কিতাবুস সুনান (আলমুজতাবা) - ইমাম নাসায়ী রহঃ

২৫. জিহাদ-শাহাদাতের অধ্যায়

হাদীস নং: ৩১৫৭
আন্তর্জাতিক নং: ৩১৫৭
৩২. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির যুদ্ধে যোগদান
৩১৬১. কুতায়বা (রাহঃ) ......... আবু কাতাদা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) লোকদের মধ্যে দাঁড়িয়ে তাদের বললেনঃ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান সর্বোত্তম ইবাদত। এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললোঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি যদি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হই, তাহলে কি আল্লাহ তাআলা আমার সব পাপ ক্ষমা করবেন? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ হ্যাঁ। যদি তুমি ধৈর্যসহকারে সওয়াবের আশায় সামনে অগ্রসর হয়ে পিছু না হটে যুদ্ধ কর, তবে ঋণ ব্যতীত। জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম) আমাকে এরূপ বললেন।
مَنْ قَاتَلَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ تَعَالَى وَعَلَيْهِ دَيْنٌ
أَخْبَرَنَا قُتَيْبَةُ قَالَ حَدَّثَنَا اللَّيْثُ عَنْ سَعِيدِ بْنِ أَبِي سَعِيدٍ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي قَتَادَةَ عَنْ أَبِي قَتَادَةَ أَنَّهُ سَمِعَهُ يُحَدِّثُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَامَ فِيهِمْ فَذَكَرَ لَهُمْ أَنَّ الْجِهَادَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالْإِيمَانَ بِاللَّهِ أَفْضَلُ الْأَعْمَالِ فَقَامَ رَجُلٌ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَرَأَيْتَ إِنْ قُتِلْتُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَيُكَفِّرُ اللَّهُ عَنِّي خَطَايَايَ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَعَمْ إِنْ قُتِلْتَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَأَنْتَ صَابِرٌ مُحْتَسِبٌ مُقْبِلٌ غَيْرُ مُدْبِرٍ إِلَّا الدَّيْنَ فَإِنَّ جِبْرِيلَ عَلَيْهِ السَّلَام قَالَ لِي ذَلِكَ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিহাদ ও ঈমানের ফযীলত বর্ণনা করেছেন। তিনি এ দু'টিকে শ্রেষ্ঠতম আমল সাব্যস্ত করেছেন। প্রশ্ন হতে পারে, জিহাদ যদি ঈমানের সমস্তরের হয়ে থাকে, তবে এটাকে ইসলামের ভিত্তিসমূহের অন্তর্ভুক্ত করা হল না কেন? ইসলামের ভিত্তি তো পাঁচটি যেমন হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত হাদীছে আছে-
"بُنِيَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ: شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَالحَجِّ الْبَيْتِ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ"
"ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি বিষয়ের ওপর- (ক) এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবূদ নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল; (খ) নামায কায়েম করা; (গ) যাকাত দেওয়া; (ঘ) বায়তুল্লাহর হজ্জ করা ও (ঙ) রমযানের রোযা রাখা।" (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৮. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৬; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬০৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৫৬৭৩; মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ৭২০; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৫০০১; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ১৫৮)
এর উত্তর এই যে, ইসলামের এ ভিত্তিসমূহ পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জিহাদের প্রয়োজন। জিহাদ ব্যতীত অন্যান্য ধর্মের ওপর ইসলামের বিজয় ও প্রাধান্য অর্জিত হয় না। সে হিসেবে জিহাদ ইসলাম প্রতিষ্ঠার মূল উপায় ও শ্রেষ্ঠতম অবলম্বন। অপরদিকে ঈমান হচ্ছে ইসলামের ভিত্তিসমূহ স্থাপিত করার মূল অবলম্বন। অর্থাৎ ঈমান ব্যতীত তা গ্রহণযোগ্য হয় না। এভাবে ঈমান ও জিহাদ এর প্রত্যেকটিই একেক দিক থেকে মূল ও প্রধান বিষয় আর সে কারণেই উভয়টিকে শ্রেষ্ঠ আমল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

জিহাদের বিধান ও জিহাদের ফযীলত

সাধারণভাবে জিহাদ বলতে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত যে-কোনও মেহনতকে বোঝায়। তবে ইসলামী পরিভাষায় জিহাদ বলা হয় আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর কালেমা বুলন্দ করা ও তাঁর দীনকে বিজয়ী করার জন্য অমুসলিমদের বিরুদ্ধে সসস্ত্র সংগ্রাম করাকে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ

(হে মুসলিমগণ!) তোমরা কাফেরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে থাক, যাবৎ না ফিতনা দূরীভূত হয় এবং দীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর হয়ে যায়। সূরা আনফাল (৮), আয়াত ৩৯

অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

قَاتِلُوا الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلَا يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَلَا يَدِينُونَ دِينَ الْحَقِّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ حَتَّى يُعْطُوا الْجِزْيَةَ عَنْ يَدٍ وَهُمْ صَاغِرُونَ (29)

কিতাবীদের মধ্যে যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে না এবং পরকালেও নয় এবং আল্লাহ ও তার রাসূল যা-কিছু হারাম করেছেন তাকে হারাম মনে করে না এবং সত্য দীনকে নিজের দীন বলে স্বীকার করে না, তাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর, যাবৎ না তারা হেয় হয়ে নিজ হাতে জিযিয়া আদায় করে। সূরা তাওবা (৯), আয়াত ২৯

এ উভয় আয়াতে জিহাদ চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে যতদিন না সর্বত্র আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, অমুসলিমগণ মুসলিম হয়ে যায় অথবা মুসলিমদের কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেয় এবং তাদের পক্ষ থেকে সকল ফিতনা তথা জুলুম-অত্যাচার ও ইসলামবিরোধী তৎপরতা দূরীভূত হয়ে যায়। এরূপ অবস্থা পুরোপুরিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে। তাই জিহাদের বিধানও কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

الْجِهَادُ مَاضٍ مُنْذُ بَعَثَنِي اللهُ إِلَى أَنْ يُقَاتِلَ آخِرُ أُمَّتِي الدَّجَّالَ

জিহাদ (-এর বিধান) কার্যকর থাকবে আল্লাহ তাআলা আমাকে যখন পাঠিয়েছেন তখন থেকে ওই পর্যন্ত যে, আমার উম্মতের শেষ দল দাজ্জালের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ২৫৩২; সুনানে সাঈদ ইবন মানসুর, হাদীছ নং ২৩৬৭

জিহাদের উদ্দেশ্য রাজ্যবিস্তার বা গোষ্ঠী ও ব্যক্তিবিশেষের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা নয়। এসকল উদ্দেশ্যে কেউ যুদ্ধ করলে ইসলামী পরিভাষায় সে মুজাহিদরূপেও গণ্য হবে না।
একবার জনৈক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে আরয করল যে, এক ব্যক্তি গনীমতলাভের উদ্দেশ্যে লড়াই করে, আরেক ব্যক্তি খ্যাতি লাভের জন্য লড়াই করে, আরেক ব্যক্তি বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য লড়াই করে। এদের মধ্যে কে আল্লাহর পথে (জিহাদকারী)? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন-

مَنْ قَاتَلَ لِتَكُونَ كَلِمَةُ اللهِ هِيَ الْعُلْيَا فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللهِ

যে ব্যক্তি আল্লাহর কালেমাকে উঁচু করার জন্য যুদ্ধ করে, সে আল্লাহর পথে (জিহাদকারী)। সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১২৩; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৯০৪; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ২৫১৭; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৩১৩৬; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৬৪৬; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২৭৮৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৩৯৫২

যেহেতু এরূপ ব্যক্তির পার্থিব কোনও উদ্দেশ্য থাকে না, না অর্থ-সম্পদ, না সুনাম-সুখ্যাতি; বরং কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টির জন্য শত্রুর হাতে প্রাণ যাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে রণক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে, এমনকি শহীদ হয়ে যাওয়াকে প্রকৃত সফলতা গণ্য করে আর এভাবে সে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার করে, তাই এর ফযীলতও অনেক বেশি। আলোচ্য হাদীছে তো একে শ্রেষ্ঠতম আমল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ وَالْقُرْآنِ وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ مِنَ اللَّهِ فَاسْتَبْشِرُوا بِبَيْعِكُمُ الَّذِي بَايَعْتُمْ بِهِ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ (111)

বস্তুত আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও তাদের সম্পদ খরিদ করে নিয়েছেন, তাদের জন্য জান্নাত আছে-এর বিনিময়ে। তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে। ফলে হত্যা করে ও নিহতও হয়। এটা এক সত্য প্রতিশ্রুতি, যার দায়িত্ব আল্লাহ তাওরাত ও ইনজীলেও নিয়েছেন এবং কুরআনেও। আল্লাহ-অপেক্ষা বেশি প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী আর কে আছে? সুতরাং তোমরা আল্লাহর সঙ্গে যে সওদা করেছ, সেই সওদার জন্য তোমরা আনন্দিত হও এবং এটাই মহাসাফল্য। সূরা তাওবা (৯), আয়াত ১১১

এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَثَلُ الْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللهِ كَمَثَلِ الصَّائِمِ الْقَائِمِ الْقَانِتِ بِآيَاتِ اللَّهِ، لَا يَفْتُرُ مِنْ صِيَامٍ وَلَا صَلَاةِ، حَتَّى يَرْجِعَ الْمُجَاهِدُ فِي سَبِيلِ الله .

আল্লাহর পথে জিহাদকারীর দৃষ্টান্ত ওই ব্যক্তি, যে অনবরত রোযা রাখে, নামাযে দাঁড়িয়ে আল্লাহর আয়াত তিলাওয়াত করতে থাকে, (এভাবে একটানা) অক্লান্তভাবে রোযা ও নামাযে রত থাকে, যাবৎ না আল্লাহর পথে জিহাদকারী ব্যক্তি ফিরে আসে। (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৮৭৮, জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৬১৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৫২০)

অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

تكفل الله لمن خرج من بيته مجاهدا في سبيل الله لا ينهزه إلا الْجهاد في سبيله وتصديق كلمته أن يدخله الجنة أو يرجعه إلى مسكنه الذي خرج منه بما نال من أجر غنيمة

যে ব্যক্তি আল্লাহর পথের মুজাহিদরূপে নিজ ঘর থেকে বের হয়, আর তাকে আল্লাহর পথে জিহাদ ও আল্লাহর কালেমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ছাড়া অন্যকিছু এ কাজে উদ্বুদ্ধ করেনি, আল্লাহ তা'আলা তার জন্য এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন যে, হয় তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, অথবা ছাওয়াব বা গনীমতসহ তাকে তার সেই বাসস্থানে ফিরিয়ে আনবেন, যেখান থেকে সে বের হয়েছে। আলজিহাদ (ইবনুল মুবারক), হাদীছ নং ৩৯; সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩১২৩। সহীহ মুসলিম,হাদীছ নং ১৮৭৬

জিহাদের ফযীলত সম্পর্কে বহু আয়াত ও হাদীছ আছে। তবে সে ফযীলত অর্জিত হবে কেবল তখনই, যখন জিহাদ করা হবে–- এর জন্য শরী'আত যে রীতিনীতি নির্ধারণ করেছে সে অনুসারে। মনে জযবা উঠল আর অস্ত্র হাতে নিয়ে কাফের-বেঈমান হত্যা করা শুরু করে দিল, এটা আর যাই হোক জিহাদ নয় কিছুতেই। এর জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ থাকা এবং প্রভাব বিস্তার করার মত শক্তি-ক্ষমতা থাকা জরুরি। যার সঙ্গে জিহাদ করা হবে তার কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে যাওয়াও শর্ত। সেইসঙ্গে এটাও শর্ত যে, কোনও শিশু, নারী, যুদ্ধে সম্পৃক্ত নয় এমন বৃদ্ধ, আশ্রমবাসী সন্ন্যাসী ও উপাসনাকারীদেরকেও হত্যা করা যাবে না। জিহাদের উদ্দেশ্য যখন দীন প্রতিষ্ঠা, তখন এ ক্ষেত্রে অহেতুক নরহত্যা অনুমোদিত নয়। বরং ফিতনাবাজ যোদ্ধাদের নির্মূল করে তাদের জুলুম-নিপীড়ন থেকে নির্দোষ নিরীহ জনগোষ্ঠীর জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করা ইসলামী জিহাদের এক অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। কাজেই এর বিপরীত তৎপরতা জিহাদের মত মহান নামের উপযুক্ত হতে পারে না।

ঈমানের শ্রেষ্ঠত্ব ও ফযীলত

ঈমান অর্থ মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে যে দীন ও শরী'আত নিয়ে এসেছেন তাকে সত্যই আল্লাহপ্রদত্ত বলে বিশ্বাস করে পরিপূর্ণরূপে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে নেওয়া ও মুখে তা স্বীকার করে নেওয়া। এর জন্য জরুরি তাঁর প্রতি শতভাগ আস্থা রাখা। সে আস্থার ভিত্তিতে সম্পূর্ণ কুরআন মাজীদকে আল্লাহর কালাম বলে স্বীকার করা এবং এতে বর্ণিত আকীদা-বিশ্বাস ও বিধি-বিধানসহ যাবতীয় বিষয় সত্য বলে মেনে নেওয়া। তাঁর প্রতি আস্থার ভিত্তিতে আরও জরুরি তাঁর পেশ করা সুন্নাহ ও আদর্শকে সর্বোত্তম আদর্শরূপে অনুসরণীয় বলে স্বীকার করা। সে ক্ষেত্রে এ বিশ্বাসও জরুরি যে, তাঁর রেখে যাওয়া সুন্নাহ ও জীবনাদর্শে কোনও ভাগ-বাটোয়ারার সুযোগ নেই। এমন নয় যে, তাঁর রেখে যাওয়া দীন ও শরী'আতের আংশিক মানলাম আর আংশিক অমান্য করলাম বা তার পরিবর্তে অন্যদের থেকে কিছু নিলাম। বরং জরুরি হচ্ছে তাঁর সুন্নাহ'র সাথে সাংঘর্ষিক অন্যসব মত ও পথ, অন্যসব ধর্ম ও বিধান এবং অন্যসব সভ্যতা-সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যায্য জ্ঞান করা।

মৌলিকভাবে এ ঈমান অন্তরের কাজ। অর্থাৎ উপরে বর্ণিত বিশ্বাস ও চিন্তা- চেতনাকে কোনওরূপ মুনাফিকী ও কপটতা ব্যতিরেকে মনেপ্রাণে লালন করারই নাম ঈমান। আর তা লালন করার দাবি হচ্ছে জীবনকে শরী'আতের ছাঁচে ঢেলে সাজানো এবং ইহজীবনের সার্বিক ক্ষেত্রে চলার জন্য ইসলাম যে ছক এঁকে দিয়েছে সে অনুযায়ী চলতে থাকা, কোনও অবস্থায়ই সে ছকের বাইরে না যাওয়া।

বোঝাই যাচ্ছে ঈমানী জীবন এক সংগ্রামী জীবনের নাম। ওই বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনাকে লালন করতে থাকার জন্য নফস ও শয়তানের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়। ওই বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনার দাবি অনুযায়ী চলতে থাকার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয় প্রচলিত সমাজ ও সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এ সংগ্রাম কঠিন বটে, তবে হিম্মতের সঙ্গে সংগ্রাম চালাতে থাকলে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে সাহায্যও লাভ হয়। তাঁর পক্ষ থেকে ওয়াদা আছে-

وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ (69)

যারা আমার উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টা চালায়, আমি তাদেরকে অবশ্যই আমার পথে উপনীত করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সঙ্গে আছেন। সূরা আনকাবুত (২৯), আয়াত ৬৯

প্রথমত ঈমান আনাটাই এক সংগ্রাম, যেহেতু তা আনতে হয় এর বিপরীত সবকিছু পরিহার করে। তারপর ঈমানের হেফাজতও এক সংগ্রাম, যেহেতু সর্বক্ষণই এর বিরোধী ভাবনা ও বিরোধী ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করতে হয়। এ সংগ্রামে পরাজয়ের সুযোগ নেই। কেননা ঈমান টলে যাওয়ার পরিণাম যাবতীয় আমল ধূলিসাৎ করে ফেলা। ঈমান নেই তো সমস্ত আমল বাতিল। এর শেষগতি জাহান্নাম। তো দেখা যাচ্ছে ঈমান একটি সংগ্রামী আমল এবং এটি সমুদয় আমলের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। তাই এর ফযীলতও সবচে' বেশি। আলোচ্য হাদীছে এটিকে জিহাদের পাশাপাশি শ্রেষ্ঠতম আমলরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঈমান সর্বশ্রেষ্ঠ। সারা কুরআনে ঈমানের ওপরই সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বহু হাদীছে একে শ্রেষ্ঠতম আমল বলা হয়েছে। যেমন হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে-

سُئِلَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَيُّ الأَعْمَالِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: «إِيمَانٌ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ» قِيلَ: ثُمَّ مَاذَا؟ قَالَ: «جِهَادٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ» قِيلَ: ثُمَّ مَاذَا؟ قَالَ: «حَجٌّ مَبْرُورٌ»

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল, কোন আমল শ্রেষ্ঠতম? তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান। জিজ্ঞেস করা হল, তারপর ? বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ। জিজ্ঞেস করা হল, তারপর? বললেন, মকবুল হজ্জ। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১৫১৯; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৮৩; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৬২৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪৫৯৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭৬২৮, বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩৭৯৩; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ১৮৪০)

একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর

প্রশ্ন আসতে পারে যে, বিভিন্ন সময় সাহাবীগণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে শ্রেষ্ঠ আমল জানতে চেয়েছেন। তাতে দেখা যায় তিনি একেক সময় একেকটি আমলকে শ্রেষ্ঠ সাব্যস্ত করেছেন। যেমন কখনও শ্রেষ্ঠ আমল বলেছেন নামাযকে, কখনও ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে আহার্য দানকে, কখনও সালামের রেওয়াজ দানকে, আবার এ হাদীছে ঈমান ও জিহাদকে শ্রেষ্ঠ আমল সাব্যস্ত করা হয়েছে। এভাবে একেকবার একেকটিকে শ্রেষ্ঠ আমল বলার কারণ কী?
এর উত্তর হচ্ছে, আমলের শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপিত হয় কখনও সামগ্রিক বিচারে, কখনও হয় বিশেষ বিবেচনায় এবং কখনও তা হয় আপেক্ষিক। সুতরাং ঈমান সামগ্রিক বিবেচনায় শ্রেষ্ঠতম আমল, তারপর যথাক্রমে নামায, যাকাত, রোযা ও হজ্জ –অন্যান্য আমল অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, তারপর ক্ষুধার্তকে আহার্যদান, সালামের রেওয়াজ দেওয়া, জিহাদ করা ইত্যাদি আমলসমূহ বিশেষ বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ। অর্থাৎ কখনও ব্যক্তি হিসেবে বিশেষ বিশেষ আমল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, আবার কখনও সময়ের দাবি হিসেবে কোনও কোনও আমলের গুরুত্ব বেড়ে যায়। এভাবে চিন্তা করলে শ্রেষ্ঠ আমল সম্পর্কিত বর্ণনাসমূহের মধ্যে কোনও বিরোধ থাকে না।

জিহাদ দ্বারা গুনাহ মাফ হওয়া

জিহাদের ফযীলতের কথা শুনে জনৈক সাহাবী আরয করেছিলেন যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আল্লাহর পথে নিহত হলে কি আমার সব গুনাহ ক্ষমা হয়ে যাবে? এর উত্তরে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন-

نعم . إن قتلت في سبيل الله ، وأنت صابر محتسب مقبل غير مدبر

হাঁ, যদি তুমি আল্লাহর পথে নিহত হও ধৈর্যশীল, ছাওয়াবের আশাবাদী ও সামনে অগ্রগামী হয়ে এবং পৃষ্ঠপ্রদর্শনকারী না হয়ে। অর্থাৎ তুমি নিহত হলে তোমার গুনাহসমূহ ক্ষমা হয়ে যাবে, তবে এর জন্য কয়েকটি। শর্ত আছে। যেমন-
(ক) যুদ্ধ করতে হবে আল্লাহর পথে তথা আল্লাহর কালেমা বুলন্দ করার উদ্দেশ্যে।
(খ) রণক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ করতে হবে, তাতে শরীরে তরবারির আঘাত লাগুক, বর্শার খোঁচা লাগুক, তির বিদ্ধ হোক এবং এরকম যে-কোনও কষ্টেরই সম্মুখীন হতে হোক।
(গ) আশা থাকবে আল্লাহ তা'আলার কাছে জিহাদ ও শাহাদাতের পুরস্কার লাভ করা। বীরত্ব প্রকাশ ও সুনাম-সুখ্যাতি লাভ করার ইচ্ছা থাকবে না।
(ঘ) রণক্ষেত্রে শত্রুবাহিনীর অভিমুখী থাকতে হবে, আপন স্থানে অটল-অবিচল থেকে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে, পলায়ন করা যাবে না। হাঁ, যদি যুদ্ধের কৌশল হিসেবে পুনরায় হামলা করার উদ্দেশ্যে ক্ষণিকের জন্য পিছিয়ে যাওয়া হয়, তবে তা দোষের নয়। এ শর্তগুলো পূরণের সাথে যদি যুদ্ধ চালিয়ে যায় আর এ অবস্থায় শত্রুর আঘাতে নিহত হয়, তবে সে শহীদ গণ্য হবে এবং এ ত্যাগের কারণে তার সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে।

শহীদ হওয়ার দ্বারা দেনা মাফ হয় না।

উপরের কথা দ্বারা বোঝা যাচ্ছিল শহীদ হওয়ার ফলে যাবতীয় গুনাহ মাফ হয়ে যায়, তা আল্লাহর হক সংক্রান্ত হোক বা বান্দার হক সংক্রান্ত হোক। তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই সাহাবীকে তার প্রশ্নটি পুনরায় উল্লেখ করতে বললেন। সেই সাহাবী পুনরায় তা উল্লেখ করলেন। এবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগের মতই উত্তর দিলেন, তবে সেইসঙ্গে জুড়ে দিলেন যে- الا الدين 'দেনা ছাড়া'। অর্থাৎ শহীদ হওয়ার দ্বারা মানুষের দেনা মাফ হয় না। তুমি যদি মানুষের কোনও হক নষ্ট করে থাক, তবে তা দুনিয়ায় হোক বা আখিরাতে, পরিশোধ করতেই হবে। দুনিয়ায় পরিশোধ না করে গেলে আখিরাতে তোমার ছাওয়াব কেটে তা পরিশোধ করা হবে। তাতেও পরিশোধ না হলে পাওনাদারের গুনাহ কেটে তোমার ওপর চাপানো হবে, যেমন অন্যান্য হাদীছে বর্ণিত আছে। এর দ্বারা মানুষের হক কত গুরুত্বপূর্ণ তা উপলব্ধি করা যায়। জিহাদ ও শাহাদাতের মত এত বড় ফযীলতের আমল দ্বারাও তা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না।

ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, এটা তখনই, যখন মানুষের হক আদায়ের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা আদায়ে গড়িমসি করা হয়। পক্ষান্তরে যদি তা আদায়ের কোনও সামর্থ্যই না থাকে কিন্তু মনে মনে তা আদায়ের নিয়ত থাকে এবং সংকল্প থাকে যে, যখনই সামর্থ্য লাভ হবে তখনই তা আদায় করে দেবে, তবে আশা করা যায় আল্লাহ তা'আলা নিজ দয়ায় তাকে মুক্তি দান করবেন এবং পাওনাদারকে অন্য কোনওভাবে খুশি করে দেবেন।

হাদীছটির শেষে আছে, জিবরীল আমাকে এ কথা বলেছেন। এর দ্বারা বাহ্যত বোঝা যায় ওই মুহূর্তেই জিবরীল আলাইহিস সালাম আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে এই ওহী নিয়ে এসেছিলেন যে, শহীদ হওয়ার দ্বারা মানুষের দেনা মাফ হয় না। অথবা এমনও হতে পারে যে, হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম আগেই তা জানিয়েছিলেন, যা প্রথমবার উত্তর দেওয়ার সময় তাঁর স্মরণ ছিল না, পরক্ষণেই স্মরণ হয়ে যায়।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. প্রত্যেক মুমিনের জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তার ঈমান। কাজেই সর্বদা ঈমানের ব্যাপারে সচেতন থাকা চাই, যাতে কোনওভাবেই তা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

খ. জিহাদ একটি শ্রেষ্ঠ আমল। প্রত্যেকেরই নিয়ত থাকা চাই যে, যখনই তার অবকাশ আসবে, তাতে অবশ্যই অংশগ্রহণ করবে।

গ. শাহাদাতের একটি ফযীলত হচ্ছে তা দ্বারা গুনাহ মাফ হয়।

ঘ. শাহাদাত দ্বারা বান্দার হক মাফ হয় না। তাই বান্দার হক আদায়ের ব্যাপারে কিছুতেই গড়িমসি করা উচিত নয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
সুনানে নাসায়ী - হাদীস নং ৩১৫৭ | মুসলিম বাংলা