আল-আদাবুল মুফরাদ- ইমাম বুখারী রহঃ

আল-আদাবুল মুফরাদের পরিচ্ছেদসমূহ

হাদীস নং: ১৩১
আল-আদাবুল মুফরাদের পরিচ্ছেদসমূহ
৭১- সর্বাধিক মর্যাদাশালী কে ?
১৩১। হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) হইতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কে প্রশ্ন করা হইল ঃ মানুষের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত কে? ফরমাইলেন ঃ মানুষের মধ্যে সে-ই সর্বাধিক সম্মানিত, যাহার আল্লাহভীতি (তাকওয়া) সর্বাধিক। প্রশ্নকারীগণ বলিলেনঃ আমরা আপনাকে এই প্রশ্ন করি নাই। ফরমাইলেন ঃ তাহা হইলে মানুষের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত ইউসুফ আল্লাহর নবী-আল্লাহর নবী ইয়াকূব (আ)-এর পুত্র খলীলুল্লাহ্ ইবরাহীম (আ)-এর পৌত্র । প্রশ্নকারীগণ বলিলেন, আমরা এই প্রশ্নও আপনাকে করি নাই। ফরমাইলেনঃ তাহা হইলে কি তােমরা আরবদের সম্পর্কে আমাকে প্রশ্ন করিতেছ? তাঁহারা বলিলেন ঃ জ্বী হ্যা। ফরমাইলেন ঃ জাহিলিয়াতের যুগে তােমাদের মধ্যে যাহারা উত্তম বিবেচিত হইত, ইসলাম-উত্তর যুগেও তাঁহারাই উত্তম বিবেচিত হইবে-অবশ্য, যদি তাহারা ধর্ম সম্পর্কে ব্যুৎপত্তি অর্জন করে।
أبواب الأدب المفرد للبخاري
بَابُ الْكَرَمِ
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ سَلاَمٍ، قَالَ‏:‏ أَخْبَرَنَا عَبْدَةُ، عَنْ عُبَيْدِ اللهِ، عَنْ سَعِيدِ بْنِ أَبِي سَعِيدٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ‏:‏ سُئِلَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم‏:‏ أَيُّ النَّاسِ أَكْرَمُ‏؟‏ قَالَ‏:‏ أَكْرَمُهُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاهُمْ، قَالُوا‏:‏ لَيْسَ عَنْ هَذَا نَسْأَلُكَ، قَالَ‏:‏ فَأَكْرَمُ النَّاسِ يُوسُفُ نَبِيُّ اللهِ ابْنُ نَبِيِّ اللهِ ابْنِ خَلِيلِ اللهِ، قَالُوا‏:‏ لَيْسَ عَنْ هَذَا نَسْأَلُكَ، قَالَ‏:‏ فَعَنْ مَعَادِنِ الْعَرَبِ تَسْأَلُونِي‏؟‏ قَالُوا‏:‏ نَعَمْ، قَالَ‏:‏ فَخِيَارُكُمْ فِي الْجَاهِلِيَّةِ خِيَارُكُمْ فِي الإِسْلاَمِ إِذَا فَقِهُوا‏.‏

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছ দ্বারা তাকওয়ার গুরুত্ব ও মর্যাদা বোঝা যায়। যখন সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, মানুষের মধ্যে সবচে' বেশি মর্যাদাবান কে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণভাবে বললেন, যে ব্যক্তি সবচে' বেশি মুত্তাকী। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলাকে সবচে' বেশি ভয় করে চলে, আল্লাহর কাছে তার মর্যাদা সবচে বেশি। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহকে সবচে' বেশি ভয় করে, সে শরী'আতের অনুসরণ ও বেশি করে। সে সর্বপ্রকার পাপকর্ম থেকে দূরে থাকে এবং বেশি বেশি নেককাজ করতে সচেষ্ট থাকে। ফলে তার পুণ্য ও ছওয়াবও বেশি অর্জিত হয় এবং আল্লাহ ও বেশি নৈকট্য লাভ হয়। এরূপ ব্যক্তির জন্য আখিরাতে উচ্চ মর্যাদা তো রয়েছেই, দুনিয়ায়ও তারা নেককারদের দৃষ্টিতে বেশি মর্যাদাবান হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে সাদা কালো, ধনী-গরীব, আরব-অনারব ও বংশ-গোত্রের কোনও পার্থক্য নেই। এ হাদীছে সেরকম কোনও পার্থক্য করা হয়নি। মানুষ যে রঙেরই হোক, যে দেশেরই হোক, যে গোত্রেরই হোক এবং সে যত গরীবই হোক না কেন, তার মধ্যে যদি তাকওয়া ও আল্লাহভীতি থাকে, ফলে শরী'আত মোতাবেক জীবনযাপন করে, তবে আল্লাহ তা'আলার কাছে তার জন্য রয়েছে অনেক উচ্চমর্যাদা। হাঁ, দুনিয়ার অর্থবিত্ত ও প্রভাব প্রতিপত্তিই যাদের দৃষ্টিতে সবকিছু, তাদের কাছে হয়তো এরূপ লোকের বিশেষ মর্যাদা নেই। তাতে কিছু যায় আসে না। এটা তাদের বিকৃত চিন্তা-চেতনার ফল। যাদের চিন্তা চেতনা দীনের রঙে রঞ্জিত, তারা মুত্তাকীদেরকেই সর্বাধিক মর্যাদা দিয়ে থাকে, যেহেতু আল্লাহ তা'আলার কাছে তারা বেশি মর্যাদাবান। কুরআন মাজীদেও সাধারণভাবে সকলের জন্য ইরশাদ হয়েছে

إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ

‘আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সবচে' বেশি মর্যাদাবান সেই ব্যক্তি, যে বেশি আল্লাহভীরু।

তারপর সাহাবায়ে কিরাম যখন বললেন- আমরা এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করিনি, অর্থাৎ যে মর্যাদার ভিত্তি নেককাজ আমাদের জিজ্ঞাসা সে সম্পর্কে নয়, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম মনে করলেন, তারা বংশ-গোত্রভিত্তিক মর্যাদা সম্পর্কে জানতে চাচ্ছে। সুতরাং তিনি বললেন, হযরত ইউসুফ আলাইহিস-সালাম। কেননা ইউসুফ আলাইহিস-সালাম নবুওয়াতী মর্যাদার সাথে সাথে বংশীয় মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। পিতা, পিতামহ ও প্রপিতামহ তিনজনই নবী ছিলেন। তিনি চতুর্থ পুরুষ হিসেবে নিজেও নবী। এভাবে হযরত ইউসুফ আলাইহিস-সালাম বাপ-দাদার সিলসিলায় পরপর চারজন নবীর চতুর্থতম নবী। হযরত ইউসুফ আলাইহিস-সালামের আগে ও পরে কখনও এরূপ পাওয়া যায়নি। এটা কেবল তাঁরই বিশেষত্ব। তাঁর বাড়তি বিশেষত্ব ছিল নবুওয়াতের সাথে রাজত্বের অধিকারী হওয়া। তিনি মিশরের রাজক্ষমতা লাভ করেছিলেন। আরও একটি বৈশিষ্ট্য স্বপ্নের তা'বীর। স্বপ্নব্যাখ্যার বিশেষ জ্ঞান আল্লাহ তা'আলা তাঁকে দান করেছিলেন।

প্রকাশ থাকে যে, এতসব বিশেষত্ব থাকার দ্বারা অন্য সকল নবীর উপর হযরত ইউসুফ আলাইহিস-সালামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয় না। কেননা এগুলো শাখাগত বিশেষত্ব। মূল নবুওয়াত ও রিসালাতের মর্যাদায় আল্লাহ তা'আলা আম্বিয়া আলাইহিমুস-সালামের মধ্যে যে পার্থক্য করেছেন তাতে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস-সালাম, হযরত মুসা আলাইহিস-সালাম প্রমুখের মর্যাদা অনেক উপরে। সাধারণভাবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হলেন খাতামুল আম্বিয়া ওয়া সায়্যিদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

কিন্তু সাহাবায়ে কিরামের জিজ্ঞাসা ছিল মূলত আরব গোত্রসমূহ সম্পর্কে। নদী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তা বুঝতে পারলেন, তখন বললেন- বংশ, গোত্রের দিক থেকে ইসলামেও তারাই শ্রেষ্ঠ, যারা জহিলী যুগে শ্রেষ্ঠ ছিল। তবে একটা শর্ত রয়েছে। শর্তটি হল দীনের জ্ঞান-বুঝ থাকা। যারা দীনের জ্ঞান-বুঝ হাসিল করেছে, প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্ব তাদেরই। জাহিলী যুগে যদি তারা শ্রেষ্ঠ হয়ে থাকে, তবে ইসলামে তারা অধিকতর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হবে। কেননা জাহিলী যুগে যে সমস্ত সদগুণের কারণে তারা অন্যদের ছাড়িয়ে গিয়েছিল, যেমন সাহসিকতা, অতিথিপরায়ণতা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা, সত্যবাদিতা ইত্যাদি, ইসলামেও সেগুলোর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তো যখন এসব সদগুণ আগে থেকেই তাদের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে, সেইসংগে দীনের ইলম ও অনুসরণের বাড়তি মহিমাও অর্জন হয়ে গেল, তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা ইসলামেও অন্যান্যদের থেকে এগিয়ে থাকবে। বাস্তব ইতিহাসও তাই প্রমাণ করে। জাহিলী যুগে কুরায়শ গোত্র বিভিন্ন সদগুণে অন্যসব গোত্রের চেয়ে অগ্রসর ছিল। এ কারণে তারা অন্যান্য গোত্রের উপর নেতৃত্ব দান করত। ইসলামী যুগেও দেখা গেল তারা সকলের অগ্রগামী। সেই কুরায়শ গোত্রের ভেতর আবার বনু হাশিমকে শ্রেষ্ঠ মনে করা হত। তার মানে বন্ হাশিম সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গোত্র। তাই এ গোত্রেই নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব হয়। এক হাদীছে তিনি এ গোত্রের শ্রেষ্ঠত্বের সাক্ষ্য দান করেছেন। ইসলামী যুগেও তাদের সে শ্রেষ্ঠত্ব বজায় থাকে।

শ্রেষ্ঠত্ব লাভের জন্য এ হাদীছে যে শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, অর্থাৎ দীনের বুঝ-জ্ঞান, তা না পাওয়া গেলে কোনও গোত্র শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হতে পারবে না, তাতে সে গোত্র জাহিলী যুগে যতই অভিজাত গণ্য হোক না কেন। বরং জাহিলী যুগে সর্বনিম্ন স্তরের গণ্য হওয়া সত্ত্বেও যে গোত্র দীন বুঝবে ও দীনের অনুসরণ করবে, তারা অবশ্যই বেদীন গোত্রসমূহ অপেক্ষা অনেক বেশি মর্যাদাবান সাব্যস্ত হবে। ইসলামে প্রকৃত মর্যাদার মাপকাঠি কেবলই দীনের বুঝ-জ্ঞান।

উল্লেখ্য, দীনের বুঝ-জ্ঞান ও আমল-অনুসরণ পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। দীনের অনুসরণ যদি না করা হয়, তবে কেবল বুঝ-জ্ঞানের কোনও মূল্য নেই। সুতরাং যে সকল স্থানে দীনের ইলম ও দীনের বুঝ-সমঝের মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে, তাতে আমল ও অনুসরণের বিষয়টাও অপরিহার্যভাবে তার অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

এ হাদীছে বংশ-গোত্র বোঝানোর জন্য معادن শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। শব্দটি معدن -এর বহুবচন। এর অর্থ খনি। খনিতে সোনা-রূপা প্রভৃতি মূল্যবান সম্পদ থাকে। বংশ গোত্রও যেহেতু বিভিন্ন সদগুণের ধারক হয়ে থাকে, তাই রূপকার্থে তাকে معدن (খনি) বলা হয়েছে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. তাকওয়া ও আল্লাহভীতিই মানুষের মর্যাদার প্রকৃত মাপকাঠি।

খ. আল্লাহর কাছে যেহেতু তাকওয়া দ্বারাই মর্যাদা লাভ করা যায়, তাই আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য শক্তভাবে তাকওয়া-পরহেযগারী ধরে রাখা।

গ. দীনদারী ও তাকওয়া-পরহেযগারী না থাকলে বংশীয় আভিজাত্যের কোনও মূল্য নেই। সুতরাং বংশীয় অহমিকা অবশ্যপরিত্যাজ্য।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)