আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৪৯- নবীজী সাঃ ও সাহাবা রাঃ ; মর্যাদা ও বিবিধ ফাযায়েল

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৩৬০৩
২০৭৫. ইসলাম আগমনের পর নবুওয়্যাতের নিদর্শনসমূহ
৩৩৪৬। মুহাম্মাদ ইবনে কাসীর (রাহঃ) .... ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) সূত্রে নবী কারীম (ﷺ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, অচিরেই স্বজনপ্রীতি প্রকাশ পাবে এবং এমন সব কর্মকাণ্ড ঘটবে যা তোমরা পছন্দ করতে পারবে না। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! তদাবস্থায় আমাদের কী করতে বলেন? নবী কারীম (ﷺ) বললেন, তোমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন কর তোমাদের প্রাপ্যের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ কর।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরবর্তীকালের শাসকশ্রেণী সম্পর্কে একটা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, যা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়েছে।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খুলাফায়ে রাশিদীনের আমলে গোটা ইসলামী সমাজ ন্যায় ও ইনসাফের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক শাসকগণ ইনসাফের সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। ন্যায়-নীতির ব্যাপারে তাদের কাছে আপন-পর ও আত্মীয়-অনাত্মীয়ের ভেদাভেদ ছিল না। তারা সকলের প্রতি সমআচরণে অভ্যস্ত ও বিশ্বাসী ছিলেন। সকল ক্ষেত্রে ইসলামী সাম্য বজায় রাখতেন। জনগণের উপরও তাদের শাসননীতির প্রভাব ছিল। তারাও একে অন্যের উপর জুলুম করত না। শক্তিমান কর্তৃক দুর্বলকে গ্রাস করার জাহিলী রেওয়াজ নির্মূল হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে দেশ ও জাতির মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি বজায় ছিল। পরস্পরে হানাহানি না থাকায় সমগ্র জাতি বিশ্বব্যাপী দীন প্রচারে আত্মনিয়োগ করতে পেরেছিল। বিশ্বও তাদের সমীহ করত। ফলে খুব অল্প সময়ে ও অতি সহজে দূর-দূরান্তে খেলাফত বিস্তার সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু কালক্রমে মুসলিম উম্মাহ তাদের সাম্যনীতি বাস্তবায়নে শিথিল হয়ে পড়ে। বিশেষত শাসকশ্রেণী কায়েমী স্বার্থের লক্ষ্যে জুলুম-নির্যাতনের পন্থা অবলম্বন করে। ফলে খলীফা ও জনগণের সুসম্পর্ক নষ্ট হতে শুরু করে। ক্রমে একের প্রতি অন্যের অনাস্থা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সে অবকাশে চারদিকে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। একপর্যায়ে বিশাল বিস্তৃত ইসলামী খেলাফত ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। গড়ে উঠে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। সেসব রাষ্ট্রের মধ্যেও পারস্পরিক আস্থা ও সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনি। আজ মুসলিম রাষ্ট্রগুলো আত্মকলহে লিপ্ত। নিজেরা নিজেদের মধ্যে‌ দ্বন্দ্ব বাড়িয়ে শক্তিক্ষয় করছে। তাদের ইসলাম নিয়ে ভাবার ফুরসত নেই। ইসলামের শত্রুগণ সেই সুযোগ ভালোভাবেই নিচ্ছে। তারা যাতে কোনওভাবেই এক হতে না পারে, সেই ষড়যন্ত্রে তারা লিপ্ত। তাদের পাতা ফাঁদে আপন-আপন উচ্চাভিলাষ চরিতার্থের জন্য মুসলিম শাসকগোষ্ঠেী নিশ্চিন্তে পা রেখে চলেছে। একপর্যায়ে নিজেরাও ধ্বংস হচ্ছে এবং ছারখার হচ্ছে দেশ ও জাতি। ধ্বংসযজ্ঞ চলছে সারা মুসলিমজাহানে। তা কেবল শত্রুর হাতেই নয়, নিজেরাও সেই যজ্ঞে শামিল হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণের কী উপায়? উপায় একটাই- নবী করী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার অনুসরণ।

সাহাবায়ে কিরামকে লক্ষ করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, অচিরেই একটা সময় আসবে যখন তোমরা দেখতে পাবে, অন্যায়ভাবে একের উপর অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় পদ, অর্থ লেনদেন ও বিচার-আচারে পক্ষপাতিত্ব করা হচ্ছে। প্রকৃত হকদারকে বঞ্চিত করে আত্মীয়-স্বজন ও নিজ দলীয় লোককে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। তোমাদের তা পসন্দ হবে না। হওয়ার কথাও নয়। কারণ শোষন ও জুলুমবাজিতে তারা অভ্যস্ত ছিলেন না। নিজেরা ন্যায় ও ইনসাফের চর্চা করতেন এবং শাসকদেরকেও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দেখতেন। তার বিপরীতে যখন ইসলামী আদর্শের সংগে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক বৈষম্যনীতির প্রয়োগ চোখে পড়বে, তখন তাদের তা কিভাবে পসন্দ হতে পারে?

সাহাবায়ে কিরাম প্রশ্ন করলেন, সে ক্ষেত্রে আমাদের আপনি কী হুকুম দেন? তিনি বললেন, তোমাদের উপর অন্যের যা প্রাপ্য তা আদায় করে দেবে। অর্থাৎ তোমাদেরকে যদি সরকারি সুবিধাদি থেকে বঞ্চিত করা হয়, তবুও তোমরা কর্তব্য পালনে একনিষ্ঠ থাকবে। অর্থাৎ আমীরের আনুগত্য যথারীতি বহাল রাখবে। বিদ্রোহ করবে না। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে না। তাতে কেন্দ্রীয় শক্তি দুর্বল হবে ফলে শত্রুশক্তি সুযোগ পাবে এবং তার ক্ষতি তোমাদের নিজেদেরও ভোগ করতে হবে।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেইসংগে বললেন, তোমাদের প্রাপ্য আল্লাহর কাছে চাবে। অর্থাৎ অধিকার আদায়ের সংগ্রামে মাঠে নামবে না। সুবহানাল্লাহ! কী চমৎকার শিক্ষা! কর্তব্যনিষ্ঠার শিক্ষা। তোমার কর্তব্য তুমি পালন করে যাও। তোমার কাছে অন্যের যা অধিকার তা আদায় করে দাও।
প্রত্যেকে যদি আপন কর্তব্যকর্ম ঠিক ঠিক করে, অন্যের অধিকার আদায়ে যত্নবান থাকে, তবে কারও অধিকারই অনাদায় থাকে না। কিন্তু আজ মানুষের নজর নিজ কর্তব্যের দিকে নয়, অন্যের কর্তব্যের দিকে। অন্যের প্রাপ্য মেটানোর দিকে নয়, নিজ অধিকার আদায়ের দিকে। একদিকে অন্যের প্রাপ্য মেটাতে গড়িমসি করছে, অন্যদিকে নিজ অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করছে। একদিকে অন্যকে বঞ্চিত করছে, অন্যদিকে নিজেকে কেন বঞ্চিত করা হবে সে নিয়ে মাঠে নামছে। ঘরে-বাইরে সব জায়গায় আজ অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। সকল পক্ষই আপন অধিকার নিয়ে সোচ্চার, কিন্তু কর্তব্যকর্মে উদাসীন। ফলে অধিকার কারোরই যথাযথ আদায় হচ্ছে না। বঞ্চনার শিকার হচ্ছে উভয় পক্ষই। সে বঞ্চনা থেকে বাঁচার উপায় একটাই- কর্তব্যকর্মে নিষ্ঠাবান হওয়া। তাতে আর কিছু না হোক, অন্তত হানাহানি তো কমবে। সেইসংগে দেশ স্থিতিশীল থাকবে। আর তাতে বঞ্চনার মাত্রাও একটুও যে কমবে না এমন নয়। সবচে বড় কথা আখিরাতের জবাবদিহিতা থেকে বাঁচা যাবে। কেননা আল্লাহ তা'আলা প্রত্যেককে তার আপন কর্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। একের কর্তব্য সম্পর্কে অন্যকে জিজ্ঞেস করবেন না। সেদিন সদুত্তর দিতে হলে আজ আপন দায়িত্ব অবশ্যই পালন করতে হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের প্রত্যেককে আপন দায়িত্ব পালনের তাওফীক দান করুন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায়, কারও ব্যক্তিগত অধিকার খর্ব হলে তার উচিত ধৈর্যধারণ করা।

খ. আমীর ও সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হলে সেজন্য বিদ্রোহ না করে আনুগত্য বজায় রাখা উচিত।

গ. প্রত্যেকের উচিত নিজ কর্তব্যপালনে যত্নবান থাকা আর নিজ প্রাপ্য আল্লাহর কাছে চাওয়া।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন