়েছে-
فَمَنْ يُنَازِعُنِيْ فِي وَاحِدٍ مِنْهُمَا فَقَدْ عَذَّبْتُهُ (যে ব্যক্তি এ দু'টির কোনও একটি নিয়ে আমার সঙ্গে টানাটানি করবে, আমি তাকে অবশ্যই শাস্তি দেব)। ইমাম খাত্তাবী রহ. বলেন, হাদীছটির অর্থ হল- সর্বোচ্চ ক্ষমতা ও মর্যাদা এবং গৌরব আল্লাহ তা'আলার গুণ। এ গুণদু'টি তাঁরই জন্য নির্দিষ্ট। অন্য কেউ এতে তাঁর অংশীদার নয়। এ দু'টিতে হাত দেওয়া কোনও মানুষের উচিত নয়। কেননা মাখলুকের বৈশিষ্ট্য হল বিনয় ও বন্দেগী।

সুতরাং কেউ যদি এ দু'টি গুণের দাবি করে, তবে সে যেন আল্লাহর সঙ্গে এ নিয়ে টানাটানিতে লিপ্ত হল ও তাঁর সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে অবতীর্ণ হল। বলাই বাহুল্য কেউ আল্লাহর সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হলে তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কোনও ব্যক্তির নিজেকে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী ভাবা কিংবা কোনও ক্ষমতাসীনের 'নিজেকে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী গণ্য করার কোনও অবকাশ নেই।

খ. মানুষ মাত্রই কোনও না কোনওভাবে অন্যের মুখাপেক্ষী। তাই কোনও অবস্থায়ই তার গৌরব করা সাজে না।

গ. ক্ষমতার বড়াই যে করবে কিংবা কোনওকিছু নিয়ে যে ব্যক্তি গৌরব দেখাবে, তার পতন ও ধ্বংস অনিবার্য।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন